ফেরা-না ফেরার মাঝখানে
অভীক দত্ত
১.
।।অরিত্রর ডায়েরি।।
২৩শে নভেম্বর,২০০৭
অর্পিতার বাবার সাথে আর আমি কখনও কোন ওসুধের দোকানে যাব না।এরপর থেকে অর্পিতাদের বাড়িতেই যাব না। যদি অর্পিতার সাথে আমার বিয়ে হয় তবে যতটা কম যেতে হয় তাই যাব। অর্পিতার সাথে আমার বিয়ের সম্ভাবনা যদিও ০.০০০০১% এরও কম তবু আজ আমি এই প্রতিজ্ঞা করেই নিলাম।
মানে হয় নি কিছুই। এস জির টিউশন শেষে অর্পিতা বলল ওর বাড়ি থেকে খাতাটা নিয়ে যেতে। টানা দু দিন বাঙ্ক মেরে মাসির বাড়ি লিলুয়ার ঘুরে এসেছে। সাল্লু মিঞার অন্ধ ভক্ত ও। বাড়ি থেকে গেলে ওর বাবা বকবে তাই ছক করে মাসির বাড়ি গিয়ে সিনেমা দেখে এসছে। পেন্সিল বক্সে পর্যন্ত সালমান খানের ছবি রেখে দিয়েছে।
যাক গে, যে কথা বলছিলাম, অর্পিতার বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দেখি ওর খরুশ বাপ কোথায় যাবার জন্য রেডি হচ্ছে। আমাকে দেখে নাক উঁচু করে বলে কিনা “কোথায় যাবে?”
আমি বললাম “মেসে”।
বলে “চল তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। তুমি তো বাসে যাবে? আমি গড়িয়ার ওদিকেই যাব। তোমায় নামিয়ে দেব”।
কি আর বলব। খারাপ না ভেবে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আমাকে নিয়ে ঢুকল একটা ওষুধের দোকানে। আমি বললাম যে আমি গাড়িতেই বসি বলে কিনা দরকার নেই, গাড়ি তে একা একা বসে বোর হবে।
ওদের পাড়ার দোকান। দুটো নাবালক টাইপ দোকানদার বসে ছিল। ওর বাবা হঠাৎ গিয়েই দেখি কি ঝাড় দিল ছেলেদুটোকে, “তোদের কতবার বলেছি, এই সব প্রাপ্তবয়স্ক জিনিস দোকানের সামনে টাঙিয়ে রাখবি না, এগুলি লুকনোর জিনিস, ফলাও করে অ্যাড করার জিনিস না। যতসব!”
ততক্ষণে বুঝে গেছি। ওই যে কিসব তেল টেল টিভিতে অ্যাড হয়। কন্ডোমও ছিল। ওর বাবাকে তো আর বলতে পারি না এসব জিনিস আমাদের কলেজের টয়লেটেও থাকে আঙ্কেল তুমি দেখতে চাইলে একদিন দেখতে পার।
ছেলেগুলি মিউ মিউ করে কি সব বলতে গেল, অ্যাপির বাবা রাম বকুনি দিয়ে থামিয়ে দিল। চারদিকে বেশ একটা ভিড় মত জমে গেছিল। আমার লজ্জায় মাথা হেট।ওষুধ কেনার পরে চুপচাপ এসে কোন মতে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তারপরে শান্তি। এই নাক মুল্লাম কান মুল্লাম, আর জীবনে কখনও ওদের বাড়ি আমি যাব না। গাড়িতে উঠব না। আর ওষুধের দোকানের থেকে দুইশ হাত দূরে থাকব।
#
মেসে আমার খুব একটা থাকতে ভাল লাগে না। এই পঞ্চসায়র জায়গাটা কিরকম যেন। এত শান্ত জায়গা ভাবা যায় না। বাড়ির কথা কি সাধে মনে পড়ে। আমাদের পাড়াটাতে তো সকাল বিকেল ঝগড়া লেগেই আছে সাহাবাড়িতে। বীরেন সাহার দুটো বউ পালা করে চিল চিৎকার জুড়ে জমিয়ে রাখে পাড়া। কালই তো অর্ণব বলছিল একসাথে দুটো মেয়ের সাথে প্রেম করলে কেমন হয়। ওর নাকি ইয়াহু মেজেঞ্জারে কোন একটা মেয়েকে চরম লেগেছে। একদিন হাইল্যান্ড পার্কে গিয়ে দেখা করেও এসেছে। এদিকে প্রিয়াঙ্কা ওর স্টেডি জি এফ। জানলে রাম ধোলাই খাবে বাছাধন।
আমি বুঝি না অর্ণবের সাথে একসাথে দুটো মেয়ে কি করে প্রেম করে। বা অর্ণব তুললই বা কি করে। ওর মুখ দিয়ে সবসময় বেড়াল পচা গন্ধ বেরোয়। মেয়েরা কি সে সব গন্ধ পছন্দ করে নাকি। ইস।
করুক গে যা ইচ্ছা করুক। এদিকে আমার কি হবে? সামনের মাসে দশ তারিখ থেকে সেম এদিকে আদ্দেক সাজেশন জোগাড় হয় নি। ক্লাস তো করিই না। কয়েকটা ফ্যাকাল্টি এখনও আমার বাঁশি শুনেছে। চাক্ষুস দেখে নি এখনও। ভাইভায় পেলে স্রেফ জল দিয়ে গিলে খাবে মনে হয়। এই এস জিটাও মহা ... ইয়ে আছে।মাসে এতগুলি টাকা নেয় ওদিকে সাজেশন ছাড়তে বললে খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসছে। ডায়েরিতে গালাগাল দেব না ঠিক করেছি নইলে...।
যাক গে। যা হবে হোক। অত চাপ নিয়ে কি হবে। আজ প্রলয় বলেছে একটা ভাল জিনিস পেয়েছে। রাতের খাবার সাটিয়ে সেটাই দেখতে হবে।
যাক অনেক লিখে ফেলেছি আজ। নিজের সেমের ডায়েরিতে এত লিখলে নির্ঘাত E বা O পেয়ে যেতাম। অংশুকে একটু জ্বালাই গিয়ে। শুনছি পায়েল নাকি আজকাল ওর ঝাড়ির রিপ্লাই দিচ্ছে। কি কেলো! পায়েলের সাথে অংশুর বিয়ে হলে প্রোডাক্টটা যাবে হবে না। পুরো জেব্রা। খ্যাক খ্যাক।
২.
১৪ই জানুয়ারি ২০০৮
পার্বণীঃ
শীতকালটা তাও খানিকটা কলেজে আসলে বোঝা যায়। আমাদের বাড়ির ওদিকটায় তো যা তা লেভেলের গরম পড়ে। সেমের শুরুর দিন ক্লাস করার মত মজার জিনিস আর কিছু হয় না। তবু আজ ভাল লাগছিল না ক্লাস করতে। সেমের চাপ কাটিয়ে এখনই ওই কঠিন কঠিন সাবজেক্টগুলির মুখোমুখি হতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না।
দুটো ক্লাস করে থার্ডটা বাঙ্ক মেরে দিলাম। প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে মাঠের দিকে গিয়ে বসলাম।বেশ নরম রোদ, নীল আকাশ, এই রকম পরিবেশ আমার খুব ভাল লাগে। আমাদের অর্ধেক ক্লাসের ছেলেরা এদিকেই দেখি। ক্রিকেট খেলতে ব্যস্ত। বাকিগুলো বাইরে থেকে চিয়ার করছে। ওদের ওখানেই বসলাম।
সায়ন আমাদের দেখে টোন কাটল “কিরে পথ ভুল করে এলি নাকি?”
প্রিয়াঙ্কা জ্বলে পুড়ে উঠতে যাচ্ছিল। আমি ওকে একটা চিমটি কাটলাম। এই সায়নের কাজই হল কোন কাজ করবে না শুধু মাঝে মাঝে ফোঁড়ন কাটবে। আমাদের ক্লাসের ব্যান্ডে আছে অথচ ও কি করে কেউ জানে না। বাজায় না গায় ভগবান জানে।
কাদের সাথে খেলা হচ্ছিল জানি না কিন্তু হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে প্রিয়াঙ্কা বলে উঠল “উফ কি ফিগার রে মালটার। কে রে এটা?”
সত্যি দেখার মতই ফিগার ছেলেটার। ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবে।জামা খুলে বোলিং করছিল। বল করার সময় মনে হচ্ছিল হাওয়ার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে, এত সাবলীল। সায়ন শুনেছিল প্রিয়াঙ্কার কথা। আবার ফুট কাটল “অর্ণবকে বলব নাকি?”
প্রিয়াঙ্কা হাতের কাছে থাকা একটা ঢেলা ছুড়ল ওর দিকে। বলল “তোর কি বে? তুই কি অর্ণবের বাপ নাকি শালা?”
সায়ন ঢেলাটা লুফে নিয়ে বলল “ইন্সট্রু ফাইনাল ইয়ার। বেশি চাপ নিস না। বদহজম হয়ে যাবে। সি এসের সুন্দরী কৃষ্টি ওর সাথে সৃষ্টি উৎসবে ব্যস্ত”।
প্রিয়াঙ্কা মুখ বাঁকাল। সায়নের কথা শুনে আমার বেশ মজা লাগল। বললাম “বাহ, তুই তো বেশ ছন্দ মেলাতে পারিস”।
কথাটা আমার বলা উচিত হয় নি। ব্যাটা সাথে সাথে ভাও নিয়ে নিল। গম্ভীর হয়ে বলল “আমি লিটল ম্যাগাজিন করি। ক’টা লোক আছে এই কলেজে এসব করে?”
প্রিয়াঙ্কা বলল “হ্যাঁ বে শালা কলেজে তোর মত ভাট মাল তুই একটাই আছিস”।
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। প্রিয়াঙ্কার মুড আজ অফ মনে হচ্ছে। বেশ গরম গরম কথা বলছে। ওকে বললাম “চ’ ক্যান্টিনে গিয়ে বসি”।
উঠে দেখি সায়নটা পেছন পেছন আসছে। বিরক্ত হলাম। এ ব্যাটা মেয়েদেরও অধম। সব কথা শুনতেই হবে।
ক্যান্টিনে রোজের মতই অনুরাধা সাগ্নিকের সাথে ন্যাকা ন্যাকা মুখ করে বসে আছে। এ দুটোকে দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আর কি কোন কাজ নেই। সারাক্ষন বসে আছে। ক্লাসে একসাথে। লাইব্রেরীতে একসাথে। ল্যাবে একসাথে। ফেবিকল দিয়ে যেন আটকে রাখা আছে দুটোকে। আমরা ঢুকতেই আমাদের দেখে হাত নাড়ল দুটো। যেন দুটো বোন বসে আছে।
প্রিয়াঙ্কা ফিসফিসিয়ে বলল “ওই দেখ ডাকছে কি করবি?”
আমি ফিসফিসিয়েই উত্তর দিলাম “চেপে যা। এমন ভাব কর যেন দেখিস না। উল্টো মুখ করে ওদিকের টেবিলটায় বস”।
ওদেরকে কোনমতে অ্যাভয়েড করে বসলাম। সায়নও জুটল। আমি বললাম “কিরে তোর কি কোন বক্তব্য আছে? ফলো করছিস কেন?”
সায়ন তৎক্ষণাৎ মুখটা সিরিয়াস করে বলল “তোদের কাছে পঞ্চাশটাকা করে হবে?”
অবাক হলাম। এ বলে কি। “কেন?”
সায়ন আরও সিরিয়াস হয়ে বলল “নন্দীগ্রাম যাব। আমি আর কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। ওখানে একটা বাজে লেভেলের টেররিজম চলছে। রিলিফ দিতে যেতে হবে”।
আমি আর প্রিয়াঙ্কা হেসে ফেললাম “তুই বুদ্ধিজীবী? শালা তোকে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে বুদ্ধিজীবী লাগে বলত?”
প্রিয়াঙ্কা বলল “বালখিল্য লেভেলের”।
আবার হেসে ফেললাম।
সায়ন হাসল না। সিরিয়াস মুখে বলল “না রে। তোরা জানিস না। সেমের পর আমি গেছিলাম। সে কি অবস্থা। আজ এই লোক ঘরছাড়া কাল ওই”।
প্রিয়াঙ্কা বলল “আমাদের থেকে টাকা নিয়ে কি করবি?”
-ফান্ড তুলছি। ওখানে রিলিফে লাগবে।এতো কলকাতার মত শীত না। মেদিনীপুরের শীত। মারাত্মক ঠাণ্ডা। কোথাও কোথাও একটা কাথা পর্যন্ত নেই। সব ফেলে পালাতে হয়েছে।
আমি একটু অবাকই হলাম। সায়নের এরকম রূপ আগে দেখিনি। আমরা কলেজ, আড্ডা, ক্লাস এইসব নিয়ে থাকি কিন্তু ও যে এতটা গভীরে গেছে সেটা বুঝিনি।
ব্যাগে কিছু টাকা ছিল। ওকে একশো টাকাই দিলাম। প্রিয়াঙ্কাও দিল। সায়ন উঠতে উঠতে বলল “বাই দ্য ওয়ে, এবার ফেস্টে কে আসছে জানিস তো?”
আমরা মাথা নাড়লাম।
সায়ন ঘ্যাম নিয়ে বলল “গেস কর”।
প্রিয়াঙ্কা খচে গেল “দূর বাল। অত চাপ নেবার কি আছে। বললে বল, নইলে ফোট”।
সায়ন ফিউজ হয়ে গিয়ে বলল “ইউফোরিয়া আর ফসিলস”।
৩.
৩ মার্চ, ২০০৮
-মার্কস এত কম কেন?
-স্যার ক্লাস করতাম না। বুঝতাম না অর্ধেক।
-ওহ। ঠিক আছে তুমি যেতে পার।
দুটো বাক্যে অনির্বাণের ইন্টারভিউ হয়ে গেল। চুপচাপ উঠে চলে এল। গত দুটো ইন্টারভিউতেও একই জিনিস হয়েছে। এই নিয়ে তৃতীয়বার। গ্রেড কম আছে সেটা তো ওরা জানে। সেই হিসেবে কাট অফ দেওয়া আছে। তার ওপরে নাম্বার পেয়ে অ্যাপ্টিচুড ক্লিয়ার করেই তো ইন্টারভিউতে এসছে।
বাইরে সবাই মগ্ন, কেউ পড়ছে, কেউ টেকনিক্যাল দিয়ে বেরিয়ে সবাইকে গল্প শোনাচ্ছে। তিন বছরের ক্লাসটা কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেছে। এতদিন সবাই একসাথে ছিল, এক সাথে ক্লাস বাঙ্ক করত, এবার ক্যাম্পাসিং হয়ে গেলেই সবাই আলাদা হয়ে যাবে। পরিষ্কার দুটো গ্রুপ তৈরি হবে, ১) যারা ক্যাম্পাসিংএ পেল ২)যারা পেল না।
শুধু এই দুঃস্বপ্নে সে ক্যাম্পাসিংয়ে বসে। সামান্যও যদি আশা থাকে চাকরি পাবার। হেরে যাবার দলে ঢুকতে তার বড় আপত্তি।
ক্লাস থেকে বেরতে তিন চারজন তার দিকে ছুটে এল। “কিরে, কি হল?”
“কি জিজ্ঞেস করল”?
বিভিন্ন রকম প্রশ্ন ছুটে আসছিল।
সে অ্যাভয়েড করতে চাইল ভিড়টাকে। বলল “আরে আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি, নাম্বার কম কেন বলে ছেড়ে দিল”।
হতাশ শরীরটাকে বেঞ্চিতে এলিয়ে দিল সে। টাইটা বেশ শক্ত হয়ে গলায় বসেছিল। খুলে ফেলল।
বাড়ি যেতে হলে তাকে এখনই বেরতে হবে। মেসে আর যাওয়া যাবে না এখন।
অনীক এল। এটাকে দেখলে গা জ্বলে তার। আরে তোর রেজাল্ট ভাল তো কি হয়েছে। লোকজনের প্রবলেম হলে এত খুশি হবার কি আছে!
তাকে দেখে দাঁত বের করে বলল “কিরে? কেমন হল?”
সে চুপচাপ বসে ফাইলপত্তর গোটাতে গোটাতে বলল “হয় নি। রেজাল্ট খারাপ বলে ভাগিয়ে দিয়েছে”।
-হে হে; যাঃ শালা, তাহলে তো ব্যাড ল্যাক রে শালা।
উঠল সে। বলল “আমি গেলাম। আর ঝাট জ্বালাস না”।
অনীক চুপ করে গেল। অনির্বাণ বেরিয়ে প্লেসমেন্ট অফিসারের ঘরের দিকে এগোল। সবাই চুপচাপ বসে আছে। সে সোজা প্লেসমেন্ট অফিসারের ঘর নক করল “স্যার আমি একটু আসব”।
ঘর ফাঁকাই ছিল। তাকে আসতে বললেন দে স্যার। সে ঢুকে বলল “স্যার, আমার তো হয়ে গেছে আমি বাড়ি চলে যাব?”
দে মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচের ফাক দিয়ে তার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। বললেন “যাবে মানে? এখন তো সবে সকাল দশটা? কি বলল তোমায়?”
-কিছুই তো। নম্বর কম কেন বলে ছেড়ে দিল।
-ওহ।
হেলান দিয়ে চেয়ারে বসলেন দে স্যার। বললেন “রিসেশনের সময় তো। এ তো হবেই। আগে নম্বর দেখবে।ঠিক আছে, বেটার লাক নেক্সট টাইম। তুমি কি তাহলে এখন...”
-হ্যাঁ স্যার, সেটাই তো বলছিলাম।
-ঠিক আছে। পরশু এক্স জেড টেকের টা আছে কিন্তু। এস।
নীরস গলায় হ্যাঁ বলে বেরল অনির্বাণ।
প্রথম যখন কলেজ এসছিল তখন র্যাগিংয়ের ভয় ছিল। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে সে ভয় কেটে যেতে ধীরে ধীরে ভালই লাগছিল কলেজটা। ক্লাস করতে চিরকালই বড়ই অনীহা তার। তাদের একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। সমর্পণ, অভ্রদিপ, শুভ্ররা তাকে ধীরে ধীরে কলেজটা ভাল লাগাচ্ছিল।
এই সময়টার পরে আবার সব আলাদা হয়ে যাবে। ফাইলপত্র নিয়ে ব্যাগসহ সে কলেজ থেকে বেরল। বাইরে চায়ের দোকানটা গমগম করছে। সব ছেলেপিলেই টাই পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিনে কলেজটা কেমন বড় হয়ে গেছে।
সে বেরনোর পর চায়ের দোকান থেকে দুয়েকজন ডাকছিল কিন্তু সে আমল দিল না। ভ্যানে উঠে বসল। এখন বেরলে দুপুরের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। সন্ধ্যে হলে আর বনগাঁ লাইনের রিস্ক নেওয়া যাবে না।
#
বাস যখন উল্টোডাঙা ঢুকছে তখন মোবাইলে দে স্যারের নম্বরটা দেখে খানিকটা চমকাল সে। ফোনটা ধরতেই উল্টো দিক থেকে উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল “এই অনির্বাণ তুমি কোথায়?”
-স্যার উল্টোডাঙা পৌঁছে গেছি।
-আরে তুমি শিগগির ব্যাক কর। তোমাদের আরেকবার টেকনিক্যাল হবে। ওদের প্যানেল রেডি ছিল না বলে তোমাদের ব্যাক করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখনই শুরু হয়েছে। আমি বলে রেখেছি। তুমি আধঘণ্টার মধ্যে যেভাবে পার চলে এস।
ফোনটা রাখার পর বুকের হৃদপিণ্ডের স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। আধ ঘণ্টার মধ্যে কলেজ মানে তাকে এখনই নেমে ট্যাক্সি নিতে হবে। কোনমতে নেমে চলন্ত ট্যাক্সিতে ওঠার চেষ্টা করার পর তৃতীয়বার উঠতে পারল সে। কলেজের নাম বলে মাথাটা যখন ট্যাক্সির সোফায় রাখল তখন স্পষ্টই বুঝতে পারছিল ঘামে গোটা শরীরটা ভিজে গেছে।
#
সন্ধ্যা সাতটা। সকাল থেকে খালি পেটে বসার পর অনির্বাণের ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকে দেখতে পেল ছোট ঘরটায় পাঁচজন বয়স্ক লোক বসে আছেন। আর সকালের সেই চ্যাংড়ামত ইন্টারভিউয়ার।
সে অনুমতি নিয়ে বসার পরে মেশিনগানের মত প্রশ্নবাণ ছুটে এল।
“write down first write down the 1st c program”
সে লিখল। একটু তাড়াতাড়িই লিখে ফেলল। সকালের ইন্টারভিউয়ার অবাক হয়ে বললেন “কম্পিউটার আগে এক্সিকিউট করবে না তুমি আগে লিখে ফেললে হে”।
লেখার সাথে সাথেই প্রোগ্রামটার কাঁটাছেড়া শুরু করলেন পাঁচজনে মিলে। একের পর এক প্রশ্নবান তাকে জর্জরিত করে তুলছিল। কিন্তু সে নড়ল না। সেটা পারবে না বুঝছিল সরাসরি বলে দিচ্ছিল “স্যার এটা আমি জানি না”।
প্রায় আধঘন্টা খানেক ধস্তাধস্তি হবার পরে তাকে ওনারা রেহাই দিলেন। সে ফাইলটা নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল হঠাৎই তার মাথায় একটা বেয়ারা প্রশ্ন এল। সে ঘুরে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা আমি কি একটা উত্তর পেতে পারি?”
সবাই অবাক চোখে তাকালেন তার দিকে। মধ্যমণি ভদ্রলোক বললেন “ইয়েস, ক্যারি অন প্লিজ”।
সে দৃঢ়স্বরেই বলল “স্যার অ্যাম আই থ্রু অর নট?”
সবাই হেসে উঠলেন। সকালের চ্যাংড়া ইন্টারভিউয়ার বললেন “আরে একটু ওয়েট কর, আমরা জানিয়ে দিচ্ছি এখনই”।
সে বেরল। বিরক্ত লাগছিল। কলেজে ফেরার পর থেকে অপেক্ষা করিয়ে করিয়ে প্রায় পচিয়ে দিচ্ছে। বলে দিলেই পারে নেবে না নেবে না।
প্যাসেজ ধরে খানিকটা হাঁটার পর কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেল। ঘুরতে চমকে গেল। সকালের ইন্টারভিউয়ার। তাকে দেখে হাসলেন।বললেন “তুমি এত অ্যাগ্রেসিভ কেন?”
অনির্বাণ কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল “স্যার সকাল থেকে কিছু খাই নি, খালি পেটে আছি, তাই অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছি”।
হেসে ফেললেন। বললেন “তুমি থ্রু। এরপরে একটা এইচ আর ইন্টারভিউ আছে। ওটায় বেশি প্রশ্ন হবে না। ধরে নাও ইউ আর জয়েনিং আস”।
কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না অনির্বাণের। এ বলে কি? সকালে জানত আর কোন কিছু হলেও এ চাকরিটা অন্তত তার হবে না। আর এখন এত বড় একটা কথা কি অনায়াসে বলে দিলেন। বাইরেটা অন্ধকারে কালো হতে হতে কালশিটে পরে গেছে। তার মনে হচ্ছিল চেঁচিয়ে সবাইকে জানায় সে চাকরি পেয়ে গেছে।
“থ্যাঙ্ক ইউ” বলতে ভদ্রলোক তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন “আর হ্যাঁ, তুমি এখন ঠিক যেরকম অ্যাগ্রেসিভ, আমরা কিন্তু এই আগুনটাই চাই। এটা রেখ... কাজে দেবে”।
মাথা কাজ করছিল না। সে অবস্থাতেই “হ্যাঁ” বলল সে। ইচ্ছা করছিল লাফাতে, হাসতে কাঁদতে, কিন্তু কোনটাই করতে পারছিল না।
আধা অন্ধকার কলেজ প্যাসেজ সাক্ষী হয়ে রইল তার জীবনের প্রথম চাকরি পাবার।
৪.
১০ই মার্চ ২০০৮
।।অরিত্র।।
এই সায়নের সাথে এসে ফেঁসে গেলাম তো! কলেজ কেটে বেরলাম বলল সিনেমা দেখতে যাবে এখন দেখি দাড়িওয়ালা বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিয়ে এসছে। নন্দীগ্রামের একবছর নিয়ে কিসব প্রোগ্রাম টোগ্রাম হবে। ইদানীং সায়নের এইসব ব্যাপারে বেশ বাড় বাড়ন্ত হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। ক্লাস তো ঠিকঠাক করছেই না উলটে যখন তখন কলেজ কেটে এইসব কাজ করছে। আমার এখন বেশ রাগ হচ্ছে। এইসবের কোন মানে হয়! ভরদুপুরে দাড়ি দুলিয়ে কি জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে মাইরি লোকটা। এ মালটাকে জীবনেও দেখি নি। টিভিতে নামও শুনিনি। কিন্তু সায়ন এমন মনোযোগ দিয়ে লোকটার বক্তব্য শুনছে ওই মনোযোগটা ক্লাসে দিলে লাস্ট সেমে দুটো সাপ্লি পেত না।
“তোমরা শাসকের রূপ দেখনি। শাসক মানে কি? প্রথমে বুঝতে হবে এই শাসক কোথা থেকে এল? মার্ক্স কি বলেছেন শাসকের ব্যাপারে”।
সেরেছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে যে। কি ঝাট কেস। এখান থেকে উঠে পড়তে পারলে বাঁচি। গোলপার্কের কাছে এই কফিশপটা খারাপ না। প্রেম করলে গার্লফেন্ডকে নিয়ে আসার পক্ষে আদর্শ। তাও যদি এই গ্রুপে দু চারটে ডবকা পিস থাকত। দুটো মেয়ে আছে। একটাকে দেখে মনে হচ্ছে চারদিন পায়খানা হচ্ছে না। আরেকটাকে কুড়িটা বাঘ মিলেও শেষ করতে পারবে না শালা এত মোটা।
“তোমাদের পরশু দিন রাস্তা দখল করতে হবে, কলকাতা দখল করতে হবে, ভুলো না, কলকাতা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে”।
একটা ছেলে দুর্বল গলায় প্রশ্ন করল “আমরা তো এই ক’জন, এ’কজনে কি হবে?”
বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকালেন বুদ্ধিজীবী। বললেন “তার চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। আমাদের সংগঠনের সবাই আসবে। শুধু তোমাদের মধ্যে আগুনটাকে রাখ”।
বেশ একটা চকলেট চকলেট গন্ধ আসছে। অনেকেই কিছু না কিছু খাচ্ছে। আমার খিদে খিদে পাচ্ছে। তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে এসছি, দুপুরে ক্যান্টিনেও খাওয়া হয় নি। তাছাড়া এক গ্লাস কোল্ড কফি খেলে মন্দ হত না। একা একা খাওয়াটা কি ঠিক হবে?আবার এতগুলো গাম্বাটকে খাওয়াতে যাবই বা কোন দুঃখে?
