সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

ঋষি সৌরক


অনুপমের হাইওয়ের চতুর্দিকের অনিশ্চয়তা লিখলেন
ঋষি সৌরক

পোস্টমর্ডান কবিতাগুলি মর্ডান নয় - কারন তারা পোস্টমর্ডান (আসল কারণটা পরে বলছি...)। এবং এই পোস্টমর্ডার্ন ধারাটিকে কবিতার জগতে বিভিন্ন কবি এনেছেন বিভিন্ন ভাবে,আকৃতি-প্রকৃতিতে বিপ্লব তো সেই কবে থেকেই ঘটে আসছে,নতুনত্বের সন্ধান করতে করতে আজ নতুনত্ব যখন ফুরিয়ে যাওয়ার মুখে, কবি অনুপম এক বিরাট হাইওয়ে র পেটে ছেড়ে দিলেন একা বোকা।

খুব চেনা চেনা শব্দভাণ্ডার,এক-দুটি শব্দ ছাড়া সবগুলিই কুড়িয়ে পাবেন হাইওয়ের পাশে।এরপরও কিন্তু একটা 'কিন্তু' থেকেই যায় – “কারণ ছাড়াই মনের মতো হয়ে উঠছে পথ এবং পথ” । অদ্ভুত ফ্যাণ্টাসি- অচেনা পথে ছড়িয়ে আছে চেনা ছাপ, অথচ লিঙ্ক খুঁজতে যাওয়া মূর্খামো,কিছুটা মিল...কিছুটা অমিল...অমিল..অমিল...মিল...যুক্তিবাদীরা দূরে থাকুন-চুপ করে দেখুন কবি অনুপম হাতে যাদুদণ্ড- আকাশজোড়া ক্যানভাস-'পর্দাতুলে রোদ আসছে /বিছানায় সাঁতার শেখার দাগ'- 'ঘসেটি বেগমের মাথার ওপর সাতটা সবুজ টিয়া -এইমাত্র উড়ে গেল'-কবি বললেন,'পুরো ছবিটাই একটানে এঁকে ফেলতে চাইছি'।একটানে আঁকা ছবিটি রেখায় রেখায় জোড়ে না; অসীমের দিকে সমাপ্তি নেয়। বিমূর্ততা এক অন্য জিনিস,তারও মূর্তরূপ আমরা দেখেছি,কবি অনুপম দেখালেন সহস্র বিচ্ছিন্ন ভাবনার সমায়ন, যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাবনাগুলিও শার্পলি পয়েণ্টেড হয়েছে,আবার গুরুগম্ভীর চিন্তার ক্যাসুয়াল এণ্ডিং ও দেখানো

এভাবেই কবি অবিরত আপডেট এবং বিনোদন ঘটিয়েছেন দৃশ্যবদলের,ধ্রুবর কন্সেপ্টে বিশ্বাস নেই তার,তিনি সমস্ত কিছুর সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি কে ছুঁতে, চান,একটা জিনিস কে সেই জিনিসটার মত করে একবারই পেতে । অনুপমের কবিতায় ভাবনাগুলিকে মার্জ করানোর অহেতুক প্রচেষ্টা নেই,বরং ছবিতে রঙ ছেড়ে উনি খেলা দেখেন,রঙ্গের খেলা অথচ পরিমিতি বোধ তার সুদক্ষ শিল্পীর মতোই সদা তৎপর । ওই যে বিমূর্ততার কথা একটু আগেই বললাম,অনুপমের ছবিতে কোনো রেখা নেই,তাহলে? আছে এলোমেলো নানা ব্যাসার্ধের বিন্দু -অস্থিরতম বিন্দু,অনুপমের কবিতাকে ছেয়ে রেখেছে তারা অবিরাম অনিশ্চয়তায় ,গতিপথের আকস্মিক বাঁকে -অজানা সাসপেন্স ও রোমাঞ্চে - “মেঘ ছাড়াই সরে যাচ্ছে পাথরের দিকে।ঠোঁট ছাড়াই ডুবে যাচ্ছে জলের গেলাস।যে দেওয়ালে বারণ নেই - বিজ্ঞাপন লিখছে না কেউ।খিঁচুড়ির হলুদটাই ভ্যান ঘগের হলুদ।নদীতে ভেসে যাচ্ছে নকল একটা নদী।দীঘিতে ডুবে আছে আসল একটা দীঘি” ।

'টুসকির দুঃখু' একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য খণ্ড,প্রথম কবিতাতেই টুসকির বর্ণনা কবি দিয়েছেন এভাবে “টুসকি এখানে ফুল তুলছে। সূর্য এখন ডুবছে /টুসকি যখন তুলতে যায় রোদ তখনই পড়ে । / আমার মেয়ে।ফুলে ফুলে মুছে দিচ্ছে / পারফিউমের নাম।গন্ধ হওয়ার দুঃখ।" অর্থাৎ প্রথম কবিতাতেই কবি আভাষ দিলেন,টুসকি তার মেয়ে...পরবর্তী কবিতাগুলিকে এক অদ্ভুত স্নেহে লালন করেছেন কবি,'টুসকি খেলার রাণী'-'টুসকির চোখ খুব বড়।আমার আকাশে ও /আকাশ দেখতে পায়'-'টুসকি হয়তো আমার কাছে নেই!' 'টুসকি আমার মেয়ে।/উত্তরের বাতাসে দক্ষিণের হাওয়ায়' কখনো 'রাস্তাতে ওই গড়িয়ে গেল টুসকির মার্বেল' কিম্বা 'দুধের গেলাস ছুঁড়ে ফেলে পালাচ্ছে টুসকি' ...টুসকির বাচ্পনা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কবিতায়।এখন কথা হল,টুসকি আদতে কতটা বাচ্চা ? এই টুসকি ই কিন্তু কবির সিজনগুলির এক-একটি রঙ -দিনের বিভিন্ন সময়ের বিভাজিত অবচেতন-কবির মনের অন্তরমহলে চলতে থাকা কয়েককোটি নিষ্পাপ অভিব্যক্তির নিপুণ কারুকাজ-কবির স্বাধীনচেতা কবিতা-টুসকি ! টুসকিকেও কবি নিজের মাধ্যমে জেনারালাইজ করে দিলেন অবশেষে এবং এখানেই টুসকি চরিত্রটি যেনো আরো ব্যাপ্তি পেলো,'টুসকির দুঃখু' গুলো চিরন্তন হয়ে রইলো ...'বাউল বদল' এবং 'অদৃশ্য পেয়ালা ও সিলভারলাইনস্ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন প্রিয় অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নামাংকন করেছেন দেবাশিস সরকার ... রঙ্গিন প্রচ্ছদে বইটির আভ্যন্তরীন সৌন্দর্য্যের সম্যক আভাস পাওয়া যায়,ছবিটিতে রয়েছে আধুনিক মনস্কতা এবং সুরিয়ালিস্টিক ছাপ,নামাংকনের ফন্টটি বেশ তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট,যা বইয়ের চরিত্রের সাথে সহজাত ভাবেই যায় ।

কাব্যগ্রন্থ - হাইওয়ে ▀ অনুপম মুখোপাধ্যায় ▀ নতুন কবিতা