মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

বুক রিভিউ – ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

কালকূট এর ‘মুক্ত বেণীর উজানে’ বইটি নতুন করে পড়ে জানালেন ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী


কালকূটের লেখা উপন্যাসের উপরে অভিমত প্রকাশ করতে হবে এই ধারণাটা মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দের সঞ্চার করেছিল। তাই আরও বেশি সতর্ক ছিলাম, যে অনুভূতির প্লাবনে যেন ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলি যেন ঢাকা না পরে যায়। লোক কথায় বা দর্শনেও আছে, কোন জায়গার আন্তরিক ডাকই তাকে তীর্থ বানায়। ভাবলে অবাক লাগে এই তীর্থ কি শুধু বাইরে, নাকি অন্তরেও। মানুষের মন ও অনুভূতির জগতে এমন এমন সব জায়গা আছে যা আমাদের কাছে তীর্থের মতন আকাঙ্ক্ষিত। মুক্ত বেণীর উজানে পড়তে পড়তে শুধু ভ্রম লাগে যে এই সকল তীর্থ স্বরূপ মন জগতের স্থান গুলি কি শুধু মাত্র ভেসে আসা চরিত্র গুলির মনের নাকি লেখকের চোখ যা এক মানবতার চশমা হিসেবে আমাদেরকে দেখতে সাহায্য করছে। প্রত্যেকটি চরিত্র রোজকার উঠে আসা জীবন থেকে নেওয়া অথচ তারা নিজ গুনে বিরল। কাহিনীর শুরু হয় লেখকের ত্রিবেণী যাত্রা পথের বর্ণনা দিয়ে। সেখান থেকেই ঘটনা প্রবাহ এগোতে থাকে। শুরুতে ওপার বাংলার থেকে আসা সর্বহারা মহিলাদের রিফিউজি ক্যাম্প এবং তাদের জীবন যাত্রার কাহিনী আমাদের কাছে দেশ ভাগের এক বাস্তব ও করুন চিত্র প্রকাশ হয়। এই সকল মেয়েদের চাওয়া পাওয়া কামনা সমস্ত কিছুই লেখকের চোখ এড়ায় না। যেমন এড়ায় না এমদাদ আলি খাঁর চোখ। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তার মধ্যে যেমন পুরোমাত্রায় কৌতুক রস যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে এক মানবিকতা বোধ। মানবিকতা বোধ বলতে গেলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে মানুষ বলতে কি বুঝি। দয়া, মায়া, মমতা , এমন কি প্রাসঙ্গিক ভাবে বেশ্যার শব বহন করার জন্য লেখকের কাঁধ বাড়িয়ে দেওয়া। নাকি তার বাইরেয়ও কোন



প্রাসঙ্গিকতা আছে। মানুষের মনের মধ্যে যে এই দ্বিধা এবং তার স্তর ভেদ; তার চেতন ও অবচেতনের লড়াই, এ সবই আমাদের মানুষ করে। মৃতা বেশ্যা চন্দ্রাবলীকে কেন্দ্র করে যে চাওয়া পাওয়ার ছবিটি ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে যেমন তিক্ততা আছে তেমনি মাধুর্য আছে। ভ্রম হয় কোনটা রক্তের সম্পর্ক আর কন্তি নয়; তার ছেলের অর্থলিপ্সা যেমন আমাদের কষ্ট দেয় তেমনি বাকি বেশ্যাদের তার শব বহন করার মধ্যে দিয়ে কর্তব্য ছাড়িয়ে যে মানবিকতা বোধ ফুটে ওঠে তা পাঠক কে মুগ্ধ করে। এই সকল ছোট ঘটনার থেকে এক বিরাট চিত্রের ইঙ্গিত বহন করে আনে। মৃতা মহিলাকে কেন্দ্র করে যেমন অনুভূতির মেরুকরণ যেমন বিদ্যমান তেমনি থাকুরমশাইয়ের মত চরিত্রে বিদ্যমান অনুভূতির সদা আসা যাওয়া। সবচেয়ে মুগ্ধ করে যেটি সেটি হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের এক স্নেহের ফল্গু ধারা। এর গতিপথ যেমনি জটিল তেমনি আকস্মিক; অচেনা অজানা পাথরে ধাক্কা খেয়ে সে ধারা সমানে বহে চলে। সবচেয়ে বড় উধাহরন হল চক্রবর্তী মহাশয়। তার আপাত রুক্ষ স্বভাব ও জাত পাতের ভেদের আড়ালে যে তার মানবিক স্নেহশীল মনটা লুকিয়ে ছিল তার পরিচয় পেতাম না যদি না লেখক তার বাড়িতে আশ্রয় না নিতেন। শুধুমাত্র চক্রবর্তী মহাশয়ের কথা বললে একটি পরিবারের আন্তরিকতার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বলা হয়না। তার স্ত্রী ও তার মেয়ে, তার পরিবারের দুই নারী চরিত্র তাদের অহেতুকই ভালোবাসা এক অচেনা ব্যাক্তির প্রতি আমাদের মুগ্ধ করে। এবং স্বাভাবিক ভাবেই তার প্রকৃতি আলাদা। প্রত্যেকটি ভালবাসা আলাদা আলাদা করে তার স্বকীয়তা বজায় রাখে। একটি কিশোরীর মনের পথের আলিন্দে যে চাওয়া পাওয়া বা ভালোবাসার কথা লেখা থাকে তা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে এখানে প্রকাশিত হয়েছে। এবং কাহিনীর শেষে আসে এমন একজন চরিত্র যা আমাদের মনে ভয়, পুলক এবং আনন্দের সঞ্চার করে। এই “খ্যাপা বাবা” এমন একটি ব্যাক্তি যিনি দুজন তরুণী ও একজন চেলা কে নিয়ে নৌকা বিহার করেন। এক বিরাটের অবস্থান। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল দুই ভিন্ন পরিবেশের মানুষের (খ্যাপাবাবা ও লেখক) মেয়েদের সম্বন্ধে অভিমত নিয়ে। এখানেই সবচেয়ে অসামন্যতা, দুজনেই তাদের জীবন আর অভিজ্ঞতা দিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন “নারী তুমি, তুমি শক্তি, তুমি প্রেম, তুমি ত্রিভুবন ধারা ।” ভারতের শাক্ত ধর্মের ইতিহাসে এমন অনেক সাধক দেখতে পাই। কিন্তু তাদের মন জগতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য কজনের হয়। এবং সেখানে পউছেও শত অচেনার মাঝে সেই চেনা সুর কানে বাজে, চোখের সামনে ধুসর হয়ে যায় তীর্থের আচার আচরণ , শুধু ভেসে ওঠে কালব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের চাওয়া পাওয়া ভালোবাসার কথা।