বেরলাম। অনেকক্ষণ ভাট শুনেছি। কিছু খাওয়া দরকার। সায়নটা বসে থাক। আমাকে তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি সারাদিন এখানেই বসে থাকতে হবে। রাতে হোস্টেলে হুল্লাট পার্টি আছে। সিনিয়র গুলো সব চাকরি পেয়েছে।হোস্টেলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে মেসে ফিরব নাকি হোস্টেলেই থেকে যাব এখনও ডিসিশন নিই নি। মাল থাকবে, পুরিয়া থাকবে...আহ। ভাবতেই চরম লাগছে।
কলকাতা কলেজে ভর্তি হবার আগে আসতাম কিন্তু এখন অনেক কাছের মনে হয়। আর গোলপার্কের এই জায়গাটাও দারুণ লাগে। এখানে হাঁটতে ভাল লাগে। তার থেকেও বড় কথা এখানে যে লেভেলের মেয়ে আসে জাস্ট ভাবা যায় না।
কলকাতার এই একটা জিনিস আছে। বাসে ট্রামে মেট্রোতে প্রচুর মেয়ে দেখতে পাওয়া যাবে। “আমাদেরও নাকি হবে, কে জানে বাবা কবে”...।
রুমালি রুটি আর মাংস দিয়ে চুপচাপ দুপুরের খানাটা সেরে নিলাম। যা বুঝছি ওই ঝাট মালটা আর ঝাট সায়নটা অনেকক্ষণ এসব করে যাবে। সেরকম হলে কেটে পড়তে হবে। এখন দুপুর দুটো প্রায়। বিকেল থেকেই হোস্টেলে পৌঁছে যেতে হবে। কে জানে হয়ত এখনই শুরু হয়ে যেতে পারে।
পরের বছর আমাদের ক্যাম্পাসিং আছে। জানি না কি হবে। কখন যে রিসেশন আসছে কখন যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। যা হবে দেখা যাবে। অত চাপ নিয়ে কি হবে।
#
প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। এবার দেখি। সায়নকে বলে কেটে যাই। উফ। ঝাটটা এখনও বকে যাচ্ছে। এখনও শাসক প্রশাসক নগরপাল নিয়ে কালচার চলছে। শালা কোন কাজ নেই নিশ্চয়ই।
সায়নকে একটা খোঁচা মারলাম। ব্যাটা হিপনোটাইজের মত হয়ে গেছে। “কিরে, চল”।
“দাঁড়া না” বিরক্ত মুখে উত্তর দিল সায়ন।
আচ্ছা হল তো। আর এই কফির দোকানটার লোকজনগুলিই বা কিরকম। এক পয়সাও কেউ কিনছে না, চেয়ার টেবিলগুলো দখল করে বসে আছে। তুলে দিতে পারে তো। তবে এই মালগুলির যে এনথু দেখছি। তুলে দিলে মনে হয় জঙ্গলে বসেও এইসব ভাটবাজি করে যাবে।
কি হল? চারদিকটা এরকম শান্ত লাগছে কেন? মনে হচ্ছে একটা ঝড় আসব আসব করছে?
যাহ্, শালা এটা কে এল? কি দেখতে উফ পাগল হয়ে যাব তো! পিঠখোলা চুল, কাঁচা সোনার মত গায়ের রং আরও কত ভাল ভাল জিনিস, বলে বোঝাতে পারব না। বুদ্ধিজীবীটার পাশে গম্ভীর মুখে বসে পড়ল। আর হাসিটা কি রে! এরকম জিনিস থাকলে আমি সারাদিন ওই দাড়িটার ভাট শুনে যেতে রাজি আছি। বাইরের লোকজনও সবাই মেয়েটাকেই দেখছে। একটা সাধারন সালোয়ার কামিজেও কেমন অসাধারন লাগছে। অন্য গ্রহের জীবটাইপ।
#
বিকেল পাঁচটা। আমি এখনও এখানেই আছি। সায়নের থেকে নাম জানলাম মেয়েটার। বিরাট বড় নাম। বানান করতে কলম ভেঙে যাবে। পলাশমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সায়নের কানে কানে বললাম “ভাই তুই কি এই মালটার জন্য এখানে আসিস? ঠিক করে বল”।
সায়ন খিস্তি মারল একটা “দূর... ভাট বকিস না”।
“ভাট শালা, সকাল থেকে ভাটের গুষ্ঠির তুস্টি করলি। এই বাড়া, এই বালের জায়গায় আমাকে আনতে গেছিস কেন? আর যদি আনবিই তবে ওই মেয়েটাকে ডাক, কথা বলি, নাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে আজকে”।
সায়ন চমকে তাকাল। বলল “কি শুরু করলি? ১৪তারিখ মিটিং আছে, সেদিন চলে আসিস, মিছিলের সময় হাতে হাত ধরে মানববন্ধন করে নিস না হয়”।
আমি ওকে একটা রাম চিমটি কেটে বললাম “এখানেই কেলানো শুরু করব তোকে এবার”।
চিমটিটা খেয়ে সায়ন ডুকরে কেঁদে উঠল “এই পলাশমিতা” বলে। ডাকার সময় ওর গলাটা কেমন ন্যাকা ন্যাকা হয়ে গেল।
মেয়েটা এদিকে আসতে সায়ন পরিচয় করাল আমার সাথে “অরিত্র, একে আনলাম আজ, নতুন অ্যাক্টিভিস্ট আমাদের সাথে জয়েন করল আজ”।
মেয়েটা হাসল। আহা কি হাসি।আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। বেশ স্মার্ট ভাবে হ্যান্ড শেক করল। নরম হাত। একবারে তুলোর মত।
বলল “আপনি তাহলে আসছেন তো আমাদের সাথে মিছিলে?”
আমি দাঁত বার করলাম। আর কি বলব। আসব মানে? তুমি যেখানে আমি সেখানে। প্রয়োজনে জাহান্নামেও চলে যাব। “আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল বাড়া”...
৫.
২৪ মার্চ, ২০০৮
।।পার্বণী।।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছিলাম আমি আর প্রিয়াঙ্কা। অ্যাসাইনমেন্ট আছে এক টা টি কে এমের। হঠাৎই লাইব্রেরীর সামনেটা কৃশানুদা আটকাল। কৃশানুদা আমাদের এলাকার ছেলে। প্রথম যখন কলেজে এসছিলাম অনেক হেল্প করেছিল। আমার এক বছর সিনিয়র।
ভাবলাম কোন টিউশনের কথা বলবে হয়ত। প্রিয়াঙ্কা চলে গেল লাইব্রেরীতে। কৃশানুদা প্রিয়াঙ্কা যেতেই আমাকে বলল “দেখ পার্বণী, তোকে একটা কথা বলি”।
আমি বললাম “বল”।
-দেখ, বেশি বানাতে আমার ভাল লাগে না, তোকে একটা কথা বলেই দি, আমার তোকে ভাল লাগে।আগে বলতে পারিনি, ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসিংয়ের পর বলব, এখন অনেকটা স্ট্রেস ফ্রি আমি। বলেই দি, আই লাভ ইউ।
হঠাৎ এরকম আচমকা কথায় খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কি বলব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কৃশানুদা অনেকটা হেল্প করেছে জয়েনিংএর পরে, নোটস দিয়েছে, ড্রয়িং দিয়েছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু ওকে তো আমি কোনদিন কল্পনাই করতে পারিনি এসবে।
কি বলব বুঝতে না পেরে বলে ফেললাম “আমি যাই আমার কাজ আছে”।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কৃশানুদা আমায় ফলো করে লাইব্রেরী অবধি চলে এল “তোর অ্যানসারটা দিয়ে যা, মানে ওয়াট ডু ইউ থিঙ্ক অ্যাবাউট মি। দ্যাখ, আমি কিন্তু মদ খাই না, সিগারেট খাই না, কোন বাজে নেশা নেই। তাছাড়া তুই তো আমাকে দেখছিস দুবছর ধরে। তোর কি মনে হয়?”
আমি কি করব, ঝাঁট জ্বলছে, এদিকে বলতেও পারছি না। ইচ্ছা হচ্ছে ভাল মতন খিস্তি মারি। কিন্তু সেটা না করাই ভাল, প্রচুর হেল্প টেল্প করেছে আমায়। বললাম “আমি ভেবে বলি?”
মুখটা একটু উজ্জ্বল হল “কবে জানাবি? আজ রাতে ফোন করি?”
আমি চমকে বললাম “না না, এত বড় ডিশিসান, সাত আটদিন তো লাগবেই”।
-সাত আটদিন? মুখটা বড় হয়ে গেল। তারপর বলল “ওকে ডান, টেক ইউর টাইম। বাট আই অ্যাম এক্সপেক্টিং, ভুলিস না”।
এক্সপেক্টিং! কি জ্বালা, একী বাচ্চা কাচ্চা হবে নাকি।
কোনমতে কাটিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকলাম। এটাই বাঁচোয়া লাইব্রেরীতে পেছন পেছন এল না। প্রিয়াঙ্কা টুকছিল বই থেকে। আমি যেতে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল “কিরে কি বলছে? প্রপোজ করল নাকি?”
আমি অবাক হলাম “তুই কি করে জানলি?”
প্রিয়াঙ্কা খানিকটা ঘ্যাম নিল “হু হু বাওয়া, এক্সপেরিয়েন্সড মাল। আলাদা করে ডেকে নিয়ে কি পাড়ার শনিপুজোয় নেমন্তন্ন করবে তোকে?”
আমি বললাম “হ্যাঁ, সেই। কি করা যায় বলত?”
প্রিয়াঙ্কা বলল “কি বলল সেটা বল আগে”।
আমি বললাম সবই। প্রিয়াঙ্কা হাসতে হাসতে বলল “আমি জানতাম অবশ্য কেসটা এরকম একটা আছে”।
আবার অবাক হলাম “কি করে জানতি?”
-প্রায়ই আমার কাছ থেকে তোর ব্যাপারে জানতে চায়। এসছিস কিনা এটসেট্রা। আমাকে একবার বলেওছিল তোকে বলার জন্য আমি সিমপ্লি ডিনাই করে দিয়েছিলাম।
রাগ হল একটু। “সেটা আগে বলতে পারতি না?”
-আগে বলে কি হত?
-তাহলে আজ একটু প্রিপেয়ার হয়ে না বলে দিতে পারতাম। আমি তো আবার সাতদিন সময় চেয়েছি। ব্যাপারটা ঝুলে থাকল তো!
-ও হো হো। তারমানে ইচ্ছা তোমারও আছে।
বিরক্ত হলাম “দূর বাল। ওইটাকে ভাল লাগার কি আছে? হরলিক্সের কাঁচের মত চশমা। সব সময় পড়াশুনা। অত স্টুডিয়াস দিয়ে কি করব আমি?”
প্রিয়াঙ্কা নাকের নীচে চশমা নামাল “ওয়ে হোয়ে, তা কাকে চাই বস? টম ক্রুজ না ঋত্বিক রোশন? রেস দেখলি? এই শুক্রবার বেরিয়েছে”।
আমি বললাম “হচ্ছিল একটা কথা, এর মধ্যে রেস এল কোত্থেকে?”
-অর্ণব আর আমি যাব বলে। তুইও যা। ওই হরলিক্স বয়কে নিয়ে।
এবার রাগলাম খানিকটা “দ্যাখ, এই ফালতু ব্যাপারটা আমি ঘাড় থেকে নামাতে চাইছি, এটা নিয়ে আমাকে একদম টোন করবি না”।
-ওকে ওকে বাবা! ঠিক আছে। তাহলে তুইই বল তোর কাকে পছন্দ?
অনির্বাণদা ঢুকল লাইব্রেরীতে।না চাইতেও আমার চোখটা ওদিকেই চলে গেল। ও কি কোনদিন বুঝবে না আমার ওকে কতটা ভাল লাগে? এদিকেই আসছে। আমাদের টেবিলেই বসবে নাকি?
“কিরে”।
প্রিয়াঙ্কা ঠেলা দিল একটা।
বললাম “কি বলছিস?”
“বলছি কাকে পছন্দ? কোন ক্রাশ টাশ আছে নাকি?”
ইয়েস! অনির্বাণ আমাদের টেবিলেই বসেছে।আমার সামনা সামনিই বসেছে। এই পিঙ্ক কালারের সার্টটাতে যা লাগছে না। কিন্তু ভীষণ ক্যালানে। আমি যে দেখছি, একবার তাকা অ্যাটলিস্ট!
কি রকম যেন! দূর!
নাহ, কিছু একটা করতে হবে, আমি ওকে ডাকলাম “এক্সকিউজ মি, ওই বইটা একটু দেবে”?
প্রিয়াঙ্কা অবাক হল একটু। কিন্তু কিছু বলল না। আমাকে পা দিয়ে একটা ঠেলা দিল। আমি চুপচাপ থাকলাম।
অনির্বাণদা আমার দিকে তাকাল হকচকিয়ে “হ্যাঁ? আমাকে ডাকছ?”
আমি মিষ্টি করে হাসলাম “হ্যাঁ, তোমার ওই হাতের কাছের বইটা একটু দেবে?”
ও একটা বই হাতে নিল। ফিসফিস করে বলল “এইটা?”
আমি বললাম “হ্যাঁ”।
ও ঠেলে দিল বইটা। আবার পড়ায় মনোযোগী হয়ে গেল। ধুস। কিচ্ছু হবে না এর।
প্রিয়াঙ্কা কানে কানে বলল “এই কি টম ক্রুজ রে? জানতাম না তো বস!!!”
আমি দাঁতে দাঁত চিপে উত্তর দিলাম “কাউকে বললে ওটা কেটে হাতে দিয়ে দেব শালা”।
৬.
৩০ মার্চ ২০০৮
বেশ কিছুদিন থেকে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসছে বুঝতে পারছে অনির্বাণ কিন্তু সেটা যে কে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রথমত নম্বরটা একেবারেই পরিচিত না। দ্বিতীয়ত এমন সময়ে ফোনগুলি আসছে যে সময়টা সে হয় কলেজ লাইব্রেরীতে থাকছে নয়ত রাতে ঘুমাচ্ছে। সাইলেন্ট থাকার দরুন বোঝা যাচ্ছে না কে ফোন করেছে, পরে দেখছে সেই নম্বর।
কল ব্যাক করলে ফোন ধরছে না। সে একটু ল্যাদ খাওয়া টাইপ পাবলিক। বেশি চাপ নেয় না কোন ব্যাপারে। কিন্তু এই মিসড কল তাকে রীতিমত তিতিবিরক্ত করে তুলছে।
এই রোববারে বাড়ি যায় নি আর। মেসে তার সাথে তার এক বছর জুনিয়র অরিত্র আছে। অরিত্র বাড়ি যাচ্ছে না কেন সে জানে না। জিজ্ঞেস করেছিল বলল কাজ আছে। আজকাল ওকে দেখে অবাক লাগছে তার। একসময় বাড়ি যাবার জন্য লাফালাফি করত আর এখন বাড়ি যাবার নাম করে না।
অনেকদিন পরে কবিতার খাতাটা নিয়ে বসেছিল কিন্তু কিছুই আসছেনা সেরকম। গভীরতাহীন কতগুলি লাইন তৈরি হচ্ছে। একটা লাইন আসছে যাচ্ছে
“একটা মানুষ সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে”
কিন্তু তার পরেরটা কোনভাবেই আসছে না। সে বুঝতে পারছে না এই মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এই লাইনটাই কেন আসছে। গত মাসে একটা কবিতা পড়েছিল সুনীল গাঙ্গুলির সেটা থেকেই কি ভাঙছে লাইনটা। মাঝখান থেকে গোটা খাতাটা কাটাকুটিতে ভরে গেল।
সুনীলের বইটা খুলল। কবিতাটা বেশ লাগল
“ আমলকী গাছে ঠেস দিয়ে আছে শীত
উড়ে গেল তিনটে প্রজাপতি
একটি কিশোরী তার করমচা রঙের হাত মেলে দিল
বিকেলের দিকে
সূর্য খুশি হয়ে উঠলেন, তাঁর পুনরায় যুবা হতে সাধ হল”।
তাদের মেসের এলাকাটা বেশ শান্ত। গরম পড়ব পড়ব বলে এখনও পড়ে নি। খোলা জানলা দিয়ে একটা উজ্জ্বল দিনের সাথে এই কবিতাটা বেশ যাচ্ছিল।
সে আবার একটু লেখার চেষ্টা করল
“মানুষটা কি জানে সে আসলে হারিয়ে গেছে,
হারিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন, সভ্যতার ভিড়ে
সভ্য মানুষ লম্বা আকচি দিয়ে তাকে টেনে টেনে ধরে”।
আকচি শব্দটা কেমন শোনাচ্ছে। সে আবার কেটে দিল। অরিত্র নক করল।
অনির্বাণ বিরক্ত হল “কি হল?”
অরিত্র বলল “আমি একটু বেরচ্ছি”।
-কোথায় যাবি?
-একটা মিটিং আছে।
অবাক হল একটু অনির্বাণ। “কিসের মিটিং?”
-কৃষকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে।
নড়ে চড়ে বসল সে। “সেকি রে? তুই আবার এসব কবে থেকে?”
দাঁত বের করল অরিত্র। “ওই একটু আর কি?”
চাপ খেয়ে গেল সে। অরিত্র আজকাল হঠাৎ এই লাইনে সে তো কল্পনাও করতে পারছে না। বলল “যা। আর কি যে করছিস, এসব না করে পড়াশুনা করতে পারতিস। যা পারিস কর, যাঃ আর বাইরের গেট বন্ধ করে দিয়ে যাস”।
অরিত্র বেরতে মনে পড়ল, অনেকদিন আগে, প্রায় দুতিন বছর আগে অর্কুটে একটা মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছিল। বেশ কথা বলত। ভাল ভাল কবিতা বলত। সেই মেয়েটা তাকে কবিতা লিখতে ভীষণভাবে ইন্সপায়ার করত। তার আগে কবিতার সাথে তার সেরকম ভালবাসা ছিল না। মেয়েটার সাথে কথা বলতে ভাল লাগত কিন্তু হঠাৎ করে একদিন মেয়েটা প্রোফাইল ডিলিট করে দিল। কেন করল, সে জানে না। কিন্তু আর খুঁজে পায় নি।ইয়াহু মেসেঞ্জারেও পায়নি।
একদিন প্রোফাইল খুলে দেখল মেয়েটার পোস্টগুলি সব no name দেখাচ্ছে। কি হয়েছিল সে এখনও জানে না। তবে মেয়েটা এই ধরনের বৈপ্লবিক কথাবার্তা বলত। কৃষকের বিরুদ্ধে নাকি সবাই উঠে পড়ে লেগেছে ইত্যাদি।কোনদিন না দেখা মেয়েটার প্রতি একটা নরম জায়গা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, তারপরেই হারিয়ে গেল সব কিছু।
মোবাইলটা আবার বেজে উঠে চুপ করে গেল। আবার সেই আননোন নম্বর।
সে ঠিক করল এবার সে কলব্যাক করে যাবে। যতক্ষণ না ধরে কথা বলে ততক্ষণ করে যাবে।
পাঁচ ছ’বার পুরো রিং হয়ে কেটে যাবার পর ফোন ধরল, একটা মেয়ের গলা “হ্যালো”।
সে ঝাঁঝাল গলাতেই বলল “কি হয়েছে, শুধু মিসড কল মারছেন কেন?কোন কাজ নেই নাকি?”
-সরি।
-কে আপনি?
-চিনবে না।
-না চিনলে মিসড কল মারছেন কেন?
-ইচ্ছা হল।
-দূর। কাজ নেই কোন।
ফোনটা কেটে দিল অনির্বাণ। নির্ঘাত ইলোরারা ইয়ার্কি মারছে। এই হোস্টেলের মেয়েগুলি রোববার হলেই জ্বালাতন শুরু করে। তবে এই জ্বালাতনটা বেশ প্ল্যান প্রোগ্রাম করে চলছে বোঝা যাচ্ছে।
সে মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিল।
জীবনানন্দ খুলে বসল সে। আজ আর লেখা হবে না...
“ তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত এসে
কহিবে: তোমারে চাই-তোমারেই, নারী;
এই সব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি
চলে যেতে হবে দূর আবিষ্কারে ভেসে “।
৭.
৩০শে মার্চ ২০০৮
।।অরিত্র।।
অনির্বাণদা মাঝে মাঝে এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করে! কেন আমি কি মিটিঙে যেতে পারি না। অদ্ভুত ব্যাপার। অবশ্য আমি যে মিটিঙে যেতে পারি সেটা আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না পলাশমিতা না থাকলে।
মেয়েটা চাপের। প্রচুর পড়াশুনা করে, প্রচুর গান শোনে। আমি শালা কলেজ আসার আগে এত নাম জানতাম না। চিরকাল হিন্দি আর খুব বেশি হলে বাংলা ব্যান্ড। ইংলিশ গান বলতে দুটো গান জানি।
১) উই শ্যাল ওভারকাম
২) টাইটানিকের এভ্রি নাইট ইন মাই ড্রিম।
আর সে মেয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে বসছে কি সব নাম। এখন আমার কাজ হয়েছে কলেজের ছেলেগুলির থেকে গান কালেকশন করা আর সকাল বিকেল সেগুলি শোনা। কৃষকের কান্নাটান্না তাও বোঝা যায় কিন্তু এর মধ্যে পিঙ্ক ফ্লয়েড ঢুকলে বড় বিপদ।
কিন্তু হয় না। এছাড়াও অনেক হার্ডল আছে। দীপদা প্রেসির সিনিয়র। সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে ওর চারপাশে থাকে। না পারি কিছু বলতে না ওকে দেয় কিছু বলতে। পার্থদা। জে ইউর ফিজিক্সের পি এইচ ডির স্টুডেন্ট। সারাক্ষণ একসাথে।
আর অর্কুটে তো আমার সাথে তেনার কথাই হচ্ছে না। আমি “hi” লিখে হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। শেষে ঘুমিয়ে পড়ে সকালে উঠে হঠাৎ দেখি রিপ্লাই দিয়েছে। পাততাড়ি গোটানোর সময় আসন্ন মনে হচ্ছিল কিন্তু কাল রাত একটা নাগাদ যখন একটা চরম পানু দেখে বাথরুম থেকে ফিরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি হঠাৎ দেখি ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। ফোন করেছে।
আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে সেই মধুর গলা “কে অরিত্র?”
মনে মনে বললাম না অরিত্রর বাপ মুখে মধুর স্বরে উত্তর দিলাম “হ্যাঁ বলছি”।
“কাল একবার নন্দনে আসতে পারবি?”
মনে পড়ে গেল কাল খেলা ছিল কলেজে একটা কিন্তু তোমার জন্য জান হাজির দিলরুবা। বললাম “হ্যাঁ সিওর, কটায়?”
-এই সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ।
-কেন?
-আয় না।
-ইয়ে মানে সায়নকে বলব?
-না, শুধু তুই আয়। রাখছি।
যাহ্ শালা। আমাকে একা ডেকেছে, তাও নন্দনে। তারমানে কি আমায় পছন্দ নাকি।
কাল রাতে ঘুম হয় নি। গোলপার্কের পর দেখা হয়েছিল কলকাতার রাজপথে। পুলিশ কিছু বলেনি। আমরা কুড়ি পচিশজন মিছিল টিছিল করে চেঁচিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি চলে এসছিলাম। তারপরে দুয়েকবার মিটিং হয়েছে। আর সেই সময়েই এতরকম আলোচনা গান, লিটারেচর নিয়ে আমার মনে হয় অন্য গ্রহে বেড়াতে এসছি। সায়ন মালটা ভাব দেখায় যেন কতকিছু জানে। আগেরদিন অনেকক্ষণ সলমন রুশদি নিয়ে আলোচনা হল। সায়ন কি সুন্দর মাথাটাথা নাড়িয়ে চলে এল। বাইরে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম “তুই তো বহুত জানিস বে”।
সায়ন বলে “দূর বাল, কে জানে, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এখন ওসব পড়ব। না জানলে জানার ভান করবি, মাথা নাড়বি... হয়ে যাবে। এইসব করে কি হবে, সংগঠন দেখতে হবে বুঝলি?”
সায়ন বুঝেছে আমার উইকনেসটা। প্রায়ই দেখি আজকাল ঘ্যাম নিচ্ছে। ওকে হাতে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু যদি বুঝি এই কেসটা ডাস্টবিন কেস, তবে মালটার থেকে সব সুদে আসলে উসুল করে নেব।
রোববারের কলকাতার একটা অন্যরকম মজা আছে। বাকি ছ’টা দিন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ আর রোববারটা হল গে কলকাতা লীগে ভবানীপুর কালীঘাট। ঢিকির ঢিকির করে বাস চলছে। দুয়েকটা লোক উঠেছে। সবাই ব্যাজার মুখ। নিশ্চয়ই পেছনমারা গেছে এগুলোর। সামনের দিকে একটা মাল আছে বটে কিন্তু আজকাল ঝাড়িটা কমিয়েছি খানিকটা। আসলে বাঘ শিকারে বেরলে যদি ঘুঘু সামনে পায় অনেকেই ছেড়ে দেয়। আমার হয়েছে সে অবস্থা।
মেস থেকে যখন বেরলাম তখন মনে হল কাঁধে একটা অদৃশ্য বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছি।মাথায় চোঙা টুপি।
#
জয় গুরু একাই আসছে। প্রায় আধঘণ্টা দাঁড় করিয়ে এবং তিনবার আমার ফোন ধরে “এখনই আসছি” বলার পর এলেন তিনি। একা আসতে দেখে আমার লাফাতে ইচ্ছা করছিল। একটা জামা আর প্যান্ট টাইপ পড়ে এসছে। বগলের কাছে, নাকের নীচে বিন্দু বিন্দু ঘামে ঘ্যামা লাগছে মাইরি। আমাকে দেখে হাসল “সরি রে, অনেকক্ষণ এসছিস”?
আমার এতক্ষণ ঝাঁট জ্বললেও এখন মনে হচ্ছিল পাশ থেকে কেউ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে জোরে জোরে। কি আর বলব। দাঁত বের করলাম “না ঠিক আছে”।
-চল কোথাও গিয়ে বসি একটা।
বসবে বলছে। যা তা তো।
বুকের ভেতরের যন্তরটার শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। ইতি উতি অনেক প্রেমিক প্রেমিকা বসে আছে। আর সবার চোখই পলাশমিতার দিকে। আমি আলেকজান্ডারের মত একটা বেঞ্চি খুঁজে বার করলাম।
বসতেই পলাশমিতা আমার ডান হাতটা ধরে বলল “একটা কাজ করে দিতে হবে বস”।
কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আজ? হয় আয়না, নয় অনির্বাণদা। চাকরি পাবার পর থেকে অনির্বাণদা লাকি হয়ে গেছে। জয় গুরু। এরপর থেকে রোজ অনির্বাণদার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠব। মনে মনে বললাম কাজ, বল তো জান দিয়ে দেব। শুধু বলে দেখ একবার।
মুখে বললাম “হ্যাঁ নিশ্চয়ই বল”।
পলাশমিতা মুখটা করুণ করল। “দেখ আমার বাড়ি আসানসোলের এক গ্রামে। কুলটির ওদিকটা। আমার বোন বাড়ি গেছে।ও এখানেই পড়ে। প্রেসিতে। কিন্তু আসতে পারছে না। আমার বাবা খুব অসুস্থ। আর তুই তো জানিসই এদিকে সংগঠনের কাজে আমি কতটা বিজি থাকি। তুই যদি একটু নিয়ে আসিস তবে ভাল হয়। আমি অন্যদের বলতে পারতাম, কিন্তু ভরসা হল না। পারবি?”
শালা বলে কি। রাজকন্যের সাথে আরেক রাজকন্যে ফ্রি তো। একই গোডাউন যখন তখন প্রোডাক্ট তো সেম হবেই। জয়গুরু।
মনে চরম ফুর্তি হলেও মুখে টোটাল ঘ্যাম নিয়ে বরাভয় দিয়ে বললাম “হ্যাঁ শুধু কবে যেতে হবে বল”।
-কাল।
কাল তো টি কে এমের একটা ক্লাস টেস্ট আছে। দূর... ওরকম কত ক্লাস টেস্ট কাটালাম আর অত হুদো হুদো অত মালগুলিকে কাটিয়ে আমাকে যখন দায়িত্ব দিচ্ছে তারমানে ভেতরে একটা ইয়ে তৈরি হচ্ছে।
জিও কাকা...
৮.
অরিত্রর ডায়েরী
১লা এপ্রিল, ২০০৮
কালকের দিনটা ভীষণ চাপের গেল। আর এরকম মুরগি আমি এজন্মে হই নি। আসানসোল স্টেশনে আসার কথা ছিল পলাশমিতার বোনের। এল যখন আমি তো দেখে থ! এ কে রে! পলাশমিতা যদি উত্তরমেরু হয় এ মঙ্গলগ্রহের দক্ষিণমেরু।লম্বা, কালো, আর পেটানো চেহারা। পুরো ছেলেদের মত। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা। নাম অশ্রুমিতা। ওই পেছনে মিতাটা বাদ দিলে কোনকিছুই এক না। একটা ভারী ব্যাগ নিয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে আমি নিতে গিয়ে দেখি ব্যাগের ভারে আমিই পড়ে যাব। নিয়ে যখন ফেলেছি আর শালী কবুল করে ফেলেছি কষ্ট করে সেটাই নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে ধর্মতলার বাস ধরলাম।
কথা টথা কিছুই বলে না। আমি চুপচাপ মোবাইলে খেলতে লাগলাম। পলাশমিতাকে ফোন করলাম কিন্তু ধরল না, কি অদ্ভুত মেয়ে। তোর বোনকে আনতে যাচ্ছি অ্যাটলিস্ট ফোনটাতো ধর!
