অগ্নিসম্ভূতা
মুল অসমীয়া গল্পঃ গীতালি বরা
বাংলা রূপান্তর ঃ নন্দিতা ভট্টাচার্য
পার্থ ফিরে আসছে ...।
এই সংবাদ আমার জন্যে জীবনের সব আনন্দ ও ঐশ্বর্য – সম্পদ থেকেও বেশী । আঙুলের করে ক্ষণ গুনে গুনে , আকাশের তারা ও বৃক্ষপত্রে লিখে লিখে পার করেছি প্রতীক্ষার যে আকুল সময় , তা অচিরেই শেষ হবে ।
অপরাহ্ন শেষ হচ্ছে ।
পার্থকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্যে ব্যাপক আয়োজন চলছে ইন্দ্রপ্রস্থতে । মাটির প্রদীপ ও সুবর্নখচিত লন্ঠনে আলোকিত হয়ে উঠেছে রাজপ্রাসাদ --- যেন ইন্দ্রপুত্রকে স্বাগত জানানোর জন্যে সেজে উঠেছে স্বয়ং ইন্দ্রপুরী ।
গাছ-লতাপাতার বিনম্র সবুজ রং ময়ূরের মত পেখম ধরেছে । রং ও সৌরভ বিলিয়ে ঝিমিয়ে পড়া ফুলগুলো আবার সজীব হয়ে উঠেছে । বাতাসে ভেসে আসছে অগরু , চন্দন ও বিভিন্ন ফুলের মনমাতানো সুগন্ধ । পাখিদের সুললিত সঙ্গীত ও তপস্বীদের পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণে মায়ার আবেশ এনে দিয়েছে ইন্দ্রপ্রস্থতে । ইন্দ্রপ্রস্থকে এত সুন্দর , এত প্রাণবন্ত আমি আগে কখন দেখিনি ।
সমদ্রের তরঙ্গের মত হৃদয়ের আবেগের ঢেউ গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট চেষ্টা করছি আমি – ইন্দ্রপ্রস্থের রানী –পাঞ্চালী । কাকে কিভাবে বোঝাব --- চারজন রূপে-গুণে অতুলনীয় স্বামী থাকা স্বত্বেও পার্থর অভাব আমি তিলতিল করে অনুভব করেছি । ইন্দ্রপ্রস্থের বৈভব-ঐশ্বর্য পতিদের স্নেহ সাহচর্য ও কুন্তির মমতার ওমের মধ্যে থেকেও পার্থর অনুপস্থিতিতে নিজেকে নির্জন দ্বীপবাসিনী বলে মনে হত ।
আজও সেই অভিশপ্ত দিনটির কথা স্পষ্ট মনে আছে । জ্যেষ্ঠ পতি যুধিষ্ঠিরের শয়নকক্ষের সুবর্ন শয্যায় বসে মধুর আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে ছিলাম আমি ও যুধিষ্ঠির । পদ্মের মত কোমল আমার শ্যামবর্ন দুটি হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার রূপ , প্রজ্ঞা ও ধর্মীয় চেতনার প্রশংসা করছিলেন যুধিষ্ঠির ।
হঠাৎ ঝড়ের মত হুড়মুড় করে সে ঘরে ঢুকে পড়লেন পার্থ ও ঘরের এককোণে থাকা তীর-ধনুক নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ঝড়ের মতই । সেই মুহুর্তে বিব্রত হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার কথা মনেই আসেনি । কিন্তু দ্বিপ্রাহরিক সুর্যের মত গাম্ভীর্যে ঢেকে যাওয়া যুধিষ্ঠিরের মুখশ্রী আমাকে আমার বিয়ের বিশেষ শর্ত স্মরণ করিয়ে দিল আর আমি কেঁপে উঠলাম ।
