শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৪

ব্যক্তিগত গদ্য – শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়




পাঠশালা

শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়


আমাদের বাড়ির পাঁচিলের গায়েই পড়ে-থাকা একটা বড়োসড়ো জমি। সেখানে আগাছার জঙ্গল, মানুষসমান ঝোপঝাড়, একটা ছাতিম আর কয়েকখানা নারকেল গাছ। এছাড়া বড়ো বড়ো কচুপাতা, বিষকাঁটালি আর কন্টিকারির ঝোপ। মাঝে মাঝেই দেখা যায় ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে হেঁটে চলেছে বেঁজিদের সারি। ওদের ওই তুর্‌তুর্‌ করে হেঁটে যাওয়া, সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকানো বেশ লাগে। চলে গেলে মনে হয় ওদের পেরিয়ে যাওয়া জায়গাটায় কিছুটা ধূসর-বাদামি ঔদাসিন্য পড়ে আছে। নিজেদের সামান্যটুকু নিয়েই যেন বড়ো ব্যস্ত রয়েছে ওই বেঁজির দল। পুঁচকে বেঁজিগুলো সাপের সঙ্গে লড়তে পারে, একথা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হত না। কিন্তু একদিন আমাদের বাড়ির পিছনের ওই বাগানেই একটা বেঁজিকে সাপ ধরতে দেখলাম। কালো-হলুদ একখানা সাপ। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। আমাদের পাঁচিল থেকে অল্প দূরেই মাটি থেকে কিছুটা ওপরে ফণা তুলে সাপটা কেবলই এগিয়ে যাচ্ছে বেঁজিটার দিকে, ছোবল দিচ্ছে, ফোঁস করে শব্দ হচ্ছে বেশ জোরে। অমনি বেঁজিটা ঘুরে যাচ্ছে কিছুটা, সাপের মাথার পিছন দিকে। মাথা ঘোরাতে কিছুটা সময় নিচ্ছে সাপটা, আর সেই সুযোগে মাথার পিছন থেকে তাকে কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে বেঁজি। যতটা সম্ভব দ্রুত ঘুরে পরের ছোবলটা মারতে মারতেই সাপটা দেখছে বেঁজি নেই। বেশ কিছুক্ষণ এমন দ্বৈরথের পর সাপটা একবার কেটে পড়ার চেষ্টা করল অন্তত আমি তাই ভাবলাম। হঠাৎ ফণাটা নামিয়ে দ্রুত ঢুকতে গেল কাছেই একটা ঝোপে। একটু দূর থেকে এই দেখে যেই না বেঁজিটা পেছন থেকে ওর লেজ কামড়ে ধরতে গেছে, অমনি সাপটা চকিতে ঘুরেই ফণা তুলে এক ছোবল! কি আশ্চর্য বেঁজিটা যেন বাতাসে শরীরখানা ভাসিয়ে টুক্‌ করে অল্প পিছিয়ে গেল। অসাফল্যে, রাগে সাপটার তখন সেকি গজরানি। তারপর আবার কিছুক্ষণ সেই উদ্যত ফণা, সেই আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা। খানিক পর দেখি বেঁজিটা গতি বাড়িয়ে বেশ দ্রুত ঘুরপাক খেতে লাগল সাপটার চারধারে। ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় কিছুটা অবসন্ন হয়ে পড়ল সাপ। তারপর হঠাৎ অলৌকিক ক্ষিপ্রতায় বেঁজিটা একদিক অর্ধেক পাক ঘুরেই দিক বদলে অন্যদিকে গিয়ে পিছন থেকে কামড়ে ধরল সাপের মাথা। শরীর মুচড়ে মুচড়ে সাপটার সে কি ছট্‌ফটানি। কিন্তু বেঁজির কোনো বিকার নেই। বেশ কিছুক্ষণ সাপটাকে কামড়ে ধরে শান্ত হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। তার গায়ে তখন লুটিয়ে পড়ছে গড়ানো-দুপুরের ম্লান রোদ্দুর, লতাপাতার আলোছায়া। আমার শৈশবের সামান্য চরাচরে সে তখন বিজয়ী এক বীর রাজা। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি তার দিকে। কষ্ট হচ্ছে, কেন ভাষা জানি না তার। কত কি জানার ছিল ওর থেকে! একসময় মুখে-ধরা শরীরটা নিথর হয়ে আসলে বেঁজিটা ধীরপায়ে ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেল। আমি বিস্ময়ে, উত্তেজনায় অপলক দেখেছিলাম এই লড়াই। প্রত্যেক মূহূর্তে কি আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা, কি অদ্ভুত সব কৌশলপ্রয়োগ। ছোট্ট ছোট্ট দুটি প্রাণীর যুদ্ধে যেন ঝলসে উঠছিল সময়ের একেক বিন্দু। বেঁজিটা চলে যেতে, নিহত সাপটার জন্য আমার মনখারাপ হল। চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলাম কুয়োতলায়। সামনের জঙ্গলবাগান আবার শান্ত, শব্দহীন, যেন কিছুই ঘটেনি। দুপুরের নিদ্রালস বাতাসে অল্প অল্প দোল খাচ্ছে লতাগুল্মের শুঁড়, হাওয়া খেলে যাচ্ছে নারকেল, ছাতিম গাছের পাতায় পাতায়। ফুড়ুক ফুড়ুক করে উড়ে উড়ে এগাছ ওগাছ করছে কিছু পাখি। আমাদের পেয়ারাগাছে ফল খেতে এসে বসছে ঘুঘুর দল। বিষণ্ণ শব্দ হাওয়ায় ভাসিয়ে ডাক পাঠাচ্ছে দূরবর্তী সঙ্গীদের। ওদের মধ্যেও কেউ কেউ নিশ্চয়ই দেখেছে এই মহারণ। কিন্তু আমিই বোধহয় একমাত্র প্রথমবার একটা জ্যান্ত লড়াই চাক্ষুষ করলাম। তাই এত আলোড়ন, রক্তের ভেতর এত অস্থিরতা। ভাবছি সাপটার পরিবারের কথা, অনাথ সন্তানসন্ততির কথা। কিন্তু যুদ্ধের তো কোনো নিজস্ব মন নেই। সে এক আকস্মিক আগুনের মতো; মূহূর্তের স্ফুলিঙ্গপ্রসূত। আর ওই গাছপালা, আহারসন্ধানী ওই পাখির দল, সমস্ত প্রাণীজগত এই পৃথিবীতে ওরা তো সকলেই আমার চেয়ে বড়ো; তাই বোঝে যুদ্ধের চেয়ে কাজ-করাই বড়ো। কাজ-করাই আনন্দ ও মুক্তি।