দুর্গাপুর এলে বলল “আমি একটু টয়লেটে যাচ্ছি”।
আমি তো কিছুই চিনি না। বললাম “চেনো তো কোথায়?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে চলে গেল। আমি ভাবছিলাম এ তো যা ফিগার আর হাঁটাচলা আমাকে আনার কি দরকার ছিল রে বাবা। এতো একাই একশোটা ছেলেকে শুইয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখে একটা দেওয়ালে ছোটকাজ করে একটা পেপার কিনে যখন ফিরলাম তখন এসে গিয়েছে সে। আমি চুপচাপ বসে পেপারটা খুললাম যখন দুম করে বলে বসল “এই সব প্রতিক্রিয়াশীলদের কাগজ পড় নাকি?”
আমি তো থ! গাড় মেরেছে। প্রতিক্রিয়াশীল আবার কি। এই কাগজ তো ছোটবেলা থেকে বাড়িতে দেখে আসছি। আমার বাবা অফিস থেকে ফিরে লুঙ্গি বাগিয়ে চা খেতে খেতে এই কাগজ পড়ে।মা দুপুরবেলা পড়ে। ছোটবেলা থেকে আমি পড়ে আসছি। এটা আবার প্রতিক্রিয়াশীলদের কাগজ হল কবে। আর যদি হয়েও থাকে আমরাও তবে প্রতিক্রিয়াশীল। আমার বাবা বনগাঁ লোকাল ধরে ঘেমে নেয়ে ছেলের জন্য পি এফ লোন তুলে আমাকে পড়াচ্ছে মা সেলাই টেলাই করে দু পয়সা সংসারে দেয় তাহলে ওরাও প্রতিক্রিয়াশীল। যারা বিক্রিয়া করার জন্য সব সময় বসে থাকে তারা বিক্রিয়া শীল। আর যারা প্রতিক্রিয়া দেবার জন্য বসে থাকে তারা প্রতিক্রিয়াশীল?
কি ভুলভাল মাইরি। আমি আর কিছু বললাম না, দাঁত কেলিয়ে বললাম “আর কিছু ছিল না তো, এটাই ছিল”।
মুখটা সিরিয়াস করে বলল “তাহলে পোর না”।
বাপস। আমি আর চাপ না নিয়ে কাগজটা বগলে নিয়ে ঘুমনোর ভান করলাম। বাসে প্রচুর লোক, কিন্তু কেউ দাঁড়িয়ে নেই এটাই যা রক্ষে। মেয়েটা কেমন যেন, পলাশমিতার পাশে থাকলে ওর গা দিয়ে কেমন একটা জ্যোতি বেরোয়। পারফিউমের গন্ধ আর তার সাথে ওর কথাটথা। আর এটাকে মনে হচ্ছে কিরকম যেন একটা, জঙ্গি জঙ্গি ভাব। যখন তখন কামড়ে দিতে পারে।
শক্তিগড়ে দাঁড়াতে ল্যাংচা খেলাম। এখানকার ল্যাংচা নাকি বিখ্যাত। অশ্রুমিতা ঝালমুড়ি খেল। মনে মনে বললাম তোর জন্য ওই ঝাল জিনিসই ঠিক আছে।
অনেকদিন পর মনে হচ্ছিল ক্লাস টেস্টটা দিয়ে দিলেই ভাল হত। একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তাছাড়া পলাশমিতার কথায় এমন যেচে ক্ষুদিরাম হয়েছি ভাবতেই কেমন লাগছিল। অবশ্য ভালও লাগছিল। পার্থদা ছিল, সায়ন ছিল, ওদের কাউকে নিজের লোক ভাবে নি। আমাকে ভেবেছে। এটাও বিরাট ব্যাপার। তাছাড়া আমার মধ্যে একটা চার্ম তো আছেই। বাকিগুলো সব খদ্দরের পাঞ্জাবী পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো আঁতেল।
সিঙ্গুরে পুরো দমে কাজ হচ্ছে। টাটার একটা কারখানা হবে বলেছে। হলে তো ভালই হয়, এখানে যদি একটা চাকরি বাগিয়ে ফেলতে পারি তবে তো যা তা ব্যাপার হয়ে যাবে। অশ্রুমিতা ওদিকেই দেখছিল। আমি বললাম “কি দারুণ কারখানা দেখেছ? এখানে কত লোক কাজ করবে। ভাবতে দারুণ লাগছে”।
মনে হল কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলাম, আমার দিকে বড় বড় চোখ করে বলল “হোয়াট? তুমি কি রিয়েলি আমাদের সংগঠনের লোক? আমার তো রীতিমত ডাউট লাগছে এখন”।
আমি চাপ খেয়ে গেলাম। তাই তো। পলাশমিতারা যা করছে তা তো এদের এগেন্সটেই। আমি তো আচ্ছা গান্ডু হলাম। কোনমতে ম্যানেজ করলাম “আরে ইয়ার্কি মারছিলাম, কত চাষির কত ক্ষতি হয়ে গেল”।
আবার ঘুরে বসল। বাপ। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ধর্মতলা ঢোকার পর বলল একটা ট্যাক্সি ধরতে।বাসটা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানেই ওকে দাঁড় করিয়ে আমি ওই ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম। কোন ট্যাক্সি যেতে রাজি হচ্ছিল না।
আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সিকে রাজি করিয়ে ওকে ডাকলাম। ট্যাক্সির সীটে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখি তালা দেওয়া চেনের একটা জায়গা কাটা। কি জানি কেন, হঠাৎ ভীষণ কৌতূহল হল না কি হল জানি না আমার খুব দেখতে ইচ্ছা হল এত ভারী ব্যাগের ভেতর কি আছে।
চেনের জায়গাটা হাত দিয়ে একটু ফাঁক করে যা দেখলাম তাতে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা।
ব্যাগের সাইজের বড় বড় দুটো বন্দুক!
কি বন্দুক কে জানে!
আমার তো সব বাইরে বেরিয়ে নাচার মত দশা। কোনমতে স্থির হয়ে দাঁড়াতে দেখি অশ্রুমিতা এসে গেছে। আমাকে একটা থ্যাঙ্কসও না দিয়ে চলে গেল।
সেই থেকে মেসে ফেরা অবধি আর বেরোইনি। এই পেন্নাম দিলাম। আর ওই সায়ন আর সায়নের সংগঠনে আমি যাব না। আজ থেকে কলেজের সব ক্লাস করব। এই ডায়রি লিখলাম। এবার স্নানে যাব। তারপর খেয়েদেয়ে কলেজ। আর কোত্থাও না। বাপ! তারপর পেছনে হুড়কো খাই আর কি!!!
৯.
২রা এপ্রিল, ২০০৮
পার্বণী।।
সাহসটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করব? অনির্বাণদা এত সিরিয়াস টাইপ ছেলে, সব সময় কি যে করছে কে জানে। রেজাল্টটাও তো শুনেছি হাই ফাই কিছু নেই, কিন্তু কলেজে ওর ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পাবার গল্পটা মিথ লেভেলে চলে যাচ্ছে। এমন কেত দেখিয়েছে নাকি শুনছি...
তিন বছর হয়ে গেছে কলেজে এখনও একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই। মেয়েদের প্রতি ছুক ছুকানি নেই। নিজের মত থাকে।
আমার এই ধরনের ছেলেই পছন্দ। ওই সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে ভিতরে ভিতরে ছকবাজি করা কৃশানু টাইপ ছেলে আমার দু চোখের বিষ। খুব মিসড কল মারছিল প্রপোজ করার পর থেকে। আর এস এম এসের কি ছিরি। উফ।
তুমি আগুন আমি জল না কিসব বিরক্তিকর জিনিসপত্র। কলেজ আসতে যেতে ধরা ধরি। শেষ মেষ এত ঝাঁট জ্বলল আমাকে যখন ক্যান্টিনে ধরল আমি রীতিমত চেঁচিয়েই বলে দিয়েছি, “দেখ কৃশানুদা তোমাকে চিরকাল বড় দাদার মত চিন্তা করে এসছি, এখন অন্য কিছু ভাবতে পারব না। সো স্টপ সেন্ডিং দোজ ইরিটেটিং এস এম এসেস”। ব্যাটা শেষে পালিয়ে বাঁচে। আমার এই কনসেপ্টটাই নোংরা লাগে। প্রথমে বোন বানিয়ে নেবে তারপর প্রপোজ। অদ্ভুত টাইপ একদম।
মনে আছে অনির্বাণদা আমাদের র্যাগিং পিরিয়ডে একবার এসছিল। আমাকে তখন একটা সিনিয়র দিদি চাটছিল। অনির্বাণদা কুল কাল এসে দাঁড়াল। আমার মুখটা দেখে দিদিটাকে বলল “কিরে খুব ভাল লাগে না? তোকে চাটি এবার?”
কিছুই না। কিন্তু কত কিছু। দিদিটা চুপচাপ সরে পড়ল। কোন কথাও না। অনির্বাণদা তখন খেজুর করতে পারত আমার সাথে আরামসে। কিন্তু সেসবের ধার দিয়েও গেল না। চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে।
সেদিন থেকেই প্রেমে পড়ে গেলাম এক্কেবারে। কিন্তু কাউকে বলি নি। কাউকে না। সেদিন যখন শুনলাম চাকরি পেয়েছে, ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। তবু চুপচাপ ছিলাম।
এই মিসড কল দিতে বেশ মজাই লাগে। তাছাড়া আমার নাম্বারটা আমার বাবার নামে আছে। বুঝতেও পারবে না। হি হি।
অরিত্র ওর মেসে থাকে।কিন্তু এ ব্যাটা এত কম ক্লাস করে যে ওকে পাওয়াই যায় না। ল্যাব গুলো পর্যন্ত মাঝে মাঝে বাঙ্ক মেরে দেয়। তার ওপর এক নম্বরের মাইক্রোফোন। ওকে কিছু বলা মানে গোটা ক্লাস জেনে যাবে। তবে কাল একটু অবাক হয়ে গেলাম। অরিত্র কালকে সবকটা ক্লাস করেছে। এমনকি জি এসের ক্লাস যেটা নাইন্টি পারসেন্ট ক্লাসই অ্যাটেন্ড করেনি সেটাও করেছে। আমি প্রিয়াঙ্কা আর দু তিনটে মেয়ে ছিলাম আর ওই অরিত্র ব্যাটা ছিল। ইভেন জি এসও অরিত্রকে দেখে চাপ খেয়ে গিয়ে বলেছে “সেকি তুমি ক্লাস করছ?”
পেট ব্যথা হয়ে যাবার যোগাড়। আমি খোঁচালে বলল ও নাকি এখন সিরিয়াস হয়ে গেছে। কি অবস্থা!
কৃশানুদা তারপর থেকে আর জ্বালায় নি। শুধু একটা এস এম এস করেছে “সরি, আমি আর তোকে ডিস্টার্ব করব না”। আমি লিখতে যাচ্ছিলাম “রিয়েলি, বাঁচালে”।
কিন্তু তারপর মনে হল তাহলে আবার ভাটানো শুরু করতে পারে। তাই চেপে গেলাম পুরোটাই। ..
১০.
তেসরা এপ্রিল, ২০০৮
অরিত্র।।
ক্লাস করতে যে কি ঝাঁট জ্বলে কি বলব। সকালের দিকে একটা দুটো তাও ঠিক আছে, দুপুরে খাবার পরে মনে হয় লম্বা ঘুম দিই একটা।
কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি যখন তখন ক্লাসটাই করব। পলাশমিতা কালকে একটা থ্যাঙ্কস জানিয়ে এস এম এস করেছে। অনেক রাতের দিকে। তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে এস এম এসটা দেখে কি করব অনেকক্ষণ ভাবলাম। তারপর চিন্তা করলাম ভদ্রতা তো করতেই হয়, ভদ্রতাই ছেলেদের ভূষণ না কি যেন বলে, তাই আমিও রিপ্লাই মেরে দিলাম “মেনশন নট”। মেনশন বানানটা রাতে মনে আসছিল না, শেষে মোবাইলে টেক্সট অন করে পাঠাতে হল। ভাগ্যিস দেখেছিলাম, নইলে মেনশনটা ম্যানশন হয়ে গেছিল। এই ইংরেজিটাই আমাকে গিলে ফেলবে মনে হচ্ছে। বাংলা মিডিয়ামের ছেলেগুলিও আজকাল কলেজে কি সুন্দর ইংলিশ বলছে, আমিই কেমন কাকাতুয়া টাইপ হয়ে যাচ্ছি।
সায়ন কলেজ এসছিল। আমাকে চোখ টিপছিল। ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিলাম বলে বেশি ট্যাঁ ফো করতে পারছিল না। ডি সি ক্লাস নিচ্ছিল আর আমি সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছিলাম, হঠাৎ দেখি গান্ডুটা ফোন করেছে। ক্লাসের মাঝখানে প্যাঁ প্যাঁ করে ফোন বেজে উঠল। ডিসি একটা চক ছুড়ে মারল, যদিও আমার গায়ে লাগেনি তবু ইন্সাল্ট ইজ ইন্সাল্ট।
ফোনটা অফ করে রাখলাম। ক্লাস শেষ হতে এসে নিচু গলায় বলল “পরশু মিটিং আছে চলে আসিস”।
মনে হচ্ছিল ক্লাসের মধ্যেই মালটার বিচিতে একটা গাক করে লাথ মারি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম।
আমি কিছু বললাম না। আবার বলল “কি রে যাবি তো?”
আমি বললাম “ওই মেয়েটা কি সত্যি পলাশমিতার বোন?”
সায়ন গম্ভীর হয়ে আমাকে নিয়ে প্যাসেজে গিয়ে দাঁড়াল। তখনও নেক্সট লেকচারার আসেননি। বলল “হ্যাঁ রে”।
আমি বললাম “ওর যা কথা বার্তা ফিগার ও তো নিজেই আসতে পারত। আর তাছাড়া বন্দুক আনতে আমাকে কি বডিগার্ড হিসাবে পাঠানো হয়েছিল?”
বন্দুকের কথায় সায়ন একটা শক খেল, বলল “তুই জানলি কি করে?”
আমি খিস্তি মারলাম একটা “আমাকে দেখে কি মনে হয় বাড়া, কিছু বুঝি না?”
সায়ন গলা নিচু করে বলল “কাউকে বলিস নি তো?”
আমি মাথা নাড়লাম। বলল “সামনে বিরাট বড় অপারেশন আছে। সিঙ্গুরে। হাইকম্যান্ড থেকে পাঠিয়েছে। আর সব পার্টির এসব থাকে। তুই নতুন নতুন এসছিস বলে মনে হচ্ছে। চল লাইব্রেরী চল, এই ক্লাসটা বাঙ্ক মারি, তোকে পুরোটা বুঝিয়ে বলি”। টি কে এম ঢুকল ক্লাসে।
আমার হাতটা ধরে নিতে চাইল ও। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম “না যা বলার ক্লাসের পরে। সব ক্লাস করব আমি”।
সায়ন খিস্তি মারল “শালা বিরাট পড়াশুনা হচ্ছে নাকি?”
আমি ক্লাসে ঢুকে গেলাম। সায়ন আমাকে দুয়েকবার দরজা থেকে ইশারা করল, আমি দেখেও দেখলাম না। এই সব ঝুট ঝামেলা ঠিক ভাল লাগছে না আমার।
ফোনটা অন করলাম না আর। মালটা আবার জ্বালাবে এই বার। সব থেকে ভাল নম্বর চেঞ্জ করে নিতে হবে।
তাহলে আর কেউ বেশি জ্বালাতে পারবে না।
#
কলেজ শেষ হলে ক্লাস থেকে বেরলাম। আজকে ল্যাব ছিল না কোন। অর্পিতা বলছিল ওর বাড়ি যেতে কাটিয়ে দিলাম। ওর বাপ একটা স্যাম্পেল। ওটাকে পাগলা গারদে পাঠাক তারপর যাব। তাছাড়া ঘরে কেউ না থাকলে চুমু টুমু খেয়ে নেয় যদি। আধ পাগলা মেয়ে। বেশি কাছে না ঘেঁষাই ভাল। অবশ্য মেয়ে ভাল। হেল্প টেল্প করে।
আজকাল পার্বণী খুব ভাল ব্যবহার করছে। কে জানে কেন। চাপ টাপ আছে নাকি আমার ওপর কে জানে। থাকলে খারাপ না। দেখতে খাসা। জিনিসপত্রও ডাসা। সমস্যাটা হল বড্ড সিরিয়াস। এত সিরিয়াস মেয়ে বিয়ে করলে চাপ আছে। সিরিয়াস মুখে “বাল” বলে। এরকম সিরিয়াস একটা মেয়ে এত সিরিয়াসলি খিস্তি মারে আমি এর আগে জীবনে দেখিনি মাইরি।
বিয়ে করলে হয়ত বললাম চ ওই ওসব করি। সিরিয়াস মুখে “বাল” বলে দিল। তাহলেই কেলোর কীর্তি।
আজকাল শুনছি অর্পিতাদের বাড়ি টিকেএম একটা ট্যুশন শুরু করবে। আমাকে বলেছে। এখনও ভেবে দেখিনি। যেতে পারি। পড়াশুনাটা সিরিয়াসলি করে দেখি। অনেকদিন তো বিলাগিরি হল।
মাচায় সায়ন। আমার জন্যই মনে হয় ওয়েট করছিল। আমাকে বেরতে দেখে এল। বলল “ফোনটা অফ করে খুব সিরিয়াস হয়ে গেছিস নাকি রে? তুই আসবি তো মিটিংয়ে?”
এই একটা সমস্যা, ডাইরেক্ট না বলতে পারি না। কাটাতে চাইলাম “দেখি, কাজ ছিল, বাড়ি যেতে পারি, থাকলে যাব”।
সায়ন খুশি হল। বলল “মেসে যাবি? চ’ আমিও যাই”।
যাহ্ শালা। মহা ঝাঁট তো। নাহ এটা মেসে গেলে এখন চাপ আছে। আমি নিশ্চিন্ত মুখে ঢপ মারলাম “না রে, অর্পিতাদের বাড়ি যাব। কাজ আছে”।
সায়নের সাথে অর্পিতার বনে না। একবার তুমুল হয়েছিল ল্যাবে।
চুপচাপ কেটে গেল।
#
মেসের খাবার দিন দিন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। এই অনির্বাণদাটা হয়েছে একটা পাগল। কি খায়, কেন খায় কিছুই জানে না। আর বাকি ছেলেগুলি কিপ্টের হাতবাক্স। রোজ রোজ ডিম পোষায়! আর মাসি তো অ্যাক্যুরেসিতে মাস্টার ডিগ্রি। একই রান্না। কোন ভ্যারাইটি নেই।
পটলের তরকারি দিয়ে ভাত ভাঙতে ভাঙতে মনে হল মোবাইলটা অফ আছে এখনও। খুলতেই একের পর এক এস এম এস। বাপ রে। পাঁচ পাঁচটা এস এম এস পলাশমিতার।
মিটিংয়ে মনে হয় নিয়েই ছাড়বে আমাকে!!!
১১.
৫এপ্রিল ২০০৮
অনেকদিন অর্কুট খোলা হয় না। অনির্বাণ বসেই দেখতে পেল অনেকগুলি স্ক্রাপ জমে গেছে। বেশিরভাগই কলেজের, কিছু কিছু একটু অন্যরকম। কবিতা লিখত এককালে একটা ওয়েবসাইটে। সেখানকার কিছু বন্ধু খেজুরে করে গেছে।
কলেজের একটা জুনিয়র মেয়ে অ্যাড করেছে সেটাও দেখা গেল। একই ডিপার্টমেন্টের। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে, লাইব্রেরীতে
চাকরি পাবার পর আজকাল জীবনটা ভীষণ সোজা হয়ে গেছে। আগে যে স্যারেরা ক্লাস না করলে চাটতে চাইত আজকাল তারা অন্যভাবে বকছে। খারাপ লাগে না।
চ্যাট বক্সটা ওপেন হল। জুনিয়রটা। নামটা পার্বণী।
-হাই।
অনির্বাণ রিপ্লাই করে ফেলল
-হাই।
-so u r in orkut...
অনির্বাণ বুঝল না এই কথার কি উত্তর দেবে। লিখল
-any problem?
-lol. No. Above all u r my departmental senior.
-hmm.
-so?
-so wat?
-ki korcho aj? chuti to?
-kichu na...
-kichu korar nei?
-nah
-oh.
-thik ache. bye for now
-jah
-keno? jah keno?
-ei bolle kichu korar nei. tahole kothai jabe? porte bosbe?
-pagol? sem er age chara ami pori na.
-tomake dekhe khub serious mone hoi
-tai naki? tui dekhechis naki?
-library te dekhi majhe majhe
-ok
-tomar hobby ki?
-kichu na
-really?
-hum
-gan sono na?
-ha
-kar valo lage?
উফ। এ মেয়েটা তো ঠিকুজী কুষ্ঠী বের করার তালে আছে মনে হচ্ছে। ইচ্ছা করেই কলেজে কবিতা লেখার কথাটা বলে না সে। এই সব কলেজে কবিতা লেখার কথা বললে প্যাঁক খেতে হবে।
সে কার গান শোনে? একটু অন্যরকম বলা যাক,
-begum akhtar
-wow... amr khb favrt
সেরেছে। এ বেগম আখতারের একটা গান জানে সে। বেশি প্যাঁচাতে গেলে চাপ হয়ে যাবে। ট্র্যাক চেঞ্জ করার জন্য বলল সে
-kobita poris?
-ha... joy goswami khub bhalo lage amar
যাঃ... কবিতা? তাদের কলেজে? তাও জয় গোস্বামী? জাস্ট ভাবা যায় না!!!
সে এবার একটু চাপ নিল।
-nije likhis?
-nah... oto capa nei...
-chesta kore dekhechis konodin?
-duekbar korehi...hoy na
-dekhas
-kothai dekhbe?
-college e
-pagol
-keno?
-college e ami kobita nie gele ar dekhte hobe na
এ তো তারই বুলি...মজা পেল বেশ...
-tahole ar dekha holo na :(
-keno hobe na? baire dekhabo
-baire?
-ha... aj ki korcho?
-mess e bore hocchi
-chole eso
-kothai?
-city center, salt lake...parbe?
অনির্বাণের হাসি পাচ্ছিল... আবার কলেজের জুনিয়র বলেও কথা... কি করবে ঠিক করতে পারছিল না সে, ভাবতে ভাবতে চ্যাট বক্সে ভেসে উঠল
-are bhoy paccho keno? ami ki bagh singho naki?
১২.
7th April 2008
অরিত্র।।
যা তা ব্যাপার। আমি ভাবতেই পারি নি, কেসটা এদিকে চলে গেছে। আর আমি শালা অন্যকিছু ভাবছিলাম। পার্বণীর অনির্বাণদার উপর নাকি ফুল্টু চাপ আছে আর ওরা দেখা করেছে পরশু সিটি সেন্টারে। প্রিয়াঙ্কা বলল। দুজনে যে এত চুপচাপ এইসব করে বেড়াচ্ছে আগে বুঝিনি। তারমানে পার্বণী যে প্রেম প্রেম চোখে আমার দিকে তাকাত, ওটা অনির্বাণদার জন্য।
যাক গে। যা পারে করুক গে যাক ওরা। আজ রাতে অনির্বাণদাকে শুধু ধরে, একটা টোটাল চাপ দিতে হবে। বিয়ার পার্টি বনতা হ্যায় বস।
পার্বণীকে প্রিয়াঙ্কারা খুব চাটছে। অর্ণব আর প্রিয়াঙ্কা নাকি গেছিল ওখানে। হঠাৎ দেখে ট্রামের সামনে দুজনে লজ্জা লজ্জা মুখ করে গেজাচ্ছে।
প্রিয়াঙ্কা কিছু বলেনি। কলেজ এসে পাকড়েছে চোর। এখন দরদাম চলছে। যা পারে করুক, পার্বণীর বাপের বহুত পয়সা, না খেয়ে ছাড়া যাবে না। আমিও ভিড়ব। আর ওর আমাকে হাতে রাখতেই হবে, নইলে কেস ঘোটালা হয়ে যাবে।
মনটা কাল থেকে হুহু করছে এদের এসব দেখে। পলাশমিতা খুব এস এম এস করছে। মেয়েটার মনে হয় আমার উপর কোন সফট কর্নার তৈরি হয়েছে। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ করে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখলাম। একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছি আর পেছনে সায়ন আর অশ্রুমিতা দুটো বড় বড় বন্দুক নিয়ে আমাকে তাড়া করেছে।
নাহ। অনেকদিন ক্লাস হল। একটানা সাআআআআআআত দিন। ভাবা যায়? কে করেছে? না আমি! উফ। যা হয় হবে, আমি আজ পলাশমিতার সাথে দেখা করতে যাব।
একটা ক্লাস করেই কাটব আজ। পলাশমিতাকে একটা এস এম এস করলাম “aj jacchi. Nandan e aste parbi?”
বেশ খানিকক্ষণ বাদে এস এম এস এল “madhusudan manche aste parbi aj sondhe 6tai? raktakarabi dekbo”
চাপ হয়ে গেল। আমি আর পলাশমিতা নাটক দেখব? এখনই বেরতে হবে কলেজ থেকে। নাটক দেখতে যাব যখন একটা পাঞ্জাবী কিনে নি। ওটা ছাড়া তো আবার নাটক দেখা যাবে না।
#
আমার মনে হচ্ছে পায়ের তলা থেকে মাটি ফাটি সরে যাবে। কি লাগছে। শাড়ি পড়ে এসছে। এই সন্ধ্যে, দক্ষিণ কলকাতা না তা কেন, গোটা কলকাতার সব রঙ যেন পলাশমিতার ওপর এসে পড়েছে। আর সব কটা পাবলিক ওকেই দেখছে।
আমি এগিয়ে গেলাম। আমায় দেখে বলল “চমকে দিলি তো। তোকে পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছে”।
আমি আর বলতে পারলাম না যে তুই আমার মুখের কথাটাই কেড়ে নিলি। একটা হেড়ে কালো মত লম্বা লোক ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল “সম্বুদ্ধদা, আমার দাদা”।
আমি আর চাপ নিলাম না। কারণ অশ্রুমিতার থোবড়া যেমন পলাশমিতার সাথে মেলে না...ভুল ভাবছি হয়ত। এ নিজের দাদা নাও হতে পারে, আজকাল তো দাদা বোন পাতানোর যুগ। হয়ত কলেজের কেউ হবে।
চেয়ারে বসার অ্যারেঞ্জমেন্টটা হল এরকম। প্রথমে পলাশমিতা। তারপর আমি। আমার পাশে সম্বুদ্ধদা।
সমস্যাটা হল নাটকটা। যেটা হল। কিছুই বুঝলাম না। আমাকে মনে হচ্ছিল কেউ তেলভর্তি কড়াইতে চুবিয়ে দিয়ে গ্যাসটা অন করে দিয়েছে। আর পাশে সম্বুদ্ধদা আর পলাশমিতা যেমন মুগ্ধ হয়ে দেখছে দেখে আমিও আর চাপ ফাপ না নিয়ে মুগ্ধতার ভান করে রইলাম।
মাঝে বাথরুম যাবার নাম করে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার ঢুকলাম। পাশে হালকা পারফিউমের গন্ধ, আর পলাশমিতা পলাশমিতা আমেজ আমাকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছিল। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বিপজ্জনক একটা ভাঁজ উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। ভদকার নেশা থেকে কোন অংশে কম নয় এই নেশা।
আমি বোল্ড। তিনটে উইকেটই পড়ে গেছে আমার। এবার তুমি যা বলবে তাই করব নন্দিনী, সরি পলাশমিতা...
#
-আমায় একটু রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন পৌঁছে দিতে পারবি? আসলে সম্বুদ্ধদার রুটটা উল্টোদিকে।
রাত ন’টার সময় কোন মেয়েকে একা যদি কোথাও পৌঁছে দিতে বলে তাও পলাশমিতার মত একটা মেয়েকে, আনন্দে নাচা উচিত বলেই আমার মনে হয়। মাসের শুরু। দরকার হলে শেষের দিকে ধার করব এই চিন্তা করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম।
উঠে পলাশমিতা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমার হার্টবিট কোথায় উঠে গেছে বুঝতে পারছি না।
কিছু একটা বলতে হবে বুঝে আমি বললাম “আমি এই উইকে মিটিঙে যাব”।
-কেন আগের উইকে কি হয়েছিল?
-ক্লাস পড়ে গেছিল।
-কেন? সায়ন তো আসে রেগুলার।
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল পলাশমিতা।
আমি চিন্তা করে দেখলাম খালি মার্কেটে সায়নের মেরেই দি। বলে দিলাম “ও আজকাল ক্লাস টাস ছেড়েই দিয়েছে। সারাদিন এই সবই করে বেড়ায়”।
পলাশমিতা ভাবল কিছুক্ষণ। গাড়ির হাওয়ায় ওর চুলগুলি হ্যালোজেন লাইটে খেলা করছিল। আরও কিছু বলছিল হয়ত। আমিও কিছু উত্তর দিয়েছিলাম হয়ত।
কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না...
১৩.
১৩ই এপ্রিল, ২০০৮
একটা ঘরে মিটিং, স্থানঃ কলকাতার কোন একটা বাড়ি
পাঁচজন ঘরের মধ্যে আছে। সবাই গম্ভীর। তিনজন ছেলে। দুজন মেয়ে। তিনজন ছেলের মধ্যে দুজনের নাম পার্থ আর দীপ। দুজনেরই বয়স বাইশ তেইশের মধ্যে। বাকিজনের বয়স পয়ত্রিশ। নাম কণিস্ক। মেয়ে দুজনের নাম পূর্বা আর সুদীপ্তা। পূর্বাকে অরিত্র অশ্রুমিতা নামে চেনে।
কণিস্কের গলার মধ্যে একটা বসসুলভ ব্যাপার আছে। সেই বলছিল “সিগন্যাল কিন্তু যে কোন সময় আসতে পারে। আমি সেরকম কিছু পেলে পার্থকে জানিয়ে দেব, তারপর পার্থ জানিস নিশ্চয়ই বাকিটা”।
পার্থ দাঁড়ি চুলকাচ্ছিল। সুদীপ্তা বিরক্ত মুখে বলল “বিপ্লবী হলে দাঁড়ি রাখতে হবে এটা ওল্ড ফ্যাশন পার্থদা”।
পার্থ বলল “না না, আজ দাঁড়ি কাটব ভেবেছিলাম, কণিস্কদা না এলে তো তাই করতাম”।
পূর্বা রাগ রাগ চোখে বলল “আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে পুরুলিয়া যেতে হবে। এই দাঁড়ি নিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ হলে ভালো হয়”।
কণিস্ক বিরক্ত হল “আহ, তোরা থামবি? তোদের ফোকাসটা কোনদিকে? সামনে এতবড় একটা অপারেশন আছে আর তোরা যত ভাট বকে যাচ্ছিস!”
দীপ মোবাইলে টুক টুক করে কি করছিল। সুদীপ্তা বলল “তার আগে আমাদের কিছু লোকের মোবাইলে গেমস খেলাটা বন্ধ করতে হবে”।
দীপ সুদীপ্তার দিকে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে একবার তাকাল। বলল “গেমস না, একটা গুরুত্বপূর্ণ এস এম এস পাঠাচ্ছি”।
সুদীপ্তা বলল “ওকে... ক্যারি অন। কেউ এস এম এস করুক, কেউ ঝগড়া করুক, একটা ক্রুশিয়াল মিটিংয়ের দিনে আমরা এই করেই কাটিয়ে দি তাহলে”।
কণিস্ক গলা চড়াল “ওকে। নাও লিসন টু মি। দীপ। তুই আজ পূর্বার সাথে পুরুলিয়া যাবি। দুটো বেসে যেতে হবে তোকে। পূর্বাকে স্পট ওয়ানে পৌঁছে তুই সোজা চলে যাবি স্পট টুতে”।
দীপ মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল “ওকে”।
পূর্বা বলল “আর আমার একটা কমপ্লেইন আছে”।
কণিস্ক বলল “হ্যাঁ কি আছে বল”।
পূর্বা বলল “রাঁচি থেকে ফেরার সময় আসানসোল স্টেশনে কথা ছিল আমাদের ইউনিটের কেউ থাকবে। একটা বাইরের আতা ক্যালানে ছেলেকে পাঠানো হল কেন?”
কণিস্ক জিজ্ঞাসু চোখে পার্থর দিকে তাকাল “কি ব্যাপার পার্থ? বাইরের ছেলে মানে?”
পার্থ হাসার চেষ্টা করল “না বাইরের ছেলে কোথায়? পলাশমিতার বন্ধু। আমার কাজ পড়ে গেছিল একটা আসলে। ওই ম্যানেজ করল”।
পূর্বা বলল “আজকাল অনেকের বাইরের কাজটা বেশি ইম্পরট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে কণিস্কদা”।
কণিস্ক পার্থর দিকে রাগ রাগ চোখে তাকাল “দ্যাখ পার্থ, তোরা জানতিস পূর্বার সাথে জিনিস আসবে। তাও তুই গেলি না। তোদের এই সব নেগলিজেন্সি জানিস অরুণজি জানলে কি হবে?”
পার্থ সবাইকে চমকে দিয়ে কান ধরল, “সরি ভুল হয়ে গেছে আর হবে না”।
কণিস্ক কাঁধ ঝাঁকাল “এটা ছেলেখেলা না পার্থ।ওই ছেলেটা যদি অন্য কিছু বেরত? আর পলাশমিতা কোথায়? ও কি আদৌ আসবে?”
দীপ বলল “না, এইমাত্র এস এম এস করল। আটকে গেছে মাসির বাড়িতে”।
কণিস্ক হতাশ মুখে সুদীপ্তার দিকে তাকাল “যা পারিস কর তোরা। আমি আর কিছু বলব না। তুই লিফলেটগুলি পলাশমিতাকে দিয়েছিলি?”
সুদীপ্তা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কণিস্ক বলল “সামনে কিন্তু কঠিন দিন আসছে। সবাই রেডি থাক। আর কিছু ছেলে জোগাড় কর। জেদি। শক্তিশালী”।
দীপ মোবাইল রাখল। বলল “কি কঠিন দিন?”
কণিস্ক হাসল “অপারেশন টাটাগোল্ড”।
১৪.
১৬ই এপ্রিল, ২০০৮
পার্বণী।
বড় কেলো হয়ে গেছে।পাশের ফ্ল্যাটের জ্যেঠু জ্যেঠি কোন কাজে সিটি সেন্টার গেছিল। আমাকে আর অনিকে দেখে ফেলেছে। তারপর গুছিয়ে মা-কে লাগিয়েছে। ফেরার পর থেকে খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। ঝাঁট জ্বলে লাট হয়ে যাচ্ছে আমার।
আমার বাবাকে অনির্বাণদা সম্পর্কে চুপি চুপি সবই বলেছি পরশুই। বাবাকে নিয়ে আমার কোন চাপ নেই। চাপটা মা-কে নিয়ে। মা হল অষ্টাদশ শতাব্দীর লোক। পারলে আমাকে বোরখা পড়িয়ে রাখে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর পেছনে কয়েক লাখ টাকা খরচা করবে শুনে মা বলেও ফেলেছিল টাকাগুলি আমার বিয়ের জন্য রাখলে ভাল হত।
বাবা অত আমল দেয় নি। বাবা সবসময় চেয়েছে আমি চাকরি করি, নিজের পায়ে দাঁড়াই। আমার ছোট ছোট দু-চার লাইন লেখা লেখি সম্পর্কেও প্রবল উৎসাহ দিয়ে এসেছে চিরকাল। মা ঠিক উল্টো। ছুটির দিনগুলি ছুতো নাতায় রান্নাঘরে আমাকে ঢোকাবেই। কে বোঝাবে আমার এত্ত এত্ত অ্যাসাইনমেন্ট বাকি আছে!
তবু এর ফাঁকে কিছু রান্না শিখে গেছি অবশ্য। বিরিয়ানিটা ভালই হচ্ছে আজকাল। ইচ্ছা আছে অনির্বাণদাকে একদিন খাওয়াব।
সকালে খাবার দেবার সময় মা একবার জিজ্ঞেস করে গেছে বাঁকা গলায় “আজ কলেজেই যাবি তো নাকি অন্য কোথাও?”
মা এই কথাগুলি বলেই টুক করে সরে পড়ে যাতে আমি কাউন্টার করতে না পারি । বাবার দিকে হতাশ মুখে তাকালাম। বাবা খেতে খেতেই বলল “বেশি কানে দিবি না, খেয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে যা”।
তবু জ্বলছিল ভেতরটা। একটা ছেলের সাথে একদিন সিটি সেন্টারে কেউ দেখে ফেলেছে বলে এত বাওয়াল হবে কে জানত। তাছাড়া আমার কপালটাও এমন। এই প্রথম অনির্বাণদাকে নিয়ে গেলাম আর শুরুতেই দেখে ফেলল।
বাবা গলাটা খাটো করে বলল “একটা কাজ করতে পারবি, অনির্বাণকে নিয়ে আমার অফিসে চলে আয়, তারপরে আমরা আজ সন্ধ্যেয় একটা নাটক দেখে আসি”।
বাবার মাঝে মাঝে এই চমকে দেওয়া কথাগুলি শুনে বেশ ভাল লাগে আমার। মায়ের কথাগুলি শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন মজা লাগল। বললাম “কিন্তু মা?”
বাবা খাওয়া শেষ করে উঠে আমার কানে কানে বলল “সে আমি ম্যানেজ করে নেব ক্ষণ”।
আমি লাফাব না ঝাঁপাব কি করব বুঝে ওঠার আগেই মা ঢুকল ঘরে। চুপচাপ গম্ভীর হয়ে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম।
#
অনির্বাণদা লাইব্রেরীতে ছিল। চুপচাপ গিয়ে বসলাম পাশে। প্রিয়াঙ্কা দূর ঠেকে দেখে চোখের ইশারা করল। আমি না দেখার ভান করলাম। একটা খাতা বের করে লিখলাম
“আজ সন্ধ্যেয় ফ্রি আছ তো? বাবা আমাদের নাটক দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছে”।
অনিদা চমকাল লেখাটা পড়ে। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে লিখল
“এর মধ্যে এদ্দুর?”
আমার হাসি পেল। লিখলাম
“চাপ হয়েছে একটা। আমাদের দেখে নিয়েছে আগের দিন পাশের বাড়ির লোক। বাড়িতে লাগানোও হয়ে গেছে। তবে আমার বাবা সম্পর্কে চাপ নিও না। আমাদের মতই”।
অনিদা হাসল। লিখল
“যা তা ব্যাপার। কিন্তু একদিন প্রেমে মেয়ের বাবা দেখা করতে চায় এটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম না?”
হাসি চাপতে চাপতেই লিখলাম
“কোন চাপ নেই”।
অনিদা আমার দিকে হেসে কাঁধ ঝাঁকাল। এদিকে গোটা ক্লাসটাই মনে হয় লাইব্রেরীতে ঢুকে পড়েছে।
নাহ, কলেজ বাড়ি সব জায়গাতেই কেস খেয়ে গেলাম দেখছি।
১৫.
১৮ এপ্রিল, ২০০৮
অরিত্রকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত তিনদিন ধরে মেসে ফেরেনি। অনির্বাণ ভেবেছিল বাড়ি গেছে হয়ত। কিন্তু সে ভুলটা ভেঙেছে মেসের ল্যান্ডলাইনে ওর বাড়ি থেকে ফোন আসার পর। পরপর দুদিন মোবাইল ফোনটা সুইচড অফ বলার পর মেসের ল্যান্ডলাইনে করেন।
ওর বাবা মা থানায় ডায়েরি করেছেন। সে নিজেও বুঝতে পারছিল না কি বলে সান্তনা দেবে। সব থেকে আশ্চর্যজনক কথা হল ওর ঘরে জামাকাপড় আছে শুধু কলেজের ব্যাগটা নেই। সেদিন পার্বণী আর ওর বাবার সাথে যখন বেরনোর কথা ছিল তখন সে লাস্ট ক্লাস বাঙ্ক করে বাড়ি চলে এসেছিল। দেখেছিল অরিত্র খুব সাজছে। তার ডিওটা নিয়ে মাখল।
তখন ওকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল কোথায় নাকি মিটিং আছে। ক’দিন ধরেই ছেলেটার গতিবিধি তার কাছে সন্দেহজনক লাগত। আগে মেসে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে গেমস টেমস খেলত, আড্ডা মারত, ইদানীং ফিরতে অনেক রাত করছিল।
সেসব কথাই ওর বাবা-মা আর পুলিশকে যা জানে বলল সে। পার্বণী পরে জানাল সায়নের সাথে নাকি ইদানীং খুব দোস্তি হয়েছিল। কোথায় কোথায় যেত।
সেকথা সে আর পুলিশকে বলল না। সায়নের কথা ভেবেই। তবে অরিত্রর মা বাবা কে বলেছে। তারা সায়নকে ফোন করেছিল বটে কিন্তু সায়ন বলেছে ও নাকি সেদিন ছ’টা অবধি কলেজে ছিল এব্যাপারে কিছু জানে না। কলেজের কয়েকজন কনফার্মও করেছে সেটা। অবশ্য তেমন বুঝলে সায়নের কথা ওনারাই পুলিশকে বলে দেবেন।
ওর বাবা-মার চোখ মুখ একেবারে বসে গেছে। তারা জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করিয়েছিল কিন্তু তারা কিছুই খেলেন না। এমন একটা হাসি খুশি ছেলে কোথায় গেল কি করল কিছুই বোঝা গেল না।
সব হাসপাতাল ইত্যাদিতে অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই চেহারার কেউ নেই। কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে।
কলেজে, মেসে ওর সব বন্ধুদেরই পুলিশ অনেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু তেমন কিছুই জানতে পারেনি।
শুধু অনির্বাণ এটুকুই মনে করতে পেরেছে নিরুদ্দেশ হবার সময় অরিত্রর পরনে ছিল হলুদ টি শার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট। আর গায়ে তার ডিও।
মাঝখান থেকে তার ভাল লাগাগুলি কোথাও যেন গুটি শুটি মেরে পরে রইল। পার্বণীর বাবা দারুণ লোক। একেবারে বন্ধুর মত মেশেন। নাটক দেখার পরে তারা একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করল। তারপর তাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন মেসে।
পার্বণীও এখন অরিত্রর ব্যাপার নিয়ে বেশ টেন্সড হয়ে আছে। তাদেরই ক্লাসের। কোথায় গেল ছেলেটা কে জানে।
অনির্বাণের সন্দেহ হচ্ছে দুজায়গায়। যদি ও কারও সাথে দেখাই করতে যায় তাহলে কলেজের ব্যাগ নিয়ে গেল কেন? আর ওর একটা ডায়েরী ছিল। সেটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
তাহলে অরিত্র কি জেনে শুনেই কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল?
৭ই জানুয়ারি ২০১১
১।
ল্যাদ হয়ে যাচ্ছ তুমি খুব আজকাল।
কেন?
দেখতেই তো পাচ্ছি। বিয়ের পর অ্যাটলিস্ট কোথাও যাও না যাও বাড়ির কাছ থেকে তো একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পার।
তুমি তো দেখছই ছুটিই পাই না আজকাল।
এর থেকে তো আইটির চাকরিটা করতে পারতে। আমি অন্তত বাকি বন্ধুগুলোর মত ফেসবুকে আমেরিকার ছবি লটকাতে পারতাম, কি দরকার ছিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট জবের?
অনির্বাণ পার্বণীকে জড়িয়ে ধরে বলল “সব জায়গায় যাব সোনা তার আগে বলত তোমার বাবা মা কবে আসবে বলেছিল?”
পার্বণী অনির্বাণের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “সে আসবে দেরী আছে, কিন্তু আমি ওসব জানি না, তুমি আমাকে এই উইকএন্ডে কোথাও নিয়ে চল। আর ভাল লাগছে না আমার এই থোড় বড়ি খাড়া জিন্দেগী”।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল “কোথায় যাবে?”
পার্বণী উৎসাহিত হল “কাছে পিঠে কোথাও চল, শান্তিনিকেতন কিংবা মুকুটমণিপুর”।
তারা দুর্গাপুরে এসছে ছ’মাস হল। স্টিল প্ল্যান্টের চাকরিতে সবে ঢুকেছে সে। ট্রেনিংএর জ্বালায় ছুটি ছাটা বিরল থেকে বিরলতম হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এবার পার্বণী না ছোড় হয়ে গেছে। বিয়ের এক বছর হয়ে গেল তাদের এদিকে কোথাও যাওয়া তো দূরস্থান নিজের বাপের বাড়ি যাওয়াটাও আজকাল ঠিক ঠাক সম্ভব হয়ে উঠছে না।
অনেক দর কষাকষির পর ঠিক হল মুকুটমণিপুর যাওয়া হবে। একটা গাড়ি ঠিক করে শনি রবি দুদিন ওখান থেকে ঘুরে আসা যাবে। এর আগে তারা অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছে কিন্তু শেষ অবধি কোথাও যেতে পারেনি। হয় শেষমুহূর্তে তার ছুটি ক্যান্সেল হয়েছে নয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং পরে গেছে।
এমনিতে দুর্গাপুর জায়গাটা খারাপ না। ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, দু তিনটে শপিং মল, পার্ক, দামোদরের তীর সবই আছে কিন্তু সব থাকলেও অনির্বাণ সারাক্ষণ অফিসে থাকার ফলে পার্বণীর বিরক্তি ধরে যায়। আর অগতির গতি ফেসবুক। তাতে প্রায় সব বন্ধুই বাইরে থাকায় তার মন খারাপ হয়ে যায়। কেউ হয়ত ক্যালিফোর্নিয়া কেউ অ্যারিজোনা থেকে সব ঝাঁ চকচকে ফটো আপলোড করছে। আর সে পচে মরছে এখানে।
ক্যাম্পাসিংএর চাকরিটা পার্বণী শেষ মেষ না করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। অনির্বাণ আই টির চাকরি পেলেও পরে সরকারি চাকরি পাওয়ায় দুর্গাপুরে পোস্টিং পাওয়ায় সে ঠিক করে অনির্বাণের সাথেই থেকে যাবে।
এখানে শীত পড়ে জাঁকিয়ে। বেড়াতে যাবার মজাটা অন্যরকম পাওয়া যায়।
পার্বণী সোয়েটার গোছাতে গোছাতে অনির্বাণকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল “কি ভেবেছিলাম কি হলাম। কোথায় কবিতা টবিতা লিখতে, এখন তো সে সবও চুলোয় নাকি?”
অনির্বাণ ল্যাপটপে কাজ করছিল। পার্বণীর টিপ্পনীর জবাবে বলল “আর তো মাস তিনেক। ট্রেনিং পিরিয়ডটা শেষ হতে দাও। তারপর দেখ কবিতায় বান আসবে কেমন”।
পার্বণী স্যুটকেসটা বন্ধ করে বলল “বান আসবে না বাল আসবে কে জানে”।
এই কথায় দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়ল।
অনির্বাণ বলল “তুমি তো আগে এত খিস্তি মারতে না”।
পার্বণী বলল “মারতাম তবে তোমার সামনে না। আর আজকাল তো খিস্তির চাষ হচ্ছে মাথার ভেতরে ঘরে থাকতে থাকতে। টিভি আর ফেসবুক কাঁহাতক সহ্য হয় বলতো?”
অনির্বাণ বলল “এক কাজ করতে পার তো, বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পার”।
পার্বণী অনির্বাণের গাল টিপে নাকি সুরে গেয়ে উঠল “তুঝে না দেখু তো চ্যায়ন মুঝে আতা নেহি হে”।
অনির্বাণ পার্বণীকে কাছে পেতেই এই সুযোগে জড়িয়ে ধরে বলল “কাল না গেলে হয় না? মঙ্গলবার একটা পরীক্ষা আছে”।
পার্বণী জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল “না না না, আমি কিচ্ছু জানি না, কালই যাব”।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “ঠিক আছে। যথা আজ্ঞা”।
২।
৮ই জানুয়ারি, ২০১১
যাবে না যাবে না করেও শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে অনির্বাণের বেশ ভাল লাগছিল। বিশেষ করে দুর্গাপুর ব্যারেজ পার হবার পর বেশ খানিকটা স্ট্রেস কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল তার। পার্বণীর চোখ মুখ বদলে যাচ্ছিল। শিশুর মত তার প্রশ্ন শুরু হয়ে গেছে। “ওটা কি?” “ওই যে নদীতে ভেসে যাচ্ছে ওটা কি কচুরিপানা”?
যেন অনির্বাণ সবকিছু জানে। সেটা পার্বণীকে বলেও ফেলল সে “দেখ তুমিও যা জান আমিও তাই, খালি খালি জিজ্ঞেস করে কি হবে”?
পার্বণী অনির্বাণের হাতটা একটু চাপ দিয়ে বলল “তা কি করে হবে, তুমি আমার হাবি না? তুমি সব চেয়ে বেশি জানবে”।
হেসে ফেলল অনির্বাণ পার্বণীর কথা শুনে। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া সত্ত্বেও তার দিকের কাঁচ খুলেই রেখেছে পার্বণী অতি উৎসাহে। অনির্বাণ বেশ কয়েকবার বলে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। ব্যারেজ পেরতে বেশ সময় লেগে গেল তাদের। রাস্তা সরু। তার ওপর প্রচুর গাড়ি। ধীরে ধীরে পার হচ্ছে।
এ জায়গাটা স্টিল টাউনশিপের মত ঝা চকচকে নয়। একটা গ্রাম্য ব্যাপার আছে চারদিকে। অনির্বাণ বলল “এককালে দামোদরকে বাংলার দুঃখ বলা হত জান তো?”
পার্বণী মুখ টিপে হাসল।
অনির্বাণ অবাক হল “কি?”
পার্বণী বলল “যেই বললাম সব জান অমনি জ্ঞান দেওয়া শুরু হয়ে গেল না? এরপর নিশ্চয়ই বলবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই নদ সাঁতরে পার হয়েছিল?”
অনির্বাণ হেসে ফেলল। “ হ্যাঁ, সেটাও প্রোগ্রামে ছিল আর কি”।
পার্বণী বলল “আমরা ব্রেকফাস্ট করে নি এবার কি বল?”
অনির্বাণ বলল “দাঁড়াও, আরেকটু যাই, বাবলু বাবু আর কতক্ষণ লাগবে?”
ড্রাইভার ছেলেটার নাম বাবলু। ও বলল “কিছুই আসি নি স্যার, এখনও অনেক দেরী”।
পার্বণী বলল “ভাল হয়েছে, অ্যাটলিস্ট কিছু তো দূরে হোক, সবই বাড়ির কাছে হবে নাকি?”
অনির্বাণ বলল “সে অবশ্য ঠিক। দূরের জিনিস সব সময় ভাল”।
পার্বণী ব্যাগ থেকে ফ্রুট কেকের প্যাকেট বের করে বলল “একটা করে খেয়ে নিই চল”।
অনির্বাণের সকালে পেট পরিষ্কার হয় নি। সে দ্বিধা করছিল। শেষ পর্যন্ত বলল “তুমিই খাও, আমার ক্লিয়ার নেই, শেষে কেলো হয়ে যাবে”।
পার্বণী মুখ ভ্যাংচাল “উফ টোটাল ঝুল কেস তুমি। কি করে যে অত কবিতা আওড়াতে কে জানে!”
অনির্বাণ পার্বণীর সোয়েটারএর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পেটে একটা চিমটি কেটে বলল “কবিতার ভাই হয়েছে”।
পার্বণী বলল “নাম কি?”
অনির্বাণ মাথা চুলকে বলল “ভাই না বোন, নাম পার্বণী”।
পার্বণী এবার অনির্বাণকে একটা রাম চিমটি কাটল। বলল “আমার নাম নিয়ে নো ইয়ার্কি”।
ব্যারেজ পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল মসৃণ গতিতে। রাস্তা এদিকটা এখনও পর্যন্ত টু লেন হলেও বেশ ভাল। ঝাঁ চকচকে নীল আকাশ আর গাড়ির ভেতর বহুদিন পরে কোথাও বেরতে যাবার আনন্দে টগবগ করে ফোটা দম্পতিকে উৎসাহী করে তুলছিল।
পার্বণী বলল “কলেজে তোমার ক্লাস না করাটা এরা মনে হচ্ছে সুদে আসলে তুলে নিচ্ছে”।
অনির্বাণ বলল “যা বলেছ। প্রচুর চাপ। আর প্ল্যান্ট ভিসিট মাঝে মাঝে যখন করছি তখন ঘোর লেগে যাচ্ছে কি বিরাট সব ব্যাপার স্যাপার”।
পার্বণী বলল “বেশ হয়েছে। তখন খালি বাঙ্ক আর কবিতা। এবার দেখ কেমন লাগে”।
এই কথাটার সাথে সাথেই একটা শব্দ হল। আর বাবলু গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। অনির্বাণ উৎকণ্ঠিত হল “কি হল?”
বাবলু শুকনো মুখে বলল “পাংচার”।
একেবারে দুদিকে ধুধু মাঠের মাঝখানে গাড়িটা পাংচার হয়ে যাওয়ায় অনির্বাণের মুখ থেকে আপনা আপনিই বেরিয়ে গেল “ধুস শালা”।
পার্বণী বলল “বিরক্ত হোয়ো না তো। ও পাংচার সারতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
অনির্বাণ বলল “দেখ স্টেপনি আছে কিনা”।
মুখের কথা বেরল না বাবলু এসে মাথা চুলকে বলল “স্যার স্টেপনি নেই”।
এবার পার্বণীর মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল “কি হবে?”
বাবলু বলল “আমি বাসে করে যাচ্ছি ঠিক করে নিয়ে আসছি, ততক্ষণ আপনারা গাড়িতেই বসুন”।
-কতক্ষণ লাগবে?
বাবলু বলল “এক ঘণ্টা তো লাগবেই ম্যাডাম”।
একটা বাঁকুড়ার দিক থেকে আসা গাড়িতে চেনা ড্রাইভার দেখে টায়ারটা নিয়ে বাবলু চলে গেল।
অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে পার্বণী বলল “হাগু পেয়েছে? পেলে ওই মাঠে গিয়ে কর”। বলে ফিক করে হেসে ফেলল।
অনির্বাণ গোঁজ হয়ে বসে রইল গাড়ির ভেতর।
রাস্তার মাঝখান দিয়ে তাদের গাড়িটাকে মাঝে মাঝে ভাইব্রেট মোডে রেখে ট্রাকগুলি চলে যাচ্ছে। বাসও যাচ্ছে দুয়েকটা। শীতকাল বলে ট্রেকারে গাক গাক করে গান বাজাতে বাজাতে কিছু মস্তিখোর পাব্লিক যাচ্ছে।
মিনিট বিশেক যাবার পর অনির্বাণ শুকনো মুখে পার্বণীকে বলল “কি করি বলতো?”
পার্বণী উৎসুক মুখে তাকাল।
“কি হয়েছে?”
অনির্বাণ করুণ মুখে বলল “আমার খুব জোরে পেয়ে গেছে, আমি আর আটকে রাখতে পারছি না”।
পার্বণী বলল “এক কাজ কর তবে, এই জলের বোতলটা নিয়ে মাঠেই যাও না হয়”।
অনির্বাণ শুকনো মুখে বলল “আর দশ মিনিট দেখি। নইলে তাই করতে হবে মনে হচ্ছে”।
পার্বণী টেন্সড হয়ে পড়ল এই সময়। চারদিকে বেশ একটা ধু ধু ব্যাপার আছে। ফাঁকা জমি চাষের মাঝে মধ্যে। এই জায়গায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই।
আরও দশ মিনিট বাদে গাড়ি থেকে নেমে মাঠের দিকেই দৌড়ল অনির্বাণ। পার্বণী গাড়িতে একা একা বসে রইল।
৩.
৮ই জানুয়ারি ২০১১
একটা গোপন ডেরা, জঙ্গলের মধ্যে
সময়ঃ সকাল ১১টা
কণিস্ক পার্থ আর দীপ বসে আছে একটা তাঁবুর ভেতরে।
কণিস্ক গম্ভীর মুখে বলল “বয়েজ আজকেই যা করার করতে হবে। গভর্নমেন্টকে সমঝে দিতে হবে যে আমরা এখনও ফেলনা নই”।
পার্থ তাঁবুর ভেতর বসে যথারীতি দাড়ি চুলকাচ্ছিল। বলল “নই তো। ওই ইঞ্জিনিয়ারটা আর বউ দুটোকেই তুলবে তো?”
কণিস্ক বিরক্ত হয়ে বলল “ক’বার তোকে বলতে হয় বল তো? জ্বালিয়ে খেলে মাইরি”।
দীপ বলল “কিন্তু এ তো সামান্য একটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি। একে তুলে লাভ কি?”
কণিস্ক আরও বিরক্ত হয়ে বলল “তাছাড়া আসছে কে? কোন ইয়ে আসছে? সময়টা কম বুঝতে পারছিস না তোরা?”
দীপ বলল “হুম। তাহলে দুপুর নাগাদ ঢুকলেই অ্যাটাক তাই তো?”
কণিস্ক হাত তুলল “ইয়েস গাইজ”।
পার্থ বলল “সিকিউরিটি থাকবে না তো কোন?”
কণিস্ক বলল “ভুল ভাল কথা বলিস না তো, সিকিউরিটি কেন থাকতে যাবে। একটা ট্রেনী ইঞ্জিনিয়ার”।
পার্থ দাঁড়িয়ে পরে বলল “তাহলে এই অপারেশনটা আমি করব”।
দীপ বিড়বিড় করে বলল “সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনত, তেড়ে মেরে ডাণ্ডা করে দেব ঠাণ্ডা”।
৪।
৮ই জানুয়ারি ২০১১
রাত ৮টা
ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনির্বাণ বসল সোফায়। বেশ কিছু পর্যটক রয়েছে এখন। পার্বণী বলল “রাতে মাংস খাচ্ছ না তো? তোমার যা অবস্থা দেখছই, পিলেরুগী কোথাকার। পটল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খাও বরং”।
অনির্বাণ রাগ রাগ মুখ করে বলল “মাংসই খাব। এমন কিছুই হয় নি। সকালে পেট খারাপ ছিল না, শুধু পুরো ক্লিয়ার ছিল না বলে রাস্তার মাঝখানে পেয়ে গেছিল”।
পার্বণী বলল “কাল সকাল সকাল বেরব তবে”।
অনির্বাণ কম্বলের ভেতর ঢুকে জমিয়ে বসল। বলল “এই শীতে আমি আর ভোরে উঠতে পারছি না। আর কি বেরনোর দরকার। হানিমুনে আসলে আবার বেরনোর দরকারটা কি বলত?”
পার্বণী রেগে গিয়ে বলল “আমি ওসব জানি না, কালরাতে প্রিয়াঙ্কা বলে দিয়েছে ঝিলিমিলি না দেখে যেন না ফিরি”।
অনির্বাণ বলল “যাব তো, সকাল দশটার পরে যাব না হয়”।
পার্বণী বলল “তাহলে পাহাড়ে উঠবে কখন? বিকেলে ফিরবে না?”
একটা ছেলে চা দিতে এল। অনির্বাণ তাকে বলল “তোর নাম কি রে?”
ছেলেটা দাঁত বের করে বলল “ভরত”।
অনির্বাণ বলল “পাহাড়ে উঠে কি লাভ রে?”
ছেলেটার বয়স বেশি না। পনেরো ষোল হবে। বলল “একটা মন্দির আছে”।
পার্বণী উৎসাহিত হল “হ্যাঁ আমি শুনেছি ওখানে একটা বহু প্রাচীন জৈন মন্দির আছে। কেউ যায় না ওখানে। একটা মেলাও হয় ওখানে”।
ছেলেটা বলল “মেলা দেরী আছে গো বাবু”।
পার্বণী তবু উৎসাহ হারাল না, বলল “না তাও যাব, তুমি সকাল সকাল তুলে দিতে পারবে আমাদের?”
ছেলেটা বলল “ক’টায় তুলতে হবে”?
পার্বণী বলল “ছ’টা, তখন চা-ও দেবে”।
ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে গেল।
অনির্বাণ বলল “দুদিন থাকতে এসেছি কোথায় ল্যাদ খাব তা না, তোমার এই জ্বালাতন শুরু হয়ে গেল”।
পার্বণী বলল “বেশ হয়েছে, এই ল্যাদ খেয়ে খেয়েই তো কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না,এবার এসছি যখন এভাবেই ঘুরব, আর জায়গাটা কি সুন্দর, আমার তো মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই সারাজীবন,পশ্চিমবঙ্গের ভেতর এত দারুণ জায়গা আছে জানতাম না আগে সত্যি”।
অনির্বাণ হতাশ হয়ে বসে রইল।
৫।
৯জানুয়ারি সকাল ১০টা
তাঁবুর ভেতরে পায়চারি করছে অনির্বাণ । ক্যাম্প খাটে টেন্সড মুখে পার্বণী বসে আছে।
সে বলল “কি হল, এত হাটো কেন?”
অনির্বাণ দাঁত খিচাল “হাঁটব না তাহলে কি নাচব? কি দরকার ছিল এই আজগুবি প্ল্যানগুলি করে। নাও এবার ঠ্যালা সামলাও”।
পার্বণী বলল “আচ্ছা এরা বাথরুম কোথায় করে?”
অনির্বাণ কাঁধ ঝাঁকাল “তার আমি কি জানি?”
পার্বণী হঠাৎ হেসে বলল “এটাও কিন্তু একটা চরম অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে যাই বল”।
অনির্বাণ খচল এবারে “আমার পরশু ইম্পরট্যান্ট টেস্ট আছে আর তুমি বলছ অ্যাডভেঞ্চার!”
পার্বণী গুছিয়ে বসে বলল “তাতে কি? পেপারে খবর বেরবে, নিউজ চ্যানেলে দেখাবে, তুমি আমি ফেমাস। আর তোমার কোম্পানিও তখন তোমাকে বীরের সম্মান দেবে”।
অনির্বাণ ক্যাম্পে এসে বসল। এই শীতের মধ্যেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমছিল। বলল “যদি বেঁচে ফিরতে পারি তো”।
পার্বণী অনির্বাণের পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বলল “চাপ কিসের? মধু কবি তো বলেই দিয়েছে জন্মিলে মরিতে হবে এটসেটরা এটসেট্রা। আচ্ছা এদের বল না একটু কফি খাওয়াতে যা শীত ঠাণ্ডা লাগছে”।
অনির্বাণ বলল “পিকনিকে এসছ নাকি? এই জায়গায় কদিন থাকতে হয় দেখ এবার”।
তাঁবুর ভেতরে পার্থ ঢুকল। দাড়িতে হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাদের দেখে অনির্বাণকে বলল “এই তুমি ফেসবুকে আছ না?”
অনির্বাণ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। বলল “হ্যাঁ”।
পার্থ উৎসাহিত হল “হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি দেখেছি তোমায়। ওই আদরের নৌকায় তোমার একটা কবিতা পড়েছিলাম মনে হয় আগের মাসে”।
পার্বণী ফিক করে হেসে ফেলল। অনির্বাণ ভাবল এবার ম্যানেজ করা যেতে পারে। বলল “আচ্ছা আমাদের ক’দিন আটকে রাখা হবে?”
তার কথা শেষ না হতেই দীপ আর কণিস্ক ঢুকল তাঁবুর ভেতরে। কণিস্ক পার্থর দিকে তাকিয়ে বলল “খেজুর করতে এসছিস নাকি এখানে?”
পার্থ দীপকে বলল “আরে এই সেই ছেলেটা যার কবিতাটা তুই আমাকে শেয়ার করলি,তারপর কণিস্কর দিকে তাকিয়ে বলল “কণিস্কদা ছেলেটা দারুণ কবিতা লেখে”।
দীপ চোখ কপালে তুলল “ওহ, তুমিই সেই অনির্বাণ। বাহ বাহ, তোমার হবে”।
অনির্বাণ আর পার্বণী অবাক হয়ে এদের কথোপকথন শুনছিল। এদের দেখে বোঝাই যাচ্ছে কলকাতার গন্ধ এখনও এদের গা থেকে যায় নি।
কণিস্ক ওদের থামাল “ঠিক আছে, কবিতা লিখেছে ভাল করেছে। শোন বাপু অনির্বাণ, তোমাকে এখানে আটকে থাকতে হবে কিছু করার নেই। গভর্নমেন্টের কাছে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট দাবী আছে। সেগুলি আমাদের চাই। আর হ্যাঁ, যদি গভর্নমেন্ট যদি সেগুলি না মানে তাহলে তোমাদের ওপর গুলি চালাতে কিন্তু আমরা পিছপা হব না। ইন ফ্যাক্ট আমাদের ওপর সেরকমই ইন্সট্রাকশান আছে”।
অনির্বাণ এতক্ষণ আশার আলো দেখছিল। এখন তার মুখটা শুকিয়ে গেল। বলল “কিন্তু আমাদের দোষটা কি?”
কনিস্ক চোখ পাকাল “দোষ মানে? পুরোটাই দোষ, তুমি সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোক, আমাদের শ্রেণীশত্রু”।
পার্বণী রেগে বলল “শ্রেণীশত্রু মানে আবার কি? আপনি তো দেখছে অ্যালেন সলির প্যান্ট পড়েছেন। আপনি তাহলে তো আরও বড় শ্রেণীশত্রু। তাছাড়া, বাবা মা লোন নিয়ে ছেলেকে পড়াশুনা করাবে ছেলে কি করবে তার জায়গায়? ভিক্ষা করবে? না চাকরি করবে?”
কণিস্ক কটমট করে পার্বণীর দিকে তাকিয়ে বলল “অত জবাব আমি দিতে পারব না, গভর্নমেন্টের জন্য ওয়েট করব, তারপর ইন্সট্রাকশান ফলো করব। চল তোরা”।
বেরিয়ে গেল ওরা। যাবার সময় পার্থ হাত নেড়ে গেল।
অনির্বাণ পার্বণীকে বলল “কি দরকার ছিল এটার?”
পার্বণী বলল “কি দরকার মানে? তুমি কি ভেড়া? ওই মালটা ভাট বকে যাবে আর শুনবে?”
অনির্বাণ হাত জোর করে বলল “আচ্ছা মা, ঠিক আছে, ঠিক আছে”।
৬.
৯ই জানুয়ারি, মাঝরাত
এইরকম যে ঘটতে পারে অনির্বাণ বা পার্বণী কেউ কোনদিন ভাবতেও পারেনি। দুপুরে খেতে দিয়েছিল পাউরুটি আর ডিমসেদ্ধ। পার্বণী “ভাত আছে” নাকি জিজ্ঞেস করায় একটা ছেলে এসে একটা বাটিতে করে মেঠো ইঁদুর পোড়া দিয়ে গেছিল। সেটা দেখে পার্বণী ওখানেই বমি করে দেয়।
বিকেলের দিকে অন্য তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের চোখ বন্ধ করে।তাঁবুর বাইরে সবসময় পাহারা থাকে। সকালটা যদিও ভালভাবে কেটেছিল কিন্তু রাত গড়াতেই জঙ্গলের তুমুল ঠাণ্ডা তাদের অস্থির করে দেওয়া শুরু করল। তাদের ক্যাম্পের ওপর দুটো কম্বল রাখা। গায়ে তাদের শীত রক্ষার জন্য কোট আছে বটে কিন্তু সেটা একেবারেই কোন কাজে লাগছে না বোধ হচ্ছে।
অনির্বাণ পার্বণীকে বলল “রাতে আর বমি টমি কোর না। তাহলে না আবার বাইরে বের করে দেয়”।
পার্বণী বলল “কি করব, হঠাৎ করে ওরকম ইঁদুর দেখলে আর ঠিক থাকা যায়?”
অনির্বাণের রাগ হচ্ছিল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল এই খাবারগুলি ইচ্ছা করেই তাদের দেওয়া হচ্ছে। সকালে কণিস্কর মুখে মুখে কথা বলারই শাস্তি এটা।
রাতে তারা খেল না। পাউরুটিই দেওয়া হয়েছিল আরেকবার। অনির্বাণের মনে হচ্ছিল পার্বণীর অসুস্থ লাগছে।
পার্বণী শুয়ে পড়ল। সকালের উৎসাহটা অনেকটাই কমে গেছিল তার।
ক্যাম্পের নীচে একটা জলের বোতল থেকে জল নিয়ে পার্বণীর মাথায় সামান্য দিল অনির্বাণ। পার্বণী আঁতকে উঠে বসল “কি করছ?”
অনির্বাণ ম্লান হাসল “এবার অ্যাডভেঞ্চারটা ভাল লাগছে তো?”
পার্বণী বলল “কি আর হবে, ম্যাক্সিমাম আমাদের মেরে ফেলবে, অত চাপ নিয়ে লাভ আছে কি?”
অনির্বাণ বলল “আমার তো মনে হয় গুলি করে মারার আগে এই ঠাণ্ডাই আমাদের মেরে ফেলবে”।
পার্বণী হঠাৎ অনির্বাণের হাতটা ধরল। বলল “তোমাকে একটা কথা বলি”?
অনির্বাণ অবাক হল। “কি?”
পার্বণী বলল “আজ সকালে পাহাড়ে যাচ্ছিলাম কেন জান?”
অনির্বাণ বিরক্ত হয়ে বলল “না, যা বলবে একবারে বল না, এত ভূমিকা কিসের?”
পার্বণী মুখ ফিরিয়ে বলল “তাহলে বলব না যাও”।
অনির্বাণ আরও বিরক্ত হল “কি পেয়েছ বল তো? সকাল থেকে এই চলছে পুরোটাই তোমার জন্য আর তোমার এখন মান অভিমানের পালা শুরু হল?”
পার্বণী রেগে মেগে বলল “আমি কনসিভ করেছি। বুঝলেন? সেই সারপ্রাইজটা দেবার জন্য পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাচ্ছিলাম তোমায়”।
অনির্বাণ খুশি হবে না দুঃখ পাবে বুঝতে পারছিল না। বলল “সে কি? এত বড় একটা কথা তুমি দুর্গাপুর থেকে পেটে চেপে আসছ”?
পার্বণী বলল “সে তুমি কি বুঝবে? কোথাও নেবে না, সারাদিন বাড়িতে পচিয়ে মারবে, এই জন্যই তো এত জোর করেছিলাম বেড়াতে আসার জন্য”।
অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল পার্বণী। অনির্বাণ বুঝতে পারল একটা খুব বড় কেলো করে ফেলেছে সে।
পার্বণীকে এবার বোঝানো শুরু করল সে। কিন্তু অনেক অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও পার্বণী শক্ত হয়ে শুয়ে থাকল।
হঠাৎ বাইরে থেকে একটা চাপা গলার আওয়াজ এল “অনির্বাণদা ও অনির্বাণদা বাইরে এস শিগগির”।
গলার আওয়াজটা শুনে অনির্বাণ আর পার্বণী দুজনেই চমকে উঠল। পার্বণী বিছানায় উঠে বসে অনির্বাণের হাতটা শক্ত করে ধরল। অনির্বাণ উঠতে গেলে বাঁধা দিল। সেই বলল “ভেতরে আয়”।
প্রায় তিন বছর পরে অরিত্রর দেখা পেল তারা। অনির্বাণ বা পার্বণী কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি এইভাবে এই জায়গায় অরিত্রর দেখা পাওয়া যাবে।হ্যাজাকের আলোতেও অতটা না বোঝা গেলেও মুখে হালকা দাঁড়ি, গায়ের রঙে বেশ খানিকটা কালশিটে পড়ে গেছে এটা বোঝা যাচ্ছিল।
অনির্বাণ বুঝতে পারছিল না কি বলবে। পার্বণীই মৌনতা ভাঙল “কি রে তুই? এখানে কি করছিস? জানিস তোকে কত খোঁজা খুঁজি হয়েছে?”
অরিত্রকে দেখে সেই কলেজ লাইফের চঞ্চল ছেলেটা মনে হচ্ছিল না অনির্বাণের। দেখে স্পষ্টই বোধ হচ্ছিল ওর বয়সটা যেন কুড়ি বছর বেড়ে গেছে।
অরিত্র বলল “কি বলি বলত। এদের পাল্লায় পড়ি আমি তখন। পলাশমিতা নামে এক মেয়ের টোপে। সেই থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ছত্তিসগড়”।
অনির্বাণ বলল “বাড়িতে একটা খবর তো দিতে পারতিস?”
অরিত্রর চোখ ছল ছল হল। বলল “কি করে দেব। তখন আমি স্ট্রিক্ট নজরে। আমার পরীক্ষা হচ্ছে। সে সব ভয়ঙ্কর দিন গেছে। আর এখন যোগাযোগ করে কি হবে আর, কোনদিন তো পুলিশের গুলিতেই মরতে হবে। বাবা মার কাছে মরে তো গেছিই। আর বেঁচে আছি জানলে এক্সপেক্টাশন তৈরি হবে। সত্যি বলতে কি এখন আর সভ্য সমাজে ফিরে বাঁচার উপায় নেই অনির্বাণদা”।
অনির্বাণ কি বলল বুঝতে পারল না। সে বুঝতে পারছিল হারিয়ে যাবার আগে অরিত্রর যাতায়াতগুলিই তাকে শেষ পর্যন্ত এই ট্র্যাপে ফেলে দিয়েছিল। হঠাৎ করে সাজ পোশাক বেড়ে গিয়েছিল। কখনও রোজ ক্লাস করা শুরু করল, তারপরেই আবার ডুব দিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াত। কথার খেই হারিয়ে ফেলছিল সে। মনে প্রচুর প্রশ্ন আসছিল কিন্তু কোনটা আগে করবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারল না।
অরিত্রই বলে চলল “শোন আমি যে জন্যে এখন এসছি। এই সময়টা কণিস্ক দীপ আর গার্ডগুলি কেউ নেই। প্রায় আধঘণ্টা সময় আছে হাতে। তাঁবুর পেছনদিকটা বরাবর হাঁটা শুরু কর। আলো দেখতে পাবে বেরিয়েই, ওই বরাবর হাঁটলে একটা পুলিশ চৌকি দেখতে পাবে। ততক্ষণ আমি এদের ব্যস্ত করে রাখছি।একঘণ্টা মত লাগবে পৌঁছতে যদি তাড়াতাড়ি যাও যত তাড়াতাড়ি পার পালাও”।
পার্বণী বলল “আর তুই? তুইও চল আমাদের সাথে”। হঠাৎ মুক্তির আনন্দে পার্বণী ঝলমল করে উঠল। কিন্তু অরিত্রকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতেও ইচ্ছা করছিল না তাদের।
অরিত্র ম্লান হাসল। “আমি এখন চাইলেও যেতে পারব না রে... আর কিছু করার নেই আমার”।
“আর সেই মেয়েটার খবর কি? যার জন্য সবকিছু ছেড়ে তুই এখানে?”
অরিত্র হাসিটা বজায় রেখেই বলল “কে জানে হয়ত কোন এন আর আই এর ঘর করছে এখন, তোরা আর দাঁড়াস না, পালা এখনি, অরুণজি খুব মুডি লোক, কখন কি মনে হবে দিল হয়ত গুলি করে, এই রাস্তাটা বরাবর যা চলে আর কোথাও দাঁড়াবি না, এদের নেটওয়ার্ক সাংঘাতিক, একবার ধরা পড়লে আর দেখতে হবে না”।
অনির্বাণ জুতো পরে নিল তাড়াতাড়ি। পার্বণীকে নিয়ে বেরতে বাস্তবিকই দেখা গেল এখন আর কোন গার্ড নেই। দূরে একটা তাবু থেকে হই হল্লা ভেসে আসছে।
জঙ্গলের অন্ধকারে মিশে যাবার আগে সে জিজ্ঞেস করল অরিত্রকে “তোর বাবা মা কে কিছু বলতে হবে?”
অন্ধকারের মধ্যে অরিত্রর মুখটা দেখা গেল না। শুধু একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল “না”।
তারপরে তারা ছুটতে শুরু করল।
আলোর উদ্দেশ্যে...
প্রথম পর্ব
১.
।।অরিত্রর ডায়েরি।।
২৩শে নভেম্বর,২০০৭
অর্পিতার বাবার সাথে আর আমি কখনও কোন ওসুধের দোকানে যাব না।এরপর থেকে অর্পিতাদের বাড়িতেই যাব না। যদি অর্পিতার সাথে আমার বিয়ে হয় তবে যতটা কম যেতে হয় তাই যাব। অর্পিতার সাথে আমার বিয়ের সম্ভাবনা যদিও ০.০০০০১% এরও কম তবু আজ আমি এই প্রতিজ্ঞা করেই নিলাম।
মানে হয় নি কিছুই। এস জির টিউশন শেষে অর্পিতা বলল ওর বাড়ি থেকে খাতাটা নিয়ে যেতে। টানা দু দিন বাঙ্ক মেরে মাসির বাড়ি লিলুয়ার ঘুরে এসেছে। সাল্লু মিঞার অন্ধ ভক্ত ও। বাড়ি থেকে গেলে ওর বাবা বকবে তাই ছক করে মাসির বাড়ি গিয়ে সিনেমা দেখে এসছে। পেন্সিল বক্সে পর্যন্ত সালমান খানের ছবি রেখে দিয়েছে।
যাক গে, যে কথা বলছিলাম, অর্পিতার বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দেখি ওর খরুশ বাপ কোথায় যাবার জন্য রেডি হচ্ছে। আমাকে দেখে নাক উঁচু করে বলে কিনা “কোথায় যাবে?”
আমি বললাম “মেসে”।
বলে “চল তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। তুমি তো বাসে যাবে? আমি গড়িয়ার ওদিকেই যাব। তোমায় নামিয়ে দেব”।
কি আর বলব। খারাপ না ভেবে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আমাকে নিয়ে ঢুকল একটা ওষুধের দোকানে। আমি বললাম যে আমি গাড়িতেই বসি বলে কিনা দরকার নেই, গাড়ি তে একা একা বসে বোর হবে।
ওদের পাড়ার দোকান। দুটো নাবালক টাইপ দোকানদার বসে ছিল। ওর বাবা হঠাৎ গিয়েই দেখি কি ঝাড় দিল ছেলেদুটোকে, “তোদের কতবার বলেছি, এই সব প্রাপ্তবয়স্ক জিনিস দোকানের সামনে টাঙিয়ে রাখবি না, এগুলি লুকনোর জিনিস, ফলাও করে অ্যাড করার জিনিস না। যতসব!”
ততক্ষণে বুঝে গেছি। ওই যে কিসব তেল টেল টিভিতে অ্যাড হয়। কন্ডোমও ছিল। ওর বাবাকে তো আর বলতে পারি না এসব জিনিস আমাদের কলেজের টয়লেটেও থাকে আঙ্কেল তুমি দেখতে চাইলে একদিন দেখতে পার।
ছেলেগুলি মিউ মিউ করে কি সব বলতে গেল, অ্যাপির বাবা রাম বকুনি দিয়ে থামিয়ে দিল। চারদিকে বেশ একটা ভিড় মত জমে গেছিল। আমার লজ্জায় মাথা হেট।ওষুধ কেনার পরে চুপচাপ এসে কোন মতে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তারপরে শান্তি। এই নাক মুল্লাম কান মুল্লাম, আর জীবনে কখনও ওদের বাড়ি আমি যাব না। গাড়িতে উঠব না। আর ওষুধের দোকানের থেকে দুইশ হাত দূরে থাকব।
#
মেসে আমার খুব একটা থাকতে ভাল লাগে না। এই পঞ্চসায়র জায়গাটা কিরকম যেন। এত শান্ত জায়গা ভাবা যায় না। বাড়ির কথা কি সাধে মনে পড়ে। আমাদের পাড়াটাতে তো সকাল বিকেল ঝগড়া লেগেই আছে সাহাবাড়িতে। বীরেন সাহার দুটো বউ পালা করে চিল চিৎকার জুড়ে জমিয়ে রাখে পাড়া। কালই তো অর্ণব বলছিল একসাথে দুটো মেয়ের সাথে প্রেম করলে কেমন হয়। ওর নাকি ইয়াহু মেজেঞ্জারে কোন একটা মেয়েকে চরম লেগেছে। একদিন হাইল্যান্ড পার্কে গিয়ে দেখা করেও এসেছে। এদিকে প্রিয়াঙ্কা ওর স্টেডি জি এফ। জানলে রাম ধোলাই খাবে বাছাধন।
আমি বুঝি না অর্ণবের সাথে একসাথে দুটো মেয়ে কি করে প্রেম করে। বা অর্ণব তুললই বা কি করে। ওর মুখ দিয়ে সবসময় বেড়াল পচা গন্ধ বেরোয়। মেয়েরা কি সে সব গন্ধ পছন্দ করে নাকি। ইস।
করুক গে যা ইচ্ছা করুক। এদিকে আমার কি হবে? সামনের মাসে দশ তারিখ থেকে সেম এদিকে আদ্দেক সাজেশন জোগাড় হয় নি। ক্লাস তো করিই না। কয়েকটা ফ্যাকাল্টি এখনও আমার বাঁশি শুনেছে। চাক্ষুস দেখে নি এখনও। ভাইভায় পেলে স্রেফ জল দিয়ে গিলে খাবে মনে হয়। এই এস জিটাও মহা ... ইয়ে আছে।মাসে এতগুলি টাকা নেয় ওদিকে সাজেশন ছাড়তে বললে খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসছে। ডায়েরিতে গালাগাল দেব না ঠিক করেছি নইলে...।
যাক গে। যা হবে হোক। অত চাপ নিয়ে কি হবে। আজ প্রলয় বলেছে একটা ভাল জিনিস পেয়েছে। রাতের খাবার সাটিয়ে সেটাই দেখতে হবে।
যাক অনেক লিখে ফেলেছি আজ। নিজের সেমের ডায়েরিতে এত লিখলে নির্ঘাত E বা O পেয়ে যেতাম। অংশুকে একটু জ্বালাই গিয়ে। শুনছি পায়েল নাকি আজকাল ওর ঝাড়ির রিপ্লাই দিচ্ছে। কি কেলো! পায়েলের সাথে অংশুর বিয়ে হলে প্রোডাক্টটা যাবে হবে না। পুরো জেব্রা। খ্যাক খ্যাক।
২.
১৪ই জানুয়ারি ২০০৮
পার্বণীঃ
শীতকালটা তাও খানিকটা কলেজে আসলে বোঝা যায়। আমাদের বাড়ির ওদিকটায় তো যা তা লেভেলের গরম পড়ে। সেমের শুরুর দিন ক্লাস করার মত মজার জিনিস আর কিছু হয় না। তবু আজ ভাল লাগছিল না ক্লাস করতে। সেমের চাপ কাটিয়ে এখনই ওই কঠিন কঠিন সাবজেক্টগুলির মুখোমুখি হতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না।
দুটো ক্লাস করে থার্ডটা বাঙ্ক মেরে দিলাম। প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে মাঠের দিকে গিয়ে বসলাম।বেশ নরম রোদ, নীল আকাশ, এই রকম পরিবেশ আমার খুব ভাল লাগে। আমাদের অর্ধেক ক্লাসের ছেলেরা এদিকেই দেখি। ক্রিকেট খেলতে ব্যস্ত। বাকিগুলো বাইরে থেকে চিয়ার করছে। ওদের ওখানেই বসলাম।
সায়ন আমাদের দেখে টোন কাটল “কিরে পথ ভুল করে এলি নাকি?”
প্রিয়াঙ্কা জ্বলে পুড়ে উঠতে যাচ্ছিল। আমি ওকে একটা চিমটি কাটলাম। এই সায়নের কাজই হল কোন কাজ করবে না শুধু মাঝে মাঝে ফোঁড়ন কাটবে। আমাদের ক্লাসের ব্যান্ডে আছে অথচ ও কি করে কেউ জানে না। বাজায় না গায় ভগবান জানে।
কাদের সাথে খেলা হচ্ছিল জানি না কিন্তু হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে প্রিয়াঙ্কা বলে উঠল “উফ কি ফিগার রে মালটার। কে রে এটা?”
সত্যি দেখার মতই ফিগার ছেলেটার। ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবে।জামা খুলে বোলিং করছিল। বল করার সময় মনে হচ্ছিল হাওয়ার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে, এত সাবলীল। সায়ন শুনেছিল প্রিয়াঙ্কার কথা। আবার ফুট কাটল “অর্ণবকে বলব নাকি?”
প্রিয়াঙ্কা হাতের কাছে থাকা একটা ঢেলা ছুড়ল ওর দিকে। বলল “তোর কি বে? তুই কি অর্ণবের বাপ নাকি শালা?”
সায়ন ঢেলাটা লুফে নিয়ে বলল “ইন্সট্রু ফাইনাল ইয়ার। বেশি চাপ নিস না। বদহজম হয়ে যাবে। সি এসের সুন্দরী কৃষ্টি ওর সাথে সৃষ্টি উৎসবে ব্যস্ত”।
প্রিয়াঙ্কা মুখ বাঁকাল। সায়নের কথা শুনে আমার বেশ মজা লাগল। বললাম “বাহ, তুই তো বেশ ছন্দ মেলাতে পারিস”।
কথাটা আমার বলা উচিত হয় নি। ব্যাটা সাথে সাথে ভাও নিয়ে নিল। গম্ভীর হয়ে বলল “আমি লিটল ম্যাগাজিন করি। ক’টা লোক আছে এই কলেজে এসব করে?”
