শেষ কথা
চারদিকে ঠাণ্ডা পড়েছে । সোনালী নরম আলো চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মায়াময় হয়ে আছে চারদিক । মায়া ! হ্যাঁ মায়াই বটে ।
চারদিন আগে ভেনাসের সাথে দেখা হবে ভেবে সারারাত ঘুমাতে পারেনি ও। সেই ভেনাস, যে ওকে টেনে এনেছিল অন্ধকার থেকে আলোর জগতে।
শিঞ্জিনীর সাথে ভালোবাসার খেলায় যেদিন বুঝেছিল ও আসলে বাজি ধরে ঠকানোর পুতুল মাত্র , সেদিনই মরে যেতে পারতো । ফোনে আলাপ , তাও এক বন্ধুর বন্ধু হিসাবে । বি আর সিং হাসপাতালে সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাচ্চা মেয়েকে দুবার না ভেবে রক্ত দিয়েছিলো অণীক । তার থেকেই বন্ধুত্ব । তারপর শিঞ্জিনীর নাম্বার দিয়ে বন্ধু বলেছিল - ' মেয়েটা খুব দুঃখী , তোর ভালোবাসা পেলে বাঁচবে ।' শুনে আকাট অণীক ফাঁদে পা দিল । পরে যখন জানলো ওই বন্ধুর প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য ডিলারশিপ ও জায়গা প্রয়োজন বলেই শিঞ্জিনীর মাধ্যমে ওকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল , তখন ও একটাই প্রশ্ন করেছিলো -- ' আমাকেই !' তবু ভালোবাসা মরেনি । যদিও সেই মেয়েটিকে ও দেখেনি কোনোদিন তবু নির্বোধ বলেই পুড়তো আপনমনে ।
তারপর সময় বয়ে গেল । অণীক ফেসবুকে এল । শুরু করলো কবিতায় মনের কথা বলা । এরই মধ্যে এমন একজনকে পেল যে ছিল অন্যরকম । যার কাছে ও সব খুলে বলতো । চিরকালের মুখচোরা ছেলেটা ওর কাছেই উজাড় করতো সব । আস্তে আস্তে যত সময় গড়াতে লাগলো অণীক বুঝতে পারলো ওর সব বাঁধা পরে গেছে । দুজনেই বুঝতে পারছিলো - ভালোবাসা বড্ড বোকা তাই আবার এসেছে । মেয়েটির নাম ভেনাস ।
ভেনাসের সাথে একদিন কথা না বললে ঘুমাতে পারতো না অণীক । গল্প করার সময় অণীক যত বকুনি , গালাগাল খেত তা ও কোনোদিন খায়নি । ভালোলাগায় মরে যেত অণীক, বকুনিও যে মিষ্টি সেটা ও বুঝতে পারতো ।
অণীক জানতো ভেনাস ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, তবে সেই ভালোবাসার প্রকাশ কম বলে রেগে যেত মাঝে মাঝে । অণীক ভেনাসকে নিজের থেকে আলাদা ভাবতেই পারতো না । মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে উঠত আদরে আদরে ভেনাসকে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য ।
ভেনাস ওকে চরম হতাশার সময় হাত ধরে তুলেছিল অন্ধকার একটা কুয়ো থেকে । অণীক বুঝতে পারছিলো ওর সুপ্ত সবকিছু কিভাবে সোনার- কাঠির স্পর্শে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে । ও চেষ্টা করছিল বিষাদ ঝেড়ে ফেলে ভেনাসকে নিয়ে বাঁচার । নিজের অধীত যাবতীয় ও দিতে চাইছিল ভেনাসকে ।
দেখা হল , একরাশ শিউলিফুল নিয়ে গিয়েছিল ও । প্রথমবার দেখেই চমকে উঠেছিল অণীক । এই সেই মেয়ে যাকে ও স্বপ্নে দেখত । যার জন্যই ওর বেঁচে থাকা । প্রচণ্ড ভালবাসতে ইচ্ছা করছিল ওর, চুমু খেতে ।
তারপর ও বিবশ হয়ে গিয়েছিল । জড়িয়ে ধরে আগ্রাসী ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিলো ঠোঁটে । ন্যায় না অন্যায় সেসব ভাবেনি । ভেবেছিল - ' ও তো আমার, দেহ দুটো কিন্তু মন একটাই ।'
চলে আসার সময় চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল দু-ফোঁটা জল । সেটা ভেনাসের চোখ এড়ায়নি । বলেছিল - ' আরে ইয়ার, কাঁদছিস নাকি ! পাগল একটা ।'
তারপর থেকেই আবার একঘেয়ে জীবন । প্রতি মুহূর্তে ভেনাসকেই দেখত চোখের সামনে । হঠাৎ ও জানলো ও নাকি নাটক করে, অপেরা টাইপ কথা বলে । আশ্চর্য হয়ে অনীক ভাবলো -- তাহলে কি সেই চিরায়ত দৈব ওকে প্রবঞ্চনা করছে , যে কিনা ভীষ্ম, কর্ণ কাউকেই ছেড়ে দেয়নি !
