শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলী
দিনেশ দাস’এর কবিতা : সময়ের দলিল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
১৯২১এ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর কাজী নজরুল ইসলাম আপামর বাঙালির কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় । নজরুল ছাড়া বাংলা সাহিত্যে এমন ব্যাপার ঘটেছে আর মাত্র একজনে ক্ষেত্রে – তিনি দিনেশ দাস । ১৯৩৮এ শারদসংখ্যা ‘আনন্দ বাজার’এ ‘কাস্তে’ কবিতাটি প্রকাশের পর, তখন পঁচিশ বছরের নবীন কবি দিনেশ দাস রাতারাতি বাঙ্গালির কাছে পরিচিত হয়ে গেলেন ‘কাস্তে কবি’ নামে । অগ্রজ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে ‘কাস্তে’ কবিতার সেই অবিস্মরণীয় পংক্তি ‘এ যুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে’ উদ্ধৃত করে দুটি কবিতা লিখলেন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ ‘পত্রিকায় , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন ছোট গল্প । আমরা অতয়েব বুঝতে পারি বাংলা সাহিত্যের পাঠক জনমানসকে কি প্রবল ভাবে আন্দোলিত করেছিল একটি পাঁচ স্তবকে কুড়ি পংক্তির কবিতা । আজও – রচনার ছিয়াত্তর বছর পরেও ‘কাস্তে’ কবিতার কুড়িটি পংক্তি নতুনতর জীবনের বোধের আকাঙ্খায় থাকা মানুষের মনকে একই ভাবে আন্দোলিত করে । এখনও এই কবিতাটি নিয়ে গান করেন, দেওয়ালে পোষ্টার সাঁটেন পীড়িত মানুষের কোন সংগঠন, তাঁর কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করেন । কোন যাদুতে এমন সম্ভব ? অনেক পরে, জীবনের উপান্তে পৌঁছে কবি নিজেই শিল্প ও শিল্পীর সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন এই ভাবে –“আজ এই মহা দুর্যোগের দিনে এখনো আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টা ও শিল্পীরাই এযুগের শেষ যাদুকর । ‘কাস্তে’ কবিতায় শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদটাকে তিনি শ্রমজীবী কৃষকের ফসল-কাটার ক্ষুরধার অস্ত্র কাস্তের সঙ্গে তুলনা করেন । কাব্যজগতে প্রেম ও সৌন্দর্য ও লাবণ্যের প্রতীক চাঁদকে তিনি খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুললেন। চাঁদের উপমায় আর এক চিরস্মরণীয় কাব্য পংক্তি সুকান্ত ভট্টাচার্যর ‘পূর্ণীমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ । ১৯৩৭এ দিনেশ দাস যখন ‘কাস্তে’ লিখলেন, সুকান্ত তখন ১১ বছরের বালক ।
দিনেশ দাস’এর আর একটি পংক্তি বোধ করি ‘কাস্তে’র সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিটির চেয়েও জনপ্রিয় – অনন্তকাল ধরে উচ্চারিত হবে ১৯৫১তে লেখা ‘অহল্যা’ কাব্যগ্রন্থের রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত ‘প্রণমি’ কবিতার শেষ স্তবকের চারটি পংক্তি “আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায় / ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম, / তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা /কোনখানে রাখবো প্রণাম” । সম্প্রতি কোন এক তরুণ আলোচকের কবিতায় দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগের পক্ষে সওয়াল করা মন্তব্য দেখেছিলাম যে ‘পাঠককে শব্দের অর্থ আবিষ্কার করতে হবে , সহজ শব্দ খুঁজলে আর কবিতা পড়া কেন ? টিভি সিরিয়াল দেখো’ । আমার বলতে ইচ্ছা করে - ‘বাপু হে, আগে দু এক ছত্র দিনেশ দাস পড়ে নাও’ । সহজ সাবলিল আন্তরিকতায় ঘটনা ও ভাবনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা স্থাপন করতে পেরেছিলেন কবি তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল অতলান্ত জীবনবোধের কাব্যভাষ্য ।
তাঁর কবিতা বোঝার আগে আমি বুঝতে চাইবো মানুষ দিনেশ দাসকে । সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রের উক্তি শিরোধার্য করি “ কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ । কবিতা দর্পণ মাত্র - তাহার ভেতর কবির ছায়া আছে” । দিনেশ দাস এক উত্তাল সময়ের কবি , এক সংকট কালের কবিও বটে । বিশ্বের তাবৎ মহৎ সৃষ্টিই তো রচিত হয় সংকট কালেই । কবির প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩এ ‘দেশ’ পত্রিকায়, একুশ বছর বয়সে, আর শেষ কাব্য গ্রন্থ ‘রাম গেছে বনবাসে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১তে । ১৯৮২তে এই গ্রন্থটির জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ এবং ১৯৮৫র ১৩ই মার্চ প্রয়াণ বাহাত্তর বছর বয়সে । ১৯১৩ থেকে ১৯৮৫ এই বিস্তীর্ণ সময় কালে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছিল কবিকে, নির্মাণ করেছিল ‘কবি দিনেশ দাস’কে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগের বছর কবির জন্ম। চারবছর বয়সে ঘটে গিয়েছে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব । নিতান্ত কৈশোরে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গুপ্ত বিপ্লবী সমতির সঙ্গে । ১৯৩০এ এপারে গান্ধীজির নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ ওপারে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন । সেই অগ্নি সময়ে কবি যুক্ত হলেন গান্ধীজির আদর্শে লবণ সত্যাগ্রহে । মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন বটে কিন্তু পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় কিছু সময়ের ছেদ পড়লো । অনেক দেরিতে ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে, সেখান থেকে স্কটিশ চার্চ কলেজে । কিন্তু গুপ্ত সমিতির কাজকর্ম, দুটি লাইব্রেরি পরিচালনা আর সাহিত্য চর্চার কাজে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর বি এ পরীক্ষা দেওয়া হল না । অসন্তুষ্ট পিতা চাইলেন পুত্র তবে চাকুরী করুক , কবি সম্মত হলেন না ইংরাজ সরকারের চাকুরী করতে । কলকাতা ত্যাগ করে চলে গেলেন কার্শিয়াং এ । সেখানে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করলেন , প্রথমে গৃহ শিক্ষকতা ও পরে একটা চাকুরী, চা বাগানে । সেখানে চা বাগানের কুলি-কামিনদের জীবন যাত্রা নিবিড় ভাবে জানার সুবাদে কবির মোহ ভঙ্গ হ’ল গান্ধীবাদ থেকে । ১৯৩৬এ আবার কলকাতায় ফিরে এলেন । কলকাতায় ফিরে আবার তিনি কলেজে ভর্তি এবং স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন । এই সময়েই দিনেশ দাস দীক্ষিত হলেন মার্কসবাদ’এ । ১৯৩৭এ লিখলেন ‘কাস্তে’ –
বেয়োনেট হোক যত ধারালো
কাস্তেটা শাণ দিও বন্ধু ।
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শাণ দিও বন্ধু ।
নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে ?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে” ।......
এই কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার এক মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় আর কবি হয়ে ওঠেন মেহনতী মানুষের জীবন-যন্ত্রণা প্রকাশের মুখপাত্র ।
১৯৩৩ এ কুড়ি বছর বয়সে স্নাতক স্তরে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ প্রকাশ হবার সময় বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এসে গেছে নতুনতর কাব্যভাবনার কাল – সূচনা হয়েছে রবীন্দ্র-প্রভাব বলয়ের বাইরে বাংলা কবিতার নতুনতর ভুবন ‘কল্লোল গোষ্ঠীর নেতৃত্বে । সেটা বাংলা কবিতায় বিষয় ভাবনার পালা বদলের সময়কালও বটে । চিরাচরিত প্রেম এবং প্রকৃতি থেকে সরে এসে সমসাময়িক সমাজ ও ইতিহাস চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা কবিতা । ১৯৩৭এ চব্বিশ বছর বয়সে যখন ‘কাস্তে’ লিখলেন তখন বাঙালির সমাজ চিন্তা-চেতনায় আর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে । একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি অন্যদিকে বিশ্বজোড়া শিল্পী- সাহিত্যিকদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন । ১৯৩৬এ বাংলায় যাত্রা শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের আশির্বাদ নিয়ে ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’র । দিনেশ দাসের কাব্যচেতনা পরিপুষ্ট হ’ল এই তোলপাড় সময়ের আবহে ।
১৯৪১এ প্রকাশিত হ’ল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা’ । ১৯৪২-৪৭এ উত্তাল ভারত । একদিকে ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রবল তরঙ্গ, আর একদিকে আজাদহিন্দ ফৌজের সংগ্রাম । ৪৩এ পঞ্চাশে মন্বন্তরে, কলকাতার ফুটপাথে মৃত্যুর মিছিল ৪৬এর নৌ বিদ্রোহ, ১৯৪৭এ দেশভাগ ও খন্ডিত স্বাধীনতা । প্রতিটি ঘটনার ছায়াপাত ঘটলো তাঁর কবিতায় । পঞ্চাশের মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল দেখে কবি লিখলেন ‘ডাস্টবিন’ ‘ভুখামিছিল’, ‘গ্লানি’ ‘নববর্ষের ভোজ’। কবির কলমে ধ্বনিত হ’ল পুঁজিবাদের প্রতি তীব্র ধিক্কার , তাঁর কবিতা হয়ে উঠলো সময়ের দলিল । ৪৮এ গান্ধিজির হত্যাকে মনে রেখে লিখলেন ‘শেষ ক্ষমা’,’স্বর্ণভস্ম’ ‘পূণর্জন্ম’ । লিখলেন –
“কোটি কোটি লাঙলের ভার নিয়ে হাঁটো একা একা,
তুমি বলেছিলে খালি
দিল্লি নয় চলো নোয়াখালি” (পূণর্জন্ম) ।
কবি নিজে যেমন এক অস্থির সময়ের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর ব্যক্তি জীবনেও ছিল নানান অস্থিরতা । ব্যাঙ্কের চাকুরী ত্যাগ করে পত্রিকা সম্পাদনা, কিছুদিন চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন সহকারী পরিচালক রূপে । সে কাজ তাঁর ভালো লাগেনি । অতঃপর কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে হাওড়ার নির্জন দেউলপুর গ্রামে একটি স্কুলে পধান শিক্ষকের চাকুরী নিলেন । আবার একবছর পরে কলকাতায় ফিরে এলেন । যোগ দিলেন চেতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক রূপে । এই পর্বে কবি অনেক শান্ত সমাহিত । তাঁর কবি মানসেরও দিক পরিবর্তন ঘটে এই সময়কালে । এই পর্বের কবিতাগুলি নিয়ে ১৯৫৪ তে প্রকাশিত হ’ল কাব্যগ্রন্থ ‘অহল্যা’ , যেটি সম্পর্কে অগ্রজ কবি জীবনানন্দ দাশ কবিকে এক পত্রে লিখেছিলেন “অহল্যা’কে আপনি আধুনিক যুগের বা সনাতন পৃথিবীর মানবের ব্যথিত শিলীভূত প্রাণের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে যে চেতনার পরিচয় দিয়েছেন তা অপূর্ব...” ।
সব মহৎ সাহিত্যই সময়ের দলিল । আজ – একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমরাও তো এক বিপন্ন, বিপর্যস্ত সময়ের সাক্ষী । এই বিপন্ন সময়ের দলিল যারা রচনা করবেন কবিতায় তাদের দিনেশ দাসকে জানতেই হবে, অবগাহন করতেই হবে তাঁর কবিতায় । প্রয়াত সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন “স্বচ্ছন্দে তাঁর কবিতার কাকচক্ষু জলে অবগাহন করা যায় । চারপাশে ঘটছে, ঘর আর বাইরের টানা-পোড়েন, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব, জীবন আর মৃত্যু – কবিতায় সবই আছে । সেইসঙ্গে আছে বেদনাবিধুর সেই মন যার হাতে ধুলোমুঠো ধরলে সোনামুঠো হয়...”
দিনেশ দাস সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন , কিন্তু কখনো কোন দলীয় আনুগত্যে নিজেকে বাঁধেন নি । তার কবিতায় শুধু শোষণ-পীড়নের প্রতি কুন্ঠাহীন ধিক্কার, আর জীবনের মিছিল তাঁর কবিতায় । কবি তাঁর অর্ধ শতাব্দীর কাব্য পরিক্রমার সারাৎসার লিখেছেন তাঁরই পংক্তিতে -
“কবিতার ভেতরেই আমার শ্রেণীর পরিচয় ।
আমার কবিতা একযোগে ।
গান, স্লোগান, মেসিনগান” ।
মৃতুর দু’বছর আগে কবি লিখেছিলেন
“...... মনে হয় আকাশে বাতাসে চারপাশে কোথাও ভয় উড়ছে ।
এইসব অকারণ ভয়ের নাড়ীভুঁড়ি ছিড়ে
কবে ভোরের আলোয় আমাদের জন্মান্তর হবে –
সকালের সূর্য ফেটে পড়বে ডালিমের মত ?”(নোটবুকঃ১৯৮৩) ।
এই জিজ্ঞাসা তো আমাদের এখনও । দিনেশ দাস নির্মাণ করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের কাব্যভাষ্য ।
দিনেশ দাস’এর কবিতা : সময়ের দলিল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
১৯২১এ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর কাজী নজরুল ইসলাম আপামর বাঙালির কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় । নজরুল ছাড়া বাংলা সাহিত্যে এমন ব্যাপার ঘটেছে আর মাত্র একজনে ক্ষেত্রে – তিনি দিনেশ দাস । ১৯৩৮এ শারদসংখ্যা ‘আনন্দ বাজার’এ ‘কাস্তে’ কবিতাটি প্রকাশের পর, তখন পঁচিশ বছরের নবীন কবি দিনেশ দাস রাতারাতি বাঙ্গালির কাছে পরিচিত হয়ে গেলেন ‘কাস্তে কবি’ নামে । অগ্রজ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে ‘কাস্তে’ কবিতার সেই অবিস্মরণীয় পংক্তি ‘এ যুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে’ উদ্ধৃত করে দুটি কবিতা লিখলেন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ ‘পত্রিকায় , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন ছোট গল্প । আমরা অতয়েব বুঝতে পারি বাংলা সাহিত্যের পাঠক জনমানসকে কি প্রবল ভাবে আন্দোলিত করেছিল একটি পাঁচ স্তবকে কুড়ি পংক্তির কবিতা । আজও – রচনার ছিয়াত্তর বছর পরেও ‘কাস্তে’ কবিতার কুড়িটি পংক্তি নতুনতর জীবনের বোধের আকাঙ্খায় থাকা মানুষের মনকে একই ভাবে আন্দোলিত করে । এখনও এই কবিতাটি নিয়ে গান করেন, দেওয়ালে পোষ্টার সাঁটেন পীড়িত মানুষের কোন সংগঠন, তাঁর কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করেন । কোন যাদুতে এমন সম্ভব ? অনেক পরে, জীবনের উপান্তে পৌঁছে কবি নিজেই শিল্প ও শিল্পীর সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন এই ভাবে –“আজ এই মহা দুর্যোগের দিনে এখনো আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টা ও শিল্পীরাই এযুগের শেষ যাদুকর । ‘কাস্তে’ কবিতায় শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদটাকে তিনি শ্রমজীবী কৃষকের ফসল-কাটার ক্ষুরধার অস্ত্র কাস্তের সঙ্গে তুলনা করেন । কাব্যজগতে প্রেম ও সৌন্দর্য ও লাবণ্যের প্রতীক চাঁদকে তিনি খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুললেন। চাঁদের উপমায় আর এক চিরস্মরণীয় কাব্য পংক্তি সুকান্ত ভট্টাচার্যর ‘পূর্ণীমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ । ১৯৩৭এ দিনেশ দাস যখন ‘কাস্তে’ লিখলেন, সুকান্ত তখন ১১ বছরের বালক ।
