শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৪

ছোটগল্প – জয়াশীষ ঘোষ




              

বৃষ্টির গন্ধ

জয়াশীষ ঘোষ



()



পাড়াগাঁয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যে নামে। বাড়ির সামনের বুড়ো আমলকী গাছটায় পাখিগুলো রোজকার মতই ফিরে আসে। পাশে সবিতাদের বাড়িতে শাঁখ বাজার শব্দ শোনা যায়। নুসরত চৌকিতে শুয়ে ছটফট করে। তিনদিন হয়ে গেল জ্বর নামছে না।  আম্মি কেন কাছে নেই? অভিমান হয় খুব। জল পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ। মোমবাতির মরে যাওয়া আলোয় একরাশ ভয় চেপে ধরে তের বছরের রোগাভোগা মেয়েটাকে। গেল বছর সবিতার দিদিমা জ্বরে ভুগে মারা গেছিল। বুড়ি নুসরতকে খুব ভালবাসত। সবিতার মাকে লুকিয়ে কুলের আচার খাওয়াত। টেনে নিয়ে যাবে না তো বুড়ি? দুর্বল শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে কোনোমতে বাইরে নিয়ে আসে নুসরত। উবু হয়ে বসে নাসিমা পাটকাঠির উনুনে আপ্রাণ ফুঁ দিচ্ছে আঁচ বাড়ানোর জন্য। মেয়েকে সাবু জ্বাল দিয়ে খেতে দেবে। আগুনের লালচে আভায় আম্মির ফর্সা মুখটা আরও লাল দেখায়।   
-আম্মি, তেষ্টা লাগে। পানি দিবা একটু?
নুসরতের কাঁপা কাঁপা স্বরে আম্মি মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। ঝামর চুলের ফাঁকে মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। ডাগর চোখদুটো ছলছল করছে।
-বাইরে আসলি কেনে? দেখিস না কেমন হাওয়া দিচ্ছে? ঘরে যা।
-ঘরে ভয় লাগে, আম্মি। এখানে একটু বসি?
নুসরত বাঁশ ধরে দাওয়ার ওপর বসে পড়ে। নাসিমা উঠে এসে প্লাস্টিকের গ্লাসে করে জল দেয়। বিষতেতো মুখে জল রোচে না। একটু চুমুক দিয়েই রেখে দেয় নুসরত।
- আমি কি মরে যাবো? বল না আম্মি।
-যত সব অলুক্ষুনে কথা! মরবি কেনে? জ্বর হলে কেউ মরে?
-ঘুমের ভেতর সবিতার দিদা এসে ডাকে যে!
- ও তোর জ্বরের বিকার। পেট গরম হলে উলটাপালটা ভাবনা আসে। পেটে নারকেল তেল মালিশ করে দিব। দেখবি ভাল ঘুম আসবে।
-আম্মি, আব্বু কবে ফিরবে? আমার জন্য লাল রঙের লিপিস্টিক নিয়ে আসবে বলেছিল। ভুলে যাবে না তো? 
নাসিমা নিঃশ্বাস ফেলে। ঘরের মানুষটা যে কবে ফিরবে? নুসরতের আব্বু রশিদ মণ্ডল কলকাতায় কাজের খোঁজে গেছে মাস ছয়েক হল। আগে হুকুমপুরে রহিম মিয়াঁর ধানের গোলায় কাজ করত। রহিম মিয়াঁ মজুরী ঠিকঠাক দিত না। সেই নিয়ে একদিন বচসা হয়। মারামারির জেরে তিনদিন জেলে থাকার পর ছাড়া পায় রশিদ। কিন্তু কাজটা চলে যায়। মুর্শিদাবাদের গ্রাম গঞ্জ থেকে প্রচুর মানুষ দিন মজুরের কাজ করে শহরে। ভালই পয়সা মেলে। কলকাতায় যাওয়ার পর একটাই টেলিফোন এসেছিল সবিতাদের বাড়ি। তারপর থেকে আর খবর আসেনি। না কোন টেলিফোন, না কোন চিঠি।  
- আম্মি, আমি মরলে জন্নতে যাবো না জাহান্নামে?
নুসরত চিন্তায় পড়ে। জাহান্নামে নাকি বড় বড় তেলের কড়ায় জ্যান্ত মানুষ ভাজা হয়। আম্মি ঠোঁটে হাত চাপা দেয়আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়মেয়েটা খুব ভোগে।
-   আম্মি চলো না, মঞ্জু আপাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। যাবা?
নাসিমা মেয়ের দিকে তাকায়। রশিদ চলে যাওয়ার সময় নাসিমার হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে গেছিল। দিন কুড়ির মধ্যে সে টাকা শেষ হয়ে যায়। মঞ্জুদের বাড়ি কাজটা নিতে প্রথমে খুব শরম লেগেছিল। ভাল ঘরের মেয়ে, শেষে কিনা লোকের বাড়ি বাসন মাজবে? মঞ্জুর বাবার বড় পাইকারি দোকান আছে কান্দি বাজারে। মঞ্জু মেয়েটি বড় ভাল। ফরসা গোলপানা মুখটার দিকে তাকালে যেন প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। নুসরতকে খুব ভালবাসে। মাঝে মাঝে বাবা মাকে লুকিয়ে নিজের জামাকাপড়, বই, ইমিটেশনের হার, দুল  নাসিমার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয় নুসরতের জন্য। আজ মঞ্জুর জন্মদিন। 
-   তোর না শরীর খারাপ? যাবি কি করে?
-   ও কিছু হবে না আম্মি। আপাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। চলো না...
নাসিমা ইতস্তত বোধ করে। সকালবেলা মঞ্জু বারবার বলেছিল নুসরতকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসতে। মঞ্জুর জন্য হাতে করে কিছু একটা না নিয়ে যাওয়া যায় না। মাসের শেষ। ঘরে চাল, আলু ও বাড়ন্ত। এসময় উপহার কেনার পয়সা কোথায় পাবে? নাসিমা তাই ভেবেছিল একেবারে কাল সকালে গিয়ে মঞ্জুকে দেখেও আসবে আর নুসরতের জন্য বাসি খাবার যদি কিছু থাকে তা নিয়ে আসবে। নুসরতের রুগ্ন শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে মনের কথাটা বলতে পারে না নাসিমা।
-   দূর পাগলী! এতটা রাস্তা তুই হেঁটে যেতে পারবি নে।
-    পারব আম্মি। ঠিক পারব। মঞ্জুআপার জন্য আমি পাটের দড়ি দিয়ে একটা পুতুল বানিয়েছি। আপা খুব খুশী হবে ।
মেয়েটার চোখটা ঝলমল করে ওঠে। দুর্বল শরীরটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। দৌড়ে গিয়ে টিনের বাক্স থেকে লাল জরির সালোয়ার কামিজ বের করে। দু বছর আগে ঈদের সময় আব্বু যেটা কিনে দিয়েছিল। নাকের কাছে ধরে গন্ধ নেয় প্রাণ ভরে।
-   এটা পরব আম্মি?
মেয়ের আনন্দ দেখে চোখে জল আসে নাসিমার। সম্মতি জানায় ঘাড় নেড়ে। নুসরতের চুল বিনুনি দিয়ে বেঁধে কপালে একটা কাজলের টিপ এঁকে দেয়।
-   তাড়াতাড়ি কর আম্মি। তুমি কিন্তু আজকে ওই বেগুনী শাড়িটা পড়বে।
বিয়ের সময় নাসিমার আপা নাসিমাকে একটা সিল্কের শাড়ি দিয়েছিল। বিয়ের পরে প্রথমবার যখন আব্বাজানের বাড়ি যায়, ওই বেগুনী রঙের শাড়িটা পরেছিল। রশিদ তো তাকে চোখে হারাত! 
-   মাথা খারাপ নাকি তোর? বুড়ি মাগী আমি। ওই শাড়ি কি এখন আমারে মানায়?
আম্মিকে জড়িয়ে চুমু খায় নুসরত
-   কে বলল আমার আম্মি বুড়ি? চুলে ফিতা বাঁধলে ফিলিমের নায়িকা লাগে।
-   চড় খাবি কিন্তু বলে দিচ্ছি! সাবুটা খেয়ে নে।
সাবু মুখে দিয়ে বমি পায় নুসরতের।  কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করে বাটিটা পাশে সরিয়ে রাখে। বাইরে হাওয়ার জোর বাড়ে। উঠোন জুড়ে শুকনো পাতা উড়তে থাকে উনুনটা নিভে যায় হাওয়ার দাপটে। নুসরত খুব চেনা চেনা বৃষ্টির গন্ধ পায়। আম্মি বলে খুব গরমের পরে যে বৃষ্টি আসে, তাতে জিনপরি লুকিয়ে থাকে। টাটকা বৃষ্টির পানি হাতের মুঠোয় ধরে মানুষ যা চায়, তাই পায়। গেল বার নুসরত একটা জুতো চেয়েছিল। ঠিক পরের দিন ইস্কুলে যাওয়ার পথে ওর পায়ের হাওয়াই চটিটা ছিঁড়ে যায়। কাদামাখা ছেঁড়া চটি দেখে শ্রবণা দিদিমণি নিমডাঙ্গা বাজার থেকে একটা তারা দেওয়া রেক্সিনের জুতো কিনে দিয়েছিল। চোখ বুজে হাতটা মুঠো করে নুসরত। মনে মনে বলে, লিপিস্টিক চাই না জিনপরি, আব্বুকে তাড়াতাড়ি এনে দাও। বাতাসে লেবু লেবু গন্ধ ভাসে।
-   বৃষ্টি আসছে। পাটকাঠিগুলো দাওয়ার ওপর তুলে রাখ।
নাসিমার ডাকে ঘোর কাটে নুসরতের। চোখ মুছে পাটকাঠি কুড়োতে থাকে উঠোনে নেমে।



