সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

দীর্ঘ কবিতা 


পশ্চিমবঙ্গের কবি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত কিছুদিন হল লিখতে শুরু করেছেন । ইতোমধ্যেই বেশ কিছু নামী পত্র পত্রিকায় লিখেছেন । ক্ষেপচুরিয়াসের শুভাকাঙ্ক্ষী এই কবি স্বভাবে বিনয়ী , রাজ্য সরকারি কর্মচারী ।

মৎস্য কন্যা

১। ভেলায় ভাসছি

মিলিয়ে যায় দ্বীপ, বনরাজি সবুজ;
বাঁধন আলগা করছে প্রবল ঢেউ,
কাঠে কাঠে ঘষটানি-
মহাসাগরিক ওঠাপড়া তালে তালে;
মাস্তুল ভেঙে পালের কাপড় ভাসছে দূরে -
সর্বাঙ্গে ক্ষত দগদগে ঘা-
বড় একা অসহায় সমুদ্র ভ্রমণ,
বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে সী গাল,
প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে।

২। কতদিন এই ভাবে ভাসা,

তৃষ্ণা বড় তৃষ্ণা, ক্ষুধা-
মিঠে জল ভরপেট আহার,
চোখ বুজলে দেখি নারকেল সারি-
ফেলে আসা একান্ত আপন নিজস্ব দ্বীপ,
আগুনে ঝলসানো পশু।

৩। বালিয়াড়িতে পাথুরে গুহায়
সমুদ্র ড্রাগনের দীর্ঘশ্বাস ফিকে শোনায়,
আকাশে অপার্থিব সবুজ বন্য আলোর ছটা-
ঢেউয়ের তালে শুনি সমুদ্র অতলে উৎসারিত সঙ্গীত,
তুমি গভীরে জলকন্যা রত্ন সিংহাসনে কোঁকড়ানো সোনালী চুল
এক হাতে স্বর্ণ মুকুর, অন্য হাতে মুক্তোর চিরুনি,
সমুদ্র শুশুকেরা ঘিরেছে তোমায়,
দেখছে রূপ খোলা চোখে।
মৎস্যকন্যা!

৪। ভাসছি একা,ভাঙ্গা ভেলা।
জানি না কোথায় নিয়ে যাবে সমুদ্র ঢেউ,
এই আমার ঘরবাড়ি,
সাগরের নাম দিয়েছি স্বপ্নভঙ্গ
একা একা রাত ভাসা
তীরে ঘরবাড়ি সারি সারি
ঘুমোয় নাগরিক পৃথিবী,
আমি এভাবেও জীবিত
আশ্চর্য শুনছি নিজের হৃদয় স্পন্দন।


৫। কেশরাশি সোনালী জলপ্রপাত কন্যা সিংহাসনে,

শুশুকেরা বিদায় নেয়,ঘুম ভেঙে উঠেছে ড্রাগন-
ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় সর্পিল শরীর,
স্থির লাল দুটো চোখ রুবীর মত জ্বলে,
হিস হিস শব্দে চেরা জিভ ছুঁতে চায় তোমাকে,
মৃত্যুকে জয় করেছে যে শয়তান
সেও মরতে চায় তোমার প্রেমে,
আমি ভাসি জলে মৃতপ্রায়,
অথচ স্মৃতিতে কল্পনায় আমার জীয়ন কাঠি
ললনা মৎস্যকন্যা-এ এক বৈপরীত্য!
কাঁচ স্বচ্ছ প্রবাহিত জলে মৃগনাভি বিকশিত,
ফুটেছ সমুদ্র ফুল সুগন্ধি;
কোন এক চন্দ্র রাতে সাগরের অতলে
যদি নামে মেঘ সিঁড়ি,
আরোহণের মুহূর্তে বাজালে বাঁশি
চোখ মেলে দেখব উত্তরণ-
তাই এভাবে এখনো বেঁচে আছি।

একা সমুদ্রে ভেসে চলা,
জনারণ্যেও এভাবেই মানুষ ভাসে
একা পথ চলে,সঙ্গে হাঁটে ছায়া
এক ছন্দে চলা – কেউ বলে জীবন সঙ্গীত
সঙ্গত করে শুধু হৃদয় স্পন্দন।

৬। একদা গোধূলি দেখেছি আমি
নরম হাওয়ায় দোলে ঘাসবন,
একে একে থামে দিনের শব্দ;
কাঁধের জোয়াল নামিয়ে
পশুর সারি ফেরে ঘরে;
পাহাড় সারির গায়ে আবাসভূমি দোলে,
আকাশ কালো ঝোড়ো হাওয়ার তালে।

বন্য রাত, বন্য রাত তোমার সাথে
প্রবাহিত আমি এখন নিরুদ্দেশে,
এদিকে মনের মধ্যে জলকন্যা।

৭। কি যায় আসে বল
যদি ক্ষীণ সুতোর প্রান্তে জীবন মরণ
হাতছানি দেয় পালাক্রমে,
একাকী একটি জীবন কি অর্থ তার?
কোন কবির উপজীব্য হয় না কখনো
অর্থহীন জনৈকের বেঁচে থাকা, ভেসে থাকা,
কবরে লেখা হয় না মৃত্যুকালীন বিশেষণ,
হারিয়ে যাচ্ছি, যাবোই না হয়,
ক্ষতি কি,
গভীর গোপনে রয়েছ মৎস্য কন্যা,
অর্ধেক নারী আর বাকি কল্পনা।

৮।
শৈশবে শুনেছি উপাখ্যান
মীন কন্যার পথ শেষ হয় সমুদ্রতীরে,
জলের ভেতর অচেনা পৃথিবী,
নিঃশ্বাসে বিষ বাষ্প ড্রাগন, অমিত শক্তিধর
আঁধারের সন্তান, ভয়াবহ করাত সদৃশ দাঁত;
সে পার ভাঙা ঢেউ, তার নেই নির্দিষ্ট আকার -
মীন কন্যা বন্দিনী রাজকুমারী, বয়েস ফেলেনি ছাপ,
লয়হীন, ক্ষয়হীন, চিরযৌবনা মৎস্যকন্যা।
যুগযুগান্তর দয়িতের অপেক্ষায় কেটে যায়-
পাতাল কারাগার ভেঙে উদ্ধার করবে বীর,
এক পা রেকাবে অন্য পা মাটিতে
প্রবল বেগে ছুঁড়বে শব্দভেদী বান,
এফোঁড় ওফোঁড় ড্রাগন শরীর!
সমুদ্র অতল থেকে উঠে এসে প্রসারিত শালপ্রাংশু মহাভুজে
আত্ম সমর্পণ তোমার দেখব দু’চোখ ভরে।

৯। জলকন্যা, মনে রাজপুত্র তোমার প্রেম,
ভালবাসার জন্য সবকিছু ছাড়া যায়,
জলের বাইরে অন্য জীবন হাতছানি-
বিসর্জন দেবে তুমি
সাটিন কোমল পাখনা লেজ!
মানুষের রূপ ধরবে, গড়ে উঠবে ধীরে
অপুষ্ট নরম পঙ্গু দু’টি পা!

যদি কন্যা দেখ হীরে ফেলে ভুল তুলেছ কাঁচের টুকরো জীবন জুয়ায়,
তখন তো অর্থহীন সেই বেঁচে থাকা,
হতাশায় ক্লান্তিতে খুঁজবে নাকি মৃত্যুর দিশা?
অথচ আমাকে দেখ - সমুদ্রে ভাসছি-
ক্ষত বিক্ষত অঙ্গ, শত ফালি বস্ত্রাদি,
ভাঙা মাস্তুল, ছেঁড়া পাল----
তবু বেঁচে আছি
কারণ মনের মধ্যে তুমি
আর এভাবেও বেঁচে থাকা যায়।

১০।
তোমার কৌতূহল আর ভালবাসায় মৃত্যু হলাহল,
সন্ধে নামলে ক্রমশ তুমি সর্বত্র-
মোহনায়, উৎসমুখে পর্বতের কূটে, লোকালয়ে
সর্বত্র ছলাত ছল জল কেটে আনাগোনা
মনি খচিত চিরুনি দোলে অবিন্যস্ত চুলে,
সেই অদ্ভুত একটানা সুর লুলাবি মাতাল মাঝি মাল্লা নাবিক
ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমাকে ছুঁতে।
সন্ধ্যালোকে মৃদু বাতাসে নদীজলে কুলহীন অগন্তব্যে ভাসতে ভাসতে হাতড়ে বেড়ানো আশ্রয় চূড়ো অথবা খড়কুটো যতক্ষণ না উত্তাল ঢেউ
ডুবিয়ে দেয় শেষ আর্তনাদ,
শুনেছি এ উপাখ্যান
মীন বালিকার হাতছানির পরিণতি;
অথচ ভাসছি আমি একই ভাবে
কতদিন কত যুগ, এখনো জীবিত-
এ ভালবাসা নয়, তার বেশি অথবা অন্য কিছু।

১১। কন্যা আমি নিয়ত বদলে যাই
এই দরিয়া সময় হীন,
তুমিও অবয়বহীন,
তোমাকে খুঁজেছি জানাতে স্বতোৎসারিত অন্তর্কথন
জীবন মৃত্যু সূক্ষ্ম সুতোর দোলায় এ সময়ে
মিথ্যে ভাষণ প্রশ্নাতীত,
সময় সব বাধা দূর করে দেয়
অজস্র খণ্ডে ভেঙ্গে যাচ্ছি কন্যা,
আমি কি একই আছি না জলে ভাসে
আমার নকল দেহ!
তবু বেঁচে থাকি,
সমুদ্রে সাঁতারে তোমাকে খুঁজি না,
অজান্তে তোমার আলিঙ্গনে নিমজ্জিত
মৃত নাবিকের শোভাযাত্রায়
আমাকে পাবে না,
যদিও জানি হয়ত এভাবেই হব শেষ
ভোরের বাতাসে সমুদ্র সুবাসে
ভাসবে আমার অবশেষ।

১২। একান্ত অবহেলায় যেদিন হব শেষ,
সেদিন কোন পতাকার অর্ধ নমন হবে না,
কোন বেহালায় অন্তিম সুর বাজবে না,
এমন কি সামুদ্রিক ঘোড়ার দলও
আমার ভেলার আশে পাশে মিছিল করে
ভাসবে না,
তুমিও কি এক হতাশা আমার মত-
একদিকে সামুদ্রিক ড্রাগন
তোমার চোখের পাতায় ঢালছে কালি,
অন্যদিকে উন্মাদ নাবিকবর্গের আত্মহনন
তোমাকে ঘিরে অথচ জনশ্রুতিতে
তুমি সুন্দরী নারী আপ্লুত প্রেমে
বর্জন করেছ পাখনা লেজ,
অশক্ত অপূর্ণ দু’টি পায়ে হাঁটছ সাগর বেলায়
প্রেমিকের আবির্ভাব লগ্নের শবরী প্রতীক্ষা-
অথচ এ প্রেমও পূর্ণতা পাবে না তোমার-
উপাখ্যান তাই বলে।

১৩। তুমি বন্যার কন্যা সবুজ আভা সোনালী চুলে
খোলা চুল, অবিন্যস্ত কেশরাজি,
অঙ্গে ফুল সাজ,
অপেক্ষায় আছ পাল তোলা সমুদ্র তরীর নাবিকের,
অসহায় আত্মসমর্পণের অথবা নির্বাসিত রাজপুত্র
তোমাকে উদ্ধার করবে- কিসের অপেক্ষা তোমার,
ক্রমাগত ভেসে আসে ড্রাগনের নিশ্বাস!
এও জানি তোমার উপাখ্যান কখনই ম্লান নয়
শতাব্দী পেরিয়ে যায় আরোপিত নতুন মাত্রায়
বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমা
সমৃদ্ধ হয় কবির কল্পনায়,
চন্দ্রাহত নাবিকের বিভ্রমে,
সমুদ্র তুরঙ্গম, শুশুক, প্রবালের দল
আনমনা হয়
দিক ভ্রষ্ট চোরা স্রোত উপসাগরের অতলে
প্রবল বিক্রমে বাজে সাবধানী ঘণ্টা,
আবেগের দোলায় দুলতে থাকে ভাসমান
সমুদ্র গাছ লতাপাতা,
আকাশে প্রবল বিক্রমে জলধারা ছুঁড়ে দেয় অতিকায় তিমি,
আমি ভাসমান শুনি আওয়াজ-
হয়ত আমার মত আরও কেউ শোনে তোমার আগমনী,
সমুদ্রতীরে তাই মানুষের আনাগোনা।