ভাবতে ভাবতেই ও ঠিক করে নিলো - অনেক হয়েছে, এবার যাওয়ার সময়। লেখালিখি করে শুধু যন্ত্রণাই পেয়েছে, ভালোবেসেও । তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো । বাড়িতে থাকলে মৃত্যু অসম্ভব, বরং বঙ্কিমনগরের রেললাইনের চারপাশ অনেক সুন্দর !
ট্রেন আসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । ঝম্ঝম্- ঝম্ঝম্ । মাকে মনে পড়ছে, বাবাকেও । মা রান্নাঘরে অশক্ত শরীরটা নিয়ে রান্না করছেন নিশ্চয় । আর বাবা আজকাল বোবা হয়ে গেছেন , হাঁটতেও পারেন না । এককালের দাপুটে এক্সিকিউটিভ অফিসার এখন চেয়ারে বসে থাকেন । কেউ এলে শূন্য চোখে তাকান । অণীক জানে চলে যাওয়ার পর বাবা-মা হয়তো বেশিদিন বাঁচবেন না । তাও পরশুই নমিনি পেপার গুলোতে মায়ের সই করিয়ে জমা করে দিয়েছে । মনে পড়ছে ভেনাসের কথা । কী করছে ও এখন ? নিশ্চয়ই অসুস্থ শরীরটা নিয়েও দশভুজার মত সব সামলাচ্ছে ভীষণ একা মেয়েটা ।
ভালো থাকো সবাই । একটা কবিতা মনে পড়লো অণীকের -------
"জয় করবার মতো একটি মনও যখন আর অবশিষ্ট নেই,
যদি কোনোদিন এই রাত্রি ভোর হয়, আবার কখনো যদি
তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায়
কি আশ্চর্য ! অন্য অনন্তে যাওয়ার সময়ও কবিতা মাথায় আসে কারো !