দিনেশ দাস’এর আর একটি পংক্তি বোধ করি ‘কাস্তে’র সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিটির চেয়েও জনপ্রিয় – অনন্তকাল ধরে উচ্চারিত হবে ১৯৫১তে লেখা ‘অহল্যা’ কাব্যগ্রন্থের রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত ‘প্রণমি’ কবিতার শেষ স্তবকের চারটি পংক্তি “আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায় / ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম, / তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা /কোনখানে রাখবো প্রণাম” । সম্প্রতি কোন এক তরুণ আলোচকের কবিতায় দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগের পক্ষে সওয়াল করা মন্তব্য দেখেছিলাম যে ‘পাঠককে শব্দের অর্থ আবিষ্কার করতে হবে , সহজ শব্দ খুঁজলে আর কবিতা পড়া কেন ? টিভি সিরিয়াল দেখো’ । আমার বলতে ইচ্ছা করে - ‘বাপু হে, আগে দু এক ছত্র দিনেশ দাস পড়ে নাও’ । সহজ সাবলিল আন্তরিকতায় ঘটনা ও ভাবনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা স্থাপন করতে পেরেছিলেন কবি তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল অতলান্ত জীবনবোধের কাব্যভাষ্য ।
তাঁর কবিতা বোঝার আগে আমি বুঝতে চাইবো মানুষ দিনেশ দাসকে । সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রের উক্তি শিরোধার্য করি “ কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ । কবিতা দর্পণ মাত্র - তাহার ভেতর কবির ছায়া আছে” । দিনেশ দাস এক উত্তাল সময়ের কবি , এক সংকট কালের কবিও বটে । বিশ্বের তাবৎ মহৎ সৃষ্টিই তো রচিত হয় সংকট কালেই । কবির প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩এ ‘দেশ’ পত্রিকায়, একুশ বছর বয়সে, আর শেষ কাব্য গ্রন্থ ‘রাম গেছে বনবাসে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১তে । ১৯৮২তে এই গ্রন্থটির জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ এবং ১৯৮৫র ১৩ই মার্চ প্রয়াণ বাহাত্তর বছর বয়সে । ১৯১৩ থেকে ১৯৮৫ এই বিস্তীর্ণ সময় কালে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছিল কবিকে, নির্মাণ করেছিল ‘কবি দিনেশ দাস’কে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগের বছর কবির জন্ম। চারবছর বয়সে ঘটে গিয়েছে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব । নিতান্ত কৈশোরে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গুপ্ত বিপ্লবী সমতির সঙ্গে । ১৯৩০এ এপারে গান্ধীজির নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ ওপারে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন । সেই অগ্নি সময়ে কবি যুক্ত হলেন গান্ধীজির আদর্শে লবণ সত্যাগ্রহে । মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন বটে কিন্তু পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় কিছু সময়ের ছেদ পড়লো । অনেক দেরিতে ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে, সেখান থেকে স্কটিশ চার্চ কলেজে । কিন্তু