বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - রত্নদীপা দে ঘোষ

আঁকা আর দাদুর গল্প
রত্নদীপা দে ঘোষ



ব্রিজমোহন পাশ ফিরে শুলেন । পাশবালিশটা সরাতেই বুঝতে পারলেন যে আঁকার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আছে । মেয়েটা কিছুতেই গায়ে কিছু দেবে না, সারারাত লাথি দিয়ে দিয়ে চাদরটাকে পায়ের নীচে নামাবেই আর ব্রিজমোহন সেটাকে আবার নাতনির গায়ে টেনে টেনে ওপরে তুলবেন । সারারাত এই এক যুদ্ধ চলে দাদু নাতনির । এই সময়টা হাল্কা ঠান্ডা পড়ে উত্তরবঙ্গে, তাই দাদুকে আরও একটু বেশি সাবধানী তো হতেই হয় ।

আজকালকার বাবা মাকে একেবারেই বুঝতে পারেন না ব্রিজমোহন । পাঁচ বছরের বাচ্চাকে একলা শুতেই হবে নইলে নাকি তার বিকাশ বৃদ্ধি ঠিকঠাক হবে না । বাবান আর শ্রীকে অনেকবার বলেছেন কিন্তু কে শোনে কথা ; “তোমাদের যুগ আলাদা বাবা” , বাবানের গলায় ঔদ্ধত্য, আঁকাকে এখন থেকেই স্বাবলম্বী হতে হবে ; শ্রী হাসতে হাসতে বলেছে, এরপর যখন আঁকা কারসিয়াঙ্গের হোস্টেলে চলে যাবে তখন তো তার আপনার ছেলের মতো দশা হবে বাবা, হা হা হা, কী অবস্থা ! মাকে ছেড়ে শুতে পারে না বলে অনার্স পড়া ছেলের কী কান্না হস্টেলে ... হা হা !

কোনো অসতর্ক মুহূর্তে ব্রিজমোহনই এই গল্পটা করেছিলেন শ্রীকে, সম্ভবত বাবানের বিয়ের পর পর । শাশুড়িহীন সংসারে নতুন বউকে মেয়ে হিসেবেই গ্রহণ করেছেন তিনি । শ্রী তখন একুশ, কিশোরী বলা চলে তাকে । এখন সে আঠাশের পরিপূর্ণ যুবতী । সংসারে তার মতামতটাই প্রাধান্য পায় এখন বেশি...

আঁকা ঘুমের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো দাদুকে । মেয়েটা আসলে ভীতু প্রকৃতির আর খুব ছেলেমানুষ । একলা শুতে ভয় পায়, সব রাত্রিরেই নিজের ঘর আর বিছানা ছেড়ে চলে আসে দাদুর কাছে, আঁকড়ে ধরে ঘুমোয় । ব্রিজমোহন ঘুম থেকে ওঠেন ঠিক পাঁচটায় । বাথরুমের কাজ সেরে আঁকাকে ঘুম থেকে ওঠান । তারপর দুজনে মিলে বাগানের রঙ্গন গাছটির সাথে গল্প করেন । শ্রী যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন দাদুর চায়ের কাপ আর নাতনির দুধের কাপ শেষ । ব্রিজমোহন মাইক্রয়েভ চালানো শিখে নিয়েছেন বেশ কষ্ট করেই । এই বয়েসে নতুন কিছু শেখা যে কি কষ্টের ! তবু আঁকার জন্য সব সব কিছু করতে পারেন ব্রিজমোহন । দাদু নাতনির এই সময়টুকু একেবারে নিজস্ব, প্রতিমাকে খুব মনে পড়ে ব্রিজমোহনের, আহা ! নাতনিকে দেখতেই পেলেন না প্রতিমা ।

এরপরই বাড়িতে তুলকালাম শুরু । বাবানের অফিস, আঁকার স্কুল । ব্রিজমোহন আর নাগালটি পাবে না নাতনির । আটটায় বাস আসবে স্কুলের, স্কুল থেকে ফিরে হোমওয়ার্ক, নাচের ক্লাস । শুক্র শনিবার আধা ঘুমন্ত মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে শ্রী ছবি আঁকার স্কুলে । পাঁচ বছরের মেয়েটার কী টানাপোড়েন !

ব্রিজমোহন ছেলেকে বলতে চান, কেন রে এত চাপ দিস কেন মেয়েটাকে, আমরা কি তোকে এইভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছি, তুই কি মানুষ হোসনি ? তুই কি ক’রে খাচ্ছিস না ? বাবানের তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসিটা মনে পড়লেই মাথায় আগুন জ্বলে যায় ব্রিজমোহনের । শ্রী-ও তেমনি ! এতটুকু একটা দুধের বাচ্চাকে কীভাবে একজন মা কাছছাড়া করে শান্তিতে ঘুমোতে পারে বুঝে উঠতে পারেন না তিনি ।

মেয়েটা প্রথম একা শুলো পাঁচ বছরের জন্মদিনে । জন্মদিনের পার্টি শেষ হবার পর বারবার ছুটে আসছিল দাদুর কাছে, ও দাদু, মাকে বলো না, আমি একলা শুতে পারবো না, কিছুতেই পারবো না, আমার ভয় করে খুব, তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ, মা তোমার কথা ঠিক শুনবে । ব্রিজমোহন কিছুতেই নাতনিকে বোঝাতে পারেননি যে পাঁচের আঁকা আর পঁচাত্তরের ব্রিজমোহনের কোনো পার্থক্য নেই শ্রী আর বাবানের চোখে । একলা শোয়ার প্রথম রাতে ব্রিজমোহন সারারাত নাতনির মাথার কাছে বসেছিলেন । আঁকা ডান হাতটা ঢুকিয়ে রেখেছিল দাদুর পাঞ্জাবীর পকেটে । যেন হাত বের করলেই দাদু পালিয়ে যাবে ।

সেই থেকে এমনি চলছে । আঁকাকে কোনদিন একলা শুতে হয়নি । শুধু ব্যবস্থাটা একটু পালটে গেছে । এখন ব্রিজমোহনের ঘরে চলে আসে আঁকা । কী ভাগ্যিস, শ্রী আর বাবান ... কর্তা গিন্নী দুজনেই ঘুমকাতুরে । রাতের খাওয়া শেষ করেই ঘুমুতে চলে যায় দুজনেই । আর তক্কে তক্কে থাকে আঁকা ! দাদুর ইশারা পেলেই পালিয়ে আসে আঁকা । রূপকথার গল্প, ঠাকুরদার ঝুলি খুলে বসেন ব্রিজমোহন । আঁকার গায়ে পাতলা চাদর টেনে ব্রিজমোহন ভাবেন পুরনো দিনের কথা, প্রতিমার কথা ... আহা রে ! কী মেয়ের সখ ছিল প্রতিমার ; প্রতিমাকে নাতনির ভাগ দিতে সাধ জাগে ব্রিজমোহনের ...

পাঁচটা বাজেনি তবু আচমকা ঘুম ভেঙে গেল ব্রিজমোহনের। বুকে হাল্কা ব্যথা । পাশের টেবিলেই রাখা থাকে পলিক্রল । পকেট থেকে বের করলেন আঁকার ডান হাত, ব্রিজমোহন ঠিক করলেন বড় হলে বন্ধুদের সামনে আঁকাকে তিনি খ্যাপাবেন , জানো, তোমাদের আঁকা ছোটোবেলায় কি করতো ? দাদুর পাঞ্জাবীর পকেটে হাত রেখে ঘুমাত, পলিক্রল খেতে খেতে নিজের মনেই হাসলেন খানিক

না, বুকে অস্ত্বস্তিও হচ্ছে, একটু ঘাম ঘাম ভাব, একবার ভাবলেন, বাবানকে ডাকবেন । কিন্তু ডাকলেই বাবান আর শ্রী জানতে পেরে যাবে দাদু আর নাতনির কারচুপি । আঁকা কুঁকড়ে শুয়ে আছে, কি মনোরম এই ঘুমন্ত মুখ, রঙ্গন ফুলের সাথে কোনো পার্থক্য নেই যেন । ছেলে বউমার রাগী রাগী মুখটাও সাথে সাথে দেখতে পাচ্ছেন ব্রিজমোহন ... ধরা পড়লে দাদু নাতনির যে সাঙ্ঘাতিক শাস্তি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ...

ব্রিজমোহন নিজেকে শান্ত করলেন, না হার্ট অ্যাটাক নয়, এ গতরাতে ফুলকপির কোপ্তা খাওয়ার ফল নির্ঘাত ! না, লোভ টোভ এই বয়েসে কমানো দরকার অন্তত নাতনিটার মুখ চেয়ে ... গত সপ্তাহে প্রেসার সুগার সব চেক করা হয়েছে ... সব নর্মাল, ট্রাই - গ্লিসারাইড টা সামান্য বেশি ছিল শুধু ... না আর ভাবতে পারছেন না ব্রিজমোহন ... ঘুম থেকে উঠুক বাবানরা, একবার ডাক্তারকে খবর দিতে বলবেন ... আঁকার মাথাটা বালিশ থেকে নেমে গিয়েছিল, ব্রিজমোহন বুকের একদম কাছে টেনে নিলেন নাতনির মাথা ... আহা! এইবার ব্যথাটা কমছে যেন !

ঘুম থেকে উঠে শ্রী প্রথমে বারান্দায় আসে প্রতিদিন । এখানেই মেয়ের সাথে দিনের প্রথম দেখা হয় তার, দাদু নাতনির খুনসুটি ... পাশাপাশি দুটি কাপ, একটি চা অন্যটি দুধ ... আজ চেয়ার দুটি ফাঁকা ।

শ্রী ছুটে মেয়ের ঘরে যায়, বিছানা ফাঁকা মেয়ের । এর মধ্যে বাবান ও উঠে গেছে ... বাবা বাবা ... ডাকতে ডাকতে ব্রিজমোহনের ঘরের ভেজানো দরজা খুলছে বাবান ...

ব্রিজমোহনের ডান হাত টা অসহায়ভাবে ঝুলছে নীচে, শেষবার যেন মাটি স্পর্শ করতে চায়, নাক থেকে দু ফোঁটা রক্ত করুণ । দাদুর বুকের কাছটিতে লুটোপুটি ঘুম, দাদুর আদরের রঙ্গন ফুল, বাবান আর শ্রীর শিশুকন্যা আঁকা।

দাদুর পাঞ্জাবীর পকেটে ঢোকানো তার ডান হাত ।