()



মাতানের বিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নাসিমার বুকটা ছমছম করে। জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুদিকে আকন্দের ঝাড়। মাঝখান দিয়ে সরু মাটির রাস্তা। দিনের বেলাতেও লোকের মুখ দেখতে পাওয়া যায় না। বাড়ন্ত বয়স মেয়েটার। যদি কেউ টেনে নিয়ে যায়! একটা পেঁচা বিকট স্বরে ডেকে ওঠে। নুসরতের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে নাসিমা।
-উফ! আম্মি, লাগছে তো!
- তাড়াতাড়ি চল সোনা। বিলপার এলাকাটা ভাল না।
খুব জোরে একটা বাজ পরে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়। তার সাথে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া। আকন্দ গাছগুলো একে অন্যের গায়ে হেলে পড়ে।
-পইপই করে বলেছিলাম জেদ করিসনি। এখন তোরে নিয়ে দাঁড়াই কোথায়?
নাসিমা বিড়বিড় করে। মেয়ের মাথা আঁচল দিয়ে ঢেকে দেয়। আঁচল এক ঝটকায় সরিয়ে নুসরত দৌড়াতে শুরু করে। সালোয়ারের লাল ওড়নায় লেগে থাকা চুমকিগুলো জোনাকি পোকার মত আকাশে উড়তে থাকে।
-থাম বেটি! হাঁপ ধরে যে! আমি কি পারি নাকি তোর সাথে?
চিৎকার করে নাসিমা। ভারী শরীর নিয়ে নুসরতের পেছন পেছন দৌড়োতে থাকে। ওড়না মাথার ওপর ধরে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে মাতানের বিল পার হয়ে বাঁদিকের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়
গয়েশপুর কালী মন্দিরের কাছে যে বুড়ো বটগাছটা আছে, তার নীচে বলরামের টিনের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা চায়ের দোকান। সন্ধ্যের পর থেকে লোকে ভিড় করে, চা, বিড়ি, মুড়ি, তেলেভাজা খায়। বৃষ্টি ছুঁয়ে ফেলার আগে বলরামের চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে নুসরত। পেছনে হাঁপাতে হাপাতে নাসিমা। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়।
-   রশিদের বিবি না? এত রাতে কোথা যাও?
-   যাই বাজারপাড়ায় তপন সাহার বাড়ি। দেখেন না চাচা, কি বৃষ্টি যে শুরু হল! 
-   সে তো মেলা দূর! যাবা কি করে ঝড় জলের মাঝে? ভিতরে আইসা বস। অ্যাই বিশু, জগা তোরা ওঠ। মাইয়াদের বসতে দে।
বলরাম গলা খাঁকারি দেয়। বেঞ্চিতে বসে মা আর মেয়ে অট্টহাস্যে ভেঙ্গে পড়ে।
-দেখলা আম্মি? বৃষ্টিকে কেমন হারিয়ে দিলাম।
-ধুর বোকা! বৃষ্টিকে হারানো যায় নাকি? জিনপরি তো আমাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে এল এখানে।
- জিনপরিকে তো দেখতে পেলাম না। কেমন দেখতে গো?
- তাকে দেখা যায় না পাগলী। ওই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা দেখছিস না , ওগুলোর মধ্যে জিনপরি লুকিয়ে থাকে। গরমকালে শুকনো মাটির যখন ছাতি পোড়ে, জিনপরি বৃষ্টির পানি হয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে। 
চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে নুসরত। চায়ের দোকানে কাঠের উনুন জ্বলে ধিকিধিকি করে। বলরাম লোহার কড়াই থেকে কাঠী গেঁথে বেগুনি নামায়। ফুলো ফুলো বেগুনির সঙ্গে কাঠের ধোঁয়া মিশে জন্নতের গন্ধ পায় নুসরত।
-আম্মি, খিদা পায় যে!
- এখন আর শরীর খারাপ করে না তোর! মঞ্জুদের বাড়ি চল। মাছ, মাংস, পোলাউ সব রান্না হচ্ছে। পেট ভরে খাবি।
-দাও না আম্মি একটা বেগুনি কিনে। লোভ লাগে।
নাসিমা কাপড়ের আঁচলের খুঁট খুলে খুচরো পয়সা গোনে। মঞ্জুদের বাড়ি এখনও অনেকটা পথ। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এই অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। একটা ভ্যান রিকশা যদি পাওয়া যায়, কিছু পয়সা দিয়ে চলে যাওয়া যায়। রাতটুকু না হয় ওখানেই থেকে সকালে ফিরে আসা যাবে। নুসরত একদৃষ্টে বেগুনির ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ছলছলে চোখদুটোয় কাঠের আগুনের লাল শিখা কাঁপতে থাকে। নাসিমা মেয়ের কপালে হাত রাখে। জ্বরটা বেড়েছে। বলরাম দুটো বেগুনি কাগজের ঠোঙায় ভরে নুসরতের দিকে বাড়ায়। নুসরত হাত বাড়িয়েও আম্মির দিকে তাকিয়ে গুটিয়ে নেয়।
-   কি হল? একদম গরম আছে। নে।
-   কত পয়সা লাগবে?