গুপ্ত সমিতির কাজকর্ম, দুটি লাইব্রেরি পরিচালনা আর সাহিত্য চর্চার কাজে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর বি এ পরীক্ষা দেওয়া হল না । অসন্তুষ্ট পিতা চাইলেন পুত্র তবে চাকুরী করুক , কবি সম্মত হলেন না ইংরাজ সরকারের চাকুরী করতে । কলকাতা ত্যাগ করে চলে গেলেন কার্শিয়াং এ । সেখানে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করলেন , প্রথমে গৃহ শিক্ষকতা ও পরে একটা চাকুরী, চা বাগানে । সেখানে চা বাগানের কুলি-কামিনদের জীবন যাত্রা নিবিড় ভাবে জানার সুবাদে কবির মোহ ভঙ্গ হ’ল গান্ধীবাদ থেকে । ১৯৩৬এ আবার কলকাতায় ফিরে এলেন । কলকাতায় ফিরে আবার তিনি কলেজে ভর্তি এবং স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন । এই সময়েই দিনেশ দাস দীক্ষিত হলেন মার্কসবাদ’এ । ১৯৩৭এ লিখলেন ‘কাস্তে’ –
বেয়োনেট হোক যত ধারালো
কাস্তেটা শাণ দিও বন্ধু ।
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শাণ দিও বন্ধু ।
নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে ?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে” ।......
এই কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার এক মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় আর কবি হয়ে ওঠেন মেহনতী মানুষের জীবন-যন্ত্রণা প্রকাশের মুখপাত্র ।
১৯৩৩ এ কুড়ি বছর বয়সে স্নাতক স্তরে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ প্রকাশ হবার সময় বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এসে গেছে নতুনতর কাব্যভাবনার কাল – সূচনা হয়েছে রবীন্দ্র-প্রভাব বলয়ের বাইরে বাংলা কবিতার নতুনতর ভুবন ‘কল্লোল গোষ্ঠীর নেতৃত্বে । সেটা বাংলা কবিতায় বিষয় ভাবনার পালা বদলের সময়কালও বটে । চিরাচরিত প্রেম এবং প্রকৃতি থেকে সরে এসে সমসাময়িক সমাজ ও ইতিহাস চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা কবিতা । ১৯৩৭এ চব্বিশ বছর বয়সে যখন ‘কাস্তে’ লিখলেন তখন বাঙালির সমাজ চিন্তা-চেতনায় আর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে । একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি অন্যদিকে বিশ্বজোড়া শিল্পী- সাহিত্যিকদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন । ১৯৩৬এ বাংলায় যাত্রা শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের আশির্বাদ নিয়ে ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’র । দিনেশ দাসের কাব্যচেতনা পরিপুষ্ট হ’ল এই তোলপাড় সময়ের আবহে ।
১৯৪১এ প্রকাশিত হ’ল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা’ । ১৯৪২-৪৭এ উত্তাল ভারত । একদিকে ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রবল তরঙ্গ, আর একদিকে আজাদহিন্দ ফৌজের সংগ্রাম । ৪৩এ পঞ্চাশে মন্বন্তরে, কলকাতার ফুটপাথে মৃত্যুর মিছিল ৪৬এর নৌ বিদ্রোহ, ১৯৪৭এ দেশভাগ ও খন্ডিত স্বাধীনতা । প্রতিটি ঘটনার ছায়াপাত ঘটলো তাঁর কবিতায় । পঞ্চাশের মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল দেখে কবি লিখলেন ‘ডাস্টবিন’ ‘ভুখামিছিল’, ‘গ্লানি’ ‘নববর্ষের ভোজ’। কবির কলমে ধ্বনিত হ’ল পুঁজিবাদের প্রতি তীব্র ধিক্কার , তাঁর কবিতা হয়ে উঠলো সময়ের দলিল । ৪৮এ গান্ধিজির হত্যাকে মনে রেখে লিখলেন ‘শেষ ক্ষমা’,’স্বর্ণভস্ম’ ‘পূণর্জন্ম’ । লিখলেন –
“কোটি কোটি লাঙলের ভার নিয়ে হাঁটো একা একা,
তুমি বলেছিলে খালি
দিল্লি নয় চলো নোয়াখালি” (পূণর্জন্ম) ।
কবি নিজে যেমন এক অস্থির সময়ের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর ব্যক্তি জীবনেও ছিল নানান অস্থিরতা । ব্যাঙ্কের চাকুরী ত্যাগ করে পত্রিকা সম্পাদনা, কিছুদিন চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন সহকারী পরিচালক রূপে । সে কাজ তাঁর ভালো লাগেনি । অতঃপর কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে হাওড়ার নির্জন দেউলপুর গ্রামে একটি স্কুলে পধান শিক্ষকের চাকুরী নিলেন । আবার একবছর পরে কলকাতায় ফিরে এলেন । যোগ দিলেন চেতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক রূপে । এই পর্বে কবি অনেক শান্ত সমাহিত । তাঁর কবি মানসেরও দিক পরিবর্তন ঘটে এই সময়কালে । এই পর্বের কবিতাগুলি নিয়ে ১৯৫৪ তে প্রকাশিত হ’ল কাব্যগ্রন্থ ‘অহল্যা’ , যেটি সম্পর্কে অগ্রজ কবি জীবনানন্দ দাশ কবিকে এক পত্রে লিখেছিলেন “অহল্যা’কে আপনি আধুনিক যুগের বা সনাতন পৃথিবীর মানবের ব্যথিত শিলীভূত প্রাণের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে যে চেতনার পরিচয় দিয়েছেন তা অপূর্ব...” ।
সব মহৎ সাহিত্যই সময়ের দলিল । আজ – একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমরাও তো এক বিপন্ন, বিপর্যস্ত সময়ের সাক্ষী । এই বিপন্ন সময়ের দলিল যারা রচনা করবেন কবিতায় তাদের দিনেশ দাসকে জানতেই হবে, অবগাহন করতেই হবে তাঁর কবিতায় । প্রয়াত সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন “স্বচ্ছন্দে তাঁর কবিতার কাকচক্ষু জলে অবগাহন করা যায় । চারপাশে ঘটছে, ঘর আর বাইরের টানা-পোড়েন, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব, জীবন আর মৃত্যু – কবিতায় সবই আছে । সেইসঙ্গে আছে বেদনাবিধুর সেই মন যার হাতে ধুলোমুঠো ধরলে সোনামুঠো হয়...”
দিনেশ দাস সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন , কিন্তু কখনো কোন দলীয় আনুগত্যে নিজেকে বাঁধেন নি । তার কবিতায় শুধু শোষণ-পীড়নের প্রতি কুন্ঠাহীন ধিক্কার, আর জীবনের মিছিল তাঁর কবিতায় । কবি তাঁর অর্ধ শতাব্দীর কাব্য পরিক্রমার সারাৎসার লিখেছেন তাঁরই পংক্তিতে -
“কবিতার ভেতরেই আমার শ্রেণীর পরিচয় ।
আমার কবিতা একযোগে ।
গান, স্লোগান, মেসিনগান” ।
মৃতুর দু’বছর আগে কবি লিখেছিলেন
“...... মনে হয় আকাশে বাতাসে চারপাশে কোথাও ভয় উড়ছে ।
এইসব অকারণ ভয়ের নাড়ীভুঁড়ি ছিড়ে
কবে ভোরের আলোয় আমাদের জন্মান্তর হবে –
সকালের সূর্য ফেটে পড়বে ডালিমের মত ?”(নোটবুকঃ১৯৮৩) ।
এই জিজ্ঞাসা তো আমাদের এখনও । দিনেশ দাস নির্মাণ করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের কাব্যভাষ্য ।
1 comments:
কাস্তেটা শাণ দিও বন্ধু ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন