মিলন চ্যাটার্জী
পুজো এলেই কয়েকজনকে খুব মনে পড়ে। এইমাত্র তন্ময়দা পোক করে অনেক কিছুই মনে করিয়ে দিল। পুজোতে আমার সবথেকে প্রিয় দিন ছিল পঞ্চমীর দিন। ওইদিন সকাল থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। কারণটা অদ্ভূত ...
মহাষষ্ঠীর সকালে রাণাঘাট পাবলিক লাইব্রেরীতে শারদ সংখ্যা আর নতুন বই দেওয়া হত, সেই বই তোলার জন্য পঞ্চমীর রাত থেকেই লাইন পড়তো । তখন মোবাইলের কথা কানে আসতো, ইন্টারনেট বলে কিছুই ছিলনা । আমার ভাঙা সাইকেলটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে সকলকে ডাকতাম । আমাদের সঙ্গে আমার এক স্যারের ভাইদের গ্রুপের রেষারেষি চলতো কারা আগে বই তুলবে । একমাস আগে থেকেই কার্ড জোগাড় করতাম বই তুলবো বলে । আমাদের গ্রুপে ছিলাম -- আমি, নীলু, তন্ময়দা, টুটুলদা আর শমীকদা । একবার রাত ৪ টেয় গিয়েও মনের মতো বই না পাওয়ায় আমরা সারারাত জাগার প্ল্যান করলাম। সেইমতো বিকেলেই চলে গেলাম লাইব্রেরী, সেখানে বসে নতুন কি কি বই তুলবো তার তালিকা করলাম। সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই সবাই একজায়গায় হলাম। তারপর চা, মুড়ি সহযোগে আড্ডা শুরু। তখন একমাত্র নীলু ছাড়া কারও সামনে ফুঁকতাম না ফলে মাঝেমাঝেই আমার ছোট বাইরে পেত। বুঝতে পেরে আমার দাদারা সেদিনই পারমিশনটা দিয়ে দিয়েছিল। সেই প্রথম নিজেকে রাজাগজা ভাবার সূত্রপাত। যাইহোক, রাত ৯ টায় লাইব্রেরী বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা রাত কাটানোর ব্যবস্থায় উদ্যোগী হলাম। ঠিক হল, নীলু খবরের কাগজ নিয়ে আসবে, আমি আনবো মশা মারার ধূপ, সিগারেট শমীকদার ডিপার্টমেন্ট। তন্ময়দা ছিল (এখনও আছে) আমাদের মধ্যে সবথেকে ট্যালেন্টেড এবং মিচকে বদ, আমাদের সঙ্গ দিয়েই ধন্য করত, অনেকটা ঘনাদার মতো। যদিও অকৃপণ ভাবে খরচ করতো আমাদের পিছনে।
এরপর পালা করে বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আসব বলে ঠিক হলো। প্রথমেই তন্ময়দা, শমীকদারা বাড়ি গেলো। ওরা আসার পর গেলাম আমরা। রাত ১১/৩০ এ আমি রেডি হয়ে নীলুর বাড়ি গেলাম, ব্যাটা দেখি বাড়ি থেকে হাওয়া! অনেক খোঁজার পর ক্লাব থেকে তুলে নিয়ে লাইব্রেরী গেলুম। আমাদের দেখেই দাদাদের রাজ্যের কাজ মনে পড়ে গেলো। আসছি বলে সব ধাঁ। ঘণ্টাখানেকের ভেতর সবাই চলে এলো কিন্তু তন্ময়দার পাত্তা নেই। আবার ভাঙা সাইকেল নিয়ে তন্ময়দার বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি মনের সুখে বই পড়ছেন, আমাকে দেখেই রাত একটার সময় বললো 'আয় একহাত দাবা খেলি'। আমি প্রমাদ গুনলাম। যাইহোক ভুজুং ভাজুং দিয়ে নিয়ে এলুম লাইব্রেরীর সামনে। রাস্তায় ততক্ষণে কাগজ পেতে বেশ আমারদায়ক গা -এলানোর ব্যবস্থা হয়েছে। শুরু হলো নির্ভেজাল গুলতানি। এর পিছনে লাগে ও তো ওর পিছনে এ।
আমি অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর আখতারুজাম্মান ইলিয়াসের ভক্ত ছিলাম বলে শমীকদা আমাকে অতীন এসে গেছে বলে খ্যাপাতো। তখন আমি নাইন কি টেনে পড়ি। আমাদের পরিধির মধ্যে তন্ময়দা, শমীকদার মতো এতো মাল্টিট্যালেন্টেড যুবক ছিলনা। টুটুলদা ছিল পাক্কা কম্যুনিস্ট। ফলে সেই বয়সেই আমি ওদের থেকে প্রচুর কিছু শিখতে পেরেছিলাম। আমাকে নিত্য নতুন বইয়ের নাম বলে দিতো তন্ময়দা, পড়তেও দিতো, শমীকদা সিনেমা দেখতে বলতো। অজানা এক রাজ্য আমার কাছে তার ডালি উপুড় করে দিয়েছিল ওদের জন্যেই।
'ধান ভানতে শিবের গীত' হয়ে যাচ্ছে, আবার জায়গায় ফিরি। সেদিন রাত আমাদের সবার জীবনেই অম্লান হয়ে থাকবে চিরদিন। আমি রেডিও নিয়ে গেছিলাম তাই শোনা হলো, তারপর মেমোরি গেম। সামনেই ছিল পুরসভার মাঠ তাতে পুজো হতো, এখনও হয়। সারারাত প্যান্ডেল হচ্ছে আর হচ্ছে মাতলামি। লাইব্রেরীর পাশেই গনেশদার দোকান, সেই দোকানদারের ভাই এসেছিল আন্দামান থেকে, বিখ্যাত মাতাল। একবার দল বেঁধে এসে আমাদের বললো এই তোরা কেরে, এখানে বোম বাঁধছিস?
আমি বললাম আমরা বই তুলতে এসেছি। তারপর এসে বই দেখে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই এলো আবার, দুহাতে চটি নিয়ে। বললো কি জ্বালা মাইরি এরা কোনোটা কোনো পায়ের কে জানে। তারপর রাস্তায় চপ্পল রেখে তিরিশ মিনিট অক্লান্ত পরিশ্রম করেও পরতে না পেরে লাথি মেরে ড্রেনে ফেলে দিলো, এরপরই সব বন্ধ দোকানের শাটারে লাথি মারতে শুরু করলো। দুজন পুলিশ টহল দিচ্ছিলো, এসে ধরলো। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম পুলিশ দুজনের সাথে দোস্তি হয়ে গেছে। কারণ সহজেই অনুমেয়।
ইতিমধ্যে পুলিশের সন্দেহ পড়েছে আমাদের ওপর। এসে রাইফেল তাক করে হুমকি শুরু হলো। তন্ময়দা এতো বদ, আমাকেই নেতা বানিয়ে দিলো। পুলিশ পারলে আমাকেই গুলি করে এমন ভাব। আমি ভয়ে তখন রীতিমতো ঘামছি। এরপর হঠাৎ পুলিশের একজন তন্ময়দাকে চিনতে পেরে বললো 'আরে স্যার আপনি, চিনতেই পারিনি! কোনো অসুবিধে হলে বলবেন। এখানে মাতালের বড় উপদ্রব।' বলা হয়নি, তন্ময়দা তখন বিরোধী দলের নামকরা যুব নেতা ছিল।
এরপর আমি আর নীলু গেলাম স্টেশনে চা খেতে। সেই রাত তিনটের সময় রাণাঘাট স্টেশনে চা খাওয়া কোনোদিন ভুলবো না। ফিরে এসে দেখি সেই মাতাল আবার এসেছে আর তার ধারণা হয়েছে আমি বিরাট কেউকেটা লোক তাই সে আমাকে মাংস আর পরোটা খাওয়াবে। বুঝতেই পারলাম এটা তন্ময়দা আর শমীকদার নতুন ফন্দী। একে অত রাত তার ওপর লাইন হোটেল প্রায় দু-কিলোমিটার দূর। অনেক কষ্টে ব্যাটাকে নিবৃত্ত করলাম। আমার কোলে মাথা রেখে সে তখন কালোয়াতী গান গাইছে। সেদিন প্রথম বুঝলাম 'শব্দই ব্রহ্ম'।
ইতিমধ্যে সকাল হয়ে আসছে। চারটের সময় আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের আগমন হলো। আমাদের দেখেই আশ্চর্য হয়ে বললো তোরা কখন এলি। আমরা একটু মিচকে হাসলাম। গুহ্য কথা উহ্যই থাকা ভালো। ওরা কটা বই জমা দিয়েছি দেখতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে দেখলো ... আমরা পাঁচ জনে প্রায় গোটা চল্লিশেক বই জোগাড় করেছি। ওদের সেই ভ্যাবাচাকা মুখ দেখে যে আমাদের সকলের স্বর্গীয় আনন্দ লাভ হয়েছিল সেটা এতদিন পরে স্বীকার করতে আজ আর লজ্জা নেই।
লাইব্রেরী খুলতো সকাল সাতটায়। সাড়ে ছটায় সবাই হাজির। সেই সকালে যখন সবগুলো পূজাসংখ্যা হাতে এলো সঙ্গে আরও বেশ কিছু নতুন বই, তখন যা আনন্দ পেয়েছিলাম তার তুলনীয় আনন্দ জীবনে খুব কম পেয়েছি।
সব বই নিয়ে চলে গেলাম দোতলার রিডিংরুমে। গনেশদার ভাই আমাদের জন্যে একটা করে ক্যাকটাস দিয়ে গেলো (সেই ক্যাকটাস বেশ কয়েকবছর আমার বাড়িতে ছিল, কবছর আগে মরে গেছে)। সকালে ডিসপেনসারি লেনের ভেতরে চমৎকার জিলিপি বানায় আর কচুরি তাই নিয়ে এলো নীলু তন্ময়দার থেকে টাকা নিয়ে। সেখানেই ঠিক হলো লক্ষীপুজোর মধ্যেই সব পড়ে ফেলতে হবে। একটা ডায়রিতে কার্ড নাম্বার লিখে তার পাশে বইয়ের নাম আর কে নিচ্ছে লিখে রাখা হলো। ততক্ষণে ক্লাবে ঠাকুর আনতে যেতে হবে বলে সবাই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরলাম, যাওয়ার আগে সবাই ঠিক করলাম -- এবার থেকে প্রতিবছর আমরাই সব বই তুলে নেবো। সেই থেকে প্রতিবছর আমরাই সব বই তুলতাম। সবাই জানে রাণাঘাট পাবলিক লাইব্রেরীতে আমাদের আগে বই তোলা অসম্ভব। বেশ কবছর হল টুটুলদা, শমীকদা আর তন্ময়দা সময় পায়না। আমি আর নীলুই বই তুলি। তিনবছর হয়ে গেলো আমিও আর বই তুলতে পারিনা।
আজ তিনবছর আমি এই লাইব্রেরীরই লাইব্রেরীয়ান। এখন সব বই আগেই পড়া হয়ে যায়। রাতেও আর থাকা হয়না। তাও অভ্যাসবশত সকাল চারটেতেই চলে আসি।
আজ সেই ফেলে আসা সময়টাকে খুব মিস করি, খুব। তন্ময়দা, শমীকদা আমার বন্ধু তালিকায় আছে। যদিও অনলাইন হয়না বললেই চলে।
(অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস)
4 comments:
কথকতা - কত কথা বাজে স্মৃতির মোহন বাঁশীর সুরে
অনেক সুন্দর লিখেছ মিলন
ভালোবাসা অমলেন্দুদা, প্রলয়দা ।
গদ্যের হাত অনেক দূর যাবে মিলন। খুব সুন্দ৪র লিখেছিস
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন