সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

কল্পনা দাস


‘বাংলা গানে - নারী’


“ আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয় ভাঙা এই নায়ে।

'মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে .”............।।

রবীন্দ্রনাথের এই গানটি কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্রকে ভীষণ ভাবেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তিনি একজন পরিপূর্ণ শিল্পী। বাংলা গানের গায়নের ইতিহাসে নারীরা আজ সমাদৃত, শুধু তাই নয় ভাবতে ভাল লাগে সাদরে গৃহীত। মহিলা শিল্পীদের স্বাধিকার বোধ সমাজে বেশ ভালভাবেই স্বীকৃত, মাথা তুলেছেন নারী তাঁর গানের দাপটে। নির্ভয়ে নিজেই অর্জন করেছেন,আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার।

সংগীত বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সংগীত এনে দেয়ে মুক্তি-র স্বাদ। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মোহর কনিকা তাই গাইলেন, “আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো”...শুনে মুগ্ধ হতে হয়। সম্প্রতি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মায়া সেন কে হারালাম, সঙ্গে একটা যুগকে । প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, আমার বন্ধু অপালা সেন মায়াদির প্রিয় ছাত্রী। “ অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রান”—এই গান আমার বন্ধুর গলায়ে শুনি আর গর্ব বোধ করি। প্রশ্ন জাগে মনে, কবিকে তাই জিজ্ঞেস করি, কে দেবে আলো, কে দেবে প্রান? মায়াদির আরও একজন সুযোগ্যা শিষ্যা স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত। তাঁর কণ্ঠে “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো”---এই গানের গায়কিই বলে দেয় এই তমসাবৃত আকাশ, ব্যপ্ত চরাচর, আসন্ন সংশয়, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কে আর আমাদের ত্রাণ করবেন?

শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানেই নয়, নানা বর্ণের গানে মাহিলা শিল্পীদের মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত , নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা(Calcutta Youth Choir), আরও অনেকে শিল্পী যাঁদের স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ এক স্বর্ণ যুগের সৃষ্টি করেছিল। বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা। ওপার বাংলার শিল্পী ফিরোজা বেগমের নাম উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই, অনবদ্য তাঁর নজরুল গীতি পরিবেশনা। দরদী , মরমী কণ্ঠ। রেজয়ানা চৌধুরী বন্যা আর একজন বাংলাদেশের শিল্পী। অসাধারন তাঁর গানের গলা, রবীন্দ্র সংগীত যার রক্তে। বন্যাদিকে আমি শন্তিনিকেতনে পেয়েছি। এই সব শিল্পীদের প্রতিষ্ঠা প্রগতি পন্থার চেহারা ও চরিত্র প্রকাশ পায়, নতজানু আমরা।


বহু নারী কণ্ঠ আছে, সব উল্লেখ করা সম্ভবপর হলো না। এতদসত্ত্বেও কিছু কথা বলতে চাই। যাঁদের কথা বললাম তাঁরা সবাই পুরুষের লেখায়ে নিজের কথা ব্যক্ত করেছেন। একজন নারীর নিজের কলমের গানের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছি । নারী কণ্ঠের সংলাপ, তাঁর নিজস্ব ভাবনা, যে লিখবে তার নিজের কথা। ব্যক্ত করবে তার অনুভব। আনেক নারী কবির কথা জানি, যাদের নিজস্ব স্বর আছে, কথা আছে। জানি শাঁওলী মিত্রর “নাথবতী অনাথবৎ”, ঊষা গাঙ্গুলীর নাট্যদল, সোহাগ সেনের নাট্যদল , সীমা মুখোপাধ্যায়ের নাট্যদল, অপর্না সেন পরিচালিত চলচ্চিত্র, ক্রীড়াজগতে জোতির্ময়ী শিকদার, ঝুলন গোস্বামী, দোলা গাঙ্গুলী, আরও অনেকের কথা জানি। হ্যাঁ নিজের কথা, নিজের সুর নিয়ে আত্ম প্রকাশ করলেন মৌসুমি ভৌমিক, স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত।এরা সুর দিয়ে গান গাইতে স্বক্ষম, নিজস্ব স্টাইলে। তবে মৌসুমীর বিখ্যাত গান “ শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউ-এ চেপে নীল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ”...... মন ছুঁয়ে যায়, নতুন করে ভাবতে শেখায়ে জীবনের কথা।


বাংলা গানের জগতে নারীদের এগিয়ে চলা , আমরা তাতে গর্ব বোধ করি। আর কয়েকজনের জন্য গর্ব বোধ করি , তাঁরা হলেন--হৈমন্তী শুক্লা, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় , ইন্দ্রানী সেন, শ্রাবণী সেন, রমা মণ্ডল (তিনি অকালে চলে গেলেন), শম্পা কুণ্ডু, শুভমিতা, নীপবিথি ঘোষ, অনুসূয়া চৌধুরী, লোপামুদ্রা মিত্র। এদের গলার স্বর, পরিবেশনায় প্রকাশ পায় আত্মপ্রত্যয়। লোপামুদ্রা-র গাওয়া জনপ্রিয় গানটিতে জয় গোস্বামী-র কবিতার বেনীমাধব দ্বারা প্রতারিত এক নারীর জবানিতে করুণ আত্মবেদনা ফুটে উঠেছে, “বেনীমাধব, বেনীমাধব, তোমার বাড়ি যাব, তুমি কি আর আমার কথা ভাব”............লোপামুদ্রা নয়, যেন গাইছে প্রবঞ্চিত আর্ত বহু নারী।


এখনকার গানে প্রকাশ পায় সমসাময়িক নারী কণ্ঠের বলিষ্ঠ বয়ান। বাংলা গান শোনার উৎসাহও যোগায়।


সেই গানে আছে স্বপ্রতিভ, প্রখর, শহর সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ, রোমান্টিকতার প্রকাশ। শিক্ষারুচি , মুল্যবোধ, মানবিকতা, যে গানের ভাষায় আছে প্রতিবাদ, মানবপ্রেম, দুর্গত বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের জন্য সহানুভূতি। আর আছে লড়াই সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান।।