বাস্তবিক প্রেমের বিস্তর ফারাক !
১৫ এর প্রেম
সুদীপ স্যারের টিউশন মঞ্চে সেদিন তুই টাইটানিক। শাহরুখ-কে কিছুটা নকল করতে চাওয়ার প্রয়াসে বোধহয় একটু হেসেছিলি।জিন্স-টা তখনও আয়ত্তে আসেনে রে।সেই শূন্যস্থান পূরণ করতাম গাছে উঠে পিয়ারা ছিঁড়ে অথবা ঢিল ছুঁড়ে আম পেরে।সুরজিত তো এত কসরত করতনা।তবু বুঝিনা গোলাপের গ্রিটিংসটা ও কি করে পায়?? আমি বরাবরই নদী আঁকা গ্রীটিংস পেয়েই খুশি।
১৮ এর প্রেম
ডিও-ড্রেন-টা কিনেই ফেললাম রে।কিছুটা বাবার পকেট কেটে কিছুটা ছাতুর পয়সা বাঁচিয়ে।বলেছিলি না গায়ে বোকা-পাঁঠার মত গন্ধ
ছাড়ে?পরের দিন প্রায় সবটাই গায়ে ঢেলে এসেছিলাম ক্লাসে।পঙ্কজ-বাবু বলেছিলেন 'ইন্দ্র-দেবের পাঠা'।আর তুই?? নাকে রুমাল চেপে বসেছিলি!! একবারও তো বলতে পারতিস গোপাল কোন ডিও-ড্রেন
মাখে???
২১ এর প্রেম
প্রেসিডেন্সীতে রাত-দুপুর দাঁড়িয়ে আছি ভর্তির ফর্ম তোলার জন্য।খিদে পেয়েছিল খুব।ভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে দু গ্লাস আঁখের রস খেয়েছিলাম।ঘরে এসে দেখি তোর খাওয়া হয়ে গেছে।ফর্মটা হাতে দিয়ে দুটো বাতাসা আর এক গ্লাস জল খেয়ে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছিলাম।তোর ডাকে আবার ফিরে আসি।আমার হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে বলেছিলি “শাড়ির দামটা মা দিল,বাট্ আমার ইচ্ছা ছিল রে নেওয়ার”..................
পরের দিন অনুষ্ঠানে সেই শাড়ি পড়েই লাইব্রেরী
এলি!!কেন জানি না রঙটা নীল ছিল না। বোধহয় পিতাভ হলুদ শাড়িটা সৌরভ দিয়েছিল.......
৩৯ এ প্রেম
ডিভোর্সের পেপারটা টেবিলের ওপরই রাখা আছে গত তিনদিন ধরে।তাতে মেঘার সইটা আজ বড়ো উজ্জ্বল লাগছে অন্যদিনের থেকে।সপ্তাহের বাকি দিন-গুলোয় কাজের মধ্যে সময়টা কি ভাবে যেন কেটে যায়।শুধু রবিবারের দুপরটা কিছুতেই কাটতে চাইছেনা।যদিও উঠোনের বুকে দুটি কোকিল ফড়িং ধরে চলছে অবিরাম।তবু ওর অনুপস্থিতিটা আজ পাখির আওয়াজেও জেগে উঠছে বার বার।
ভাল-লাগছিল না বনিবনা হীন সংসারটাকে জোর করে টিকিয়ে রাখতে।কখনও মনে হয় সব কিছু থেকে মুক্তি নিয়ে সম্পূর্ণ একলা হয়ে যাই কিছুটা বেহিসাবির সাথে। মাঝে মধ্যে অঙ্কে ভুল করা ভালো।অন্তত বে-হিসেবির কিছুটা সাধ আস্বাদন করা যায়। অবশেষে সুযোগটা তো এলো। অথচ এই একলা দিনে আজ মেঘাকেই অনেক বেশি করে মনে পড়ছে! তবে একলা হতেই বা চেয়েছিলাম কেন কে জানে??হয়ত এই না চেনার কৌতূহলটাই জীবনকে কালকের জন্য বাঁচিয়ে রাখে। হয়ত বা তাই............
ঘুঘুর অবিরাম চলাফেরায় উঠোনের খয়েরী রঙটা একটু একটু প্রাণ পাচ্ছে।মেঘা ঠিক এমনই, অনেকটা নিকানো উঠোনের মত। কখনও একসারি পিঁপড়ের সাথে কঠোর ভাবে শৃঙ্খলিত,কখনও পিয়ারা ফুলের মত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে ঈশান কোণে।আবার, সকালের দিকটায় নিজেকে শালিকের কোলাহলে ব্যস্ত করে তোলে প্রতিদিন।অথচ দুপুরে ঘুঘুর ডানা ভর্তি ধোঁয়াশা ছন্দে বড়ো আপন করে নেয় নিজেকে।এই প্রান্তিক ছোঁয়া কিছুটা আমিও পেয়েছি।এমন দ্বন্দ্বের মাঝেই জীবনের উনচল্লিশটা বছর কোথা থেকে বয়ে গেছে কে জানে?? থাকার মধ্যে শুধু শুধুই একলা আছে এই নিরালা দুপুর খানি। আচ্ছা দুপুর কি সত্যি একলা হয়?? নাকি এই একাকীত্বের বোঝা জোর করে দুপুরের ঘাড়ে চাপাতে চাইছি?? জানিনা রাত-টা কি করবে??তবে মাঝে মাঝে এই ধরণের অনুভূতির প্রয়োজন আছে বোধহয়।আবার সেই প্রয়োজনের ঘরেই আশ্রয়!! মানে বেহিসাব আদপে একটা হিসেবই!! ঠিক অন্ধকার যেমন একটা শক্তি।
জানিনা আমার মত করে মেঘাও এই কথা গুলো ভাবছে কিনা??তবে ডিভোর্স পেপারটা আরও কিছুদিন টেবিলের ওপরেই থাকুক।নিশ্চয় আরও অনেকদিন থাকবে।ধীরে ধীরে পুরু আস্তরণ পড়ে যাবে ধুলোর।সব কিছু ঢেকে যাবে।শুধু ঢাকবেনা মেঘার উজ্জ্বল সই টা...............নিশ্চিত............
