শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৪

ছোটগল্প – অভীক দত্ত




শেষের শুরু

অভীক দত্ত



আসলে বিয়ের পরে সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। জীবনটা তো বাংলা মিষ্টি প্রেমের রিমেক ছবি না। বরং বলা যায় বিয়ের পরে আসল স্টোরি শুরু।
 আমার আর দেবপ্রিয়ার প্রেমটা কলেজ অবধিও পৌছায় নি। আদতে প্রেম বলেও কিছু ছিল না। ওদের বাড়িতে পড়তে যেতাম এই অবধিই। পড়তে যেতাম একা আমি না, আরও কয়েকজন। আর আমি বিরাট হিরো টাইপ কিছুও না। বরং অতিরিক্ত সময় বাথরুমে কাটাবার ফলস্বরূপ মুখে ব্রণর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল।
ঘটনাটা ঘটেছিল এক বৃষ্টির দিনে। কেউ পড়তে যায় নি। আমি চলে গেছিলাম। সেদিন নাকি স্যারই ফোন করে বলেছিলেন আসতে পারবেন না। সবাই জেনে ছিল, আমি কোন কারণে মিস করে গেছিলাম। দেবপ্রিয়ার বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ বসেছিলাম। ওর বাবা মা ছিলেন, কথাও বলেছিলাম তাদের সাথে।
পরের দিন থেকে বুঝছিলাম একজোড়া চোখ একটু প্রেম প্রেম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাড়া করছে। সেটা কি কারণ ছিল এখন জানি না, তবে যেটুকু বুঝি সেটা হল বয়ঃসন্ধির সময় এসব হতেই পারে।
ক্লাস ইলেভেনে এটা হয়েছিল, টুয়েলভ অবধি ওদের বাড়িতে পড়তাম। তখন মাঝেমাঝে ফোনেও কথা হত। কিন্তু জয়েন্টে একটা অদ্ভুত র‍্যাঙ্ক করে ফেলায় আমাকে সেই জলপাইগুড়ি চলে যেতে হয়, আর দেবপ্রিয়া জেনারেল লাইনেই পড়াশুনা করে, এবং কোন রকম ভালবাসাবাসির চাপে না পড়ে থার্ড ইয়ার নাগাদ ওর বিয়ে হয়ে যায় এক  কলকাতাবাসী বড় চাকুরে ছেলের সাথে।আমাদের মফস্বলে এই সব খবর চাপা থাকে না, ব্যাচে পড়ার সময় আমার কেসটা যে বন্ধুরা জানত তারাই খবরটা দিয়েছিল।তখন আমি হোস্টেলে রাম আর পুরিয়া মেরে লাট হয়ে পড়েছিলাম, খবর শোনার পর কি রিয়্যাকশান দিয়েছিলাম ভাল করে মনেও নেই তবে এটুকু মনে পড়ে বুকের কোন অংশেই খবরটা কোন রকম ভাইব্রেশন তৈরি করতে পারে নি। বিয়ে বাড়ির খাবারের কথা অবশ্য মনে হয়েছিল, তাই দুই পার্টনারকে রাজি করিয়ে মাঝরাতে এক কাছাকাছি বিয়েবাড়িতে হানা দিয়ে মাংসভাত খেয়ে এসেছিলাম। মেয়ের বাবা যদিও বুঝেছিলেন আমরা নেমন্তন্নহীন অতিথি, তবু পরম স্নেহে আমাদের খাওয়ার তদারকি করেছিলেন।
যাই হোক, এই সব পুরিয়া টুরিয়া বন্ধ হয়ে গেছিল কলেজ পেরতেই, তখন আবার ভাল ছেলে হয়ে কয়েকবছর ব্যাঙ্গালোরে সফটওয়্যারে চাকরি করে কলকাতায় পোস্টিং নিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। মেয়ে কলকাতারই তবে সেও চাকরি করে, প্রেম ঠিক হয় নি কিন্তু কি বুঝলাম কে জানে, মনে হয়েছিল কম্প্যাটিবিলিটি ম্যাচ করছে, ধাঁ করে কথা বার্তা বলে বিয়ে হয়ে গেল।
আমার বউয়ের নাম সুপর্ণা। অতিশয় ল্যাদ। এরকম ল্যাদ মেয়ে আজকালকার দিনে পাওয়া দুষ্কর। বিয়ের সময় আমরা মাত্র সাতদিন ছুটি পেয়েছিলাম। দ্বিরাগমনের আগেই জয়েন করতে হত। সুপর্ণা জয়েনিং এর দিন সকালবেলা আমায় বেজায় আদর করে বলল “আমি আর জয়েন করছি না, তুমি যাও”।
আমি বিয়ের আগে হিসেব করা চাকরি করা বউয়ের সূত্রে প্রাপ্ত টাকা পয়সা, লাভ ক্ষতির হিসেবে গুলি মারতে মারতে বউয়ের আবদার আরামসে মেনে নিলাম। সুপর্ণা গৃহিণী হিসেবে অবশ্য ভাল তবে একটু বেশিই বাপের বাড়ি গিয়ে থাকে।বিয়ের তিন বছর পর ক্রিসমাসের ছুটিতে আমাদের মফস্বলের বাড়িতে ফিরলাম সুপর্ণাকে ছাড়াই কারণ ওর বাড়িতে কি কাজ ছিল।
এবং ফিরে বাজারে ঘুরতে গিয়ে দেখা হল দেবপ্রিয়ার সাথে, সামান্য মোটা হলেও ভাল লাগছিল দেখতে, আর আমি অ্যাভয়েড করব করব ভেবেও গিয়ে কথা বলে ফেললাম ‘ কিরে কেমন আছিস?’
আমার প্রশ্ন শুনে খুব একটা না ঘাবড়েই জবাব দিল ‘ভাল আছি, তুই ঠিকঠাক?’
আমি মাথা নাড়লাম, তারপরে জিজ্ঞেস করলাম ‘তোর হাসব্যান্ড কোথায়?’
ও মুখ ব্যাজার করে বলল ‘কোন ছুটি নেই, আমিই একা একা এলাম, তোর বৌ?’
আমিও মুখ ব্যাজার করে বললাম ‘সে বাপের বাড়িতে। কাজ আছে কিছু’।
আমার উত্তরে দেবপ্রিয়া খুশি বলে মনে হল। বলল ‘চ কোথাও একটা গিয়ে বসি’।
আমাদের মফস্বলে এখনো কেবিন আছে, প্রেমিক প্রেমিকাদের নিভৃতে কথা বলার জন্য। আমরা একটা রেস্টুরেন্টের কেবিনে গিয়ে বসলাম। দেবপ্রিয়ার খুব একটা আপত্তি হল না কেবিনে বসার ব্যাপারে, আর আমারও মনে হচ্ছিল খোলা জায়গায় গিয়ে কথা বলার থেকে একটু প্রাইভেসি থাকা ভাল।
একথা সেকথা আকথা কুকথার পর জানা গেল দেবপ্রিয়ার বিয়ের এত বছর পরেও কোন বাচ্চা হয় নি, সেটা বরের জন্য না বউয়ের জন্য এই ব্যাপার নিয়ে কদিন হল দু বাড়িতে ব্যাপক টানাপোড়েন চলছে। দেবপ্রিয়ার কথায় আমার মনে পড়ে গেল আমিও গত এক বছর ধরে একই সমস্যায় ভুগছি। দুবাড়ি থেকেই প্রবল চাপ আসছে বাচ্চা নেবার ব্যাপারে কিন্তু সব রকম পন্থা অবলম্বন করেও আসলে অশ্মডিম্ব প্রসব হচ্ছে।
দুজনের এত বছর পরে দেখা হওয়ার পরে একই পরিস্থিতি বুঝে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম আর তারপরেই দেবপ্রিয়া সেই অদ্ভুত প্রপোজালটা দিল, যেটা আমাদের খানিকটা পিছিয়ে পড়া মফস্বলের সাথে একেবারেই বেমানান ছিল।
“আমি আর তুই একটা ট্রাই করবি? যদি সাকসেসফুল হয় তাহলে আমি একটা বাচ্চা পেলাম আর তুই পাবি তোর পুরুষত্বের প্রমাণ?”
কেন জানি না আমার প্রস্তাবটা একেবারেই ভুল ভাল লাগে নি বরং বিয়ের তিন বছর পরে পুরুষের পরকীয়া প্রেম সানন্দে সেই প্রস্তাবটা মেনে নিয়েছিল। আমি পরিষ্কার বুঝেছিলাম দেবপ্রিয়া যথেষ্ট মরিয়া এই ব্যাপারে, একটা পরনারীশরীর দখল করার লোভটা ক্রমাগত আমার ওপর জাঁকিয়ে বসছিল। বেশ খানিকক্ষণ আরও আলোচনা হবার পর আমরা ঠিক করে ফেললাম কলকাতায় যাবার নাম করে দু তিনটে ষ্টেশন বাদে কোন এক হোটেলে আমরা এই কাজটা করে ফেলব।
আসলে রান্নাটা বিরিয়ানি হোক কিংবা ইলিশ ভাপা, রোজ রোজ একই রান্না খেতে খেতে মুখে কেমন একঘেয়ে ভাব চলে আসে। সুপর্ণার প্রবল উপস্থিতি সত্ত্বেও দেবপ্রিয়ার এই প্রস্তাব আমায় ব্যাপক ভাবে দখল করে বসল এবং তার একদিন পরেই পরিকল্পনা রুপায়ন হয়ে গেল।
আমাদের দুজনের কাউকে দেখেই লম্পট মনে হয় না, হোটেলের জন্য একটা ব্যাগ আর পরের দিন ভোরের বাস ধরতে হবে এই নির্দোষ মিথ্যাতেই আরামসে এক রাত কাটানো গেল, গোটা রাত ধরে স্কুল লাইফের সেই মেয়েটার সাথে অনেকক্ষণ শরীরে শরীরে সময় কাটিয়ে ভোর বেলা যখন বেরলাম, দুজনের মনেই এতক্ষণ বিলুপ্ত থাকা অপরাধবোধ ফিরে এল এবং ফেরার পথে কেউই কারও সাথে কোন রকম কথাবার্তা বললাম না।
বাড়ি ফিরে আর আমাদের দেখাসাক্ষাৎও তেমন হয় নি। আমি কলকাতায় ফিরে গেলাম আর দেবপ্রিয়ার ব্যাপারেও কোন খোঁজখবর রাখলাম না।
এই ঘটনার প্রায় দু বছর পরে বাড়ি ফিরেছি। আমাদের সমস্যা মিটে গেছিল, আমাদের মেয়ে হয় তার এক বছর বাদে। যদিও মফস্বলী মানসিকতায় এখনো মেয়ের থেকে ছেলেই সবাই বেশি চায় কিন্তু যেহেতু প্রায় বিয়ের চার বছর পরে মেয়ে হয়েছিল সেজন্যে সবাই এই ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি চাপ নেয় নি। বাচ্চা ছোট বলে সুপর্ণা বাড়ি থেকে বেশি বেরত না যদিও বেশিরভাগ সময়টা বাড়ি থাকলে মেয়ে আমার কাছেই থাকত। অনেকক্ষণ মেয়েকে ধরে আমি ঘরে থেকে থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে বাজারে বেড়াতে গেলাম এবং  এমন কপাল সেই দেবপ্রিয়ার সাথেই দেখা হল।
আমি এবার আর নিজে থেকে কথা বললাম না তবে এবারে দেবপ্রিয়াই এগিয়ে এল, ওর সাথে বেশ হ্যান্ডসাম একজন স্মার্ট যুবক ছিল আন্দাজে বুঝতে পারলাম ওর বর। পরিচয়পর্ব মেটার পর বুঝলাম আমার অনুমান ঠিকই ছিল।
এই দুবছরে মফস্বলের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, কেবিনওয়ালা রেস্টুরেন্ট ভেঙে তিনতলার ঝকঝকে রেস্টুরেন্ট খুলেছে, পশ্চিমি কায়দায় আগে টোকেন নিয়ে পরে খাবার নেওয়ার প্রচলন ঘটেছে। দেবপ্রিয়ার বর আমায় জোর করে টেনে একটা টেবিলে বসিয়ে টোকেন কাটতে চলে যাবার পর দেবপ্রিয়া অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে আমাকে বলল “সেদিনের পরেও আমার কিছু হয় নি জানিস, ডাক্তার টেস্ট করে দেখেছে আমার কিচ্ছু নেই। একদম ফিট আমি, তাহলে কি তোরও শুভ্রদীপের মত একই সমস্যা আছে?”
আমি এই কথার উত্তর একবাক্যেই দিলাম “দূর, আমার মেয়ে হয়েছে এক বছর হল”। তারপরেই যেন আমি একটা চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেলাম, দুজনে হাঁ করে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এরপরে বেশ খানিকক্ষণ শক পরবর্তী অবস্থায় বসে রইলাম, ঝা চকচকে পরিবর্তিত রেস্টুরেন্ট কিংবা দেবপ্রিয়ার বরের কোন কথাই আমার আর কোন কানে ঢুকছিল না।
যদিও জানি, সারারাত একসাথে থাকলেই বাচ্চা হবেই এরকম কোন গ্যারান্টি নেই, হতে পারে, দেবপ্রিয়ার মেডিক্যাল টেস্ট ভুল আছে...
তবু জানি এই কাঁটাটা সারাজীবন আমার গলার কাছে বেঁধে থাকবে।
সাধে কি আর বলে, বিয়ের পরে সিনেমা শেষ হয়। জীবন শুরু হয়...