সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

সুবীর সরকার

 
এপিটাফ

১.
আমি আর জয়ন্তদা পেরিয়ে যাচ্ছি বাঁশের সাঁকো। জয়ন্তদা আমার বন্ধু। শীত আর বর্ষার বন্ধু। সাপের খোলস নিয়ে আমরা কথা বার্তা বলি মাঝে মাঝে। গাছপালা কমে যাচ্ছে পাখি কমে যাচ্ছে তাই জয়ন্তদার মাঝে মাঝে নৌকার মাঝি হতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা ... পরীদের সাথে কি মাঝিদের ডট কম-এ বাক্যালাপ চলে ? অথচ সেই নারীটির কথা বাকী জীবনআমার মনে থেকে যাবে। তার খয়ারী ঠোঁট।দু’চোখ হীরে বসানো। তার কাছে গেলে অনায়াসে খুলে যেত যাদুবিদ্যার গোপন ক্লাসরুম। কত রকমের সম্পর্ক। আর তার কিছু কিছু থেকে আমরা তো কষ্টই পাই। আকাশে খুব মেঘ করে এক একদিন বরফ পড়ে। আবার ঝলমলেরোদও ওঠে। আমার সামান্য কবিতাজীবন বরাবরই গাঢ়তম এক ছায়া খুঁজেছে । ছায়ানির্মাণের মধ্যেই তো থাকে যথার্থ বীজের হাতছানি। হাতছানি পাখীদের ঘুম ভাঙ্গায়। আবার ঘুম জুড়ে খেলাও তো করে লোক কথার বাদামী ঘোড়া। আমি কখনো যুদ্ধজাহাজ দেখি নি।ডুবোজাহাজ দেখিনি। যুদ্ধবিমানও না তবে হেলিকাপ্টার থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি রাজীব গান্ধীর হাসি মুখ দু’চারবার। কবিতা লিখে কি হয় ? লিখেই বা কি হয়! কেন নির্মাণবিশ্বে আমি একা নদীরতীরের বাতাস হই। মানুষ আর মানুষ। এই যে এত এত লোকায়ত মানুষ মাঠে মাঠে গ্রামীণ হাটে কুপির আলোয় একাধারে তাদের বিমর্ষ ও উজ্জল মুখচোখ; এত সব তো টেনে এনেছেন আমাকে কবিতার গূঢ়,জটিল কুহকের ভেতর। তাই রাতপাখি উড়ে গেলে আমার শব্দভ্রমন,অক্ষরযাপন, কবিতাযানে উধাও হওয়া। আমি আর জয়ন্তদা আপাতত পেরিয়ে যাচ্ছি নড়বরে বাঁশের সাঁকো ।

২ .
অন্ধকার রাতে লণ্ঠনের চোরা আলো হাতে আসগর আমাকে ওর ঘর সংসার দেখাচ্ছে। ওর নিত্যদিনের যাতায়াতের রাস্তাঘাট চেনাচ্ছে। আসগরদের গ্রাম। আবার নদীসংলগ্ন আসগরের বাড়ি। টেমির আলোর ভেতর গজ্ঞবাজার। আমি আর আসগর বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটি।আসগর আমাদের শহরে দিনমজুরের কাজ করে। আর টের পায় প্রতিদিন অল্প অল্প পালটে যাচ্ছে আমাদেও পৃথিবীটা। আসগর শুধু ভাবে। আলোচনা করে আসগরদের গ্রামের শেয়াল কমে যাচ্ছে। ঝোপঝাড় বাঁশবাগান কমে যাচ্ছে। আসগরের ছেলে মেয়েরা পড়তে বসে। ইস্কুলে যায়।আর গুটা রাত আসগরের গরু বাছুর ছাগল হাঁস পাহারা দেয় আসগরদেও পোষা কুকুর। আমি আর আসগর অঘ্রানের ধান মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটি কখনো। আসগর মনে করিয়ে দেয় এ সময় চারপাশটা একদম পিকচার পোষ্টকার্ডের মত। নদীর পাড়ে পাড়ে শূণ্যতা ভয়াবহ। বাতাশ অন্যরকম । এই নির্জনতা আর শূণ্যতাবাহী নদীঘেরা জনপদ থেকে উঠে আসে জাদুবিশ্বাস, সংস্কারগাথা। নদীর পাশে শ্যাওড়াগাছ,খয়ের কুল জঙ্গল। অবশ্যই বাঁশবাগান। এখানে ভুতপ্রেতেরা বসত করেন। বিচরণ করেন। মাঝে মাঝে নাকি গোল মিটিংও বসান। এইখানে তেনাদের অফুরান হাওয়াসাঁতার। আসগর আমাকে বলেছে অমাবস্যা কোন এক নিশিরাতে এলে আমাকে নাকি এসব দেখাবে। একজন মানুষই তো কয়েকশো জনকে টেনে আনে। ঘটনাকে চাপা দিয়ে সত্য হয়ে উঠে রটনা। আর আমি আসগরের হাত ধরে লোকজীবনের আলো অন্ধকারে গুড়ি মেরে ঢুকে পড়ি।

( ক্রমশঃ চলবে )