ভেনাস ভালো থাকিস । তোকে আমি সত্যি ভালবেসেছিলাম । কোনো কপটতা নয় , ছল নয় , শুধুই ভালোবাসা । যদি শেষ মুহূর্তে মরতে না পারি তাহলে এই বিরাট পৃথিবীতে হয়তো আবার দেখা হবে । না হলে তো পরজন্ম রইলই তোকে নিজের করে পাওয়ার জন্য । জানি ভালোবাসার দাম পাবোই ।
ট্রেনটা এগিয়ে আসছে । ঝম্ঝম্- ঝম্ঝম্-------- চোখ বুঝলো অনীক ।
মিলন চ্যাটার্জি
ঠাণ্ডা ইস্পাতের লাইনটায় গলা পেতে শুয়ে আছে অণীক । একটা লাল পিঁপড়ে নাকের পাশে কামড়াতেই প্রবল আক্রোশে পিঁপড়েটাকে পিষে মারল ও । তারপর পাগলের মত হাসতে থাকলো । মানুষ সত্যিই অদ্ভুত , এই মুহূর্তে একটা পিঁপড়ের কামড়েই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা হাস্যকর বইকি ।
চারদিকে ঠাণ্ডা পড়েছে । সোনালী নরম আলো চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মায়াময় হয়ে আছে চারদিক । মায়া ! হ্যাঁ মায়াই বটে ।
চারদিন আগে ভেনাসের সাথে দেখা হবে ভেবে সারারাত ঘুমাতে পারেনি ও। সেই ভেনাস, যে ওকে টেনে এনেছিল অন্ধকার থেকে আলোর জগতে।
শিঞ্জিনীর সাথে ভালোবাসার খেলায় যেদিন বুঝেছিল ও আসলে বাজি ধরে ঠকানোর পুতুল মাত্র , সেদিনই মরে যেতে পারতো । ফোনে আলাপ , তাও এক বন্ধুর বন্ধু হিসাবে । বি আর সিং হাসপাতালে সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাচ্চা মেয়েকে দুবার না ভেবে রক্ত দিয়েছিলো অণীক । তার থেকেই বন্ধুত্ব । তারপর শিঞ্জিনীর নাম্বার দিয়ে বন্ধু বলেছিল - ' মেয়েটা খুব দুঃখী , তোর ভালোবাসা পেলে বাঁচবে ।' শুনে আকাট অণীক ফাঁদে পা দিল । পরে যখন জানলো ওই বন্ধুর প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য ডিলারশিপ ও জায়গা প্রয়োজন বলেই শিঞ্জিনীর মাধ্যমে ওকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল , তখন ও একটাই প্রশ্ন করেছিলো -- ' আমাকেই !' তবু ভালোবাসা মরেনি । যদিও সেই মেয়েটিকে ও দেখেনি কোনোদিন তবু নির্বোধ বলেই পুড়তো আপনমনে ।
তারপর সময় বয়ে গেল । অণীক ফেসবুকে এল । শুরু করলো কবিতায় মনের কথা বলা । এরই মধ্যে এমন একজনকে পেল যে ছিল অন্যরকম । যার কাছে ও সব খুলে বলতো । চিরকালের মুখচোরা ছেলেটা ওর কাছেই উজাড় করতো সব । আস্তে আস্তে যত সময় গড়াতে লাগলো অণীক বুঝতে পারলো ওর সব বাঁধা পরে গেছে । দুজনেই বুঝতে পারছিলো - ভালোবাসা বড্ড বোকা তাই আবার এসেছে । মেয়েটির নাম ভেনাস ।
ভেনাসের সাথে একদিন কথা না বললে ঘুমাতে পারতো না অণীক । গল্প করার সময় অণীক যত বকুনি , গালাগাল খেত তা ও কোনোদিন খায়নি । ভালোলাগায় মরে যেত অণীক, বকুনিও যে মিষ্টি সেটা ও বুঝতে পারতো ।
অণীক জানতো ভেনাস ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, তবে সেই ভালোবাসার প্রকাশ কম বলে রেগে যেত মাঝে মাঝে । অণীক ভেনাসকে নিজের থেকে আলাদা ভাবতেই পারতো না । মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে উঠত আদরে আদরে ভেনাসকে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য ।
ভেনাস ওকে চরম হতাশার সময় হাত ধরে তুলেছিল অন্ধকার একটা কুয়ো থেকে । অণীক বুঝতে পারছিলো ওর সুপ্ত সবকিছু কিভাবে সোনার- কাঠির স্পর্শে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে । ও চেষ্টা করছিল বিষাদ ঝেড়ে ফেলে ভেনাসকে নিয়ে বাঁচার । নিজের অধীত যাবতীয় ও দিতে চাইছিল ভেনাসকে ।
দেখা হল , একরাশ শিউলিফুল নিয়ে গিয়েছিল ও । প্রথমবার দেখেই চমকে উঠেছিল অণীক । এই সেই মেয়ে যাকে ও স্বপ্নে দেখত । যার জন্যই ওর বেঁচে থাকা । প্রচণ্ড ভালবাসতে ইচ্ছা করছিল ওর, চুমু খেতে ।
তারপর ও বিবশ হয়ে গিয়েছিল । জড়িয়ে ধরে আগ্রাসী ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিলো ঠোঁটে । ন্যায় না অন্যায় সেসব ভাবেনি । ভেবেছিল - ' ও তো আমার, দেহ দুটো কিন্তু মন একটাই ।'
চলে আসার সময় চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল দু-ফোঁটা জল । সেটা ভেনাসের চোখ এড়ায়নি । বলেছিল - ' আরে ইয়ার, কাঁদছিস নাকি ! পাগল একটা ।'
তারপর থেকেই আবার একঘেয়ে জীবন । প্রতি মুহূর্তে ভেনাসকেই দেখত চোখের সামনে । হঠাৎ ও জানলো ও নাকি নাটক করে, অপেরা টাইপ কথা বলে । আশ্চর্য হয়ে অনীক ভাবলো -- তাহলে কি সেই চিরায়ত দৈব ওকে প্রবঞ্চনা করছে , যে কিনা ভীষ্ম, কর্ণ কাউকেই ছেড়ে দেয়নি !
ভাবতে ভাবতেই ও ঠিক করে নিলো - অনেক হয়েছে, এবার যাওয়ার সময়। লেখালিখি করে শুধু যন্ত্রণাই পেয়েছে, ভালোবেসেও । তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো । বাড়িতে থাকলে মৃত্যু অসম্ভব, বরং বঙ্কিমনগরের রেললাইনের চারপাশ অনেক সুন্দর !
ট্রেন আসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । ঝম্ঝম্- ঝম্ঝম্ । মাকে মনে পড়ছে, বাবাকেও । মা রান্নাঘরে অশক্ত শরীরটা নিয়ে রান্না করছেন নিশ্চয় । আর বাবা আজকাল বোবা হয়ে গেছেন , হাঁটতেও পারেন না । এককালের দাপুটে এক্সিকিউটিভ অফিসার এখন চেয়ারে বসে থাকেন । কেউ এলে শূন্য চোখে তাকান । অণীক জানে চলে যাওয়ার পর বাবা-মা হয়তো বেশিদিন বাঁচবেন না । তাও পরশুই নমিনি পেপার গুলোতে মায়ের সই করিয়ে জমা করে দিয়েছে । মনে পড়ছে ভেনাসের কথা । কী করছে ও এখন ? নিশ্চয়ই অসুস্থ শরীরটা নিয়েও দশভুজার মত সব সামলাচ্ছে ভীষণ একা মেয়েটা ।
ভালো থাকো সবাই । একটা কবিতা মনে পড়লো অণীকের -------
"জয় করবার মতো একটি মনও যখন আর অবশিষ্ট নেই,
তখন আর আমার বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি আর
কতো ভালোবাসবো? আর কার জন্যে অপেক্ষা আমার?
তার চেয়ে এই কি যথার্থ নয়? আমি খুব দূরে চলে যাই।
যদি কোনোদিন এই রাত্রি ভোর হয়, আবার কখনো যদি
সূর্য ওঠে নিষ্ঠুর বাংলায়, আবার কখনও যদি ফিরে পাই
আমার যৌবন, যদি পাই আমার স্বপ্নের সেই নারী, কবি
না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি।
তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায়
মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি চলি।
মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন, আমি যাই,
ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি।"
কি আশ্চর্য ! অন্য অনন্তে যাওয়ার সময়ও কবিতা মাথায় আসে কারো !
ভেনাস ভালো থাকিস । তোকে আমি সত্যি ভালবেসেছিলাম । কোনো কপটতা নয় , ছল নয় , শুধুই ভালোবাসা । যদি শেষ মুহূর্তে মরতে না পারি তাহলে এই বিরাট পৃথিবীতে হয়তো আবার দেখা হবে । না হলে তো পরজন্ম রইলই তোকে নিজের করে পাওয়ার জন্য । জানি ভালোবাসার দাম পাবোই ।
ট্রেনটা এগিয়ে আসছে । ঝম্ঝম্- ঝম্ঝম্-------- চোখ বুঝলো অনীক ।
1 comments:
খুব ভালো লাগলো...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন