শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

সাক্ষাৎকার - মুখোমুখি বাণীব্রত এবং মৃগাঙ্ক

সাক্ষাৎকার life
- মুখোমুখি বাণীব্রত এবং মৃগাঙ্ক



বাণীব্রত কুণ্ডু শূন্য দশকের অন্যতম প্রধান কবি । মূলত ক্ষেপচুরিয়ান হিসেবেই পরিচিত । বাণীব্রত এর লেখায় একধরণের অতিলৌকিক চেতনা খুঁজে পাওয়া যায় । বানীব্রত থাকেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরে । পেশায় শিক্ষক এবং স্বভাবে আদ্যপান্ত এই কবি বরবরই প্রচারবিমুখ । সম্পাদনা করেছেন অন্বেষী , ক্ষেপচুরিয়াস প্রভৃতি পত্রিকা । এবার সেই বাণীব্রতকেই খুঁচিয়ে বের করে আনতে শূন্যদশকের আর এক প্রধান কবি মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলীর র‍্যাপিড ফায়ারের সামনে ফেলা হল বাণীব্রতকে । প্রায় তিন মাস ধরে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে আমরা জেনে নেবো এই সময়ের কবিতার ওপরে এই দুই কবি কী ভাবছেন ।

---------------------------------------------------------------------------------


অস্থি ছুঁয়ে থাকি এ কবিতা কোথার থেকে পেলে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

কেন?
আমিই তো লিখেছিলাম। অন্য কোথাও দেখলে নাকি???
জানাও...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

না তা বলি নি
আমার মনে হয় কবিতা কোথার থেকে আসে... আমরা যেন তাকে কলম বন্দি করি।

বাণীব্রত কুণ্ডু

না, মৃগাঙ্ক!! কবিতাকে আমরা কলমবন্দী করি না বরং কোনো এক তুরীয় মুহূর্তের দুর্বলতায় (অবচেতন অবস্থায়) ঈশ্বর আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেন - এটা আমি মনে প্রাণে উপলব্ধি করেছি। তাই বিশ্বাসও করি। কারণ, যখন কবিতা লিখব বলে প্রস্তুত হই তখন তো কই কবিতা আসে না! আবার দেখো কোনো এক অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে - বাথরুমে, রাস্তায়, ভিড়বাসে কিংবা ক্লান্তিকর মুহূর্তে কবিতা আসে অনায়াসেই... কি করে হয়!!

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তাহালে কবিতায় কবি নিজের নাম দেয় কেন?

বাণীব্রত কুণ্ডু

দিই। কারণ, যেহেতু আমি কবিতা রচনায় 'ঈশ্বরের কর্তৃত্ব' স্বীকার করেছি তাই বলতেই হয়, কবিতায় কবি নিজের নাম দেয় ঠিক সেভাবেই, যেভাবে পিতা-মাতা তাঁর সন্তানের পরিচয় দিয়ে থাকেন। আমি মনে করি, নরনারীর মিলন-কামনা পার্থিব চেতনা থেকে আরম্ভ হলেও সেই মিলনের একটি পর্যায়ে আমাদের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে থাকে। যখন আমাদের চিন্তনে বহিঃজাগতিক কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। যে একাগ্রতায় একজন ঋষি সমাধিস্থ হন সেই নিবিষ্টতাতেই নারীপুরুষের মিলনমুহূর্ত পরম সাধনার স্তরে উন্নীত হয়ে থাকে। তারপর সেই ভাবজগৎ-এর সমাপতনে আবার চেতনায় লৌকিকতা ন্যাস্ত হয়। তাই আমরা পার্থিব চিন্তাভাবনার প্রাধন্যতা বশতঃই সন্তানাদির নামকরণ করি এবং তাকে নিজের পরিচয়ে পরিচিত করে থাকি। সেইরূপ কবিতাকেও আমরা নিজের পরিচয়েই প্রকাশ করি অর্থাৎ কবিতার উপর আমার পার্থিব জনকত্ব প্রতিষ্ঠা করি।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আচ্ছা। কবিতা যখন পাঠকের হাতে তুলে দাও কি expect কর?

বাণীব্রত কুণ্ডু
যদি শুধুমাত্র 'পাঠক'এর কথা বলো তো বলি, - পাঠককে আমি উঁচু আসনে বসাই। যেমন, দাতা এবং দানগ্রহীতার সম্পর্ক (বর্তমানের নিরিখে নয়)। শাস্ত্র বলছে, যাঁকে দান করা হবে তাঁকে সশ্রদ্ধায় উচ্চস্থানে উপবেশন করানো হবে আর দাতা নীচে থেকে দুবাহু তুলে তাঁর দানসামগ্রী গ্রহণ করতে অনুরোধ জানাবেন। তাঁর কাছে দাতার এই প্রার্থনাই থাকবে , যেন তিনি প্রীত হন, এবং আশীর্বাদ করেন। যেমনটি আমরা পূজার্চনায় করে থাকি আরকি! ঠিক সেরকমই পাঠককুলের কাছে আমার এই expectation-ই থাকে যেন তাঁরা কবিতাটি পড়ে বিমল আনন্দানুভূতি লাভ করেন এবং আমায় আশীর্বাদ করেন!!

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

এটা একটু মহত্ত্ব দেখানো হয়ে গেলো না ? একটু ধার্মিক ধার্মিক?

বাণীব্রত কুণ্ডু

না, মৃগাঙ্ক! ব্যাপারটা ঠিক মহত্ব বলবো না। আমি যেমনটা শিখেছি তেমনভাবেই মানুষজনদের দেখি, বিচার করি, বুঝে নিই। আর যেখানে আমি নিজেকে কবি বলে মনে করি না; কিছু খেয়ালখুশি মতো লিখি, বন্ধুদের ভালো লাগে, ব্যাস্‌ এটুকুই! তখন মহত্ব দেখাবো কোথায়!! আর 'ধার্মিক' -এটাও আমি অন্যভাবে দেখি। কারণ ধর্মের আমি অন্য সংজ্ঞা জানি যে। যেখানে ধর্ম হল সেটাই যা সমাজকে ধারণ করে, অর্থাৎ সমাজের নীতি-নিষ্ঠাগুলোকে পালনের মাধ্যমে সামাজবদ্ধ মানুষকে সঠিক পথে; সত্যের পথে, সুন্দরের পথে, মানবধর্মের পথে চলতে সহায়তা করে। আজ যে সারা দেশব্যাপী এতো অরাজকতা তা তো 'প্রকৃত ধর্ম'কে আড়াল করে রাখার কারণেই। প্রসঙ্গত, আমি অভিমন্যুর কাহিনিটা বিশ্বাস করি। তথাকথিত 'ধর্ম'কে আমি বুঝি না। শুধু আক্ষরিক অর্থে তাদের সকলকেই সম্মান জানাই।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তোমার প্রিয় কবি কে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

এইটা সত্যিই একটা কঠিন প্রশ্ন। ছোটোবেলায় জানতাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সবাই বলত যে। মাধ্যমিকস্তরে নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। 'সাম্যবাদ', 'আমার কৈফিয়ৎ', 'সর্বহারা', 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার'... তখন রবিঠাকুরকে শ্রেণিশত্রূ (শিক্ষামানের বিচারে)। জীবনানন্দ দাশ'এর কবিতা খুব ভালো লাগতো। 'রূপসী বাংলা', 'বনলতা সেন', 'আট বছর আগের একদিন'... ঠোঁটস্থ থাকত। তারপর আরো উঁচু ক্লাসে উঠলাম। আরো অনেক কবির কবিতার সংস্পর্শে এলাম। সুকান্ত ভট্টাচার্য, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং আরো এনেককেই পড়লাম। চিন্তা-ভাবনাগুলো মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঙতে লাগলো। কবি আগে না কবিতা! কে বড়ো! কাকে ধরে এগিয়ে যাব! - এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মন বলল, কবিতা-কবিতা-কবিতা। আর তাই আমার ভালো লাগা কবিতার স্রষ্টা হিসাবে অনেক কবিই আমার খুব প্রিয়। অনেকের নাম বললাম। এঁরা ছাড়াও যাঁরা আমার কাছে অভিভাবকের মতো তাঁরা -শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জসীম উদ্দীন, শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, শুভ দাশগুপ্ত, মল্লিকা সেনগুপ্ত, জয় গোস্বামী এবং আরো কেউ কেউ... আমার সমস্ত প্রিয় কবিতার স্রষ্টাই আমার প্রিয় কবি। এভাবেই বলতে হল।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

প্রিয় কবিতা ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

এই প্রশ্নের উত্তরেও তো আমি কোনো একটি কবিতার উল্লেখ করতে পারব না। অনেক কবিতার কথাই বলতে হবে। মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে কবিতার 'প্রিয়'-উপাধি। এখন যেমন আমার খুব মনে পড়ছে ব্রত চক্রবর্তী'র 'মিলিদি' কবিতাটি। তাই বোধহয় তা উল্লেখ করতে গিয়ে এই আলোচনার পাতা দীর্ঘ করে লাভ হবে না। কি বল তুমি...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


ধর এই মুহূর্তে তোমার যে কবিতা টি মনে আসছে বল

বাণীব্রত কুণ্ডু

ওই যে বললাম, 'মিলিদি'।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

পুরো কবিতাই নাকি তার কিছু লাইন

বাণীব্রত কুণ্ডু


কবিতাটির কোনো লিখিতরূপ আমার কাছে নেই... বহুদিন আগে কোথাও শুনেছিলাম। আর দুবছর আগে লাস্ট পড়েছিলাম। তবু মনে পড়ে।পুরো বর্ণনাটাই পড়ে আবছা আবছা, আর শেষের সেই ক'লাইন তো ভুলতেই পারি না... (কোট করলাম না) - দুটো দেশ পারল, দুটো নদী পারল, দুটো মানুষ পারল না...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

হঠাৎ এই লাইন দুটিই এখন মনে এলো কেন ভাবে দেখলে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু


কারণ, আজ বিকাল থেকে আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে অনেক কথা হচ্ছিল, ইভেন এখনো হচ্ছে। ছোটো থেকেই তাঁর জীবন অনেক দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। তাও আবার তাঁর বাবার কারণেই। আমি ভাবতে পারছি না, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও 'মেয়ে' বলে তার কোনো মতামত থাকবে না তাঁর পরিবারের কাছে!! তাঁর সমস্ত সখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়েছে... দূরে পোস্টিং পাওয়ার কারণে চাকুরিতে জয়েন করার পার্মিশান দেওয়া হয়নি...ভাবা যায়!!! এই রকম অনেক কিছু কথা হল। যদিও দুটোর বিষয় হুবুহু এক নয় তবুও জীবনের যে দ্বন্দ্ব, যে টানাপোড়েন সেই অনুভূতিটা এক হওয়ার কারণেই এখন আমার মাথার মধ্যে কবিতার ঐ লাইনগুলোই মনে আছাড় খাচ্ছে বারংবার...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


তোমার নিজের লেখা কোন লাইন মাথায় এলো না কেন ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
প্রথমত, নিজের লেখা লাইন সেভাবে মনে থাকে না আর থাকলেও ওই প্রসঙ্গে কিছু লেখা নাই বা তত ভালো লেখা নাই। দ্বিতীয়ত, নিজের লেখা মনে রাখার মতো কিছু হয় বলে মনে হয় না। আজ যা লিখি কাল তা আর ভালো লাগে না। হয়তো তাই... তৃতীয়ত, একটা লাইন এসেছে মাথায় - হয়তো একমাস-দুমাস কিংবা আরো পড়ে কোনো এক তুরীয় মুহূর্তে কবিতা আকার নেবে ভাবনাগুলো।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আমি একজনকে তোমার কবিতা পড়তে দিয়েছিলাম। সে বলল অতি জঘন্য লেখা। লেখার হাতই তৈরী হয় নি।

বাণীব্রত কুণ্ডু

যেকোনো মতামত প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর উপর তৈরী হয়। তিনি তাঁর স্বাধীন মত জানিয়েছেন। হতেই পারে তাঁর ভালো লাগেনি, কিংবা আমার 'লেখার হাত তৈরী হয়নি'। তেমনি আবার অনেক সমসাময়িক এবং অগ্রজকবি প্রশংসাও তো করেন। এই দুপক্ষই আমার সম্মানীয়। আমি উচ্ছ্বসিতও হচ্ছি না। আমি হতাশও হচ্ছি না। যেটুকু আমার নেওয়ার আমি নেব আর বাকিটুকু... মিলিয়ে যায়।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

এই নেওয়াটুকু কোথাও কাজে লাগে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

অবশ্যই। অবচেতনে, মনের মধ্যে সেইকথাগুলো ছায়ার মতো থাকে। হয়তো প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে না। পরোক্ষভাবে চিন্তা-ভাবনায় প্রভাব রাখে।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

ঠিক বুঝতে অয়ারলাম না। আর একটু ভেঙে বল

বাণীব্রত কুণ্ডু

ধর, যেমন তুমি বললে যে - একজনকে আমার লেখা পড়িতে দিয়েছিলে তাঁর 'জঘন্য' লেগেছে। এই শুধুমাত্র দূর থেকে জঘন্য লাগাটা আমার মনে কোনো দাগ কাটবে না। যদি তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন কেন 'জঘন্য' -আমি অবশ্যই ভাবব। এবং সেক্ষেত্রে ওই ভাবনাগুলো আমার মনের মধ্যে আমার অবচেতনে; হয়তো যখন আমি কোনো অন্য কাজেও ব্যস্ত থাকি, তখনও নিজে নিজেই গঠনশৈলীতে প্রবেশ করে। রচনারীতি পালটে দেয়। লেখা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত যা আমিও জানতে পারি না - এরকমই মনে হয়!! আর প্রশংসার ব্যাপারেও একই কথা। আরো উন্নত করার কথা ঘুরপাক খেতে থাকে আমারই অজান্তে। বোঝাতে পারলাম কি!!

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তুমি তো বলো ঈশ্বর কবিতা লেখান।

বাণীব্রত কুণ্ডু

হ্যাঁ। লেখার মুহূর্তে সেই শক্তি কাজ করেন। অবশ্যই করেন।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তাহালে তুমি কি বল তার ওপর কারো মতামত প্রভাব ফেলে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

মানে কি - ঈশ্বরের উপর ব্যক্তিমতের (কবি/সমালোচক) প্রভাবের কথা বলছো কি??? একটু বল প্লিজ্‌...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তুমি বললে ঈশ্বর কবিতা লেখান। আবার কারো মতামত কবিতায় প্রভাব ফেলে তাই জানতে চাইছি

বাণীব্রত কুণ্ডু

হ্যাঁ। কারোর মতামত যা প্রভাবিত করার আমাকে করে। আমার অবচেতনে। কবিতা লেখার সব আয়োজন (অগোছালো ভাবেই) আমার ভিতরে হয়ে থেকে। যখন লেখা আসে, ঘোর আসে তখন লেখা বেরিয়ে আসে আপনগতিতেই!! এখন পর্যন্ত আমার যেরকম অনুভূতি হয়। ঠিক যেন, সবজি-তরকারি কেটে রাখি আমি আর সেগুলো প্রয়োজন মতো প্রয়োগ করে মশলাপাতি (শব্দচয়ন, শব্দপ্রয়োগস্থান, ব্যাকরণ, বাক্যনির্মাণ, ভাবসংযোজন ইত্যাদি) দিয়ে সুস্বাদু করে পরিবেশন করেন সেই ঈশ্বর। আমার ধারণা। কারণ আমি আগাপাশতলা সামাজিক হোই-চৈ-এর মধ্যে থেকে হয়তো স্লোগান লিখতে পারবো, পোস্টার লিখতে পারবো...কিন্তু কবিতা!! পারি না।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


নতুন যে কবিতার বই এবছর প্রকাশ পেয়েছে। তার মধ্যে কোনো বই পড়েছ ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
এ বছরের প্রকাশিত...নাহ্‌! কোনো বই পড়িনি এখনো। কারণ, বইগুলো কেনা হয়নি। ওহ্‌, একটা বই অবশ্য কিনেছি। কিছুটা পড়েছিও বটে।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আগের বছর ?

বাণীব্রত কুণ্ডু


হুম। আগের বছরের পড়েছি। "ভালোবাসার জন্য" - বোধিসত্ত্ব বন্দ্যোপাধ্যায়।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

কেমন লেগেছে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

ওভার অল ভালোই লেগেছে।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


কিসের বই ছিল ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

কবিতার বইই ছিল।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তার থেকে পড়া কোন ভালোলাগা ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
ওনার কবিতায় একটা বাস্তব, মানসিক দ্বন্দ্ব, আবেগ এবং আত্মকথন-এর অদ্ভূত মেলবন্ধন তৈরী হয়। যা কবিতা পড়াকালীন মনকে কোনো এক মায়ারাজ্যে প্রবেশ করায় সহজ সাবলীলতায়। যেমন দেখো, - উনি লিখছেন,
"যাদের মুখ নির্বাসন দিয়েছো
তাদের শরীর আবার কেন টেনে আনতে চাও
ভালোবাসার জন্য তারা হাটে বসে আছে
তাদের হাতে একটা করে গোলাপ তুলে দাও।"
তারপর ধর, -
"ঈশ্বর, - তুমি ভাঙলে যখন আমায়
আমার বাউল সহাস্যে বসেছিল তোমার দাওয়ায়"
এরকম আরো অনেক শব্দবন্ধ কবিতায় মোহজাল বিস্তার করে যায় কবির।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

বাহ তোমার তো দারুণ মেমারি গো। আমাকে তো জিজ্ঞেস করলে এরকম বলতেই পারবো না।

তোমার প্রথম কবিতা লেখা কবে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
না না, মেমারী নয়। বইটা আমার কাছেই তো আছে।

প্রথম লিখি ভূতের গল্প। স্কুল ম্যাগে। তারপর কবিতা লিখেছিলাম কিন্তু স্যার সিলেক্ট করেছিলেন না। এখন বুঝি কেন ! তারপর দীর্ঘদিন লেখা হয়নি। কলেজ লাইফে আবার শুরু হয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক লিখেছি। এখন সেগুলোর দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হয় না। তবু স্যারকে দেখিয়েছিলাম। উনি আবার অনার ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে আমাকে একটি সংশাপত্র দিয়েছিলেন। তারপর থেকে লেখাটা নিয়মিত করার চেষ্টা করি। আর লিটল ম্যাগে প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল তা ২০০৬সালে। স্বর্গীয় কাশীনাথ ঘোষ সম্পাদিত "সেই সন্দীপন" পত্রিকায়।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আচ্ছা বলত এটা কেন হয়? দুই কবিতাই তো 'ঈশ্বরের লেখা'। তবে আগের লেখা কেন ভালো লাগে না?

বাণীব্রত কুণ্ডু


ওই যে, আমি যদি রান্নার যোগাড়ে শাক, উচ্ছে, কচু প্রভৃতি কুটে রাখি তা দিয়ে তো আর পোস্ত, পনির কিংবা মালাইকারি তৈরী হবে না!! তখন আমার যে সঞ্চয়, যে অর্থবোধ, যে শব্দভাণ্ডার কিংবা শব্দপ্রয়োগকৌশল বর্তমানের মতো ছিল না তাই এখন যখন আমি ভালো ভালো খাবারের সংস্থান করতে পারছি তা দিয়ে তো সুস্বাদু রান্না হবেই। তাই আর সেই শাক, উচ্ছে, কচুর দিকে মুখ ফেরাতে ভালো লাগে না।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী
কবিতায় পরীক্ষা নিরিক্ষা কে কি চোখে দেখ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবসময়েই ভালো। যে কোনো ক্ষেত্রেই তা হওয়া উচিত। তবে সেটা ভালো হলেই ভালো। কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে কবিতাতে বেশকিছু অসভ্যতা চলে। যেটা সুস্থ সংস্কৃতির বিরোধী বলে মনে করি।

সম্ভবত বছর তিনেক আগে ‘কবিসম্মেলন’এর মতো পত্রিকায় একটি কবিতা পড়েছিলাম। এবং সেই প্রথম আমি কোনো কবিতা পড়ে লজ্জাবোধ করেছিলাম। কবিতাটির উল্লেখ করতে চাই না কারণ, এভাবেই ঐ সমস্ত কুৎসিত কবিতা উদাহরণে উঠে এলে বাংলা কবিতা সম্পর্কে ভ্রান্তধারণাই প্রতিষ্ঠা পাবে। এসময়ে বেশ কিছু লেখায় দেখি কতকগুলো শরীরীশব্দ বসিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা হচ্ছে। এখানেই আমার আপত্তি। এইকথা শুনে কিছুসংখ্যক কবিতালিখিয়ে রে রে করে ছুটে আসবে। কৈফিয়ৎ চাইবে... কেন বাপু... দিনে-দুপুরে-রাতে শরীর ঘেঁটে ‘ঘ’ করে দিচ্ছ দোষ নেই আর আমরা কবিতায় একটু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বসিয়ে দিলেই যত মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বুঝি!! শুধু কবিতায় নয় সাহিত্যেই শব্দের যথার্থ প্রয়োগচেতনা বড়ো প্রয়োজন। যেমন আমরা সারমেয়বৎ সহবাস করি না তেমনই শব্দেরও আব্রূর প্রয়োজন আছে। আব্রূই সৌন্দর্যের প্রকাশক।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তোমার কি মনে হয় এটা ইচ্ছাকৃত?

বাণীব্রত কুণ্ডু
লোকে বলে। আমিও জানতাম যে – মদ খেলেই মাতাল হয় আর মাতাল হয়ে গালিগালাজ করে। কিন্তু এটা সত্যি নয় মৃগাঙ্ক! যেহেতু মাতাল অবস্থায় মনের উপরে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাই, মাতাল হলে আমাদের ভিতরকার প্রকৃত রুপটির নির্বাধ প্রকাশ ঘটে যায়। তখন যাঁর মধ্যে যেমন প্রবণতা থাকে সে তেমন আচরণই করে। সেখানে কোনো নাটক নেই। আর আমরা যাঁরা কবিতামদে মাতাল হই; যখন মাতাল হই অর্থাৎ কবিতা লিপিবদ্ধ করার সময় আমাদের ভিতরকার সেই প্রকৃত প্রবণতা অনুযায়ী কবির ভাষাব্যবহার, শব্দচয়ন, রচনারীতির প্রকাশ ঘটে। তাই সাহিত্যে যাঁরা শব্দকে বে-আব্রুভাবে, অশ্লীলভাবে গ্রন্থণা করেন হয়তো তাঁদের জীবনবোধও অনুরূপ! তাই ‘ইচ্ছাকৃত’ বলতে পারছি না।

1 comments:

BANIBRATA KUNDU বলেছেন...

২০১৩ থেকে ২০২৩, সময়টা আসলেই অনেক। একটা গোটা দশক পরেও ব্যক্তিগত কবিতাদর্শন আজও একইভাবে স্পষ্ট।

ধন্যবাদ মৃগাঙ্ক।
ধন্যবাদ টিম ক্ষেপচুরিয়ানস্।