ষাট এ প্রেম
এই বেশ ভাল আছি। একাকী।আশ্রমের গাছপালা গুলো আমারই হাতে বড় হচ্ছে রোজ। বড় হচ্ছে আর এক চরম সত্যি একটু একটু করে। তফাত্টুকু গড়ে দিচ্ছে আরও একদিন বাঁচার ইচ্ছা।গাছ পালা গুলোও নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে চায়।কিন্তু আমার হাতে কাঁচি আছে।বড় ডাল ছাঁটার।দুটি কচি ডাল একটু আমোদ করে বাড়তেও পারবেনা।উপর মহলের কড়া নির্দেশ, সুন্দরতা বজায় রাখুন। চোখের নান্দনিক কৃপায় প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত হয় বাহারে ডাল গুলি।বুঝি, ভালোলাগাও কত দানবিক হতে পারে। সব সুন্দরতাই বুঝি কিছু ক্ষত বহন করে।যেমন তাজমহল করে চলেছে।
গোলাপের কুঁড়িগুলি ফোটেনে কেন? ইনজেকশন মারো।কে দেখছে গোলাপ বিশুদ্ধ কিনা?স্বতন্ত্র কিনা?আমরা তো সুন্দরের পূজারী।বেশি দাম দিয়ে সবচেয়ে লাল গোলাপটি কিনতে চাই।
কেমন যেন সুন্দর গুলোও ব্যবসা হচ্ছে নিয়ত।কাকাতুয়াকে নিজস্ব আওয়াজ ভুলিয়ে শেখানো হচ্ছে রামকৃষ্ণের বাণী।পাখির পালক গুলোও চাহিদার স্বীকার হচ্ছে।ভুল করেও গোলাপ বাগানে শিশির পড়বেনা।এর পর ঠিক হবে শিশির মুক্তোর মত জমবে না প্লাটিনামের মত??
আর ভাল লাগছেনা এই কাজ।যেখানে শান্তির চেয়ে নিয়মের প্রাধান্য বেশি সেখানে আমার মত বৃদ্ধ পাঁজরের প্রেম খোঁজা প্লাটিনামের শিশির স্পর্শের সামিল।এর থেকে পাতি কাক ঢের বেশি স্বাধীন।ওদের পালক গুলো ঝোড়ো হাওয়ায় ইচ্ছে মত উড়তে পারে।ভিজতে পারে প্রথম বৃষ্টিতে।শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের কোণ থেকে খাবারও খুঁটে নিতে পারে অবলীলায়।ভাগ্যিস ওরা রঙিন নয়??ভাগ্যিস আমি সুন্দরী যুবতী নয়!!
আজ কাল ভোর বেলায় দেওয়ালের দিকে এক মনে চেয়ে থাকি।মাকড়সা গুলো কেমন সারিবদ্ধ সুন্দর।ওদের ছোট্ট কালো শরীর আর আটটা পা গভীর রাতে কালপুরুষের তারার মত লাগে।টিকটিকি গুলো যেন ধূমকেতু।বদ্ধ ছাদটা আকাশ।কালো কালো ঝুল গুনো ছায়াপথ থেকে নীহারিকার আমোদ রচনা করে চলে অবিরাম।পৃথিবী থেকে এক ছুট্টে মহাকাশে পারি।
পরপর দুটো সেরিব্রাল অ্যাটাকে ডানদিকটা প্যারালাইজড।মাস-খানেক হল বিছানাতেই শুয়ে।আশ্রমের কৃপায় ফ্রি-তে চিকিত্সা চলছে।তবু ভাল লাগছেনা একটুও।এখানকার দেওয়ালে টিকটিকিরা দৌড়ে বেড়ায় না।মাকড়সা জাল পাতে না।কেমন যেন ব্যবসায়িক ন্যাকা ন্যাকা সৌন্দর্যতা ছিটিয়ে আছে রক্ত আমাশার মত।আমায় আকাশ দেখতে হবেই।ভোরের আগেই কালপুরুষ দেখতে হবে।ছায়াপথেরা নীহারিকার বুকে ঘুরবে স্বাধীন ভাবে।পৃথিবী থাকুক তাদের প্লাটিনামই শিশির নিয়ে।
অনেক কষ্টে টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে টেনে আনলাম দশতলার ছাদে।কাছাকাছিই ছিলাম।শুধু দরজাটাই খুলতে একটু কষ্ট হয়েছে।
আহা এ কষ্ট সার্থক।প্রাণ খুলে আকাশ তো দেখছি।সত্যি কারের তারা দেখছি।এক ফালি চাঁদ ও ভয়ঙ্কর কাস্তে!!আশ্চর্য!নীহারিকা কোথায়??? আর ছায়াপথ??
ও-ইতো মাটির কাছাকাছি অন্ধকার।ওখানেই সত্যিকারের মহাকাশ আছে।সত্যি কারের ভালোবাসা আছে। এবার শরীরটাকে কাছে আনতে হবে।কিনারায় রাখতে হবে।অবশেষ শক্তিটুকু পাঁজরে সঞ্চিত।অন্তত দশতলার কিনারা থেকে গভীর ছায়াপথে ছুঁড়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন