সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

সরদার মেরাজ


ছোটগল্প

শীত, ক্ষুধা, অত:পর…

 
আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। রাতেও বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। তার উপর শীত পড়েছে প্রচণ্ড আকারের। সন্ধ্যার আগেই লোকজনের চলা চলতি কমে গেছে। তাই হোটেলের ব্যবসায় আজ একদম মাইর খাওয়ার জোগাড়। গ্রামের মধ্যে, চৌরাস্তার মোড়ে, ভ্যানস্ট্যান্ডটির পাশের ছোট একটি হোটেল। হোটেলটির কোন নাম নেই। হোটেল চালক এবং মালিক একজনই। তার নাম আব্দুল। বয়স বিশ হবে। অবিবাহিত তরুণ।

রাত তখন ১০টা অথবা এরকম একটা সময়। আব্দুল হোটেলের ঝাঁপ নামিয়ে কেবল খেতে বসেছে। ছোট ঝাঁপটি খোলা রেখেছে। খাওয়া শেষে থাল ধোয়া পানি ফেলবার জন্য। বাইরে সজোরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি দেখে আব্দুলের মনে পড়ে গেল।

এইতো সেদিন। এমনই সময়। বৃষ্টি ঠেলে এল ঝড়। নাম দিয়েছে সিডর। পানি ফুলে উঠল পাঁচ-ছয় হাত। ভেসে গেল হাজার হাজার মানুষ, গরু, ছাগল, শস্যক্ষেত। গাছপালা উল্টে পাল্টে পড়ে থাকল। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল বিদ্যুতের তার। নেমে এল অভাব। বাসস্থানের অভাব, কাপড়ের অভাব, খাদ্যের অভাব, বিশুদ্ধ পানির অভাব, আরও কত কী যে! রোগে শোকে মানুষ দিশেহারা হয়ে থাকল। সরকার সাহায্য দিয়েছে। বিদেশ সরকারও দিয়েছে। তবে যে ক্ষতি হয়েছে তার কিছুই পূরণ হল না। এই গ্রামের ক্ষতি হয়েছে কিছু কম। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে এই ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণের গ্রামে। জীবিতজনই সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ভাবছিল আব্দুল। এমন সময় চোখের সামনে একজন বৃদ্ধাকে দেখে শিউরে ওঠে সে। মুখটি ধীরে ধীরে তার ঝাঁপের কাছে এসে দাঁড়ায়। “কেডা কেডা তুমি,এত রাত্তিরি এই ঝড় বাদলার মধ্যি?” ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে আব্দুল। বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে কী উত্তর দিল কিছুই বুঝতে পারল না সে। আবোল তাবোল মনে হল তার কাছে। আবার বলল, “কী চাও? যাও এহান দ্যা।” এবারও কোন উত্তর না পেয়ে সে বুড়ির আগাগোড়া একবার দেখে নিল। মেটে রঙের একটি কাপড় পরণে। ভিজে চুপচুপ। অনবরত কাঁপছে। যেন ব্যাটারি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি তখনও তার গায়ে টপটপ করে পড়ছে। আব্দুল তাকে ঝাঁপের নিচে এসে দাঁড়াতে বলল। বুড়ি গিয়ে দাঁড়াল। লাঠি ভর দিয়ে আছে সে। ভাতের থাল থেকে খাওয়ার হাত গুটিয়ে অন্য হাতে একটি গামছা বাড়িয়ে দিল আব্দুল। বুড়ি একহাতে লাঠি ভর অন্যহাতে গা গতর কিছু মুছে নিল। আব্দুল তাকে পাঁচ টাকা দিতে দিতে বলল, “এই নেও, এহন যাও।” বুড়ি টাকা নিল না। জিজ্ঞেস করল, “কী নেও?” বুড়ি মাথা নিচু করে থাকল। আব্দুল বুড়ির জন্য মায়া অনুভব করল। সেও ভীষণ গরীব এক ছেলে। বুড়ির মত গরীব। তবে এ মুহূর্তে বুড়ির চেয়ে ঢের ভাল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বুড়ি যদি পাগল হয়। পাগল হলে তাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না সে। সেবার এক পাগল তার হারিকেনের চিমনি ভেঙে ফেলেছিল। তবে একে দেখে পাগল মনে হয় না। “কী পাগল টাগল নিকি আবার?” বুড়ি এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। বোঝা গেল না বলছে সে। পাগল হলে হ্যাঁ না কিছুই বলত না। সম্ভবত হাসতো।

বুড়িকে ভিতরে আসতে দিল আব্দুল। টিনের চালে বৃষ্টির ছাট সাপের মত ছোবল মারছে। রাস্তাঘাটে কোন মানুষ জন নেই। সিডর ভয় ধরিয়ে দিয়েছে সবাইকে। মেঘ দেখলে ঝড় ভেবে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যায়।


গরম কাপড় কোথায় পায় ভাবছে আব্দুল। গরম কাপড় যা আছে তা হচ্ছে একটি জ্যাকেট। তাতো তার নিজের গায়ে ওম দিচ্ছে। এটা খুলে দিলে ঠাণ্ডায় জমে যাবে সে। হোটেল ঘরের কাঠের ফাঁক দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে ভিতরে। বুড়ি কাপছে কাঁদছে এবং আরও করুণ অবস্থা তার। তার একটি ছোট পুটলি ছিল। আব্দুল খুলে দেখল। একটি চাদর, একটি ব্লাউজ, একটি ছায়া, একটি মলম আর একটি পানের বাটা। কিছুই শুকনো নেই। শীত বাড়িয়ে দেবে, কমাবে না। মলম দিয়ে কী হয় কে জানে। মলম পার্টির লোক কি না ভাবল সে। একচোখে একটু মলম মাখিয়ে বুঝে নিল, অতি সাধারণ মানের মলম এটা। এর অন্য কোন ব্যবহার থেকে থাকবে।


আব্দুল একটি লুঙ্গি বুড়িকে পরার জন্য দিল। আজ গোসল করেনি সে। তাই শুকনো লুঙ্গিটা বুড়ি পেল। তা-না হলে এই বৃষ্টির দিনে ভিজে লুঙ্গিই পরতে হত তাকে।


বুড়ি ভিজে কাপড় ছেড়ে লুঙ্গিটা পরল। তার অবস্থা ভেবে আব্দুল তাকে গায়ের জ্যাকেট খুলে দিল। তাতেও বুড়ি আরাম পাচ্ছিল না। আব্দুল হারিকেনের পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। বুড়ি দুই হাত হারিকেনের চিমনিতে ঠেষে দিয়ে উষ্ণতা পেতে লাগল।


আব্দুল আবার খেতে শুরু করল।বুড়ি বলল, “ঝড়ে ছাওয়াল বউ নাতি পুতি হগ্গল ভাইস্যা গ্যাছে।” বলতে বলতে দাঁতে দাঁতে ঠোকর খেল সে। তার কাঁপা থামছে না। আরও বাড়ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব। আব্দুল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এহন থাউক, পরে কইও।” সে বুড়িকে একটি থালে ভাত ও মাছ বেড়ে দিল। এ মুহূর্তে বুড়ির শীত এবং ক্ষুধা আর কোন কিছুই না। মৃত্যুর কাহিনি শুনতে শুনতে আব্দুলের এখন বিরক্তি লাগে। আর কত!


মিনিটের মধ্যে বুড়ি তার থাল শেষ করে ফেলল। আরেক থাল বেড়ে দিল আব্দুল। নিমেষে বুড়ি তাও শেষ করে ফেলল। বুড়িকে এবার ডিসের সব ভাতগুলো বেড়ে দিল সে। তাতেও বুড়ির পেট ভরল না মনে হল। আব্দুল তার থালের সব ভাত বুড়ির পাতে তুলে দিল। বুড়ি তার দিকে চেয়ে নি:শ্বাস ছাড়ল, “বাঁইচা থাকো বাপু, আল্লায় য্যান্ তুমারে ম্যালা ধোন সম্পদ দ্যায়।” তার চোখে পানি এসে গেল। সে দিকে তাকিয়ে দেখল আব্দুল। মাথার চুল সব পেকে পাকা সনের মত হয়ে গেছে। বয়স ৭০-৮০′র কম হবে না। গায়ের চামড়া হাতির চামড়ার মত হয়ে গেছে। মুখে স্পষ্ট বলিরেখা। কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাকে ছাড়িয়ে গেল কেমন করে। যেখানে তার জোয়ান আত্নীয়েরা সব মরে গেল।


বুড়ির শোয়া নিয়ে ভাবছিল আব্দুল। কোথায় কেমন করে তাকে রাখবে সে। এত গরম কম্বল কৈ তার? সে ঝাঁপের বাইরে উঁকি মারল। কাউকে পেলে বুড়িকে তার সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে। কাউকে দেখতে পেল না। আবার ঘরের মধ্যে ফিরল। বুড়ি খাওয়া শেষ করেছে। পেট ভরেছে কি না জিজ্ঞেস করল সে। বুড়ি একদিকে মাথা নেড়ে বলল, হুঁ। পেট না ভরলেও আর কিছু করার ছিল না আব্দুলের। আর ভাত নেই তার।


ঘরে পাটাতন নেই। মাটির পোতা। পুব দিকটায় একটা চৌকি পাতানো। একজন আরামে ঘুমানো যায়। তবে ছোট আর একজন হলেও তাকে নিয়ে ঘুমানো যায়।


ঠাণ্ডা খাটালের উপর দুইটা ছালা পাশাপাশি রেখে বুড়িকে শুতে দিল আব্দুল। একটি কাথা তাকে গায়ে জড়ানোর জন্য দিল। কাথা এই একটিই আছে। চৌকির উপর শীতল পাটি তার উপর কাথা বিছিয়ে আরামে ঘুমিয়ে থাকে আব্দুল। কিন্তু আজ আর সে আরাম হবে না। বুড়িকে কাথাটি দিয়ে দিয়েছে। শীতল পাটিতে ঠাণ্ডা বোঝাই। শীতল পাটি নিচে ফেলে দিয়ে চৌকির ময়লার উপর শুয়ে পড়ল আব্দুল। একমাত্র লেপটি গায়ে জড়াল।


কিন্তু ঘুম আর এল না। বুড়ি প্রলাপ বকছে। লেপ ছেড়ে বের হল আব্দুল। ঘরের মধ্যে শীত ঢালা হয়েছে কয়েক টন। বৃদ্ধের মত সেও কাঁপছিল। মেজাজ তার খারাপ হচ্ছে। একেতো ব্যবসা হয়েছে মন্দা তার উপর এসে জুটেছে ঝামেলা। একটু ঘুমাবারও জো নেই। “কী অইছে এত চিল্লাছ ক্যা? শুতি পাত্তিছি ন্যা, আর এট্টুও চিল্ল্যাবা না, গাল ফাঁক করবা না। বাইরি থুইয়া আসপো কিন্তু।”


হঠাৎ করে বুড়ি একদম নীরব হয়ে গেল। বাইরের কথা চিন্তা করে সে হয়তো ভয় পেয়েছে। আব্দুল আবার লেপের মধ্যে ঢুকে গেল। আবারও তার ঘুম এল না। বুড়ি আবারও কী সব আজেবাজে বকছে। তবে আগের মত জোরে নয়। আব্দুল দাঁত কড়মড় করে উঠে এল। ভাবল ঘুমাতে হলে বুড়িকে বাইর করতেই হইবো। হেঁটে এসে বুড়ির হাত ধরল। এত ঠাণ্ডা মানুষের দেহ হয় কখনও সে চিন্তা করে নি। ঠাণ্ডা বরফের রডের মত তার হাত।


বুড়ির গায়ে লেপ নামিয়ে দিল আব্দুল। তাতেও কোন পরিবর্তন নেই। নিচের থেকে ঠাণ্ডা আসছে। কী করা যায়? বুড়িকে কোলে ধরে চৌকির উপর শুইয়ে দিল সে। বুড়ির অস্পষ্ট প্রলাপ তাতেও থেমে গেল না। চৌকির নিচে বুড়ির মাথার কাছে হারিকেনটা বাড়িয়ে দিল আব্দুল। বুড়ি চোখ মেলে তাকাল। ভয়ঙ্কর তার চাহনি। আব্দুল তার কপালে হাত দিল। আরও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে সে।


দরজা খুলে বাইরের দিকে তাকাল আব্দুল। ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি। কোন মানুষজন নেই।

বুড়ির কাছে এল সে। বরফ হয়ে যাচ্ছে বুড়ি। লেপের মধ্যে ঢুকে পড়ল আব্দুল। বুড়ির পায়ে পা দিয়ে, হাতে হাত দিয়ে মেসেজ করতে থাকল। বুড়ি তবু গরম হচ্ছে না। প্রলাপ বকা থামছে না তার। বুড়ির গায়ের জ্যাকেট খুলে তার কান ও মাথা ভাল করে মুড়িয়ে দিল। পরনের লুঙ্গিটাও খুলে নিয়ে তার এক পা ঢাকল এবং নিজের গায়ের গরম গেঞ্জিটা দিয়ে আরেক পা মোড়াল। বুড়িকে শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। “বুড়ি তোমার ঠাণ্ডা আমারে দিইয়া দেও, কোনোতা হবে না, আমার বয়স কুড়ি, আর তুমি বাঁইচ্যা যাও।”

তবু বুড়ির পরিবর্তন হচ্ছে না। নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে সে। তার প্রলাপ বকুনি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে জেগে উঠেছে আব্দুল। উত্তপ্ত কড়াইয়ের মত গরম হয়ে উঠেছে তার শরীর। এ গরম সে ছড়াতে চাইছে বুড়ির সারা গায়ে। যদিও তা অশীতিপর বৃদ্ধা। এতক্ষণে নিজের সতীত্ব হারিয়েছে আব্দুল। বুড়ি তাকে শক্ত করে চেপে ধরেছে। এত শক্ত যে দিশা ফিরে পেয়েছে সে। “বুড়ি!”বুড়ির প্রলাপ বকুনি বন্ধ হয়ে গেছে। রা-শব্দ নেই। শক্ত কাঠের মত হয়ে গেছে শরীর। কোন দিকে হেলে দোলে না। নি:শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তার। মরে গেছে সে। আব্দুল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে দিকে। এখন কী করার! ভয়ে কাঁপছিল সে। মাথায় কোন বুদ্ধি আসছিল না তার। হঠাৎ ভাবল। যা ভাবল তাই করল। বুড়ির শরীরে ভেজা কাপড়খান কোনমতে পেঁচিয়ে তার মৃত দেহটা নিয়ে মোল্লাদের কুটার পালার পাশে রেখে এল সে। হাতে পুটলিটা ধরিয়ে রাখল। বৃষ্টি পড়ছে ঝপঝপ করে। বাতাস হচ্ছে ঝড়ের মত।


দোকানে ফিরল আব্দুল। শরীর তার ধরে আসছে। দেখল, বুড়ির চাদরটি রুমের মধ্যে। তবু বাইরে বের হওয়ার সাহস হল না তার। ঘুমিয়ে পড়ল সে।


পরদিন ঘুম ভেঙে হোটেল খুলল আব্দুল। মিষ্টি রোদ উঠেছে। মোল্লাদের কুটার পালার পাশে ভীড়। ভীড় ঢেলে এগিয়ে গেল সে। জনৈক বৃদ্ধ মহিলা মরে পড়ে রয়েছে। কেউ তার খোঁজ জানে না।

বুড়িকে এলাকার গোরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হল। আব্দুল তার কাফনের কাপড় কিনে দিয়েছে। আতর লোবান ছিটিয়ে দিয়েছে।