-   বেশি না। মাত্র চার টাকা।
-   থাক। লাগবে না। রেখে দাও।
বলরাম জোর করে নুসরতের হাতে বেগুনির ঠোঙ্গাটা গুঁজে দেয়। নাসিমা পয়সা গুনে বলরামের হাতে দেয়। নুসরতের মুখে হাসি ফোটে। একটা বেগুনি বের করে কামড় দিতে গিয়ে জিভে ছ্যাকা খায়। উফ করে ওঠে।
-   মুখ পুড়ে যাবে তো। একটু রেখে খা।
-   তুমি একটা খাও আম্মি।
-   নাহ রে! আমার খিদা নাই। তুই খা।
বাচ্চার গলায় কান্নার শব্দ পেয়ে সবাই বাইরের দিকে তাকায়। একজন কমবয়সী মেয়ে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ভেতরে চালার নীচে এসে দাঁড়ায়। কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে। বাইরে ভীষণ জোরে একটা বাজ পড়ে। বাজের শব্দে মেয়েটা ভয় পেয়ে আরও জোরে কেঁদে ওঠে। নাসিমা দৌড়ে যায়।
-   হে আল্লা! এই ঝড় জলের রাতে এই টুকুন বেটিকে নিয়ে কেউ বেরোয়? আমায় দে ওরে। চাচা, একটু গরম দুধ দাও।
নাসিমা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছিয়ে দেয়। মেয়েটা ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে।
-   কোথা থেকে আসছিস রে তুই? নাম কি?
নাসিমা নুসরতের কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে মেয়েটার কাছে এসে দাঁড়ায়। উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটির পিঠ দমকে দমকে ওঠে কান্নায়।
-   বাসনা।
কান্নাভেজা গলার শব্দ বৃষ্টিতে মিশে যায়। বলরাম কাঁচের গ্লাসে জল মেশানো দুধ দেয়। নুসরত বেগুনির ঠোঙা পাশে রেখে বাচ্চা মেয়েটাকে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করে। পাটের পুতুলটা ওর হাতে দেয়।
-   আমারে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বে করেছে আরেকটা! বাজারের মাগীটাকে ঘরে এনে তুলেছে।
একদমে বলে যায় মেয়েটি। নাসিমা নুসরতের দিকে তাকায়। বুকের ভেতর কেমন একটা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। কি যে নসীব আছে মেয়েটার!
-   আরে, এটা কালিদাস বাউরির বউ না? এই তো সেদিন বিয়া হল!
-   দেখ গে, পয়সা কড়ি পায়নি হয়ত ঠিক মত।
-   তা বলে এত রাতে বের করে দেবে? কাজটা ঠিক করেনি কালিদাস।
-   দুটা মুবাইল ফোন আছে কালিদাসের। কাঁচা পয়সা। খানকি বাড়ি  যায়।
দোকানের ভেতরে ফিসফাস শুরু হয়। বউটি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরে। নাসিমা রেগে গিয়ে একবার ভিড়ের দিকে তাকায়। গুঞ্জন থেমে যায়।
-   তুই ঘর ছাড়লি কেনে? নুড়ো দিয়ে মারতে পারলি না হারামিটার মাথায়? পেটের মেয়েরে যে রেয়াত করে না...। মরদ শালা!
রাগের চোটে মুখ দিয়ে থুতু বেরোয় নাসিমার। ভেতর থেকে উঠে বাইরে আসে এনায়েত আলি। পেটানো চেহারা। 
-   চুপ কর সবাই। এত রাতে এই টুকুনি মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবে ও? শালা কালিদাসের পোঁদে হুড়কো দেওয়া উচিত। হিঁদুর ছোঁড়া, একটা বউ থাকতে আরেকটা বিয়া করা। দেখাচ্ছি। আমিও পাট বেচে খাই। তুই কিছু ভাবিস না বেটি। ঝড় থামলে আমার সাথে চল। আজ দেখছি, কালিদাসের পেছনে কত জোর আছে।
-   আমি যাবো নে ওই ঘরে ! গাছ তলায় থাকব তবু ওর ঘরে পা দেব না।
বাইরে বৃষ্টির তেজ কমে আসে। আকাশে গুটি কয়েক তারা ফোটে। বাচ্চা মেয়েটা পাটের পুতুল নিয়ে খেলা করে আপন মনে। নুসরত ওকে বেগুনি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাইয়ে দেয়। বলরাম ঠোঙ্গায় করে মুড়ি, লঙ্কা, চপ দেয়। পয়সা নেয় না এবারেনাসিমা আর বাসনা পাশাপাশি চালার নীচে বসে মুড়ি চিবোয়। এনায়েত ওর সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার সময় বউটির হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে যায়। দোকানের ভেতরটা ধীরে ধীরে খালি হয়ে যায়।
-   আম্মি, ওরে আমি কি বলে ডাকবো?
নুসরত আম্মির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে
-   ফুলি বলে ডাকিস। একদম ফুলের মত মুখখানা।
-   আম্মি, আমি কিন্তু ওর কাছে শোব। জানো, ফুলির না গালে গর্ত আছে। হাসলে যা সুন্দর লাগে না!
নাসিমা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরটা আর নেই।


()



গরম ভাতের গন্ধে চারদিক ম ম করে। নাসিমা হাঁসের ডিমের খোলা ছাড়ায়। বাসনা আলুসেদ্ধ মাখে পেঁয়াজ দিয়ে। নুসরত উবু হয়ে বসে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অনেকদিন পর গোটা হাঁসের ডিম রান্না হচ্ছে।
- আম্মি দেখ না, ফুলি খালি পানির দিকে যায়।
- তুই না ওর আপা। ওরে কোলে রাখতে পারিস না?
- কথা শোনে না যে!
নুসরত ফুলির পেছনে ছোটে। বাসনা হেসে ফেলে। হাসলে মেয়েটাকে খুব মিষ্টি লাগে। নাসিমা একটা কলাইয়ের থালায় ভাত মাখে। থালা ঘিরে বসে পড়ে সবাই। নাসিমা ভাত তুলে পালা করে সবার মুখে দেয়। নুসরত নিজের ডিম থেকে ভেঙ্গে একটু কুসুম ফুলিকে খাইয়ে দেয়। ফুলি হাসে গালে টোল ফেলে। বৃষ্টি থামার শেষে আকাশে হাল্কা হলুদ রঙের ডিমের কুসুমের মত যে চাঁদটা ওঠে, সেটাও হেসে ফেলে ওদের দেখে।
ধুইয়ে দেওয়া জ্যোৎস্নার আলোয় একটা ছায়ামূর্তি উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টিতে জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতো সব চুপচুপে ভেজা। নাসিমার হাত ভাতের থালায় থেমে যায়।
-   আব্বু!!
নুসরত দু হাত বাড়িয়ে দৌড়ে যায়। নাসিমা দাঁত দিয়ে ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। ছায়ামূর্তির সামনে গিয়ে নুসরত স্থবির হয়ে যায়।
-   আমি রশিদের বন্ধু বাসুদেব। কলকাতায় একসাথে থাকতাম।
বাসুদেব ব্যাগ খুলে খবরের কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট নুসরতের হাতে দেয়
-   আম্মি গো!!
কাঁপা গলায় চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়ে নুসরত।  হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। নাসিমা ভাত মাখা হাতে দৌড়ে আসে। পায়ের ধাক্কায় জলের কুঁজোটা উল্টে যায়।
রশিদের পাঠানো দোমড়ানো মোচড়ানো কিছু টাকার সঙ্গে একটা রঙ ওঠা লাল রঙের ঢাকনাখোলা লিপস্টিক পড়ে থাকে বৃষ্টিভেজা উঠোনে।