পঞ্চপতির সঙ্গে আমার অসাধারণ (!) ঘরকন্নাকে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রন করার জন্যে আমরা সকলে আলোচনা করে একটি শর্ত রেখেছিলাম – যদি আমি একজন স্বামীর সঙ্গে শয়নকক্ষে থাকার সময় অন্য একজন স্বামী সেই শয়ঙ্কক্ষে ঢুকে পড়ে তাহলে তাকে বার বছরের জন্যে বনবাস যেতে হবে ।
সেদিন একেবারে নিরুপায় হয়েই শর্ত ভঙ্গ করতে হয়েছিল পার্থকে । আর তাই তাকে অরন্যযাত্রার প্রস্তুতি নিতে হল । যুধিষ্ঠির প্রিয় ভ্রাতার এই অপরাধ ক্ষমা করে তাকে নিরস্ত করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ধর্ম পালনের জন্য ইন্দ্রপুত্র অবিচল রইলেন ।
রাজবস্ত্র ও মুক্তাহার খুলে শ্বেতশুভ্র পুষ্পহার পরা অরন্যযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হওয়া প্রিয়তম স্বামীর দিকে তাকিয়ে আমারমন হাহাকার করে উঠল । ইন্দ্রপ্রস্থর রাজসুখ ছেড়ে পার্থর সহচারিণী হতে পারলে আমার প্রানের আরাম হত । সেটাই আমার কাম্য । মন থেক চাই । কিন্তু প্রানাধিক ভালবাসার লোক হলেও তার সঙ্গে বনে যাবার সৌভাগ্য আমার হবে না । কারণ ধর্ম রক্ষার জন্যে তাঁর চারজন অগ্রজ ও অনুজ দের ও আমি স্বামীরূপে বরণ করেছি ।
নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম --- আমি অগ্নিসম্ভুতা যাজ্ঞসেনী । আগুনের মধ্যে যার জন্ম । প্রিয় বিরহানলে কি করে সে নিঃশ্বেসিত হবে !
পার্থ বনে চলে গেছে । আমার জন্যে রেখে গেছে শূন্য ইন্দ্রপ্রস্থ । অনেক দিন আমার নিজেকে স্রোতহীন একটি ঝর্নার মত মনে হত । মা ও পতিদের প্রতি কর্তব্যে কোন অবহেলা যদিও আমি করিনি । ভেতরের শূন্যতাকে ছাইচাপা দিয়ে হাসিমুখে সকলেকে বোঝাতে হত আমি ভীষণ সুখি । তৃপ্ত । কাজটা কিন্তু অত সোজা ছিল না । পার্থবিহীন ইন্দ্রপ্রস্থ তরুহীন , ছায়াহীন রদ্দুরপোড়া আমার আত্মাকে দহন করে চলেছিল । শান্তির জন্যে সুর্য প্রণাম ও সান্ধ্য উপাসনাতে আমি সখিদের সঙ্গে নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে লাগলাম । কিন্তু পার্থ ছিল সন্ধ্যারতির সেই পবিত্র দীপশিখার মত – যে আমার স্তিমিত আত্মাকে আলো জ্বেলে রেখেছিল । তাই পার্থর অনুপস্থিতিতে আমার চোখের মনিতে অন্ধকার জাপটে ধরল । উধাও হল প্রজ্বলিত দীপশিখা ।
নীলপদ্মের মত আমার অগ্নিসম্ভুত শ্যাম শরীর আস্তে আস্তে শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছিল । ঝরে পড়া ফুলের মত ম্লান হয়ে আসছিল মুখশ্রী । স্বর্ণভূষণ ও সোনারূপো । মনিমুক্তা-খচিত বিলাস ব্যসন সাজ পোশাক প্রত আমি কেমন যেন উদাসীন হয়ে পড়ছিলাম । শৈলজ নদীর মত বয়ে যাওয়া আমার ঘনকৃষ্ণ কেশরাজি যত্ন করে রাখার কথা প্রায় ভুলে গেলাম । কার জন্যে এই রূপ ? আর্যাবর্তের সকলের মুখে মুখে চর্চিত হওয়া নিটোল আঁকা দেহ কার জন্যে ?
যুধিষ্ঠির ভেবেছিল – ধর্ম ও উপাসনায় আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছি । ভীম সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল পার্থর বিরহ আমাকে বিষণ্ণ ও উদাসীন করে তুলেছে তাই হাসিঠাট্টায় , আদর-যত্নে আমাকে ঘিরে রাখছিল ।
সান্ধ্য আরতি সমাপন করে প্রত্যেকদিন গোধুলি বেলায় প্রাসাদ উদ্যানের মাঝে থাকা সরোবর তীরে সখী নিতম্বিনীর সাথে হাঁটছিলাম আমি । সেই সময় কোন একজন স্বামীর সঙ্গে বাস করার সময় পার্থর কথা মন থেকে মুছে দিতে চাইছিলাম । উদ্যান ও সরোবরের স্বচ্ছতা দিয়ে আবিষ্ট কৌমুদিদল আমার মনকেও পবিত্র ও নিকা করে তুলছিল ।
ঠিক তখুনি খবর পেলাম – পাতালে নাগকন্যা উলুপীর পাণিগ্রহণ করেছেন ফাল্গুনী । শ্যামন্তক মনির মত উজ্জল ও আকর্ষণীয় উলুপীর সঙ্গে আমার প্রিয়তম স্বামীর বিবাহবার্তা আমাকে বিচলিত করে তুলল ।
মনের ভেতরের ঝড় ও অভিমানে কাতর হয়ে শয্যা নেয়ার সময়ও দেখলাম এ দুঃখ কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যায় না । বুকে পাথর রেখে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজরানীর ভুমিকা সুচারুরূপে পালনে আমি মননিবেশ করলাম ।
এরমধ্যে আবার দূত খবর আনল যে নবপরিণীতা উলুপীকে পাতালে রেখে কলিঙ্গের পথে রওয়ানা হয়েছেন পার্থ । কলিঙ্গ তীর্থভুমি বিভিন্ন দেবদেবীর লীলাভূমি হওয়ার সুবাদে সাধু তপস্বীদের প্রিয়স্থান ও অন্যদিকে কলা -সংস্কৃতি স্থাপত্য শিল্প আর ঐতিহ্যের দিক থেকেও কলিঙ্গ আর্যাবর্তের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ।
দূত বলেছিল , বেদাদি অধ্যয়ন ও জ্ঞান চর্চায় সম্পুর্ন রূপে মন নিবেশ করেছে পার্থ । আমার অভিমান সরে যাচ্ছিল । আসলে পার্থর প্রতি আমার প্রেম ছিল বিশাল নীল আকাশের মত , অভিমানের কাল মেঘ এর স্বচ্ছতা বেশীক্ষণ ঢেকে রাখতে পারবে না । পার্থর মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করছিলাম ।
...... কিছুদিন কেটে গেল । এবার স্বয়ং নারদ ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন অর্জুনের খবর নিয়ে । নারদকে নানা উপাচারে শ্রদ্ধায় সম্বর্ধনা জানানো হল । মা কুন্তি ও চার পাণ্ডব অতিথিশালায় দেবর্ষি কে ঘিরে ধরলেন । আমি দেবর্ষির আপ্যায়নের ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত ছিলাম । অতিথিশালায় ঢুকে মা এবং স্বামীদের উজ্জল মুখ দেখে ভাবলাম ঋষি নারদ হয়ত অর্জুনের কোন বীরত্বের কাহিনী শোনাচ্ছেন বা আগ্রহান্বিত হওয়ার মত কোন শুভ সংবাদ । ‘ পাঞ্চালী , ভবিষ্যতে যদি কোন ধর্মযুদ্ধ হয় , নাগলোক , কলিঙ্গ , ও আর্যাবর্তের উত্তর – পুর্বের পার্বত্য রাজ্য মণিপুরের সহায়তা পাব আমরা নিশ্চিত ।‘ উতফুল্ল হলেন ধর্মরাজ । আমারও আনন্দ হল । সবিশেষ জানবার জন্যে আমি দেবর্ষির কুশাসনের পাশে বসে পড়লাম । কিন্তু এ কেমন কথা ! কলিঙ্গের রাজনন্দিনী আর্যাকে বিয়ে করল পার্থ ! চোখের জল আটকাবার জন্যে মাথা নিচু করল করলাম । কিন্তু দেবর্ষি শোনালেন আর একটি হৃদয় বিদারক খবর । কলিঙ্গের পর উত্তর- পুর্বের দিকে রওয়ানা দিলেন অর্জুন – পাণিগ্রহণ করলেন মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার ।
হতাশ হয়ে বিষণ্ণ হওয়া রানীকে শোভা পায়না । তার ওপর আমার হৃদয় নিংড়ে নেয়া এই সংবাদ কিন্তু ইন্দ্রপ্রস্থে আনন্দের জোয়ার নিয়ে এসেছে । মনের কথা গুম করে রেখে আমি উল্লাস প্রকাশ করতে লাগলাম । নীরবে প্রার্থনা করলাম আমার মা যজ্ঞাগ্নিকে ---‘হে মাত । তোমা হতে উদ্ভুত যাজ্ঞসেনীর শরীরে ধারণ করা মাটির হৃদয়কে ঈর্ষা , ক্ষোভ ও বেদনার এই দহন সহ্য করার শক্তি দাও ‘। আনন্দ উৎসবের আয়োজন চলছিল প্রাসাদে । ধ্যান মগ্ন মুনির মত ইন্দ্রপ্রস্থের আকাশে ভেসে থাকা এক টুকরো মেঘের দিকে তাকিয়ে ভাবে এই মেঘের মত আমিও তো যখন তখন অশ্রু বর্ষন করতে পারি না । একটি নিস্তব্ধ সময়ের জন্যে আমায় অপেক্ষা করতে হবে – সে অবকাশ আমার দৈনন্দিন জীবনে কোথায় !
* * *
পার্থের জন্যে হাহাকার , গুমরে থাকা বিষাদ ও অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাস সাক্ষী --- দুস্বপ্নের মত কেটে গেল বারটা বছর ।
অবশেষে পার্থ ফিরে আসছে । দূত খবর দিয়েছে—উলুপি , আর্যা ও চিত্রাঙ্গদাকে নিজ নিজ রাজ্যে রেখে তিনি ফিরছেন ।
সুখ আর আনন্দে আমার মন থৈ পাচ্ছিল না । প্রিয় জনের জন্যে অপেক্ষা করে থাকা আর অন্তহীন নয় । এখন পার্থের জন্যে অপেক্ষা করবে শুধু পাঞ্চালী । আমি কি জানতাম না – যত সুন্দরি ই হোক নাগকন্যা উলুপি , কলিঙ্গের সেই সুলক্ষণা রাজনন্দিনী অথবা পর্বতকন্যা চিত্রাঙ্গদা ---পাঞ্চালীর কাছেই ফিরে আসতে হবে তাকে । আমি তো পঞ্চপতিকেই বরণ করেছি । কিন্তু আমি জানি আমার মনের ভেতর বাস করে কে ...আমার আত্মার গভীরে কার নামের অনুরণন হয় ...
তাহলে কেন পার্থের অন্যের প্রতি উথলে ওঠা সাময়িক মোহতে আমি দুঃখী হই , ঈর্ষা ও অভিমানে কাতর হয়ে পড়ি ।
আমার আত্ম উপলব্ধি হচ্ছে । আগুনে পোড়া সোনার মত শুদ্ধ ,পবিত্র উজ্জ্বল হয়েছ আমার হৃদয়... যে এখন সর্বান্তকরণে পার্থকে গ্রহন করার জন্যে প্রস্তুত ।
ইন্দ্রপ্রস্থ আনন্দে ঝলমল করছে । হবে নাই বা কেন ! থিক বার বছর পুর্ন করে নিজ রাজ্যে ফিরে আসছে আর্যাবর্তে শ্রেষ্ঠ বীর , শাস্ত্রজ্ঞ ধনঞ্জয় । গোলাপ , কদম ও পদ্ম বিছিয়ে দেয়া হয়েছে রাজপথে । নারীপুরুষ তাদের গৃহের দরজা আমের প্পল্লব দিয়ে সাজিয়েছে । মন্দিরে মঙ্গলধ্বনি বাজছে । যুবক-যুবতীরা সুন্দর পোশাক পরে গৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তাকে স্বাগত জানাবার জন্যে ।
আর আমি!!
অনেকদিন পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছি । কৃশ হয়ে যাওয়া এই শ্যাম দেহলতা , সান্ধ্য জোনাকির মত স্নিগ্ধ মুখমণ্ডলে যেন কোমল কান্তি ফিরে এসেছে । না মনের আনন্দ আমার রূপকে নীল পদ্মের মত উদ্ভাসিত করে তুলেছে ।
অর্জুনের প্রিয় পীতবস্ত্রে সখিরা আমাকে সাজিয়ে তুলেছে । মণিমুক্তা স্বর্নখচিত ভূষণ যেন সোনার মধ্যে আর একপ্রস্থ উজ্জ্বল প্রলেপ দিয়েছে । কাঁকালে কিঙ্কিণী ও পায়ে নূপুর পরেছি । বিরল সমুদ্র মাণিক আমার দীর্ঘ কেশকে সযত্ন বেষ্টন করে রেখেছে ।
যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে প্রাসাদকে নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে । বহুমূল্যের শ্বেত পাথরে নির্মিত বাসগৃহকে দূর থেকে শঙ্খ – মণির মত লাগছে । কারুকার্য খচিত সুবর্ণশয্যায় মধুচন্দ্রিমার রাতের মত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বহুরঙ্গের গোলাপ ও পদ্মফুল ।
নববধুর মত আমি লজ্জাবনতা । যুধিষ্ঠির নিশ্চয়ই আমার মনের আকুলতা আঁচ করেছেন । তাই এই আয়োজন ! আঃ কত উদার ধর্মরাজ !!
বাসগৃহ থেকে বাতাসে উড়ে আসা ফুলের নির্যাস বুকের ভেতর টেনে আমি সখীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে অপেক্ষারত – কখন উপস্থিত হবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ – কখন পার্থর সেই বুদ্ধিদীপ্ত , চুম্বকের মত মুখ আমি দেখব ।
-- ‘ কৃষ্ণা পার্থকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে তৈরি হও ।‘ মা আআর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন আরতির পবিত্র থালা । কিন্তু দুটো মালা কেন ! আমার ঠোঁটের কোনে হাসি এক পাক দিয়ে গেল । তারমানে অর্জুনের সঙ্গে আসছে যদুপতি কৃষ্ণও !
হাতে মুক্তোর মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি অর্জুনের সামনে । ... ওঁর শ্যাম কলেবর , পূর্ণচন্দ্রের মত মুখশ্রীর দিকে এখন আমি কি করে তাকাব ! এই আকুলতা , চাতক পাখির মত তৃষ্ণার্ত দুটি চোখকে কি করে সঁপে দেব ফাল্গুনির পদ্মের মত চোখে ! যদিও আমি স্থিতপ্রজ্ঞা , জ্ঞান-বিদ্যা ও অভিজ্ঞতা যদিও স্থিরতা এনে দিয়েছে আমার ব্যবহারে , ভয় হয় নাজানি প্রিয়তমের দীর্ঘ অদর্শন আমার চোখ না জলে ভাসিয়ে দেয় ... ভিজে যায় আখিপল্লব !
আঃ !কত প্রহর বাকি !সমুখে নিটোল রজনি—যা মাকে ওর কাছে নিয়ে যাবে । পার্থর প্রশস্ত বুকে মাথা গুঁজে গত হয়ে যাওয়া বারটা বছরের যাতনা চোখের জলে ভাসিয়ে দেব ।
মালা নিয়ে দু – হাত মেলে ধরেছি ---যেন কুমারি কন্যা প্রথমবারের মত –হ্যা এই প্রথম বার তার প্রয়তম পতিকে বরণ করছে ।
কিন্তু এ কে !একেবারে গা ঘেঁসে স্মিতহাস্যে স্বর্ণবর্ণী ত্বনী –ইন্দ্রপ্রস্থকে আলো করে রাখা সুবর্ণ লন্ঠনের জ্যোতিও ম্লান হয়ে গেছে ওর রূপের কাছে । উলুপি , আর্যা বা চিত্রাঙ্গদা তো ওঁর সঙ্গে আসার কথা ছিল না !
‘অ সুভদ্রা । শ্রীকৃষ্ণর ভগ্নী । অর্জুনের নবপরিণীতা ‘। কে বলল ? কে বলল এই কথা !
এক্তি উতফুল্লিত আর্য নগরী ও হর্ষোল্লাসে ফেটে পড়া প্রজাগণ কেউ জানতে পারল না কি ভাবে পঞ্চপতির পত্নী পাঞ্চালীর হৃদয় নিমেষে চুরমার হয়ে গেল ।
কিন্তু , আমি রাজমহিষী ! সাধারণ নারীর মত আমি বিচলিত হওয়ার অধিকার তো আমার নেই । একটি মৃতদেহ দুহাতে অর্জুন অ সুভদ্রাকে মঙ্গল মাল্য পরাল আর বলল –‘ ইন্দ্রপ্রস্থে স্বাগত ‘।
* * *
সুভদ্রা বিনয়ী , নম্র , সুলক্ষণা । অর চেহারা যেরকম সুন্দর । ততটাই সুন্দর ওর কথা ও ব্যবহার ।
‘ আমি আপনার দাসী ‘ বলে আমার পা স্পর্শ করল যাদব রাজকুমারী ---অকে আমি বোনের স্নেহে বুকে টেনে নিলাম ।
অপূর্ব সুস্মিত শরীর সৌষ্ঠব ও অপরূপ মুখশ্রীর এই ষোড়শীকে সতীন বলে ঈর্ষা করা যায় না ।
ঐ-- দূরে শঙ্খমনির মত পার্থর শয়নকক্ষ সুভদ্রার জন্যে অপেক্ষা করছে । একটু আগে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছিল পার্থ ।
‘ তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে না ?’ জিজ্ঞেস করেছিল সে ।
‘ ক্ষমা ? আর্য রাজকুমারদের বহুবিবাহ বিধিসম্মত । আপনি তো কোন অপরাধ করেন নি । ক্ষমার কথা এল কেন ? ‘ নির্লিপ্ত হয়ে বললাম ।
‘ তুমি অনন্যা কৃষ্ণা’। --পার্থ বলল ।
তাইতো , আমি অনন্যা । কারণ পাণ্ডবের মাতৃবাক্য পালনের জন্যে অনিচ্ছাসত্বেও আমি পঞ্চপতি বরণ করতে পারি । হৃদয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন দুঃখ , ক্ষোভ ও অভিমান স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করেছি – অন্তত বুকের ভেতর চুরচুর হয়ে গেলেও বাইরে সে থাকবে নিস্তরঙ্গ । তারমানে যে নারী ধর্মের নামে , পিতৃকুল ও শ্বশুরকুলের মঙ্গলের জন্যে সংসারের নীরব অনলে নিজেকে নৈবিদ্য করে উৎসর্গ করতে পারবে , সে অনন্যা !
অর্জুনের মুখে অপরাধিভাব ফুটে উঠছিল । তদুপরি একধরনের দীপ্তি , একধরনের মগ্নতা ছিল । ওঁর চোখে আমার জন্যে না ছিল আকুলতা না ছিল ভালবাসা । যা ছিল তা হল সমীহ ও কৃতজ্ঞতা । আমার মনে হচ্ছিল , সুভদ্রার কাঁচা সোনার মত উজ্জ্বল উপস্থিতির কাছে আমার অবস্থান দূরের তারার মত নিস্প্রভ ।
এইতো –আমার সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে সুভদ্রা । পার্থর নবপরিণীতা । পার্থ নিশ্চয়ই ফুলের শয্যায় বসে অপেক্ষা করছে সুভদ্রার জন্যে ।
যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত ,পুনরায় আমার চরণ স্পর্শ করছে সুভদ্রা ।
‘ সুখি হও বোন । সৌভাগ্যবতী হও । আমি অন্তর উজাড় করে সুভদ্রাকে আশির্বাদ করলাম ও অর্জুনের প্রাসাদের চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম ।
শুয়ে আছে ইন্দ্রপ্রস্থ । শয়নকক্ষের কাছে থাকা উদ্যানের নীল সরোবরের পারে বসে আমি জেগে রইলাম । গলানো রূপোর টুপটুপে জোছনায় ডূবে আছে সমস্ত রাতের নগরী । নীলাভ নীরে বিম্বিত হওয়া আমার শ্যাম শরীর যেন আমাকেই বিদ্রূপ করছে ।
তারমানে পুরুষের কাছে শুধু শরির ই সত্যি ১ বয়েস যাকে সহজে ক্ষয় করে , ভেঙ্গে চুরে ঝরঝরে করে ফেলে , অবিনশ্বর আত্মা থেকেও বেশী সত্যি বলে ধরা দেয় এই নশ্বর সৌন্দর্য !
... পার্থ আর কখন আমার জন্যে ব্যাকুল হবে না । , কখন শুনবে না আমার আত্মার আকুতি , হৃদয় উপচে থাকা প্রেম অ আনুগত্যের নীরব উচ্চারণ পার্থ কখনও উপলব্দি করতে পারবে না । অথচ এই পার্থের জন্য ই নীরব প্রার্থনা । গোপন অশ্রুপাত ।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছি আমি । চন্দ্রালোকিত এই রাত আমি আমার হৃদয় সম্পূর্ণভাবে উপড়ে ফেলে দেব -- যাতে সে আর কোনদিন কোন প্রত্যাশা না রাখে ।
( বানান অপরিবর্তীত রূপে রাখা হলো )
1 comments:
খুব ভাল লাগলো, বেশ। গীতালিকে শুভেচ্ছা, নন্দিতা'দি তোমাকেও।
লেখক এবং অনুবাদকের নামের রাইট অ্যালাইনমেন্টটি অ্যাডজাস্ট না হবার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। :)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন