শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৪

গুচ্ছ কবিতা – রিয়া চক্রবর্তী





পেইনকিলার আমার শব্দরা
রিয়া চক্রবর্তী

গভীররাতে যখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে
ছটফট করছি নিজের চিতাভস্মের ওপর
জানি তুমি জেগেছিলে, জেগেছিল তোমার শব্দেরা
শুনতে পাইনি তাদের চিৎকার, শূন্যতা, বিষাদময়তা
তারপর রাতের আকাশ বয়ে চলেছে ভোরের দিকে
জেগে উঠছে রাস্তা, গাছ, পাখি সূর্য
ঠিক তখনই ইথারের ঠিকানায় দেখলাম
তোমার শব্দের কান্না, ঝাপসা হয়েছে চোখ
বৃষ্টি কুড়িয়েছে দু'হাত

ব্যাস্ত শহরে আরও ব্যাস্ত হতে পেইন কিলারের
সাহায্যে, মনের সারেঙ্গী তখন তুমি ময়
সেই চেনা নাম, সেই চেনা স্বর
যে সুর রামধনুর সবকটা রং ভেঙ্গে
ছড়িয়ে পড়ছে ঝঙ্কার তুলে
নতুন করে বাঁচার প্রেরণায়

হঠাৎ চিরবিদায়ের শব্দ তোমার কলমে
জানলার গরাদ পেরিয়ে আলো, আর চোখের বৃষ্টি
রক্তাক্ত করছে হৃদয়, ক্ষত বিক্ষত করছে মন
বৃষ্টি বয়ে চলে বিষণ্ণতার অবুঝ গতিতে


রিয়া চক্রবর্তী

দিনের ফাটলের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় রাতের রূপকথা
শূন্যতা আর তারার মধুর মিলনে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন আলোর পথ

বসন্তের উষ্ণ দুপুরে যখন আসবে কবিতা
একটু নুন, একটু চিনি মেশাবার সাথে সাথেই
বুভুক্ষু নিঃসঙ্গতা ঝাঁক বেঁধে আসবে
শান্তির জন্য আবারও মেশাতে হবে একটু ভালোবাসা,
একটু আন্দাজ মতো রং
তৈরি হবে তোমার কবিতা

বিকল্প তাদের পরিবেশন করবে কিছু সুখের মুহূর্ত,
আজকাল আবার কবিকে কবিতা লেখার সময়
শিল্পের দিকে, রঙের দিকে লক্ষ্য রাখতেই হয়,
তখনই কবিতা তৈরির সাথে সাথেই
তৈরি হবে জ্যামিতিক রঙ্গভূমি

প্রত্যেকটি শব্দই নিজেদের সাজাবে 
সরল নিষ্পাপ সৌন্দর্যে,
উপভোগ করবো নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের সাথে

উৎসারিত দুর্বার শব্দেরা মিছিল করবে
দীর্ঘ, মহৎ নৈপুণ্যে অর্জিত হাত মাথায়
অনায়াস ব্যাবহারের জন্য-দুর্দম
ঘোড়সওয়ারদের অশ্ব চালনায় প্রকাশ পাবে।


রিয়া চক্রবর্তী

ছন্দ-মাত্রা সব কিছুতেই যেন আজ গরমিল
রক্ত গুলো জমাট বেঁধে নীল হয়ে আছে হাতের মাঝে
কবিতাকে বিদায় দিয়ে কঠিন গদ্যের মুখোমুখি
 দুপুর গড়িয়ে বিকেল, কতক্ষন হেঁটে গেছি জানিনা
চোখের পাতায় মেঘেদের আনাগোনা, এক দুফোঁটায় বর্ষাও নেমেছে
নিস্তরঙ্গ জমাট বাঁধা জলের মতন জীবন, যেখানে শ্যাওলার সংসার
সবশেষে একদিন এইভাবেই রক্তাক্ত স্তব্ধ হয়েই চিরবিদায় হবে
প্রতিবার ভেবেছি এই তো শেষ, দুঃস্বপ্নের অবসান
কিন্তু এই মহাকাব্যের শেষ নেই।কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রক্তাক্ত বারবার
বুকের ভেতর রক্তোগ্ন্যুৎপাতের পরও
আমার নিঃশব্দ ভাঙন, নিশ্চুপ বর্ষণ
আর রয়ে যায় হাতের তালুতে কৃষ্ণচূড়া নীল হয়ে


রিয়া চক্রবর্তী

সাড়ে নয় রাত
আনোয়ার শা ওপর চলন্ত দানব
খসিয়ে দিতেই
মৃত্যু ঝিঁঝিঁ মাথার খুলিতে আঁচড় কাটে
সাদা লাইনের ভেতরেই জ্ঞানহীন
ইচ্ছের স্বপ্ন শূন্যতা নিয়ে অর্ধচেতন লাশ
পড়ে থাকে জীবনের অক্সিজেন
পুনরুদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টায়,
বাসের শেষ চাকায় হ্যান্ডশেক
অপূর্ণই রয়ে গেল আজও
গুনগুন-কোলাহল-গেল গেল-
চোখের পাতার নিচে সরে যায়
কাঁপা কাঁপা ছবির কোলাজ;
ধ্বনি ফিরে আসে বিবর্ধিত লয়ে
নিরবাসিত চোখের পলকে ভয়-আতঙ্ক
সন্ধে গড়িয়ে রাতের পার্লারফেরত মুখে
জ্বলজ্বল করে সারিসারি লোভাতুর দোকান
পেটের ভেতর নড়াচড়া করে
কবরস্থ দোকানীর বুদ্বুদ জীবন
হাইভোল্টেজ শকথেরাপিতে
পৃথিবী বোবা হয়ে গেছে,
ত্বকের ওপরে শিরায় শিরায় আতঙ্কমোহর,
গম্ভীর পর্যবেক্ষণে রাততারারাও
কোথায় যেন টুং টাং ঠুং ঠুং
বেজেই চলেছে বিসর্জনের ঘন্টা,
চাকাদের ঘর্ঘরে ঢাক ঢোল কাঁসর
বেজে ফিরিয়ে আনে
ভয়ংকর বলিদানের তীক্ষ্ণপ্রহর;
গতিশূন্য পতনে নিউটনকে হারিয়ে
শুধু কিছু শব্দের শবযাত্রায়
রিক্সার হর্নের সাথে ভেসে যায়
নুড়িপাথরের দীর্ঘশ্বাস


রিয়া চক্রবর্তী

উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে যখন 
নক্ষত্রদের গান পৌঁছে যায় গভীর থেকে গভীরে
নুড়ি পাথর গুলো মুগ্ধ হয়ে গড়িয়ে পড়ে
সমুদ্রের ধুয়ে দেওয়া বালির ওপর। 
কোথাও কোন গতিশূন্য কবির মৃত্যুতে
সারা বিশ্ব সরগরম কবির মাহাত্ব্যে
,শুধুমাত্র কবিতার শব্দ গুলোই যাত্রা করে
নিঃশব্দে সেই কবির সাথে মহাপ্রস্থানের পথে। 

অন্যএক জীবন
একটি অভাববোধ, কিছু
অমানবিক বঞ্চনার স্মৃতি
দীর্ঘ বন্দীদশা,নীরব কান্নায় পৃথিবীও
ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়,এক একটি লোহার শিকল খুলে
বেড়িয়ে যাওয়ার পরেও
স্মৃতি বহনের কষ্টের কষ্টত্ব থেকেই যায়। 

স্মৃতির ব্যবচ্ছেদে যখন পেশীতন্তু ব্যকুল হয়ে ওঠে
তখন, একমাত্র কবিতাই মনকে স্থির করে রাখতে পারে,
রাত্রির প্রতিটি শিরায় উপশিরায়
আঘাত করে হৃৎপিণ্ডের মাংস ছিন্ন ভিন্ন করে। 
যখন সকাল হয়, নতুন ভোরের সাথে
দিনটাও জলের মতো বয়ে চলে


রিয়া চক্রবর্তী


মাঝে মাঝে মাঝরাতে পথভুলে
পৃথিবীর নাভি ঘেঁষে ওঠে একফালি চাঁদ

নিঃশ্বাসের ওঠানামায় দিগভুল হয় 
হাওয়াদের চিরচেনা পথের

কখনও কখনও চোখের কোনের চিকচিকে বালি
ঢেকে দেয় রাতজাগা তারাখসা জল

ভোরও মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে ওঠে
রোদেরাও লুকোতে চায় নিজেদের ছায়ায়

উতল নদীরা জল সেচে, মাতাল হয়ে
পাড় ভাঙে কোন শান্ত বৃদ্ধ গ্রামের। 

তখনও ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেনি শহর
মনের সংযমের বাঁধ ভেঙে ছারখার হয়

শান্ত স্থির পায়ে ঘুরে ফেরে ইচ্ছেরা
লজ্জায় খসে যায় পৃথিবীর আঁচল

কখনও কখনও অভিমানের গনগনে আঁচ,
ভেঙে দেয় মনের যত বে-আব্রু সঙ্কোচ

কুয়াশার চাদরে নিজেকে আড়াল করেছে পৃথিবী
বোঝেনা কেউ, বুঝতে চায় না কেউ। 

কখনো কখনো পৃথিবীও গলে পরে, ঝরে পরেপথ
ভোলা রাতে পৃথিবীর নাভি ঘেঁষে উঠে চাঁদ

মাঝে মাঝে পৃথিবীও কক্ষচ্যুত হয়.....