শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

প্রদীপ কবির খান


কবি সুবীর সরকার এবং তার " বন্দুকনামা" কবিতা সংকলন নিয়ে দু'চার কথা

প্রদীপ কবির খান



প্রাজ্ঞ আধুনিক , জটিল সময়টাতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের ছায়া জটিল থেকে জটিলতম করেছে চিন্তাধারা বোধের পরিধি'কে । মানুষের চিন্তা ও চেতনের ধারাবাহিক পরিবর্তন যেন সময়েরই মূর্ত ধূসর ছবি। এই সময় হাতে এসে পৌঁছল সুবীর সরকার মহাশয়ের "বন্দুকনামা" কবিতা সংকলন । উৎসর্গপত্রের নীচের লাইনে কবি যা বলেছেন ----

"
দ্যাখে পালাচ্ছে ফণা তোলা সাপ ; গুগল আর্থ"

আর্থসামাজিক পরিবেশের এই যে দৌড় পৃথিবী ছোঁয়ার , সমগ্র কবিতায় চেতন-অবচেতন জুড়েই তার অবস্থান পরিলক্ষিত হয় ।
সমগ্র কবিতা জুড়ে এই সময় , এই অস্থির সময়কে শব্দে বেঁধে ধরবার প্রয়াস যা সার্থক কবির মনন কলমে , সমস্ত কবিতা জুড়ে একটা নির্মোহ আবহ তৈরি করেছেন কবি ,
"
বন্দুকনামার" ১ নং কবিতায় ----

"
টেবিলে বন্দুক , যদিও মরচেধরা
বরফে ডুবে গেছে হাত-পা
ভুলে যাওয়াটাই সংগত , ভুল
                         ইতিহাস "

তো এই সময়ের যেন জীবন্ত ছবি , শুধু চোখের সামনে যে পর্দাটুকু আছে তাকে একটু সরিয়ে নিলেই যেন স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি চারপাশের দগ্ধ ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে কোথায় যেন একাত্মা হয়ে গেছে এই লাইনগুলো । কবি সন্দেহ প্রকাশ করছেন কিম্বা মনে মনে বিড়বিড় করছেন যে ইতিহাস আমরা পড়ছি সেটুকুই কি ইতিহাস ? কই সেখানে তো আমার কথা নেই !
সমস্ত কবিতায় কবি যেন নিজের সাথে নিজে কথা বলছেন , বিভিন্ন আঙ্গিকে ধরতে চাইছেন জীবন যন্ত্রণা অস্তিত্ব বিলোপের দিন , সমস্ত কবিতায় চাপা অন্ধকার , আবার কোথাও অন্ধকার উত্তরণের দিশাও খুঁজে পাচ্ছেন কবি , যেমন ----

"
শরণার্থীর সন্তরণবিলাসে
লণ্ঠনের আলোয় দৃশ্যপট
স্বপ্ন ফেরাচ্ছে ব্রিজ ও
জলাশয়
ফিনিশ হচ্ছে গসপেল
তর্কযুদ্ধের পর ভাষা সাজাই "

"
শরণার্থীর সন্তরণবিলাসে" কথাটা খাপছাড়া মনে হতে পারে , শরণার্থীর সেই বিলাসের সময় কই? কিন্তু এখানেই সার্থক কবি । দুঃখের মধ্যে জেগে থাকে মানুষের সুখের অনন্ত খোঁজ , কারন তার পড়েই আসতে পারে সুখের ভবিষ্যৎ , সেই জন্য যেন লন্ঠনের প্রতীকী আলোয় ব্রিজ পেড়িয়ে কোন এক সুখের দিকে জীবনের প্রবাহ চলতেই থাকে । মানুষের চিরন্তন এই চেতনকে কবি চমৎকার ধরেছেন ।
কবি সমগ্র কবিতায় নিজেকে এক জায়গায় বেঁধে রাখেননি , বিভিন্ন ভাবে ভেঙেছেন , গড়েছেন , নিজে মিশে গেছেন নিজের সঙ্গে , কখনও প্রলাপের মতো বলেছেন -----

"
একাকীত্ব টুকে রাখি । ঘুরে এসেছে
সাদা ফেনা । টানটান উইকএন্ড , লোকাল
ভাষায় গুঁজে দেওয়া । শেষ দৃশ্যে
স্মৃতিচারণ । গল্পের জট খুলছে ।
বইয়ের র‍্যাকে একাকীত্ব রেখে আসি "

এখানে লক্ষণীয় , প্রত্যেকটা দৃশ্য শেষে কবি দাঁড়ির ব্যাবহার করেছেন , কারণ বক্তব্য ওখানে শেষ হচ্ছে , ঐ সম্বন্ধীয় আর কিছু বলার নেই কবির , যেমন " একাকীত্ব টুকে রাখি । " কোথায় টুকে রাখেন আমাদের জানার দরকার নেই , কি হবে সেসব জেনে ! আর এই একাকীত্ব এই কবিতা জুড়ে নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা নিয়েছে , কী কী একাকীত্ব কবিকে গ্রাস করে কিছুটা বলেছেন , কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করেছে শেষ লাইন , লক্ষ্য করুন , শেষ লাইনে দাঁড়ির ব্যবহার করেননি কবি । কিন্তু প্রশ্ন কেন ? কবি সচেতনভাবেই করেছেন বলেই মনে হয় , একাকীত্ব তো একটা সীমাহীন প্রবাহ , তাকে কি শুধু বইয়ের র‍্যাকের মধ্যে বন্দী করে রাখা যায়! কবি যেন আর অনেক অনুভূতির মধ্যেই ফেলে এসেছি এই একাকীত্ব ।

কবি শুধু একটা সময়ের উপর থেমে থাকেন নি , বিমূঢ়ভাবে কিছু শূন্যতার দৃশ্য তুলে ধরেছেন , এটা দেখুন -

"
অবিক্রীত হাতপাখাগুলি পেখমের ওমে
চড়ুই শালিক কমে আসছে
ধানসেদ্ধ ভুলে দু'দণ্ড উদাসীন
রাত নামছে শেয়ালের গর্তে
হাওয়ার সাঁতার , নদীগর্ভে - "

দেখুন তো কী সুন্দর চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলেছেন , আহাঃ মুগ্ধতা । শীতকালের এই আবহ শব্দের কারিগুরিতে কি দারুণ মাত্রা পেয়েছেন ভাবতে পারছেন ? গরমের হাতপাখাগুলি এখন অন্ধকার কোন গরম জায়গায় পড়ে আছে , ধানসিদ্ধ ভুলে কে উদাসীন ? সে হয়তো আমার গ্রাম্য মা ঠাকুমা হবেন ! রোদ পোহাচ্ছেন আর হয়তো বিগত স্মৃতিচারণে সে ভারাক্রান্ত , উফফফ...! রাত নামছে শেয়ালের গর্তে , চিরকালীন , শেয়াল গর্ত মানে ? অগ্রহায়ণের পড় ফাঁকা মাঠের শূন্যতা , আর মাঠের ইঁদুরের গর্তেই শেয়ালের আস্তানা , এই এক লাইনের বোঝা যাচ্ছে কবি শীতের প্রভাবে প্রভাবিত , কিন্তু এই শীত বর্তমানের কোনো শীতের কথা কিংবা হয়তো শরীরের কোনো গন্ধ লেগে আছে মনে , হয়ত সেই গ্রামে ফিরবার ইচ্ছা এখনও সমানভাবে আছে জেগে । অনবদ্য কিছু অনুভূতি কবিতা জুড়ে এক প্রকার বিরহই সৃষ্টি করেছে , যা খাচ্ছে অস্থি-মজ্জা ।

গ্রাম বাংলার অন্ত্যজ ( সাধারণ মানুষকেই বলছি ) মানুষের রোজনামচা উঠে এসেছে কবির কলমে,

দুপুরে ঘি- ভাত , ভাঁটা শাক
পানাহার শেষে গান -
"
নদীতে বান আসিল রে "
নদিয়ালী মাছের বৃত্তান্ত
আশ্চর্য পদচিহ্ন , বনভোজন

এ তো সনাতনী বাংলার ছবি , একদম সাধারণ কিছু মানুষের চিত্র , যদিও ঘি খাচ্ছে দেখে
ভ্রম হতে পারে , কিন্তু এই ঘি তো নিজেদের গোরুর দুধ থেকে উৎপাদিত ,
আর এখানে কাদের কথা বলা হচ্ছে ? সাধারণ মৎস্যজীবী মানুষের কথা , সেই যেন
"
ছোট প্রাণ ছোট কথা " তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে নদী , নদী কেন্দ্রীক সাধারণ মানুষের কথা কবি সহজ সরল ভঙ্গীতে চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন ।

প্রথমেই বলেছিলাম কবি সময়টাকে ধরেছেন নিজস্ব অনুভবে , আর কবির অনুভব এবং পাঠকের মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেলেই কবিতার সার্থকতা ।"বন্দুকনামা"র " ২৫ টি কবিতা বিভিন্ন ভাবে এই সময়টাকে নিয়ে খেলেছে , বন্দুকনামার শেষ কবিতাটা এবার দেখা যাক -----

"
দু'দণ্ড শোকার্ত হও --
ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে
                        থাকি
শীত ও শ্যাওলার যাপনদৃশ্য
শান্ত গলা , দোলাবাড়ি
মাঠময় জলের শব্দ
পাখিরা ভিজছে । ফাটা
                  গোড়ালি । "

শেষ কবিতায় এসে জীবনের- মরণের একটা বিরহসঙ্গীত বাজছে । ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে , আহা , সব্বাইকেই দাঁড়াতে হবে একদিন ছবি তোলার জন্য , জীবন তো আর আমার ইচ্ছাধীনে নয় ! " শীত ও শ্যাওলার যাপনদৃশ্য " এখানেই মানুষের পরাজিতের কাহিনী , উষ্ণতা লোভী মানুষ চিরকাল উষ্ণতার প্রত্যাশায় , তবুও সমস্ত শীতলতায় বোধহয় নেমে নিতে হয় ,কতকিছু করার ছিল তবুও করার আগেই নশ্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়া ! সেই তো যেন মশকের জন্মের মতো জন্ম , কিছুদিন রক্ত চুষে , পেট ভরিয়ে নোংরা জলে সন্তান উৎপাদনের মেশিন হয়ে বিদায়ের ঘণ্টাধনির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে পড়বে , আরে , এই জীবনে কিচ্ছু করা হয়ে উঠলো না , জীবনটা বৃথায় গেল চলে ! কিন্তু , এখানেই জীবন শেষ নয় , কবি কিছু আশাও দেখতে পাচ্ছেন
"
মাঠময় জলের শব্দ পাখিরা ভিজছে " এ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে ? পুনর্জন্ম ? নাকি আমি না থাকলেও জীবন থেমে থাকবে না! সুদূর অতীত হতেই চরৈবেতি , এই অল্প সময়ের মধ্যেই জীবনের পূর্ণতা , গতকাল স্বপ্ন , আগামী আগত , আজ যদি ভালোভাবে বাঁচা আগামীকাল সুখের স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় , বন্ধু , আজকের দিনে আজকের দিকে তাকাও ।


সুবীর সরকার মহাশয়ের কবিতা পাঠের তেমন সুযোগ ঘটেনি আগে , ইতিউতি কিছু পড়েছি এখানে-ওখানে , "বন্দুকনামা" হাতে এল যখন তখন কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে হল ।

"
বন্দুকনামা" সরাসরি বন্দুক তাক করে রেখেছেন বুকের দিকে , বিদ্ধ তোমাকে করবেই .
সমগ্র বন্দুকনামার মধ্যে সর্বাত্মক কিছু ধনাত্মক অনুভূতি কুরেকুরে খাই হাড়মাস নিজে বুঝে ওঠার আগেই , নদীর নিস্তেজ শীতকালীন স্রোতের মত প্রবাহিত ধারায় যে গান হয় , তেমনভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র কবিতায় একটা আবেশের ছোঁয়া মুগ্ধ করে ।
মনের নিরুচ্চারিত কথা শব্দের মায়াজালে আবদ্ধ করে পাঠকের হৃদয় , এই কবিতায় যেন নিজেকেই আবিষ্কারের খেলা , তবু খেলতে ক্লান্তি নেই , নির্ভেজাল এক আত্মতুষ্টি নিজেকেই জাগিয়ে রাখে অনেকক্ষণ , আর সেখানেই কবি সফল ।
অন্য আরো কিছু কথা না বললে আলোচনা অসমাপ্ত থাকবে । আধুনিক কবিতা কোথাও যেন শব্দের এবং অসমাপ্ত ভাষণে বহুমুখী পথ খুলে দিচ্ছে , কবির উচ্চতায় উঠে কবিতা পাঠের চেতন সকল পাঠকের মধ্যে হয়ত থাকে না , তারা খাবি খেলে পক্ষান্তরে কবিতারই ক্ষতি-বৈ লাভ নেই । কবিকে আরো কিছুটা পাঠকের সঙ্গে একাত্মা হতে হবে বলেই আমার ব্যক্তিগত অভিমত ।
দ্বিতীয়ত , কিছু কবিতায় অনিচ্ছাকৃত কিছু একই ধরনের শব্দ প্রয়োগ কবির মনোযোগ আকর্ষণের দাবী রাখে বলেই আমার বিশ্বাস  

1 comments:

prolay mukherjee বলেছেন...

মারাত্মক বিশ্লেষণ। অনন্য বুঝেছেন। বোঝালেন। অনুভবে চিত্রে কবিতা আমার সমান।