শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অত্রি ভট্টাচার্য

  অত্রি ভট্টাচার্য

এই শ্রাবণের বৃষ্টিতে স্পষ্টতঃ একটা বেনিয়মের গন্ধ। গদ্যের সাথে পদ্যের সীমানা ভেঙেচুরে এলোমেলো হয়ে টয়ে একাকার – তার গর্ভগৃহে কোথাও একটা নির্জন আধো অন্ধকার ঘর, গণেশ পাইনের ছবিতে সম্ভ্রান্ত পিদিম জ্বলছে সংকটের। জ্বলনের তিনটি সিল্যুয়েট – সাদা, কালো বা আধা কালো এবং ধূসর। এই শ্রাবণের খোড়ো অর্থনীতি একযোগে তিনটি রংকেই ধরেছে। এক অচেতনের শ্রেণী, যারা এই মায়াবী দূরাবস্থা-য় (পোস্ট ২০১১) যুগপৎ লাভবান ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। কারণ আমলাতন্ত্রের মধু-র সঙ্গে সঙ্গে অসংগঠিত সন্ত্রাসের বিষ-ও ছড়িয়ে পড়ছে মতে-মতান্তরে। এছাড়া রয়েছেন অবচেতন শ্রেণী, যারা শুধুই লাভবান – কারণ সব্জীবাজারের ওঠানামা পারদ অথবা মাঝারী মেয়েদের লুটোপুটি, গ্রুপডি-গ্রুপসি-র অবলুপ্তি, বন্ধ ইনক্রিমেন্ট বা অনিবার্য্য খরার ব্যাকগ্রাউন্ডে গ্রাম্য চিতা ও চিতাবাঘ তাদের স্পর্শ করার পাস পায় না। এদের প্রসঙ্গ থাক। চলে আসি তৃতীয় শ্রেণীতে; তৃতীয় বিশ্বের ভেতর যাদের চতুর্থ বিশ্ব অভিধায় ভূষিত করেছিলেন জনৈক ইতিহাসবিদ, টাইমস অফ ইন্ডিয়া দৈনিকে। এরা সচেতন। না হয়ে উপায় নেই, হলুদ সূর্য্য এদের কাছাশুদ্ধ জ্বালিয়ে তবে মুখ ঢেকেছে। আদিম সংবাদঘোষক যাদের অনাবৃষ্টির ৪২%-র আওতায় দেগে দিলেন, তারাই এরা। বৃষ্টি কম হ’লে আমার বাবার অসুবিধা, আ-গ্রীষ্ম একে-একে উঁকি মারা কারবাঙ্কলেরা বর্ষাসিক্ত হয়েও মরে না, ঠিক যেন মার-খাওয়া ফসলের সুদ ! উপর্যুপরী ফুটতে থাকে, ফাটতে থাকে, ফোটাতে থাকে প্রাণঘাতী সুইসাইডাল হুল! সব ওষুধ ব্যর্থ হবার পর বাবা-র বালিয়াড়ি পিঠে ফিটকিরি ঘষে দিতে দিতে আমার মনে হয় এরাই সেই চাষীরা, মাইনে বন্ধ হওয়া পরিবহণকর্মী, মামলার তলায় আঁটিশুটি দীর্ঘশ্বাস তথা মামলার কাগজের উপর ঝুলন্ত পা-গুলি। কৃষিক্ষেত্রগুলির ফার্টিলিটি নেহাৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে রয়েছে একপাশে!

আজকালকার রাজনীতি আর অর্থনীতি এত হাতে হাতে ধরিধরি এর আগে কখনো দেখা গিয়েছে কি? ওপারের উৎরোল আর এপারের বাঁজা গন্ডগোল নিয়ে এই নন-ফার্টাইল গ্রীষ্ম-বর্ষার পরে প্রাক-পুজোর ঢেউখেলানো বাঙালি যেন কাদায় কোঁচা-দেওয়া ধুতির মতোই ল্যাজেগোবরে, নাজেহাল! আরামবাগের তাজা মুরগির মতো মজা-ও মারছে, রাত হ’লে শুতেও যাচ্ছে ম্যারিনেট হয়ে, অথবা ডিপফ্রিজড হচ্ছে ডগম্যাটিক হাটেবাজারে পেষাই হবার জন্য! এইসব ডিস্টার্বিং চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে শিল্প ও শিল্পস্থাপন যে গভীরভাবে জড়িত তা আমরা গত কয়েক বছরে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি, বাজারি পত্রিকা ও একচালা টিভি চ্যানেলগুলির দৌলতে। শিল্প, ভারী অদ্ভুত একটি শব্দ! শিল্পকর্ম মানে হাতের কাজ, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ কাজ, আর তার আধার হিসেবে গড়ে ওঠা কারখানা! সুতরাং Art থেকে Industry – একটি ইভোলিউশনারী প্রসেস, যদিও বাংলা প্রতিশব্দটি একটুও এগোয়নি, পৈত্রিক কবচের মতো ঝুলে রয়েছে ফি-প্রজন্মের ঘুনসিতে। যদিও, শিল্পী আর শিল্পপতি – বিশেষিত এক্সপার্টাইজ পৃথক হয়েছেন, হতে বাধ্য বলেই হয়েছেন! তবু, অমোঘ অর্থনীতি সমান গতিতে উত্তমর্ণ –অধমর্ণ-এর বৈজ্ঞানিক সম্পর্ককে বাঁধিয়ে রাখে, যথা শিল্পীর গতি শিল্পপতি – উদা. হর্ষ নেওটিয়া এবং অন্যান্য সেরা শিল্প সংগ্রাহক। একজন শিল্পপতির পকেটে এতজন শিল্পী রয়েছেন – কার প্রতি বাঙালীর চির উন্নতশির নত হবে বলুন ধর্মাবতার? কলকাতা লন্ডন হতে পারে, কিন্তু প্যারিস তো আর হতে পারে না ! প্রসঙ্গতঃ, আমাদের সত্যজিতের ছবি দেখবার জন্য সেখানে চার দশক ধ’রে অপেক্ষা করেন পথরেস্তরাঁ-র ওয়েটার! কার গলায় যে মানিকের মালা!

