সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

মেহেদী হাসান


ইসরাফিলের হজ্জ্ব যাত্রা


পিঠ বাঁকা করে সামনে সামান্য ঝুকে সামাদ। ইসরাফিলের কোমড়ে কষে গিট দেয়। শক্ত বিষ গিট। উহ্! শব্দ করে ককিয়ে উঠে ইসরাফিল।

পেটে স্থায়ী জমাট বাঁধা নাদুসনুদুস চর্বির উপর প্যান্টের ফিতার তীব্র চাপ। আকস্মিক চাপে ব্যথা। ব্যথায় শব্দটা আপনা আপনি তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে।

সাফল্যের খুঁশিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সামাদ। আগে ইসরাফিলের মুখে এমন ব্যথার শব্দ উচ্চারিত হলে রক্ষে ছিল না। কিন্তু আজ সব ব্যতিক্রম। সামাদ উল্টো বুক চেতিয়ে বলে, দুলাভাই অহন আর চিন্তা কইরেন না। ব্যবস্থা এক্কেবারে পাঁকা। খাটি জিনিস। আপনার মান ইজ্জত আটকাইয়া দিছি! কেউ আর নিতে পারবো না। হাঃ হাঃ ..কী বলেন? হাঃ হাঃ...। সামাদের মুখের হাসি অফুরন্ত।

ইসরাফিল কিছু বলে না। মনে মনে বিরক্ত হয়। এমনিতে কম কথার মানুষ। কিন্তু বিরক্ত হলে না ঝেড়ে থাকতে পারে না। তার ব্যবসায়িক বিশ্বাস রাগ, ক্ষোভ, বীর্য এবং টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখতে নেই। সঞ্চয়ে অপচয়! লগ্নি করতে হয়।

ইসরাফিল ব্যবসায়িক আদর্শের বাইরে। সামাদকে কিছু বলে না। সামনে তিন দিনের ‘ঐতিহাসিক’ অভিসার। বাকি দেড় কালের শেষ অভিসার! এমন আনন্দের মহাযজ্ঞে কাউকে গালি দিয়ে মন খারাপের মানে হয় না। আজকাল সামাদ না থাকলে ইসরাফিল এক ধরণের অচল। এটা দু’জনেরই জানা। কিন্তু সামাদের আচরণ কখনও সুযোগ সন্ধানী হয়নি।

ইসরাফিলের শরীরে সবুজ রঙের বেঢপ আকারের বাংলা হাফ প্যান্ট। নেতিয়ে পড়া পতাকার মতো ঝুলে আছে। খুব বেশী বেমানান। ততোধিক বেমানান ভুড়ির উপরে ফিতার গিট। তার কালো কুচকুচে উদোম গা। মনে হয় বিশ্বকাপে ক্যামেরুন দলের সেই রজার মিলার। তবে মধ্যপ্রদেশে ইসরাফিল মিলারের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। অতিমাত্রার উঁচু পেট ট্যাপা মাছের মতো ফুলে আছে।

মাত্র এক ঘন্টার নোটিশে কাপড় কিনে এই হাফ প্যান্ট এবং পরিধানের আয়োজন। রির্জাভ করা বাসে বসে সামাদই প্রস্তাব দেয়। অগত্যা ঘাটে না গিয়ে ফরিদপুর থেকে রাজবাড়ীর নিউ মার্কেট। ইসরাফিলের সঙ্গে জনা বিশেক মানুষ। সবাইকে ঠিক মানুষ বলা যাবে না। অধিকাংশ মাসল্ম্যান। দল বেঁধে দৌলতদিয়া যৌন পল্লীতে ইরাফিলের শেষ অভিসারের সহযাত্রী।

নাচ। নগ্ন নাচ! এ নগ্নতার মধ্যে যৌনতা বা অশ্লীলতা নেই ঠিক। কিন্তু উন্মাদীয় আনন্দ আছে। আহ্লাদী আমোদ। এ দৃশ্য দেখার জন্য সমবেতরা গত দু’দিন অপেক্ষা করেছে। দু’রাত কেটেছে হতাশায়। হতাশার পিঠ উল্টে গেলে আশা হীম সকালে সূর্যের মতো উঁকি দেয়। এ সব বুজরকী কথাবার্তা জেনেই যেন সবার অপেক্ষা। ইসরাফিল এখন উদোম শরীরে নাচছে। সাহস পাচ্ছে না কেউ কাছে ঘেষতে। এমনকি নাচ থামিয়ে প্যান্টটা পরিয়ে দিতেও! সেটা তার থেকে পাঁচ-ছয় হাত দূরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

চারদিকে হাসির রোল! হৈই হুল্লোড় শুনে যারা দূরে ছিল, ছুটে আসে। শিস্ দেয়। খিস্তি। খেউড়। চিৎকার। ঢোলের বাড়ি। নাচের সহযাত্রী। সব এক নিমিশে বেড়ে যায়। অনেক দিন পর ঘাটের এই পল্লী অন্য রকম আনন্দে খলখলিয়ে উঠে। মজা পুকুরের মাছ যেমন বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার নতুন জল গায়ে মাখে। আনন্দে খলবল করে। ঠিক তেমনি লাফালাফি। তেমনি আনন্দে যৌনপল্লী মেতে উঠে।

পৃথিবীর তাবৎ পুরুষের শরীরবৃত্তীয় কীটেরা কামড় দেয় এবং কামনার কামুকতা জেগে উঠে নগ্ননৃত্য দেখার। আজ ব্যতিক্রম! এখানে ইসরাফিল উলঙ্গ হয়ে নাচছে! দূর থেকে মনে হয় এক খণ্ড লম্বা কুঁচকুঁচে অথচ তৈলাক্ত মাংসপিন্ড দ্রুত হেলছে। হেলতে হেলতে দুলে উঠছে। নাচে লয় নেই। তাল আছে। মদের নেশায় তালে তাল মিলে বেতালও হচ্ছে না। তাল মিলছে ঢোলের বাড়ির ছন্দে। ছন্দ আসছে দর্শক সাড়ির আমুদে উল্লাস থেকে। উল্লাস মেখে দর্শকের সাড়িতে উপস্থিত নারী-পুরুষ; এমনকি মানুষও। সবাই এক কাতারে। কেউ এসেছে ইসরাফিলের নাচ দেখতে। কেউ আনন্দের সঙ্গী হতে। আর কেউ বা অন্যের আনন্দ দেখে দেখে নিজেকে বিলীন করতে।

আনন্দের জোয়ার আসে না কেবল সুমীর মা’র চোখে-মুখে। দূর থেকে সে আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করেছিল। আতঙ্ক বাস্তবে এসে অপেক্ষার যতি টানে। সামাদ হাসতে হাসতে আশ্বস্ত করেছিল, বুবু কইস্যা গিট দিছি। মুত আইলেও খুলতো না!

সুমীর মা সামাদের কথা বিশ্বাস করেছিল। আবার শঙ্কাও ছিল। যদি সত্যি সত্যি ‘সেই সময়’ প্যান্ট না খুলে! সব তো ভিজে যাবে! আবার নতুন বিপদ। পাড়ায় নতুন মস্করার উৎপত্তি! ইসরাফিল চলে যাবার পর কম হলেও সাতদিন সরার টিটকেরি সহ্য করতে হবে। ঝিনুকের মতো সয়ে যেতে হবে। সুমীর মা কাউকে কিছু বলতে পারবে না। যুতসই উত্তরও দিতে পারবে না। মনে মনে সবার কথা আবার মেনেও নিতে পারে না। তখন ভেতরে কষ্ট হবে। এত কষ্ট যা গুণে শেষ হয় না। যেমন আকাশের তারা গুণে শেষ করা যায় না। সে রকম। কষ্ট। অনেক কষ্ট।

ইসরাফিল তার বান্দা কাস্টমার। সুমী একমাত্র সন্তান। কাছের মানুষ বলতে কেবল এই দু’জন। বছর দু’য়েক হলো সুমী ‘সেফ হোম’এ থাকে। এই যৌনপল্লী থেকে আশ্রিত সব শিশুরা সেভ হোমে পড়ালেখা শিখছে। মানুষ হচ্ছে। পতিতা(!)’র মেয়ে হয়েও সুমী ভবিষ্যৎ যৌনকর্মী হবে না। একজন যৌনপল্লীর মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় স্বপ্নের আর কী হতে পারে? এমন আশার ঘরে-স্বপ্নের ঘরেও পিতার পরিচয় লাগে! আশ্রিত শিশুদের রেজিস্টারে নাম লিখতে হয়। সে নাম, নামের একক পরিচয় সন্তুষ্ট করতে পারে না ‘পঞ্চম প্রজন্ম’ নামের নতুন সভ্যতাকে! হোমে পিতার পরিচয় লাগে। ভর্ত্তি করাতে গিয়ে সুমীর মা চিৎকার করে বলতে চেয়েছিল, খানকীর মেয়ের আবার জন্ম কিসের? পরিচয় কিসের? পল্লীর সব মাইয়্যারা হলো এক একজন মা মেরী।

মিশনারীর লোকেরা একবার ছোট ছোট কিছু বই দিয়েছিল। সুমীর মা সেখানে ‘মা মেরী’কে আবিস্কার করে। কিন্তু সুমীর বাবার নাম কী? কে তার বাবা? জানে সুমীর মা। জানে আরও পল্লীর অনেকে। কিন্তু ভয়! পরিচয় দেবার অনুমতি কোথায়? রেজিস্টারের ঘর থাকে ফাঁকা। সুমীকে নিয়ে ফিরে আসেন একজন মেরীর মা।

ইসরাফিল কাস্টমার হয়ে আসার পর সুমীর মা অন্য কাউকে কোনোদিন নেয়নি। ইসরাফিল দেয়নি। কেউ সাহসও পায়নি সুমীর মার দিকে হাত বাড়াতে। বিনিময়ে লোকটা তার কোনো অভাব রাখেনি। আবার পল্লীর বাইরেও নিয়ে যায়নি। সুমীর মা বুঝতে পারে না কী করবে? ইসরাফিল ঘরে এলে ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে। লোকটা কোনো উত্তর দেয়নি। সকালে যাবার সময় সুমীর হাত ধরে সেভ হোমে নিয়ে যান। পূরণ করে দেয় রেজিস্টারের ঘর। বিনিময়ে ইসরাফিল পায় দেবতার ভালোবাসা।

মানুষটা পল্লীতে এলে অন্য ঘরেও যায়। করুক না যা ইচ্ছে। সব কিছু মেনে নেয় সুমীর মা। মানতে পারে না কেবল মদ এবং নাচের নেশায় পাওয়া উলঙ্গ নাচ। লোকটা নাচতে গেলেই লুঙ্গি ঝরে পড়ে। প্রাগৈতিহাসিক উলঙ্গ নেশার আনন্দ পায় ইসরাফিল। আর বাজে কথা শুনতে হয় সুমীর মায়ের। শেষ অভিসারের শেষ রাতের সুমীর মা দূর থেকে মনে মনে প্রার্থণা করে। লোকটা আরও মদ গিলুক। মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক। কিন্তু সে জানে আকাশে আলো ফোটা পর্যন্ত এ নাচ চলবে। নাচ শেষে এ পল্লী ঢলে পড়বে। লোকটাও চলে যাবে। নাকি আর আসেব না? কথাটা বিশ্বাস করে সে। আবার করে না। সামাদও তাই জানিয়েছে। সামাদের কথা মনে হতেই তার মনে একা একা রাগ হয়।

সামাদ আপন কেউ না। কিন্তু কেন জানি সামাদ ছেলেটা তারে বোনের মতো মনে করে। ইসরাফিল টাকা-পয়সা যা দেয় সব সামাদের হাত দিয়েই পাঠায়। দরকার হলে সে সামাদের কাছ থেকেও চেয়ে নেয়। সামাদের মতো তার একটা ভাই কেন থাকলো না? ভাই কি বোনকে এই নরকে রেখে দিত? সুমীর মায়ের বুক টনটন করে উঠে।

সামাদ একাই না। কম চেষ্টা করেনি ইসরাফিলের সাঙ্গপাঙ্গরা। সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। চ্যুতি-বিচ্যুতি মাথায় রেখে চেষ্টারও কোনো ত্রুটি ছিল না। অবশেষে শেষ রক্ষা হলো না! ঘটনাটি সামাদকে লজ্জ্বায় ফেলে। সালু কাপড়ের উপর ইসরাফিলের সবুজ প্যান্টের দিকে তাকায়। লালের মধ্যে এক খণ্ড সবুজাভাব। জাতীয় পতাকার উল্টোপিঠ! পতাকার উল্টো পিঠ বলতে কিছূ আছে কি? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে সামাদ।

সামাদের ইচ্ছেও হয় না প্যান্ট তুলে দুলাভাইয়ের হাতে দিতে। দিলেও লাভ হবে না। জানে তা। ফিতা নেই! সামাদ লাবুর কোমড়ের দিকে একবার তাকায়। রাগে গজ গজ করতে করতে সে বিভৎস নাচের রঙ্গিন চিৎকারের উল্লসিত মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসে। মঞ্চ বলতে দু’সারি বাঁশ দিয়ে ঘেরা চৌকোণা জায়গা। মাটিতে ত্রিপল। তার উপর মোটা সালু কাপড় বিছিয়ে ইসরাফিল এবং সাঙ্গদের যাবতীয় ফূর্তির ব্যবস্থা। বাঁশের ওপাশে সাজানো দশ/বারোটা জেরিকেনে ভর্তি বাংলা মদ। একজন সাবাইকে তা বিলিয়ে দিচ্ছে। বাঁশের ভেতরের দিকে টেবিলে সাজানো বিদেশী মদ। বাংলা মদ সমবেত দর্শকদের জন্য। ঘোষণা আছে তিন রাতের বাংলা মদ সবার জন্য এবং দলের সঙ্গীদের জন্য যত ইচ্ছে বিদেশী মদ ও যৌনকর্মী ফ্রি।

এবার আয়োজনটা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম হয়েছে ইসরাফিলের পোষাক আর টাকা ব্যায়ের উচ্ছৃঙ্খলতায়।

সপ্তাহ খানেক আগে সে বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে বলেছিল, বুঝলি খানকী পাড়ায় এবার শ্যাষবার যামু। যত ইচ্ছা খরচা করবি। অনেক দিন পাড়ার সব্বাই যেন আফসোস করে ইসরাফিল বাপের ব্যাটা কাসটোমার আছিল একখান। কথা বলেই ইসরাফিল হুত হুত হুত করে হাসে।

সামাদ এমন কুৎসিত ভঙ্গির হাসি আর কারও দেখেনি। ইসরাফিল এমন হুত হুত করে হাসলে মাংসল চেহারা হয় হায়নার মতো। চোখা। শব্দওটা যেন কেমন! হায়নার মতো কি? যদিও সামাদ কখনও হায়না’র হাসি শোনেনি। কোনো বইতে পড়েছিল হায়নার হাসি নাকি ভয়ঙ্কর! যাই হোক ইসরাফিলের ইচ্ছার কথা শুনে সামাদ অবাক এবং একই সঙ্গে উৎকণ্ঠিত। কোনো ব্যামো? খারাপ কিছু? দুলাভাইয়ের এমন কথা বিচলিত করে দেয় তাকে। সে ইসরাফিলের গদির উপর পাশে উঠে আসে এবং নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করে, বস্ এমন কথা কইলেন ক্যান?

ঠিক করছি হজ্জ্বে যামু। পাক-পবিত্র হইয়া আসুম। তারপর কমিশনার গিরিও ছাইড়া দিয়া ব্যবসা-পাতি নিয়া জীবন কাটামু। এক সঙ্গে ঠিক করছি তোরে একটা বিয়াও দিমু।
বিয়ের কথা শুনে সামাদ কেমন একটু আনমনা হয়। গদি থেকে নেমে বাইরে যেতে যেতে বলে, দুলাভাই আপনের মন আজও বুঝবার পারলাম না।

সামাদ আড়তের বাইরে আসে। সিগারেট জ্বালিয়ে নদীর দিকে জলের দিকে হাটতে থাকে। পদ্মা পাড়ের সি এন্ড বি ঘাটে ইসরাফিলের বেশ বড় আড়ত। এখানে ধান-চাল কিনে রাখে। ঢাকার পাইকারী বাজারে পাঠায়। পৌরসভার কমিশনার হবার পর দুলাভাইয়ের ব্যবসা যেন বিশাল থেকে বিশালতা ধারণ করে। বর্তমানে তার ট্রাকের সংখ্যা এক কুড়ি। আড়তের ব্যবসা ছাড়াও আছে ডেকোরেটর এবং জমি কেনার নেশা। দরিদ্র মাস্টারের ছেলে সে। একমাত্র বোনের বিয়ে দেয়ার পাঁচ বছর পর বাবা মারা যান। মা সেই ছোট বেলায়। বাবার মৃত্যুর পর দুলাভাইয়ের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। সে ইসরাফিলকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আশ্রয়দাতা এবং মাতৃসম বোনের স্বামী। এ সব কিছু জীবনের বৈচিত্র্য বলে সামাদ মেনে এবং মনেও নিয়েছে। উপরন্তু সামাদের উপর ইসরাফিলের আকন্ঠ বিশ্বাস। সব কিছু মিলিয়ে বসবাসের একটা ক্ষেত্র এবং বলয়ও তৈরী হয়েছে। এ বলয় ভেঙ্গে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছে তার আর নেই। কিন্তু ‘বিয়ে’ শব্দটা সামাদকে নতুন দিনের হাতছানি দিয়ে ডাকে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আগামী নির্বাচনে কমিশনার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার।

সামাদ সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক মতো করলেও মাত্র ক্ষুদ্র একটা ভুল। গত দু’রাতে নাচের আসর থেকে ইসরাফিল যতবার বাথরুমে গেছে সঙ্গে সে ছিল। কাজ শেষে প্যান্টে শক্ত গিটও দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এবার কি মনে করে যেন লাবুকে পাঠায়। হারামজাদা এতই মাতাল দুলাভাইয়ের প্যান্টের ফিতা নিজের কোমড়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে!

রাত গভীর থেকে গভীর হতে থাকে। এক সময় গভীর তল স্পর্শ করে আবার উঠে আসতে থাকে। এ সময় একজনকে হাতের নাগালে পেয়ে ইসরাফিল মঞ্চে টেনে নেয়। চুমাচাট্টিও খায়। এমন ঘটনা দেখে অন্যান্য যৌনকর্মী-দর্শকেরা হুড়মুড় করে মঞ্চে ঢুকে পড়ে। মাতালদের উন্মাদীয় নৃত্যের তালে এবার যৌনকর্মীরাও অংশ নেয়।

সামাদ ভয় পায়! এখনই আবার ঘটবে কী নতুন কোনো কেলেংকারী? ধর্ষণ কিংবা কোনো নির্যাতন! তাকে বিস্মিত করে পুরো মঞ্চ যেন তালে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে। সমবেত নাচের তালে ঢেকে যায় ইসরাফিলের নগ্নতা। নগ্ন শরীর। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য সামাদের ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। জৈষ্ঠ্য মাসের অলস দুপুরের ধান ক্ষেত। সামাদ দেখতে পেত ক্ষেতের উপর দিয়ে বাতাস কেমন ঢেউ তুলে পুরো মাঠ দুলিয়ে দিত। ক্ষেতের দুলুনী দেখলে মন কেমন চঞ্চল হতো। ঠিক তেমনি এই যৌনপল্লীর উল্লাসিত মাতাল নারী-পুরুষ এবং মানুষেরা অজানা বাতাসের ছন্দে দুলছে। নাচের মঞ্চটাকে সামাদের মনে হয় জৈষ্ঠ্যের ধান ক্ষেতের মতো ঐশ্বরিক।
ভোরের আলো ফুটতে ইসরাফিল অন্য মানুষ। যেমন অন্য মানুষ হয়ে আড়তে বসে। সুমীর মা’র ঘরে যায়। কেউ নেই। বিছানার স্ট্যান্ডে ঝোলানো পাজামা-পাঞ্জাবী নিয়ে পড়তে যায়। এই প্রথম খেয়াল করে তার শরীরে শাড়ী পেচানো। সুমীর মায়ের। পোষাক পাল্টে ঘরের বাইরে আসে। সামাদ অপেক্ষা করছে। কী রে সবাই বাসে উঠছে তো?
সামাদ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শেষ সীমানায় আসতেই ইসরাফিল সুমীর মার মুখোমুখি। প্রত্যেকবার চলে যাবার সময় সে এ পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এবার আগেই এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরাফিল বলে, সুমীর মা আমার জন্য দোয়া করো। যেন বালা-মুসীবত কাটায় ফিরতে পারি। আর তোমার জন্য যা যা করা দরকার সব সামাদ করবো।
সুমীর মা কিছু বলে না। ইসরাফিল নিজের পথ ধরে। একটু এগিয়ে আবার ফিরে আসে এবং জিজ্ঞাসা করে, হজ্জ্বে যাইতাছি। বল, আল্লাহ’র ঘরে গিয়া তোমার জন্য কী চামু?
সুমীর মা যেন কিছু চিন্তা করে এবং বলে, আমার জন্য কিছু চাইতে হইব না। তয় আমার একটা কথা রাখবেন সুমীর বাপ?
ইসরাফিল সম্মতি দেয়।
বলেন রাখবেন? আবার প্রশ্ন করে সুমীর মা।
রাখবো। বলো তো। কিছুটা বিরক্তি।
আপনি হাজী হইয়া ফিরা আইবেন। আমার ভালা লাগতেছে। খুব ভালোলাগতাছে। তয় কথাটা হইল আপনি হাজী হইলে তো ফুর্তি করতে আর এই হানে আইবেন না। তয় একদিন আইবেন। আমি জানি। আইবেন এই পল্লী উঠাইয়া দিতে। আমার অনুরোধ সেই দলে আপনি থাইকেন না।