ইন্ডাস্ট্রী নানান সমস্যায় জর্জরিত, আমাদের কথা ভাবার ফুরসৎ কোথায়? বরং শিরোনামটি সার্থকনাম ক’রে তোলবার জন্য আর্ট প্রসঙ্গেই আসি! শিল্পের ফার্টিলিটি তো একান্তই একটি গুণগত দ্যোতক, কিন্তু অশ্লীলতা? ফার্টিলিটি-র সাথে কতটুকু সম্পর্ক রয়েছে তার? নারায়ন সান্যাল “অশ্লীলতার দায়ে” লিখে অনেকটা ভেবে গিয়েছেন আমাদের জন্য। বরং এই প্রসঙ্গে ফিরে যাই সেই প্যারিসে, একজন স্প্যানিশভাষী শিল্পীর বোহেমিয়ান জীবনের আঁতুড়গৃহে।


পাবলো পিকাসো এক নগ্নিকা ড্র ক’রে দেখালেন বন্ধুকে। জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন হয়েছে?” বন্ধু ঘাড় নেড়ে বললেন, নগ্ন নারিদেহ? এর থেকে অশ্লীল কিছু হতে পারে না! তখন পিকাসো নগ্নিকার পায়ে একজোড়া পাম্প শ্যু এঁকে দিলেন। বন্ধু স্বীকার করলেন, এই ছবিটি আগেরটির থেকে অনেক বেশী অশ্লীল। সুতরাং অশ্লীলতার কনসেপ্টটি, এমনকি, স্থান-কালের গন্ডীর মধ্যেও, পরিবর্তনশীল! কিন্তু নগ্ন নারীদেহ-কে ফার্টিলিটি-র প্রতীকরূপে দেখানোর প্র্যাক্টিস তো নতুন নয়, সেই রেনেসাঁর সময় থেকে চলে আসছে। কিন্তু বিতর্ক যে স্থান বা কালকে গ্রাহ্য ক’রে না, সে তো আমরা দেখেছি ফিদা হোসেনের নগ্ন সরস্বতী (চিত্রঃ ২) নিয়ে চরম নোংরামী-র সময়ে। অশীতিপর ভূমিপুত্রকে কি মৃত্যুর পূর্বে ফিরিয়ে নেওয়া যেতো না তার জন্মভূমির মাটিতে? সরকারী মনোভাব-ও কি মৌলবাদের গোপন লালনঘর ছিল? ওয়েল, এক্ষেত্রে দ্বিতীয় গল্পটিতে আসা যাক। সাল-তারিখ স্মরণে আনতে চাই না, কারণ গল্পটি চিরকালীন! দিল্লীর রামলীলা ময়দানে শিল্পমেলায় স্টল সাজাচ্ছেন দুই বাঙালী তরুণ শিল্পী। উপকরণে, অনেক প্রিন্টের মধ্যে রয়েছে সুবিখ্যাত বত্তিচেল্লীর ভেনাস (চিত্রঃ ১)। দুজন আমলা উদ্বোধনের আগের রাত্রে লাস্ট মিনিট তত্ত্বাবধানের কাজে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন পূর্বোক্ত স্টলের সম্মুখে। ভেনাসের প্রিন্টটি দেখামত্র চমকে উঠলেন দুই কর্তা! এ কি? এ তো অশ্লীল! এসব এখানে লাগানো চলবে না, নামিয়ে ফেলুন! এককথায় শিল্পের সুদীর্ঘ ইতিহাসকে ফুৎকারে উড়িয়ে চলে গেলেন তারা! বিকাশ ভট্টাচার্য হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন তার সঙ্গীর দিকে!

অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস

1 comments:

Hasan Mosfiq বলেছেন...

বোহেমিয়ান । ভালো লাগলো ।