প্রিয়াঙ্কা বলল “হ্যাঁ বে শালা কলেজে তোর মত ভাট মাল তুই একটাই আছিস”।
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। প্রিয়াঙ্কার মুড আজ অফ মনে হচ্ছে। বেশ গরম গরম কথা বলছে। ওকে বললাম “চ’ ক্যান্টিনে গিয়ে বসি”।
উঠে দেখি সায়নটা পেছন পেছন আসছে। বিরক্ত হলাম। এ ব্যাটা মেয়েদেরও অধম। সব কথা শুনতেই হবে।
ক্যান্টিনে রোজের মতই অনুরাধা সাগ্নিকের সাথে ন্যাকা ন্যাকা মুখ করে বসে আছে। এ দুটোকে দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আর কি কোন কাজ নেই। সারাক্ষন বসে আছে। ক্লাসে একসাথে। লাইব্রেরীতে একসাথে। ল্যাবে একসাথে। ফেবিকল দিয়ে যেন আটকে রাখা আছে দুটোকে। আমরা ঢুকতেই আমাদের দেখে হাত নাড়ল দুটো। যেন দুটো বোন বসে আছে।
প্রিয়াঙ্কা ফিসফিসিয়ে বলল “ওই দেখ ডাকছে কি করবি?”
আমি ফিসফিসিয়েই উত্তর দিলাম “চেপে যা। এমন ভাব কর যেন দেখিস না। উল্টো মুখ করে ওদিকের টেবিলটায় বস”।
ওদেরকে কোনমতে অ্যাভয়েড করে বসলাম। সায়নও জুটল। আমি বললাম “কিরে তোর কি কোন বক্তব্য আছে? ফলো করছিস কেন?”
সায়ন তৎক্ষণাৎ মুখটা সিরিয়াস করে বলল “তোদের কাছে পঞ্চাশটাকা করে হবে?”
অবাক হলাম। এ বলে কি। “কেন?”
সায়ন আরও সিরিয়াস হয়ে বলল “নন্দীগ্রাম যাব। আমি আর কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। ওখানে একটা বাজে লেভেলের টেররিজম চলছে। রিলিফ দিতে যেতে হবে”।
আমি আর প্রিয়াঙ্কা হেসে ফেললাম “তুই বুদ্ধিজীবী? শালা তোকে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে বুদ্ধিজীবী লাগে বলত?”
প্রিয়াঙ্কা বলল “বালখিল্য লেভেলের”।
আবার হেসে ফেললাম।
সায়ন হাসল না। সিরিয়াস মুখে বলল “না রে। তোরা জানিস না। সেমের পর আমি গেছিলাম। সে কি অবস্থা। আজ এই লোক ঘরছাড়া কাল ওই”।
প্রিয়াঙ্কা বলল “আমাদের থেকে টাকা নিয়ে কি করবি?”
-ফান্ড তুলছি। ওখানে রিলিফে লাগবে।এতো কলকাতার মত শীত না। মেদিনীপুরের শীত। মারাত্মক ঠাণ্ডা। কোথাও কোথাও একটা কাথা পর্যন্ত নেই। সব ফেলে পালাতে হয়েছে।
আমি একটু অবাকই হলাম। সায়নের এরকম রূপ আগে দেখিনি। আমরা কলেজ, আড্ডা, ক্লাস এইসব নিয়ে থাকি কিন্তু ও যে এতটা গভীরে গেছে সেটা বুঝিনি।
ব্যাগে কিছু টাকা ছিল। ওকে একশো টাকাই দিলাম। প্রিয়াঙ্কাও দিল। সায়ন উঠতে উঠতে বলল “বাই দ্য ওয়ে, এবার ফেস্টে কে আসছে জানিস তো?”
আমরা মাথা নাড়লাম।
সায়ন ঘ্যাম নিয়ে বলল “গেস কর”।
প্রিয়াঙ্কা খচে গেল “দূর বাল। অত চাপ নেবার কি আছে। বললে বল, নইলে ফোট”।
সায়ন ফিউজ হয়ে গিয়ে বলল “ইউফোরিয়া আর ফসিলস”।
৩.
৩ মার্চ, ২০০৮
-মার্কস এত কম কেন?
-স্যার ক্লাস করতাম না। বুঝতাম না অর্ধেক।
-ওহ। ঠিক আছে তুমি যেতে পার।
দুটো বাক্যে অনির্বাণের ইন্টারভিউ হয়ে গেল। চুপচাপ উঠে চলে এল। গত দুটো ইন্টারভিউতেও একই জিনিস হয়েছে। এই নিয়ে তৃতীয়বার। গ্রেড কম আছে সেটা তো ওরা জানে। সেই হিসেবে কাট অফ দেওয়া আছে। তার ওপরে নাম্বার পেয়ে অ্যাপ্টিচুড ক্লিয়ার করেই তো ইন্টারভিউতে এসছে।
বাইরে সবাই মগ্ন, কেউ পড়ছে, কেউ টেকনিক্যাল দিয়ে বেরিয়ে সবাইকে গল্প শোনাচ্ছে। তিন বছরের ক্লাসটা কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেছে। এতদিন সবাই একসাথে ছিল, এক সাথে ক্লাস বাঙ্ক করত, এবার ক্যাম্পাসিং হয়ে গেলেই সবাই আলাদা হয়ে যাবে। পরিষ্কার দুটো গ্রুপ তৈরি হবে, ১) যারা ক্যাম্পাসিংএ পেল ২)যারা পেল না।
শুধু এই দুঃস্বপ্নে সে ক্যাম্পাসিংয়ে বসে। সামান্যও যদি আশা থাকে চাকরি পাবার। হেরে যাবার দলে ঢুকতে তার বড় আপত্তি।
ক্লাস থেকে বেরতে তিন চারজন তার দিকে ছুটে এল। “কিরে, কি হল?”
“কি জিজ্ঞেস করল”?
বিভিন্ন রকম প্রশ্ন ছুটে আসছিল।
সে অ্যাভয়েড করতে চাইল ভিড়টাকে। বলল “আরে আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি, নাম্বার কম কেন বলে ছেড়ে দিল”।
হতাশ শরীরটাকে বেঞ্চিতে এলিয়ে দিল সে। টাইটা বেশ শক্ত হয়ে গলায় বসেছিল। খুলে ফেলল।
বাড়ি যেতে হলে তাকে এখনই বেরতে হবে। মেসে আর যাওয়া যাবে না এখন।
অনীক এল। এটাকে দেখলে গা জ্বলে তার। আরে তোর রেজাল্ট ভাল তো কি হয়েছে। লোকজনের প্রবলেম হলে এত খুশি হবার কি আছে!
তাকে দেখে দাঁত বের করে বলল “কিরে? কেমন হল?”
সে চুপচাপ বসে ফাইলপত্তর গোটাতে গোটাতে বলল “হয় নি। রেজাল্ট খারাপ বলে ভাগিয়ে দিয়েছে”।
-হে হে; যাঃ শালা, তাহলে তো ব্যাড ল্যাক রে শালা।
উঠল সে। বলল “আমি গেলাম। আর ঝাট জ্বালাস না”।
অনীক চুপ করে গেল। অনির্বাণ বেরিয়ে প্লেসমেন্ট অফিসারের ঘরের দিকে এগোল। সবাই চুপচাপ বসে আছে। সে সোজা প্লেসমেন্ট অফিসারের ঘর নক করল “স্যার আমি একটু আসব”।
ঘর ফাঁকাই ছিল। তাকে আসতে বললেন দে স্যার। সে ঢুকে বলল “স্যার, আমার তো হয়ে গেছে আমি বাড়ি চলে যাব?”
দে মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচের ফাক দিয়ে তার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। বললেন “যাবে মানে? এখন তো সবে সকাল দশটা? কি বলল তোমায়?”
-কিছুই তো। নম্বর কম কেন বলে ছেড়ে দিল।
-ওহ।
হেলান দিয়ে চেয়ারে বসলেন দে স্যার। বললেন “রিসেশনের সময় তো। এ তো হবেই। আগে নম্বর দেখবে।ঠিক আছে, বেটার লাক নেক্সট টাইম। তুমি কি তাহলে এখন...”
-হ্যাঁ স্যার, সেটাই তো বলছিলাম।
-ঠিক আছে। পরশু এক্স জেড টেকের টা আছে কিন্তু। এস।
নীরস গলায় হ্যাঁ বলে বেরল অনির্বাণ।
প্রথম যখন কলেজ এসছিল তখন র্যাগিংয়ের ভয় ছিল। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে সে ভয় কেটে যেতে ধীরে ধীরে ভালই লাগছিল কলেজটা। ক্লাস করতে চিরকালই বড়ই অনীহা তার। তাদের একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। সমর্পণ, অভ্রদিপ, শুভ্ররা তাকে ধীরে ধীরে কলেজটা ভাল লাগাচ্ছিল।
এই সময়টার পরে আবার সব আলাদা হয়ে যাবে। ফাইলপত্র নিয়ে ব্যাগসহ সে কলেজ থেকে বেরল। বাইরে চায়ের দোকানটা গমগম করছে। সব ছেলেপিলেই টাই পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিনে কলেজটা কেমন বড় হয়ে গেছে।
সে বেরনোর পর চায়ের দোকান থেকে দুয়েকজন ডাকছিল কিন্তু সে আমল দিল না। ভ্যানে উঠে বসল। এখন বেরলে দুপুরের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। সন্ধ্যে হলে আর বনগাঁ লাইনের রিস্ক নেওয়া যাবে না।
#
বাস যখন উল্টোডাঙা ঢুকছে তখন মোবাইলে দে স্যারের নম্বরটা দেখে খানিকটা চমকাল সে। ফোনটা ধরতেই উল্টো দিক থেকে উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল “এই অনির্বাণ তুমি কোথায়?”
-স্যার উল্টোডাঙা পৌঁছে গেছি।
-আরে তুমি শিগগির ব্যাক কর। তোমাদের আরেকবার টেকনিক্যাল হবে। ওদের প্যানেল রেডি ছিল না বলে তোমাদের ব্যাক করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখনই শুরু হয়েছে। আমি বলে রেখেছি। তুমি আধঘণ্টার মধ্যে যেভাবে পার চলে এস।
ফোনটা রাখার পর বুকের হৃদপিণ্ডের স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। আধ ঘণ্টার মধ্যে কলেজ মানে তাকে এখনই নেমে ট্যাক্সি নিতে হবে। কোনমতে নেমে চলন্ত ট্যাক্সিতে ওঠার চেষ্টা করার পর তৃতীয়বার উঠতে পারল সে। কলেজের নাম বলে মাথাটা যখন ট্যাক্সির সোফায় রাখল তখন স্পষ্টই বুঝতে পারছিল ঘামে গোটা শরীরটা ভিজে গেছে।
#
সন্ধ্যা সাতটা। সকাল থেকে খালি পেটে বসার পর অনির্বাণের ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকে দেখতে পেল ছোট ঘরটায় পাঁচজন বয়স্ক লোক বসে আছেন। আর সকালের সেই চ্যাংড়ামত ইন্টারভিউয়ার।
সে অনুমতি নিয়ে বসার পরে মেশিনগানের মত প্রশ্নবাণ ছুটে এল।
“write down first write down the 1st c program”
সে লিখল। একটু তাড়াতাড়িই লিখে ফেলল। সকালের ইন্টারভিউয়ার অবাক হয়ে বললেন “কম্পিউটার আগে এক্সিকিউট করবে না তুমি আগে লিখে ফেললে হে”।
লেখার সাথে সাথেই প্রোগ্রামটার কাঁটাছেড়া শুরু করলেন পাঁচজনে মিলে। একের পর এক প্রশ্নবান তাকে জর্জরিত করে তুলছিল। কিন্তু সে নড়ল না। সেটা পারবে না বুঝছিল সরাসরি বলে দিচ্ছিল “স্যার এটা আমি জানি না”।
প্রায় আধঘন্টা খানেক ধস্তাধস্তি হবার পরে তাকে ওনারা রেহাই দিলেন। সে ফাইলটা নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল হঠাৎই তার মাথায় একটা বেয়ারা প্রশ্ন এল। সে ঘুরে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা আমি কি একটা উত্তর পেতে পারি?”
সবাই অবাক চোখে তাকালেন তার দিকে। মধ্যমণি ভদ্রলোক বললেন “ইয়েস, ক্যারি অন প্লিজ”।
সে দৃঢ়স্বরেই বলল “স্যার অ্যাম আই থ্রু অর নট?”
সবাই হেসে উঠলেন। সকালের চ্যাংড়া ইন্টারভিউয়ার বললেন “আরে একটু ওয়েট কর, আমরা জানিয়ে দিচ্ছি এখনই”।
সে বেরল। বিরক্ত লাগছিল। কলেজে ফেরার পর থেকে অপেক্ষা করিয়ে করিয়ে প্রায় পচিয়ে দিচ্ছে। বলে দিলেই পারে নেবে না নেবে না।
প্যাসেজ ধরে খানিকটা হাঁটার পর কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেল। ঘুরতে চমকে গেল। সকালের ইন্টারভিউয়ার। তাকে দেখে হাসলেন।বললেন “তুমি এত অ্যাগ্রেসিভ কেন?”
অনির্বাণ কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল “স্যার সকাল থেকে কিছু খাই নি, খালি পেটে আছি, তাই অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছি”।
হেসে ফেললেন। বললেন “তুমি থ্রু। এরপরে একটা এইচ আর ইন্টারভিউ আছে। ওটায় বেশি প্রশ্ন হবে না। ধরে নাও ইউ আর জয়েনিং আস”।
কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না অনির্বাণের। এ বলে কি? সকালে জানত আর কোন কিছু হলেও এ চাকরিটা অন্তত তার হবে না। আর এখন এত বড় একটা কথা কি অনায়াসে বলে দিলেন। বাইরেটা অন্ধকারে কালো হতে হতে কালশিটে পরে গেছে। তার মনে হচ্ছিল চেঁচিয়ে সবাইকে জানায় সে চাকরি পেয়ে গেছে।
“থ্যাঙ্ক ইউ” বলতে ভদ্রলোক তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন “আর হ্যাঁ, তুমি এখন ঠিক যেরকম অ্যাগ্রেসিভ, আমরা কিন্তু এই আগুনটাই চাই। এটা রেখ... কাজে দেবে”।
মাথা কাজ করছিল না। সে অবস্থাতেই “হ্যাঁ” বলল সে। ইচ্ছা করছিল লাফাতে, হাসতে কাঁদতে, কিন্তু কোনটাই করতে পারছিল না।
আধা অন্ধকার কলেজ প্যাসেজ সাক্ষী হয়ে রইল তার জীবনের প্রথম চাকরি পাবার।
৪.
১০ই মার্চ ২০০৮
।।অরিত্র।।
এই সায়নের সাথে এসে ফেঁসে গেলাম তো! কলেজ কেটে বেরলাম বলল সিনেমা দেখতে যাবে এখন দেখি দাড়িওয়ালা বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিয়ে এসছে। নন্দীগ্রামের একবছর নিয়ে কিসব প্রোগ্রাম টোগ্রাম হবে। ইদানীং সায়নের এইসব ব্যাপারে বেশ বাড় বাড়ন্ত হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। ক্লাস তো ঠিকঠাক করছেই না উলটে যখন তখন কলেজ কেটে এইসব কাজ করছে। আমার এখন বেশ রাগ হচ্ছে। এইসবের কোন মানে হয়! ভরদুপুরে দাড়ি দুলিয়ে কি জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে মাইরি লোকটা। এ মালটাকে জীবনেও দেখি নি। টিভিতে নামও শুনিনি। কিন্তু সায়ন এমন মনোযোগ দিয়ে লোকটার বক্তব্য শুনছে ওই মনোযোগটা ক্লাসে দিলে লাস্ট সেমে দুটো সাপ্লি পেত না।
“তোমরা শাসকের রূপ দেখনি। শাসক মানে কি? প্রথমে বুঝতে হবে এই শাসক কোথা থেকে এল? মার্ক্স কি বলেছেন শাসকের ব্যাপারে”।
সেরেছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে যে। কি ঝাট কেস। এখান থেকে উঠে পড়তে পারলে বাঁচি। গোলপার্কের কাছে এই কফিশপটা খারাপ না। প্রেম করলে গার্লফেন্ডকে নিয়ে আসার পক্ষে আদর্শ। তাও যদি এই গ্রুপে দু চারটে ডবকা পিস থাকত। দুটো মেয়ে আছে। একটাকে দেখে মনে হচ্ছে চারদিন পায়খানা হচ্ছে না। আরেকটাকে কুড়িটা বাঘ মিলেও শেষ করতে পারবে না শালা এত মোটা।
“তোমাদের পরশু দিন রাস্তা দখল করতে হবে, কলকাতা দখল করতে হবে, ভুলো না, কলকাতা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে”।
একটা ছেলে দুর্বল গলায় প্রশ্ন করল “আমরা তো এই ক’জন, এ’কজনে কি হবে?”
বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকালেন বুদ্ধিজীবী। বললেন “তার চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। আমাদের সংগঠনের সবাই আসবে। শুধু তোমাদের মধ্যে আগুনটাকে রাখ”।
বেশ একটা চকলেট চকলেট গন্ধ আসছে। অনেকেই কিছু না কিছু খাচ্ছে। আমার খিদে খিদে পাচ্ছে। তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে এসছি, দুপুরে ক্যান্টিনেও খাওয়া হয় নি। তাছাড়া এক গ্লাস কোল্ড কফি খেলে মন্দ হত না। একা একা খাওয়াটা কি ঠিক হবে?আবার এতগুলো গাম্বাটকে খাওয়াতে যাবই বা কোন দুঃখে?
বেরলাম। অনেকক্ষণ ভাট শুনেছি। কিছু খাওয়া দরকার। সায়নটা বসে থাক। আমাকে তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি সারাদিন এখানেই বসে থাকতে হবে। রাতে হোস্টেলে হুল্লাট পার্টি আছে। সিনিয়র গুলো সব চাকরি পেয়েছে।হোস্টেলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে মেসে ফিরব নাকি হোস্টেলেই থেকে যাব এখনও ডিসিশন নিই নি। মাল থাকবে, পুরিয়া থাকবে...আহ। ভাবতেই চরম লাগছে।
কলকাতা কলেজে ভর্তি হবার আগে আসতাম কিন্তু এখন অনেক কাছের মনে হয়। আর গোলপার্কের এই জায়গাটাও দারুণ লাগে। এখানে হাঁটতে ভাল লাগে। তার থেকেও বড় কথা এখানে যে লেভেলের মেয়ে আসে জাস্ট ভাবা যায় না।
কলকাতার এই একটা জিনিস আছে। বাসে ট্রামে মেট্রোতে প্রচুর মেয়ে দেখতে পাওয়া যাবে। “আমাদেরও নাকি হবে, কে জানে বাবা কবে”...।
রুমালি রুটি আর মাংস দিয়ে চুপচাপ দুপুরের খানাটা সেরে নিলাম। যা বুঝছি ওই ঝাট মালটা আর ঝাট সায়নটা অনেকক্ষণ এসব করে যাবে। সেরকম হলে কেটে পড়তে হবে। এখন দুপুর দুটো প্রায়। বিকেল থেকেই হোস্টেলে পৌঁছে যেতে হবে। কে জানে হয়ত এখনই শুরু হয়ে যেতে পারে।
পরের বছর আমাদের ক্যাম্পাসিং আছে। জানি না কি হবে। কখন যে রিসেশন আসছে কখন যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। যা হবে দেখা যাবে। অত চাপ নিয়ে কি হবে।
#
প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। এবার দেখি। সায়নকে বলে কেটে যাই। উফ। ঝাটটা এখনও বকে যাচ্ছে। এখনও শাসক প্রশাসক নগরপাল নিয়ে কালচার চলছে। শালা কোন কাজ নেই নিশ্চয়ই।
সায়নকে একটা খোঁচা মারলাম। ব্যাটা হিপনোটাইজের মত হয়ে গেছে। “কিরে, চল”।
“দাঁড়া না” বিরক্ত মুখে উত্তর দিল সায়ন।
আচ্ছা হল তো। আর এই কফির দোকানটার লোকজনগুলিই বা কিরকম। এক পয়সাও কেউ কিনছে না, চেয়ার টেবিলগুলো দখল করে বসে আছে। তুলে দিতে পারে তো। তবে এই মালগুলির যে এনথু দেখছি। তুলে দিলে মনে হয় জঙ্গলে বসেও এইসব ভাটবাজি করে যাবে।
কি হল? চারদিকটা এরকম শান্ত লাগছে কেন? মনে হচ্ছে একটা ঝড় আসব আসব করছে?
যাহ্, শালা এটা কে এল? কি দেখতে উফ পাগল হয়ে যাব তো! পিঠখোলা চুল, কাঁচা সোনার মত গায়ের রং আরও কত ভাল ভাল জিনিস, বলে বোঝাতে পারব না। বুদ্ধিজীবীটার পাশে গম্ভীর মুখে বসে পড়ল। আর হাসিটা কি রে! এরকম জিনিস থাকলে আমি সারাদিন ওই দাড়িটার ভাট শুনে যেতে রাজি আছি। বাইরের লোকজনও সবাই মেয়েটাকেই দেখছে। একটা সাধারন সালোয়ার কামিজেও কেমন অসাধারন লাগছে। অন্য গ্রহের জীবটাইপ।
#
বিকেল পাঁচটা। আমি এখনও এখানেই আছি। সায়নের থেকে নাম জানলাম মেয়েটার। বিরাট বড় নাম। বানান করতে কলম ভেঙে যাবে। পলাশমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সায়নের কানে কানে বললাম “ভাই তুই কি এই মালটার জন্য এখানে আসিস? ঠিক করে বল”।
সায়ন খিস্তি মারল একটা “দূর... ভাট বকিস না”।
“ভাট শালা, সকাল থেকে ভাটের গুষ্ঠির তুস্টি করলি। এই বাড়া, এই বালের জায়গায় আমাকে আনতে গেছিস কেন? আর যদি আনবিই তবে ওই মেয়েটাকে ডাক, কথা বলি, নাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে আজকে”।
সায়ন চমকে তাকাল। বলল “কি শুরু করলি? ১৪তারিখ মিটিং আছে, সেদিন চলে আসিস, মিছিলের সময় হাতে হাত ধরে মানববন্ধন করে নিস না হয়”।
আমি ওকে একটা রাম চিমটি কেটে বললাম “এখানেই কেলানো শুরু করব তোকে এবার”।
চিমটিটা খেয়ে সায়ন ডুকরে কেঁদে উঠল “এই পলাশমিতা” বলে। ডাকার সময় ওর গলাটা কেমন ন্যাকা ন্যাকা হয়ে গেল।
মেয়েটা এদিকে আসতে সায়ন পরিচয় করাল আমার সাথে “অরিত্র, একে আনলাম আজ, নতুন অ্যাক্টিভিস্ট আমাদের সাথে জয়েন করল আজ”।
মেয়েটা হাসল। আহা কি হাসি।আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। বেশ স্মার্ট ভাবে হ্যান্ড শেক করল। নরম হাত। একবারে তুলোর মত।
বলল “আপনি তাহলে আসছেন তো আমাদের সাথে মিছিলে?”
আমি দাঁত বার করলাম। আর কি বলব। আসব মানে? তুমি যেখানে আমি সেখানে। প্রয়োজনে জাহান্নামেও চলে যাব। “আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল বাড়া”...
৫.
২৪ মার্চ, ২০০৮
।।পার্বণী।।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছিলাম আমি আর প্রিয়াঙ্কা। অ্যাসাইনমেন্ট আছে এক টা টি কে এমের। হঠাৎই লাইব্রেরীর সামনেটা কৃশানুদা আটকাল। কৃশানুদা আমাদের এলাকার ছেলে। প্রথম যখন কলেজে এসছিলাম অনেক হেল্প করেছিল। আমার এক বছর সিনিয়র।
ভাবলাম কোন টিউশনের কথা বলবে হয়ত। প্রিয়াঙ্কা চলে গেল লাইব্রেরীতে। কৃশানুদা প্রিয়াঙ্কা যেতেই আমাকে বলল “দেখ পার্বণী, তোকে একটা কথা বলি”।
আমি বললাম “বল”।
-দেখ, বেশি বানাতে আমার ভাল লাগে না, তোকে একটা কথা বলেই দি, আমার তোকে ভাল লাগে।আগে বলতে পারিনি, ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসিংয়ের পর বলব, এখন অনেকটা স্ট্রেস ফ্রি আমি। বলেই দি, আই লাভ ইউ।
হঠাৎ এরকম আচমকা কথায় খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কি বলব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কৃশানুদা অনেকটা হেল্প করেছে জয়েনিংএর পরে, নোটস দিয়েছে, ড্রয়িং দিয়েছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু ওকে তো আমি কোনদিন কল্পনাই করতে পারিনি এসবে।
কি বলব বুঝতে না পেরে বলে ফেললাম “আমি যাই আমার কাজ আছে”।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কৃশানুদা আমায় ফলো করে লাইব্রেরী অবধি চলে এল “তোর অ্যানসারটা দিয়ে যা, মানে ওয়াট ডু ইউ থিঙ্ক অ্যাবাউট মি। দ্যাখ, আমি কিন্তু মদ খাই না, সিগারেট খাই না, কোন বাজে নেশা নেই। তাছাড়া তুই তো আমাকে দেখছিস দুবছর ধরে। তোর কি মনে হয়?”
আমি কি করব, ঝাঁট জ্বলছে, এদিকে বলতেও পারছি না। ইচ্ছা হচ্ছে ভাল মতন খিস্তি মারি। কিন্তু সেটা না করাই ভাল, প্রচুর হেল্প টেল্প করেছে আমায়। বললাম “আমি ভেবে বলি?”
মুখটা একটু উজ্জ্বল হল “কবে জানাবি? আজ রাতে ফোন করি?”
আমি চমকে বললাম “না না, এত বড় ডিশিসান, সাত আটদিন তো লাগবেই”।
-সাত আটদিন? মুখটা বড় হয়ে গেল। তারপর বলল “ওকে ডান, টেক ইউর টাইম। বাট আই অ্যাম এক্সপেক্টিং, ভুলিস না”।
এক্সপেক্টিং! কি জ্বালা, একী বাচ্চা কাচ্চা হবে নাকি।
কোনমতে কাটিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকলাম। এটাই বাঁচোয়া লাইব্রেরীতে পেছন পেছন এল না। প্রিয়াঙ্কা টুকছিল বই থেকে। আমি যেতে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল “কিরে কি বলছে? প্রপোজ করল নাকি?”
আমি অবাক হলাম “তুই কি করে জানলি?”
প্রিয়াঙ্কা খানিকটা ঘ্যাম নিল “হু হু বাওয়া, এক্সপেরিয়েন্সড মাল। আলাদা করে ডেকে নিয়ে কি পাড়ার শনিপুজোয় নেমন্তন্ন করবে তোকে?”
আমি বললাম “হ্যাঁ, সেই। কি করা যায় বলত?”
প্রিয়াঙ্কা বলল “কি বলল সেটা বল আগে”।
আমি বললাম সবই। প্রিয়াঙ্কা হাসতে হাসতে বলল “আমি জানতাম অবশ্য কেসটা এরকম একটা আছে”।
আবার অবাক হলাম “কি করে জানতি?”
-প্রায়ই আমার কাছ থেকে তোর ব্যাপারে জানতে চায়। এসছিস কিনা এটসেট্রা। আমাকে একবার বলেওছিল তোকে বলার জন্য আমি সিমপ্লি ডিনাই করে দিয়েছিলাম।
রাগ হল একটু। “সেটা আগে বলতে পারতি না?”
-আগে বলে কি হত?
-তাহলে আজ একটু প্রিপেয়ার হয়ে না বলে দিতে পারতাম। আমি তো আবার সাতদিন সময় চেয়েছি। ব্যাপারটা ঝুলে থাকল তো!
-ও হো হো। তারমানে ইচ্ছা তোমারও আছে।
বিরক্ত হলাম “দূর বাল। ওইটাকে ভাল লাগার কি আছে? হরলিক্সের কাঁচের মত চশমা। সব সময় পড়াশুনা। অত স্টুডিয়াস দিয়ে কি করব আমি?”
প্রিয়াঙ্কা নাকের নীচে চশমা নামাল “ওয়ে হোয়ে, তা কাকে চাই বস? টম ক্রুজ না ঋত্বিক রোশন? রেস দেখলি? এই শুক্রবার বেরিয়েছে”।
আমি বললাম “হচ্ছিল একটা কথা, এর মধ্যে রেস এল কোত্থেকে?”
-অর্ণব আর আমি যাব বলে। তুইও যা। ওই হরলিক্স বয়কে নিয়ে।
এবার রাগলাম খানিকটা “দ্যাখ, এই ফালতু ব্যাপারটা আমি ঘাড় থেকে নামাতে চাইছি, এটা নিয়ে আমাকে একদম টোন করবি না”।
-ওকে ওকে বাবা! ঠিক আছে। তাহলে তুইই বল তোর কাকে পছন্দ?
অনির্বাণদা ঢুকল লাইব্রেরীতে।না চাইতেও আমার চোখটা ওদিকেই চলে গেল। ও কি কোনদিন বুঝবে না আমার ওকে কতটা ভাল লাগে? এদিকেই আসছে। আমাদের টেবিলেই বসবে নাকি?
“কিরে”।
প্রিয়াঙ্কা ঠেলা দিল একটা।
বললাম “কি বলছিস?”
“বলছি কাকে পছন্দ? কোন ক্রাশ টাশ আছে নাকি?”
ইয়েস! অনির্বাণ আমাদের টেবিলেই বসেছে।আমার সামনা সামনিই বসেছে। এই পিঙ্ক কালারের সার্টটাতে যা লাগছে না। কিন্তু ভীষণ ক্যালানে। আমি যে দেখছি, একবার তাকা অ্যাটলিস্ট!
কি রকম যেন! দূর!
নাহ, কিছু একটা করতে হবে, আমি ওকে ডাকলাম “এক্সকিউজ মি, ওই বইটা একটু দেবে”?
প্রিয়াঙ্কা অবাক হল একটু। কিন্তু কিছু বলল না। আমাকে পা দিয়ে একটা ঠেলা দিল। আমি চুপচাপ থাকলাম।
অনির্বাণদা আমার দিকে তাকাল হকচকিয়ে “হ্যাঁ? আমাকে ডাকছ?”
আমি মিষ্টি করে হাসলাম “হ্যাঁ, তোমার ওই হাতের কাছের বইটা একটু দেবে?”
ও একটা বই হাতে নিল। ফিসফিস করে বলল “এইটা?”
আমি বললাম “হ্যাঁ”।
ও ঠেলে দিল বইটা। আবার পড়ায় মনোযোগী হয়ে গেল। ধুস। কিচ্ছু হবে না এর।
প্রিয়াঙ্কা কানে কানে বলল “এই কি টম ক্রুজ রে? জানতাম না তো বস!!!”
আমি দাঁতে দাঁত চিপে উত্তর দিলাম “কাউকে বললে ওটা কেটে হাতে দিয়ে দেব শালা”।
৬.
৩০ মার্চ ২০০৮
বেশ কিছুদিন থেকে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসছে বুঝতে পারছে অনির্বাণ কিন্তু সেটা যে কে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রথমত নম্বরটা একেবারেই পরিচিত না। দ্বিতীয়ত এমন সময়ে ফোনগুলি আসছে যে সময়টা সে হয় কলেজ লাইব্রেরীতে থাকছে নয়ত রাতে ঘুমাচ্ছে। সাইলেন্ট থাকার দরুন বোঝা যাচ্ছে না কে ফোন করেছে, পরে দেখছে সেই নম্বর।
কল ব্যাক করলে ফোন ধরছে না। সে একটু ল্যাদ খাওয়া টাইপ পাবলিক। বেশি চাপ নেয় না কোন ব্যাপারে। কিন্তু এই মিসড কল তাকে রীতিমত তিতিবিরক্ত করে তুলছে।
এই রোববারে বাড়ি যায় নি আর। মেসে তার সাথে তার এক বছর জুনিয়র অরিত্র আছে। অরিত্র বাড়ি যাচ্ছে না কেন সে জানে না। জিজ্ঞেস করেছিল বলল কাজ আছে। আজকাল ওকে দেখে অবাক লাগছে তার। একসময় বাড়ি যাবার জন্য লাফালাফি করত আর এখন বাড়ি যাবার নাম করে না।
অনেকদিন পরে কবিতার খাতাটা নিয়ে বসেছিল কিন্তু কিছুই আসছেনা সেরকম। গভীরতাহীন কতগুলি লাইন তৈরি হচ্ছে। একটা লাইন আসছে যাচ্ছে
“একটা মানুষ সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে”
কিন্তু তার পরেরটা কোনভাবেই আসছে না। সে বুঝতে পারছে না এই মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এই লাইনটাই কেন আসছে। গত মাসে একটা কবিতা পড়েছিল সুনীল গাঙ্গুলির সেটা থেকেই কি ভাঙছে লাইনটা। মাঝখান থেকে গোটা খাতাটা কাটাকুটিতে ভরে গেল।
সুনীলের বইটা খুলল। কবিতাটা বেশ লাগল
“ আমলকী গাছে ঠেস দিয়ে আছে শীত
উড়ে গেল তিনটে প্রজাপতি
একটি কিশোরী তার করমচা রঙের হাত মেলে দিল
বিকেলের দিকে
সূর্য খুশি হয়ে উঠলেন, তাঁর পুনরায় যুবা হতে সাধ হল”।
তাদের মেসের এলাকাটা বেশ শান্ত। গরম পড়ব পড়ব বলে এখনও পড়ে নি। খোলা জানলা দিয়ে একটা উজ্জ্বল দিনের সাথে এই কবিতাটা বেশ যাচ্ছিল।
সে আবার একটু লেখার চেষ্টা করল
“মানুষটা কি জানে সে আসলে হারিয়ে গেছে,
হারিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন, সভ্যতার ভিড়ে
সভ্য মানুষ লম্বা আকচি দিয়ে তাকে টেনে টেনে ধরে”।
আকচি শব্দটা কেমন শোনাচ্ছে। সে আবার কেটে দিল। অরিত্র নক করল।
অনির্বাণ বিরক্ত হল “কি হল?”
অরিত্র বলল “আমি একটু বেরচ্ছি”।
-কোথায় যাবি?
-একটা মিটিং আছে।
অবাক হল একটু অনির্বাণ। “কিসের মিটিং?”
-কৃষকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে।
নড়ে চড়ে বসল সে। “সেকি রে? তুই আবার এসব কবে থেকে?”
দাঁত বের করল অরিত্র। “ওই একটু আর কি?”
চাপ খেয়ে গেল সে। অরিত্র আজকাল হঠাৎ এই লাইনে সে তো কল্পনাও করতে পারছে না। বলল “যা। আর কি যে করছিস, এসব না করে পড়াশুনা করতে পারতিস। যা পারিস কর, যাঃ আর বাইরের গেট বন্ধ করে দিয়ে যাস”।
অরিত্র বেরতে মনে পড়ল, অনেকদিন আগে, প্রায় দুতিন বছর আগে অর্কুটে একটা মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছিল। বেশ কথা বলত। ভাল ভাল কবিতা বলত। সেই মেয়েটা তাকে কবিতা লিখতে ভীষণভাবে ইন্সপায়ার করত। তার আগে কবিতার সাথে তার সেরকম ভালবাসা ছিল না। মেয়েটার সাথে কথা বলতে ভাল লাগত কিন্তু হঠাৎ করে একদিন মেয়েটা প্রোফাইল ডিলিট করে দিল। কেন করল, সে জানে না। কিন্তু আর খুঁজে পায় নি।ইয়াহু মেসেঞ্জারেও পায়নি।
একদিন প্রোফাইল খুলে দেখল মেয়েটার পোস্টগুলি সব no name দেখাচ্ছে। কি হয়েছিল সে এখনও জানে না। তবে মেয়েটা এই ধরনের বৈপ্লবিক কথাবার্তা বলত। কৃষকের বিরুদ্ধে নাকি সবাই উঠে পড়ে লেগেছে ইত্যাদি।কোনদিন না দেখা মেয়েটার প্রতি একটা নরম জায়গা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, তারপরেই হারিয়ে গেল সব কিছু।
মোবাইলটা আবার বেজে উঠে চুপ করে গেল। আবার সেই আননোন নম্বর।
সে ঠিক করল এবার সে কলব্যাক করে যাবে। যতক্ষণ না ধরে কথা বলে ততক্ষণ করে যাবে।
পাঁচ ছ’বার পুরো রিং হয়ে কেটে যাবার পর ফোন ধরল, একটা মেয়ের গলা “হ্যালো”।
সে ঝাঁঝাল গলাতেই বলল “কি হয়েছে, শুধু মিসড কল মারছেন কেন?কোন কাজ নেই নাকি?”
-সরি।
-কে আপনি?
-চিনবে না।
-না চিনলে মিসড কল মারছেন কেন?
-ইচ্ছা হল।
-দূর। কাজ নেই কোন।
ফোনটা কেটে দিল অনির্বাণ। নির্ঘাত ইলোরারা ইয়ার্কি মারছে। এই হোস্টেলের মেয়েগুলি রোববার হলেই জ্বালাতন শুরু করে। তবে এই জ্বালাতনটা বেশ প্ল্যান প্রোগ্রাম করে চলছে বোঝা যাচ্ছে।
সে মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিল।
জীবনানন্দ খুলে বসল সে। আজ আর লেখা হবে না...
“ তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত এসে
কহিবে: তোমারে চাই-তোমারেই, নারী;
এই সব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি
চলে যেতে হবে দূর আবিষ্কারে ভেসে “।
৭.
৩০শে মার্চ ২০০৮
।।অরিত্র।।
অনির্বাণদা মাঝে মাঝে এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করে! কেন আমি কি মিটিঙে যেতে পারি না। অদ্ভুত ব্যাপার। অবশ্য আমি যে মিটিঙে যেতে পারি সেটা আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না পলাশমিতা না থাকলে।
মেয়েটা চাপের। প্রচুর পড়াশুনা করে, প্রচুর গান শোনে। আমি শালা কলেজ আসার আগে এত নাম জানতাম না। চিরকাল হিন্দি আর খুব বেশি হলে বাংলা ব্যান্ড। ইংলিশ গান বলতে দুটো গান জানি।
১) উই শ্যাল ওভারকাম
২) টাইটানিকের এভ্রি নাইট ইন মাই ড্রিম।
আর সে মেয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে বসছে কি সব নাম। এখন আমার কাজ হয়েছে কলেজের ছেলেগুলির থেকে গান কালেকশন করা আর সকাল বিকেল সেগুলি শোনা। কৃষকের কান্নাটান্না তাও বোঝা যায় কিন্তু এর মধ্যে পিঙ্ক ফ্লয়েড ঢুকলে বড় বিপদ।
কিন্তু হয় না। এছাড়াও অনেক হার্ডল আছে। দীপদা প্রেসির সিনিয়র। সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে ওর চারপাশে থাকে। না পারি কিছু বলতে না ওকে দেয় কিছু বলতে। পার্থদা। জে ইউর ফিজিক্সের পি এইচ ডির স্টুডেন্ট। সারাক্ষণ একসাথে।
আর অর্কুটে তো আমার সাথে তেনার কথাই হচ্ছে না। আমি “hi” লিখে হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। শেষে ঘুমিয়ে পড়ে সকালে উঠে হঠাৎ দেখি রিপ্লাই দিয়েছে। পাততাড়ি গোটানোর সময় আসন্ন মনে হচ্ছিল কিন্তু কাল রাত একটা নাগাদ যখন একটা চরম পানু দেখে বাথরুম থেকে ফিরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি হঠাৎ দেখি ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। ফোন করেছে।
আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে সেই মধুর গলা “কে অরিত্র?”
মনে মনে বললাম না অরিত্রর বাপ মুখে মধুর স্বরে উত্তর দিলাম “হ্যাঁ বলছি”।
“কাল একবার নন্দনে আসতে পারবি?”
মনে পড়ে গেল কাল খেলা ছিল কলেজে একটা কিন্তু তোমার জন্য জান হাজির দিলরুবা। বললাম “হ্যাঁ সিওর, কটায়?”
-এই সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ।
-কেন?
-আয় না।
-ইয়ে মানে সায়নকে বলব?
-না, শুধু তুই আয়। রাখছি।
যাহ্ শালা। আমাকে একা ডেকেছে, তাও নন্দনে। তারমানে কি আমায় পছন্দ নাকি।
কাল রাতে ঘুম হয় নি। গোলপার্কের পর দেখা হয়েছিল কলকাতার রাজপথে। পুলিশ কিছু বলেনি। আমরা কুড়ি পচিশজন মিছিল টিছিল করে চেঁচিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি চলে এসছিলাম। তারপরে দুয়েকবার মিটিং হয়েছে। আর সেই সময়েই এতরকম আলোচনা গান, লিটারেচর নিয়ে আমার মনে হয় অন্য গ্রহে বেড়াতে এসছি। সায়ন মালটা ভাব দেখায় যেন কতকিছু জানে। আগেরদিন অনেকক্ষণ সলমন রুশদি নিয়ে আলোচনা হল। সায়ন কি সুন্দর মাথাটাথা নাড়িয়ে চলে এল। বাইরে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম “তুই তো বহুত জানিস বে”।
সায়ন বলে “দূর বাল, কে জানে, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এখন ওসব পড়ব। না জানলে জানার ভান করবি, মাথা নাড়বি... হয়ে যাবে। এইসব করে কি হবে, সংগঠন দেখতে হবে বুঝলি?”
সায়ন বুঝেছে আমার উইকনেসটা। প্রায়ই দেখি আজকাল ঘ্যাম নিচ্ছে। ওকে হাতে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু যদি বুঝি এই কেসটা ডাস্টবিন কেস, তবে মালটার থেকে সব সুদে আসলে উসুল করে নেব।
রোববারের কলকাতার একটা অন্যরকম মজা আছে। বাকি ছ’টা দিন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ আর রোববারটা হল গে কলকাতা লীগে ভবানীপুর কালীঘাট। ঢিকির ঢিকির করে বাস চলছে। দুয়েকটা লোক উঠেছে। সবাই ব্যাজার মুখ। নিশ্চয়ই পেছনমারা গেছে এগুলোর। সামনের দিকে একটা মাল আছে বটে কিন্তু আজকাল ঝাড়িটা কমিয়েছি খানিকটা। আসলে বাঘ শিকারে বেরলে যদি ঘুঘু সামনে পায় অনেকেই ছেড়ে দেয়। আমার হয়েছে সে অবস্থা।
মেস থেকে যখন বেরলাম তখন মনে হল কাঁধে একটা অদৃশ্য বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছি।মাথায় চোঙা টুপি।
#
জয় গুরু একাই আসছে। প্রায় আধঘণ্টা দাঁড় করিয়ে এবং তিনবার আমার ফোন ধরে “এখনই আসছি” বলার পর এলেন তিনি। একা আসতে দেখে আমার লাফাতে ইচ্ছা করছিল। একটা জামা আর প্যান্ট টাইপ পড়ে এসছে। বগলের কাছে, নাকের নীচে বিন্দু বিন্দু ঘামে ঘ্যামা লাগছে মাইরি। আমাকে দেখে হাসল “সরি রে, অনেকক্ষণ এসছিস”?
আমার এতক্ষণ ঝাঁট জ্বললেও এখন মনে হচ্ছিল পাশ থেকে কেউ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে জোরে জোরে। কি আর বলব। দাঁত বের করলাম “না ঠিক আছে”।
-চল কোথাও গিয়ে বসি একটা।
বসবে বলছে। যা তা তো।
বুকের ভেতরের যন্তরটার শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। ইতি উতি অনেক প্রেমিক প্রেমিকা বসে আছে। আর সবার চোখই পলাশমিতার দিকে। আমি আলেকজান্ডারের মত একটা বেঞ্চি খুঁজে বার করলাম।
বসতেই পলাশমিতা আমার ডান হাতটা ধরে বলল “একটা কাজ করে দিতে হবে বস”।
কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আজ? হয় আয়না, নয় অনির্বাণদা। চাকরি পাবার পর থেকে অনির্বাণদা লাকি হয়ে গেছে। জয় গুরু। এরপর থেকে রোজ অনির্বাণদার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠব। মনে মনে বললাম কাজ, বল তো জান দিয়ে দেব। শুধু বলে দেখ একবার।
মুখে বললাম “হ্যাঁ নিশ্চয়ই বল”।
পলাশমিতা মুখটা করুণ করল। “দেখ আমার বাড়ি আসানসোলের এক গ্রামে। কুলটির ওদিকটা। আমার বোন বাড়ি গেছে।ও এখানেই পড়ে। প্রেসিতে। কিন্তু আসতে পারছে না। আমার বাবা খুব অসুস্থ। আর তুই তো জানিসই এদিকে সংগঠনের কাজে আমি কতটা বিজি থাকি। তুই যদি একটু নিয়ে আসিস তবে ভাল হয়। আমি অন্যদের বলতে পারতাম, কিন্তু ভরসা হল না। পারবি?”
শালা বলে কি। রাজকন্যের সাথে আরেক রাজকন্যে ফ্রি তো। একই গোডাউন যখন তখন প্রোডাক্ট তো সেম হবেই। জয়গুরু।
মনে চরম ফুর্তি হলেও মুখে টোটাল ঘ্যাম নিয়ে বরাভয় দিয়ে বললাম “হ্যাঁ শুধু কবে যেতে হবে বল”।
-কাল।
কাল তো টি কে এমের একটা ক্লাস টেস্ট আছে। দূর... ওরকম কত ক্লাস টেস্ট কাটালাম আর অত হুদো হুদো অত মালগুলিকে কাটিয়ে আমাকে যখন দায়িত্ব দিচ্ছে তারমানে ভেতরে একটা ইয়ে তৈরি হচ্ছে।
জিও কাকা...
৮.
অরিত্রর ডায়েরী
১লা এপ্রিল, ২০০৮
কালকের দিনটা ভীষণ চাপের গেল। আর এরকম মুরগি আমি এজন্মে হই নি। আসানসোল স্টেশনে আসার কথা ছিল পলাশমিতার বোনের। এল যখন আমি তো দেখে থ! এ কে রে! পলাশমিতা যদি উত্তরমেরু হয় এ মঙ্গলগ্রহের দক্ষিণমেরু।লম্বা, কালো, আর পেটানো চেহারা। পুরো ছেলেদের মত। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা। নাম অশ্রুমিতা। ওই পেছনে মিতাটা বাদ দিলে কোনকিছুই এক না। একটা ভারী ব্যাগ নিয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে আমি নিতে গিয়ে দেখি ব্যাগের ভারে আমিই পড়ে যাব। নিয়ে যখন ফেলেছি আর শালী কবুল করে ফেলেছি কষ্ট করে সেটাই নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে ধর্মতলার বাস ধরলাম।
কথা টথা কিছুই বলে না। আমি চুপচাপ মোবাইলে খেলতে লাগলাম। পলাশমিতাকে ফোন করলাম কিন্তু ধরল না, কি অদ্ভুত মেয়ে। তোর বোনকে আনতে যাচ্ছি অ্যাটলিস্ট ফোনটাতো ধর!
দুর্গাপুর এলে বলল “আমি একটু টয়লেটে যাচ্ছি”।
আমি তো কিছুই চিনি না। বললাম “চেনো তো কোথায়?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে চলে গেল। আমি ভাবছিলাম এ তো যা ফিগার আর হাঁটাচলা আমাকে আনার কি দরকার ছিল রে বাবা। এতো একাই একশোটা ছেলেকে শুইয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখে একটা দেওয়ালে ছোটকাজ করে একটা পেপার কিনে যখন ফিরলাম তখন এসে গিয়েছে সে। আমি চুপচাপ বসে পেপারটা খুললাম যখন দুম করে বলে বসল “এই সব প্রতিক্রিয়াশীলদের কাগজ পড় নাকি?”
আমি তো থ! গাড় মেরেছে। প্রতিক্রিয়াশীল আবার কি। এই কাগজ তো ছোটবেলা থেকে বাড়িতে দেখে আসছি। আমার বাবা অফিস থেকে ফিরে লুঙ্গি বাগিয়ে চা খেতে খেতে এই কাগজ পড়ে।মা দুপুরবেলা পড়ে। ছোটবেলা থেকে আমি পড়ে আসছি। এটা আবার প্রতিক্রিয়াশীলদের কাগজ হল কবে। আর যদি হয়েও থাকে আমরাও তবে প্রতিক্রিয়াশীল। আমার বাবা বনগাঁ লোকাল ধরে ঘেমে নেয়ে ছেলের জন্য পি এফ লোন তুলে আমাকে পড়াচ্ছে মা সেলাই টেলাই করে দু পয়সা সংসারে দেয় তাহলে ওরাও প্রতিক্রিয়াশীল। যারা বিক্রিয়া করার জন্য সব সময় বসে থাকে তারা বিক্রিয়া শীল। আর যারা প্রতিক্রিয়া দেবার জন্য বসে থাকে তারা প্রতিক্রিয়াশীল?
কি ভুলভাল মাইরি। আমি আর কিছু বললাম না, দাঁত কেলিয়ে বললাম “আর কিছু ছিল না তো, এটাই ছিল”।
মুখটা সিরিয়াস করে বলল “তাহলে পোর না”।
বাপস। আমি আর চাপ না নিয়ে কাগজটা বগলে নিয়ে ঘুমনোর ভান করলাম। বাসে প্রচুর লোক, কিন্তু কেউ দাঁড়িয়ে নেই এটাই যা রক্ষে। মেয়েটা কেমন যেন, পলাশমিতার পাশে থাকলে ওর গা দিয়ে কেমন একটা জ্যোতি বেরোয়। পারফিউমের গন্ধ আর তার সাথে ওর কথাটথা। আর এটাকে মনে হচ্ছে কিরকম যেন একটা, জঙ্গি জঙ্গি ভাব। যখন তখন কামড়ে দিতে পারে।
শক্তিগড়ে দাঁড়াতে ল্যাংচা খেলাম। এখানকার ল্যাংচা নাকি বিখ্যাত। অশ্রুমিতা ঝালমুড়ি খেল। মনে মনে বললাম তোর জন্য ওই ঝাল জিনিসই ঠিক আছে।
অনেকদিন পর মনে হচ্ছিল ক্লাস টেস্টটা দিয়ে দিলেই ভাল হত। একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তাছাড়া পলাশমিতার কথায় এমন যেচে ক্ষুদিরাম হয়েছি ভাবতেই কেমন লাগছিল। অবশ্য ভালও লাগছিল। পার্থদা ছিল, সায়ন ছিল, ওদের কাউকে নিজের লোক ভাবে নি। আমাকে ভেবেছে। এটাও বিরাট ব্যাপার। তাছাড়া আমার মধ্যে একটা চার্ম তো আছেই। বাকিগুলো সব খদ্দরের পাঞ্জাবী পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো আঁতেল।
সিঙ্গুরে পুরো দমে কাজ হচ্ছে। টাটার একটা কারখানা হবে বলেছে। হলে তো ভালই হয়, এখানে যদি একটা চাকরি বাগিয়ে ফেলতে পারি তবে তো যা তা ব্যাপার হয়ে যাবে। অশ্রুমিতা ওদিকেই দেখছিল। আমি বললাম “কি দারুণ কারখানা দেখেছ? এখানে কত লোক কাজ করবে। ভাবতে দারুণ লাগছে”।
মনে হল কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলাম, আমার দিকে বড় বড় চোখ করে বলল “হোয়াট? তুমি কি রিয়েলি আমাদের সংগঠনের লোক? আমার তো রীতিমত ডাউট লাগছে এখন”।
আমি চাপ খেয়ে গেলাম। তাই তো। পলাশমিতারা যা করছে তা তো এদের এগেন্সটেই। আমি তো আচ্ছা গান্ডু হলাম। কোনমতে ম্যানেজ করলাম “আরে ইয়ার্কি মারছিলাম, কত চাষির কত ক্ষতি হয়ে গেল”।
আবার ঘুরে বসল। বাপ। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ধর্মতলা ঢোকার পর বলল একটা ট্যাক্সি ধরতে।বাসটা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানেই ওকে দাঁড় করিয়ে আমি ওই ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম। কোন ট্যাক্সি যেতে রাজি হচ্ছিল না।
আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সিকে রাজি করিয়ে ওকে ডাকলাম। ট্যাক্সির সীটে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখি তালা দেওয়া চেনের একটা জায়গা কাটা। কি জানি কেন, হঠাৎ ভীষণ কৌতূহল হল না কি হল জানি না আমার খুব দেখতে ইচ্ছা হল এত ভারী ব্যাগের ভেতর কি আছে।
চেনের জায়গাটা হাত দিয়ে একটু ফাঁক করে যা দেখলাম তাতে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা।
ব্যাগের সাইজের বড় বড় দুটো বন্দুক!
কি বন্দুক কে জানে!
আমার তো সব বাইরে বেরিয়ে নাচার মত দশা। কোনমতে স্থির হয়ে দাঁড়াতে দেখি অশ্রুমিতা এসে গেছে। আমাকে একটা থ্যাঙ্কসও না দিয়ে চলে গেল।
সেই থেকে মেসে ফেরা অবধি আর বেরোইনি। এই পেন্নাম দিলাম। আর ওই সায়ন আর সায়নের সংগঠনে আমি যাব না। আজ থেকে কলেজের সব ক্লাস করব। এই ডায়রি লিখলাম। এবার স্নানে যাব। তারপর খেয়েদেয়ে কলেজ। আর কোত্থাও না। বাপ! তারপর পেছনে হুড়কো খাই আর কি!!!
৯.
২রা এপ্রিল, ২০০৮
পার্বণী।।
সাহসটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করব? অনির্বাণদা এত সিরিয়াস টাইপ ছেলে, সব সময় কি যে করছে কে জানে। রেজাল্টটাও তো শুনেছি হাই ফাই কিছু নেই, কিন্তু কলেজে ওর ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পাবার গল্পটা মিথ লেভেলে চলে যাচ্ছে। এমন কেত দেখিয়েছে নাকি শুনছি...
তিন বছর হয়ে গেছে কলেজে এখনও একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই। মেয়েদের প্রতি ছুক ছুকানি নেই। নিজের মত থাকে।
আমার এই ধরনের ছেলেই পছন্দ। ওই সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে ভিতরে ভিতরে ছকবাজি করা কৃশানু টাইপ ছেলে আমার দু চোখের বিষ। খুব মিসড কল মারছিল প্রপোজ করার পর থেকে। আর এস এম এসের কি ছিরি। উফ।
তুমি আগুন আমি জল না কিসব বিরক্তিকর জিনিসপত্র। কলেজ আসতে যেতে ধরা ধরি। শেষ মেষ এত ঝাঁট জ্বলল আমাকে যখন ক্যান্টিনে ধরল আমি রীতিমত চেঁচিয়েই বলে দিয়েছি, “দেখ কৃশানুদা তোমাকে চিরকাল বড় দাদার মত চিন্তা করে এসছি, এখন অন্য কিছু ভাবতে পারব না। সো স্টপ সেন্ডিং দোজ ইরিটেটিং এস এম এসেস”। ব্যাটা শেষে পালিয়ে বাঁচে। আমার এই কনসেপ্টটাই নোংরা লাগে। প্রথমে বোন বানিয়ে নেবে তারপর প্রপোজ। অদ্ভুত টাইপ একদম।
মনে আছে অনির্বাণদা আমাদের র্যাগিং পিরিয়ডে একবার এসছিল। আমাকে তখন একটা সিনিয়র দিদি চাটছিল। অনির্বাণদা কুল কাল এসে দাঁড়াল। আমার মুখটা দেখে দিদিটাকে বলল “কিরে খুব ভাল লাগে না? তোকে চাটি এবার?”
কিছুই না। কিন্তু কত কিছু। দিদিটা চুপচাপ সরে পড়ল। কোন কথাও না। অনির্বাণদা তখন খেজুর করতে পারত আমার সাথে আরামসে। কিন্তু সেসবের ধার দিয়েও গেল না। চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে।
সেদিন থেকেই প্রেমে পড়ে গেলাম এক্কেবারে। কিন্তু কাউকে বলি নি। কাউকে না। সেদিন যখন শুনলাম চাকরি পেয়েছে, ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। তবু চুপচাপ ছিলাম।
এই মিসড কল দিতে বেশ মজাই লাগে। তাছাড়া আমার নাম্বারটা আমার বাবার নামে আছে। বুঝতেও পারবে না। হি হি।
অরিত্র ওর মেসে থাকে।কিন্তু এ ব্যাটা এত কম ক্লাস করে যে ওকে পাওয়াই যায় না। ল্যাব গুলো পর্যন্ত মাঝে মাঝে বাঙ্ক মেরে দেয়। তার ওপর এক নম্বরের মাইক্রোফোন। ওকে কিছু বলা মানে গোটা ক্লাস জেনে যাবে। তবে কাল একটু অবাক হয়ে গেলাম। অরিত্র কালকে সবকটা ক্লাস করেছে। এমনকি জি এসের ক্লাস যেটা নাইন্টি পারসেন্ট ক্লাসই অ্যাটেন্ড করেনি সেটাও করেছে। আমি প্রিয়াঙ্কা আর দু তিনটে মেয়ে ছিলাম আর ওই অরিত্র ব্যাটা ছিল। ইভেন জি এসও অরিত্রকে দেখে চাপ খেয়ে গিয়ে বলেছে “সেকি তুমি ক্লাস করছ?”
পেট ব্যথা হয়ে যাবার যোগাড়। আমি খোঁচালে বলল ও নাকি এখন সিরিয়াস হয়ে গেছে। কি অবস্থা!
কৃশানুদা তারপর থেকে আর জ্বালায় নি। শুধু একটা এস এম এস করেছে “সরি, আমি আর তোকে ডিস্টার্ব করব না”। আমি লিখতে যাচ্ছিলাম “রিয়েলি, বাঁচালে”।
কিন্তু তারপর মনে হল তাহলে আবার ভাটানো শুরু করতে পারে। তাই চেপে গেলাম পুরোটাই। ..
১০.
তেসরা এপ্রিল, ২০০৮
অরিত্র।।
ক্লাস করতে যে কি ঝাঁট জ্বলে কি বলব। সকালের দিকে একটা দুটো তাও ঠিক আছে, দুপুরে খাবার পরে মনে হয় লম্বা ঘুম দিই একটা।
কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি যখন তখন ক্লাসটাই করব। পলাশমিতা কালকে একটা থ্যাঙ্কস জানিয়ে এস এম এস করেছে। অনেক রাতের দিকে। তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে এস এম এসটা দেখে কি করব অনেকক্ষণ ভাবলাম। তারপর চিন্তা করলাম ভদ্রতা তো করতেই হয়, ভদ্রতাই ছেলেদের ভূষণ না কি যেন বলে, তাই আমিও রিপ্লাই মেরে দিলাম “মেনশন নট”। মেনশন বানানটা রাতে মনে আসছিল না, শেষে মোবাইলে টেক্সট অন করে পাঠাতে হল। ভাগ্যিস দেখেছিলাম, নইলে মেনশনটা ম্যানশন হয়ে গেছিল। এই ইংরেজিটাই আমাকে গিলে ফেলবে মনে হচ্ছে। বাংলা মিডিয়ামের ছেলেগুলিও আজকাল কলেজে কি সুন্দর ইংলিশ বলছে, আমিই কেমন কাকাতুয়া টাইপ হয়ে যাচ্ছি।
সায়ন কলেজ এসছিল। আমাকে চোখ টিপছিল। ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিলাম বলে বেশি ট্যাঁ ফো করতে পারছিল না। ডি সি ক্লাস নিচ্ছিল আর আমি সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছিলাম, হঠাৎ দেখি গান্ডুটা ফোন করেছে। ক্লাসের মাঝখানে প্যাঁ প্যাঁ করে ফোন বেজে উঠল। ডিসি একটা চক ছুড়ে মারল, যদিও আমার গায়ে লাগেনি তবু ইন্সাল্ট ইজ ইন্সাল্ট।
ফোনটা অফ করে রাখলাম। ক্লাস শেষ হতে এসে নিচু গলায় বলল “পরশু মিটিং আছে চলে আসিস”।
মনে হচ্ছিল ক্লাসের মধ্যেই মালটার বিচিতে একটা গাক করে লাথ মারি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম।
আমি কিছু বললাম না। আবার বলল “কি রে যাবি তো?”
আমি বললাম “ওই মেয়েটা কি সত্যি পলাশমিতার বোন?”
সায়ন গম্ভীর হয়ে আমাকে নিয়ে প্যাসেজে গিয়ে দাঁড়াল। তখনও নেক্সট লেকচারার আসেননি। বলল “হ্যাঁ রে”।
আমি বললাম “ওর যা কথা বার্তা ফিগার ও তো নিজেই আসতে পারত। আর তাছাড়া বন্দুক আনতে আমাকে কি বডিগার্ড হিসাবে পাঠানো হয়েছিল?”
বন্দুকের কথায় সায়ন একটা শক খেল, বলল “তুই জানলি কি করে?”
আমি খিস্তি মারলাম একটা “আমাকে দেখে কি মনে হয় বাড়া, কিছু বুঝি না?”
সায়ন গলা নিচু করে বলল “কাউকে বলিস নি তো?”
আমি মাথা নাড়লাম। বলল “সামনে বিরাট বড় অপারেশন আছে। সিঙ্গুরে। হাইকম্যান্ড থেকে পাঠিয়েছে। আর সব পার্টির এসব থাকে। তুই নতুন নতুন এসছিস বলে মনে হচ্ছে। চল লাইব্রেরী চল, এই ক্লাসটা বাঙ্ক মারি, তোকে পুরোটা বুঝিয়ে বলি”। টি কে এম ঢুকল ক্লাসে।
আমার হাতটা ধরে নিতে চাইল ও। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম “না যা বলার ক্লাসের পরে। সব ক্লাস করব আমি”।
সায়ন খিস্তি মারল “শালা বিরাট পড়াশুনা হচ্ছে নাকি?”
আমি ক্লাসে ঢুকে গেলাম। সায়ন আমাকে দুয়েকবার দরজা থেকে ইশারা করল, আমি দেখেও দেখলাম না। এই সব ঝুট ঝামেলা ঠিক ভাল লাগছে না আমার।
ফোনটা অন করলাম না আর। মালটা আবার জ্বালাবে এই বার। সব থেকে ভাল নম্বর চেঞ্জ করে নিতে হবে।
তাহলে আর কেউ বেশি জ্বালাতে পারবে না।
#
কলেজ শেষ হলে ক্লাস থেকে বেরলাম। আজকে ল্যাব ছিল না কোন। অর্পিতা বলছিল ওর বাড়ি যেতে কাটিয়ে দিলাম। ওর বাপ একটা স্যাম্পেল। ওটাকে পাগলা গারদে পাঠাক তারপর যাব। তাছাড়া ঘরে কেউ না থাকলে চুমু টুমু খেয়ে নেয় যদি। আধ পাগলা মেয়ে। বেশি কাছে না ঘেঁষাই ভাল। অবশ্য মেয়ে ভাল। হেল্প টেল্প করে।
আজকাল পার্বণী খুব ভাল ব্যবহার করছে। কে জানে কেন। চাপ টাপ আছে নাকি আমার ওপর কে জানে। থাকলে খারাপ না। দেখতে খাসা। জিনিসপত্রও ডাসা। সমস্যাটা হল বড্ড সিরিয়াস। এত সিরিয়াস মেয়ে বিয়ে করলে চাপ আছে। সিরিয়াস মুখে “বাল” বলে। এরকম সিরিয়াস একটা মেয়ে এত সিরিয়াসলি খিস্তি মারে আমি এর আগে জীবনে দেখিনি মাইরি।
বিয়ে করলে হয়ত বললাম চ ওই ওসব করি। সিরিয়াস মুখে “বাল” বলে দিল। তাহলেই কেলোর কীর্তি।
আজকাল শুনছি অর্পিতাদের বাড়ি টিকেএম একটা ট্যুশন শুরু করবে। আমাকে বলেছে। এখনও ভেবে দেখিনি। যেতে পারি। পড়াশুনাটা সিরিয়াসলি করে দেখি। অনেকদিন তো বিলাগিরি হল।
মাচায় সায়ন। আমার জন্যই মনে হয় ওয়েট করছিল। আমাকে বেরতে দেখে এল। বলল “ফোনটা অফ করে খুব সিরিয়াস হয়ে গেছিস নাকি রে? তুই আসবি তো মিটিংয়ে?”
এই একটা সমস্যা, ডাইরেক্ট না বলতে পারি না। কাটাতে চাইলাম “দেখি, কাজ ছিল, বাড়ি যেতে পারি, থাকলে যাব”।
সায়ন খুশি হল। বলল “মেসে যাবি? চ’ আমিও যাই”।
যাহ্ শালা। মহা ঝাঁট তো। নাহ এটা মেসে গেলে এখন চাপ আছে। আমি নিশ্চিন্ত মুখে ঢপ মারলাম “না রে, অর্পিতাদের বাড়ি যাব। কাজ আছে”।
সায়নের সাথে অর্পিতার বনে না। একবার তুমুল হয়েছিল ল্যাবে।
চুপচাপ কেটে গেল।
#
মেসের খাবার দিন দিন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। এই অনির্বাণদাটা হয়েছে একটা পাগল। কি খায়, কেন খায় কিছুই জানে না। আর বাকি ছেলেগুলি কিপ্টের হাতবাক্স। রোজ রোজ ডিম পোষায়! আর মাসি তো অ্যাক্যুরেসিতে মাস্টার ডিগ্রি। একই রান্না। কোন ভ্যারাইটি নেই।
পটলের তরকারি দিয়ে ভাত ভাঙতে ভাঙতে মনে হল মোবাইলটা অফ আছে এখনও। খুলতেই একের পর এক এস এম এস। বাপ রে। পাঁচ পাঁচটা এস এম এস পলাশমিতার।
মিটিংয়ে মনে হয় নিয়েই ছাড়বে আমাকে!!!
১১.
৫এপ্রিল ২০০৮
অনেকদিন অর্কুট খোলা হয় না। অনির্বাণ বসেই দেখতে পেল অনেকগুলি স্ক্রাপ জমে গেছে। বেশিরভাগই কলেজের, কিছু কিছু একটু অন্যরকম। কবিতা লিখত এককালে একটা ওয়েবসাইটে। সেখানকার কিছু বন্ধু খেজুরে করে গেছে।
কলেজের একটা জুনিয়র মেয়ে অ্যাড করেছে সেটাও দেখা গেল। একই ডিপার্টমেন্টের। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে, লাইব্রেরীতে
চাকরি পাবার পর আজকাল জীবনটা ভীষণ সোজা হয়ে গেছে। আগে যে স্যারেরা ক্লাস না করলে চাটতে চাইত আজকাল তারা অন্যভাবে বকছে। খারাপ লাগে না।
চ্যাট বক্সটা ওপেন হল। জুনিয়রটা। নামটা পার্বণী।
-হাই।
অনির্বাণ রিপ্লাই করে ফেলল
-হাই।
-so u r in orkut...
অনির্বাণ বুঝল না এই কথার কি উত্তর দেবে। লিখল
-any problem?
-lol. No. Above all u r my departmental senior.
-hmm.
-so?
-so wat?
-ki korcho aj? chuti to?
-kichu na...
-kichu korar nei?
-nah
-oh.
-thik ache. bye for now
-jah
-keno? jah keno?
-ei bolle kichu korar nei. tahole kothai jabe? porte bosbe?
-pagol? sem er age chara ami pori na.
-tomake dekhe khub serious mone hoi
-tai naki? tui dekhechis naki?
-library te dekhi majhe majhe
-ok
-tomar hobby ki?
-kichu na
-really?
-hum
-gan sono na?
-ha
-kar valo lage?
উফ। এ মেয়েটা তো ঠিকুজী কুষ্ঠী বের করার তালে আছে মনে হচ্ছে। ইচ্ছা করেই কলেজে কবিতা লেখার কথাটা বলে না সে। এই সব কলেজে কবিতা লেখার কথা বললে প্যাঁক খেতে হবে।
সে কার গান শোনে? একটু অন্যরকম বলা যাক,
-begum akhtar
-wow... amr khb favrt
সেরেছে। এ বেগম আখতারের একটা গান জানে সে। বেশি প্যাঁচাতে গেলে চাপ হয়ে যাবে। ট্র্যাক চেঞ্জ করার জন্য বলল সে
-kobita poris?
-ha... joy goswami khub bhalo lage amar
যাঃ... কবিতা? তাদের কলেজে? তাও জয় গোস্বামী? জাস্ট ভাবা যায় না!!!
সে এবার একটু চাপ নিল।
-nije likhis?
-nah... oto capa nei...
-chesta kore dekhechis konodin?
-duekbar korehi...hoy na
-dekhas
-kothai dekhbe?
-college e
-pagol
-keno?
-college e ami kobita nie gele ar dekhte hobe na
এ তো তারই বুলি...মজা পেল বেশ...
-tahole ar dekha holo na :(
-keno hobe na? baire dekhabo
-baire?
-ha... aj ki korcho?
-mess e bore hocchi
-chole eso
-kothai?
-city center, salt lake...parbe?
অনির্বাণের হাসি পাচ্ছিল... আবার কলেজের জুনিয়র বলেও কথা... কি করবে ঠিক করতে পারছিল না সে, ভাবতে ভাবতে চ্যাট বক্সে ভেসে উঠল
-are bhoy paccho keno? ami ki bagh singho naki?
১২.
7th April 2008
অরিত্র।।
যা তা ব্যাপার। আমি ভাবতেই পারি নি, কেসটা এদিকে চলে গেছে। আর আমি শালা অন্যকিছু ভাবছিলাম। পার্বণীর অনির্বাণদার উপর নাকি ফুল্টু চাপ আছে আর ওরা দেখা করেছে পরশু সিটি সেন্টারে। প্রিয়াঙ্কা বলল। দুজনে যে এত চুপচাপ এইসব করে বেড়াচ্ছে আগে বুঝিনি। তারমানে পার্বণী যে প্রেম প্রেম চোখে আমার দিকে তাকাত, ওটা অনির্বাণদার জন্য।
যাক গে। যা পারে করুক গে যাক ওরা। আজ রাতে অনির্বাণদাকে শুধু ধরে, একটা টোটাল চাপ দিতে হবে। বিয়ার পার্টি বনতা হ্যায় বস।
পার্বণীকে প্রিয়াঙ্কারা খুব চাটছে। অর্ণব আর প্রিয়াঙ্কা নাকি গেছিল ওখানে। হঠাৎ দেখে ট্রামের সামনে দুজনে লজ্জা লজ্জা মুখ করে গেজাচ্ছে।
প্রিয়াঙ্কা কিছু বলেনি। কলেজ এসে পাকড়েছে চোর। এখন দরদাম চলছে। যা পারে করুক, পার্বণীর বাপের বহুত পয়সা, না খেয়ে ছাড়া যাবে না। আমিও ভিড়ব। আর ওর আমাকে হাতে রাখতেই হবে, নইলে কেস ঘোটালা হয়ে যাবে।
মনটা কাল থেকে হুহু করছে এদের এসব দেখে। পলাশমিতা খুব এস এম এস করছে। মেয়েটার মনে হয় আমার উপর কোন সফট কর্নার তৈরি হয়েছে। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ করে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখলাম। একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছি আর পেছনে সায়ন আর অশ্রুমিতা দুটো বড় বড় বন্দুক নিয়ে আমাকে তাড়া করেছে।
নাহ। অনেকদিন ক্লাস হল। একটানা সাআআআআআআত দিন। ভাবা যায়? কে করেছে? না আমি! উফ। যা হয় হবে, আমি আজ পলাশমিতার সাথে দেখা করতে যাব।
একটা ক্লাস করেই কাটব আজ। পলাশমিতাকে একটা এস এম এস করলাম “aj jacchi. Nandan e aste parbi?”
বেশ খানিকক্ষণ বাদে এস এম এস এল “madhusudan manche aste parbi aj sondhe 6tai? raktakarabi dekbo”
চাপ হয়ে গেল। আমি আর পলাশমিতা নাটক দেখব? এখনই বেরতে হবে কলেজ থেকে। নাটক দেখতে যাব যখন একটা পাঞ্জাবী কিনে নি। ওটা ছাড়া তো আবার নাটক দেখা যাবে না।
#
আমার মনে হচ্ছে পায়ের তলা থেকে মাটি ফাটি সরে যাবে। কি লাগছে। শাড়ি পড়ে এসছে। এই সন্ধ্যে, দক্ষিণ কলকাতা না তা কেন, গোটা কলকাতার সব রঙ যেন পলাশমিতার ওপর এসে পড়েছে। আর সব কটা পাবলিক ওকেই দেখছে।
আমি এগিয়ে গেলাম। আমায় দেখে বলল “চমকে দিলি তো। তোকে পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছে”।
আমি আর বলতে পারলাম না যে তুই আমার মুখের কথাটাই কেড়ে নিলি। একটা হেড়ে কালো মত লম্বা লোক ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল “সম্বুদ্ধদা, আমার দাদা”।
আমি আর চাপ নিলাম না। কারণ অশ্রুমিতার থোবড়া যেমন পলাশমিতার সাথে মেলে না...ভুল ভাবছি হয়ত। এ নিজের দাদা নাও হতে পারে, আজকাল তো দাদা বোন পাতানোর যুগ। হয়ত কলেজের কেউ হবে।
চেয়ারে বসার অ্যারেঞ্জমেন্টটা হল এরকম। প্রথমে পলাশমিতা। তারপর আমি। আমার পাশে সম্বুদ্ধদা।
সমস্যাটা হল নাটকটা। যেটা হল। কিছুই বুঝলাম না। আমাকে মনে হচ্ছিল কেউ তেলভর্তি কড়াইতে চুবিয়ে দিয়ে গ্যাসটা অন করে দিয়েছে। আর পাশে সম্বুদ্ধদা আর পলাশমিতা যেমন মুগ্ধ হয়ে দেখছে দেখে আমিও আর চাপ ফাপ না নিয়ে মুগ্ধতার ভান করে রইলাম।
মাঝে বাথরুম যাবার নাম করে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার ঢুকলাম। পাশে হালকা পারফিউমের গন্ধ, আর পলাশমিতা পলাশমিতা আমেজ আমাকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছিল। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বিপজ্জনক একটা ভাঁজ উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। ভদকার নেশা থেকে কোন অংশে কম নয় এই নেশা।
আমি বোল্ড। তিনটে উইকেটই পড়ে গেছে আমার। এবার তুমি যা বলবে তাই করব নন্দিনী, সরি পলাশমিতা...
#
-আমায় একটু রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন পৌঁছে দিতে পারবি? আসলে সম্বুদ্ধদার রুটটা উল্টোদিকে।
রাত ন’টার সময় কোন মেয়েকে একা যদি কোথাও পৌঁছে দিতে বলে তাও পলাশমিতার মত একটা মেয়েকে, আনন্দে নাচা উচিত বলেই আমার মনে হয়। মাসের শুরু। দরকার হলে শেষের দিকে ধার করব এই চিন্তা করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম।
উঠে পলাশমিতা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমার হার্টবিট কোথায় উঠে গেছে বুঝতে পারছি না।
কিছু একটা বলতে হবে বুঝে আমি বললাম “আমি এই উইকে মিটিঙে যাব”।
-কেন আগের উইকে কি হয়েছিল?
-ক্লাস পড়ে গেছিল।
-কেন? সায়ন তো আসে রেগুলার।
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল পলাশমিতা।
আমি চিন্তা করে দেখলাম খালি মার্কেটে সায়নের মেরেই দি। বলে দিলাম “ও আজকাল ক্লাস টাস ছেড়েই দিয়েছে। সারাদিন এই সবই করে বেড়ায়”।
পলাশমিতা ভাবল কিছুক্ষণ। গাড়ির হাওয়ায় ওর চুলগুলি হ্যালোজেন লাইটে খেলা করছিল। আরও কিছু বলছিল হয়ত। আমিও কিছু উত্তর দিয়েছিলাম হয়ত।
কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না...
১৩.
১৩ই এপ্রিল, ২০০৮
একটা ঘরে মিটিং, স্থানঃ কলকাতার কোন একটা বাড়ি
পাঁচজন ঘরের মধ্যে আছে। সবাই গম্ভীর। তিনজন ছেলে। দুজন মেয়ে। তিনজন ছেলের মধ্যে দুজনের নাম পার্থ আর দীপ। দুজনেরই বয়স বাইশ তেইশের মধ্যে। বাকিজনের বয়স পয়ত্রিশ। নাম কণিস্ক। মেয়ে দুজনের নাম পূর্বা আর সুদীপ্তা। পূর্বাকে অরিত্র অশ্রুমিতা নামে চেনে।
কণিস্কের গলার মধ্যে একটা বসসুলভ ব্যাপার আছে। সেই বলছিল “সিগন্যাল কিন্তু যে কোন সময় আসতে পারে। আমি সেরকম কিছু পেলে পার্থকে জানিয়ে দেব, তারপর পার্থ জানিস নিশ্চয়ই বাকিটা”।
পার্থ দাঁড়ি চুলকাচ্ছিল। সুদীপ্তা বিরক্ত মুখে বলল “বিপ্লবী হলে দাঁড়ি রাখতে হবে এটা ওল্ড ফ্যাশন পার্থদা”।
পার্থ বলল “না না, আজ দাঁড়ি কাটব ভেবেছিলাম, কণিস্কদা না এলে তো তাই করতাম”।
পূর্বা রাগ রাগ চোখে বলল “আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে পুরুলিয়া যেতে হবে। এই দাঁড়ি নিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ হলে ভালো হয়”।
কণিস্ক বিরক্ত হল “আহ, তোরা থামবি? তোদের ফোকাসটা কোনদিকে? সামনে এতবড় একটা অপারেশন আছে আর তোরা যত ভাট বকে যাচ্ছিস!”
দীপ মোবাইলে টুক টুক করে কি করছিল। সুদীপ্তা বলল “তার আগে আমাদের কিছু লোকের মোবাইলে গেমস খেলাটা বন্ধ করতে হবে”।
দীপ সুদীপ্তার দিকে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে একবার তাকাল। বলল “গেমস না, একটা গুরুত্বপূর্ণ এস এম এস পাঠাচ্ছি”।
সুদীপ্তা বলল “ওকে... ক্যারি অন। কেউ এস এম এস করুক, কেউ ঝগড়া করুক, একটা ক্রুশিয়াল মিটিংয়ের দিনে আমরা এই করেই কাটিয়ে দি তাহলে”।
কণিস্ক গলা চড়াল “ওকে। নাও লিসন টু মি। দীপ। তুই আজ পূর্বার সাথে পুরুলিয়া যাবি। দুটো বেসে যেতে হবে তোকে। পূর্বাকে স্পট ওয়ানে পৌঁছে তুই সোজা চলে যাবি স্পট টুতে”।
দীপ মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল “ওকে”।
পূর্বা বলল “আর আমার একটা কমপ্লেইন আছে”।
কণিস্ক বলল “হ্যাঁ কি আছে বল”।
পূর্বা বলল “রাঁচি থেকে ফেরার সময় আসানসোল স্টেশনে কথা ছিল আমাদের ইউনিটের কেউ থাকবে। একটা বাইরের আতা ক্যালানে ছেলেকে পাঠানো হল কেন?”
কণিস্ক জিজ্ঞাসু চোখে পার্থর দিকে তাকাল “কি ব্যাপার পার্থ? বাইরের ছেলে মানে?”
পার্থ হাসার চেষ্টা করল “না বাইরের ছেলে কোথায়? পলাশমিতার বন্ধু। আমার কাজ পড়ে গেছিল একটা আসলে। ওই ম্যানেজ করল”।
পূর্বা বলল “আজকাল অনেকের বাইরের কাজটা বেশি ইম্পরট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে কণিস্কদা”।
কণিস্ক পার্থর দিকে রাগ রাগ চোখে তাকাল “দ্যাখ পার্থ, তোরা জানতিস পূর্বার সাথে জিনিস আসবে। তাও তুই গেলি না। তোদের এই সব নেগলিজেন্সি জানিস অরুণজি জানলে কি হবে?”
পার্থ সবাইকে চমকে দিয়ে কান ধরল, “সরি ভুল হয়ে গেছে আর হবে না”।
কণিস্ক কাঁধ ঝাঁকাল “এটা ছেলেখেলা না পার্থ।ওই ছেলেটা যদি অন্য কিছু বেরত? আর পলাশমিতা কোথায়? ও কি আদৌ আসবে?”
দীপ বলল “না, এইমাত্র এস এম এস করল। আটকে গেছে মাসির বাড়িতে”।
কণিস্ক হতাশ মুখে সুদীপ্তার দিকে তাকাল “যা পারিস কর তোরা। আমি আর কিছু বলব না। তুই লিফলেটগুলি পলাশমিতাকে দিয়েছিলি?”
সুদীপ্তা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কণিস্ক বলল “সামনে কিন্তু কঠিন দিন আসছে। সবাই রেডি থাক। আর কিছু ছেলে জোগাড় কর। জেদি। শক্তিশালী”।
দীপ মোবাইল রাখল। বলল “কি কঠিন দিন?”
কণিস্ক হাসল “অপারেশন টাটাগোল্ড”।
১৪.
১৬ই এপ্রিল, ২০০৮
পার্বণী।
বড় কেলো হয়ে গেছে।পাশের ফ্ল্যাটের জ্যেঠু জ্যেঠি কোন কাজে সিটি সেন্টার গেছিল। আমাকে আর অনিকে দেখে ফেলেছে। তারপর গুছিয়ে মা-কে লাগিয়েছে। ফেরার পর থেকে খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। ঝাঁট জ্বলে লাট হয়ে যাচ্ছে আমার।
আমার বাবাকে অনির্বাণদা সম্পর্কে চুপি চুপি সবই বলেছি পরশুই। বাবাকে নিয়ে আমার কোন চাপ নেই। চাপটা মা-কে নিয়ে। মা হল অষ্টাদশ শতাব্দীর লোক। পারলে আমাকে বোরখা পড়িয়ে রাখে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর পেছনে কয়েক লাখ টাকা খরচা করবে শুনে মা বলেও ফেলেছিল টাকাগুলি আমার বিয়ের জন্য রাখলে ভাল হত।
বাবা অত আমল দেয় নি। বাবা সবসময় চেয়েছে আমি চাকরি করি, নিজের পায়ে দাঁড়াই। আমার ছোট ছোট দু-চার লাইন লেখা লেখি সম্পর্কেও প্রবল উৎসাহ দিয়ে এসেছে চিরকাল। মা ঠিক উল্টো। ছুটির দিনগুলি ছুতো নাতায় রান্নাঘরে আমাকে ঢোকাবেই। কে বোঝাবে আমার এত্ত এত্ত অ্যাসাইনমেন্ট বাকি আছে!
তবু এর ফাঁকে কিছু রান্না শিখে গেছি অবশ্য। বিরিয়ানিটা ভালই হচ্ছে আজকাল। ইচ্ছা আছে অনির্বাণদাকে একদিন খাওয়াব।
সকালে খাবার দেবার সময় মা একবার জিজ্ঞেস করে গেছে বাঁকা গলায় “আজ কলেজেই যাবি তো নাকি অন্য কোথাও?”
মা এই কথাগুলি বলেই টুক করে সরে পড়ে যাতে আমি কাউন্টার করতে না পারি । বাবার দিকে হতাশ মুখে তাকালাম। বাবা খেতে খেতেই বলল “বেশি কানে দিবি না, খেয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে যা”।
তবু জ্বলছিল ভেতরটা। একটা ছেলের সাথে একদিন সিটি সেন্টারে কেউ দেখে ফেলেছে বলে এত বাওয়াল হবে কে জানত। তাছাড়া আমার কপালটাও এমন। এই প্রথম অনির্বাণদাকে নিয়ে গেলাম আর শুরুতেই দেখে ফেলল।
বাবা গলাটা খাটো করে বলল “একটা কাজ করতে পারবি, অনির্বাণকে নিয়ে আমার অফিসে চলে আয়, তারপরে আমরা আজ সন্ধ্যেয় একটা নাটক দেখে আসি”।
বাবার মাঝে মাঝে এই চমকে দেওয়া কথাগুলি শুনে বেশ ভাল লাগে আমার। মায়ের কথাগুলি শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন মজা লাগল। বললাম “কিন্তু মা?”
বাবা খাওয়া শেষ করে উঠে আমার কানে কানে বলল “সে আমি ম্যানেজ করে নেব ক্ষণ”।
আমি লাফাব না ঝাঁপাব কি করব বুঝে ওঠার আগেই মা ঢুকল ঘরে। চুপচাপ গম্ভীর হয়ে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম।
#
অনির্বাণদা লাইব্রেরীতে ছিল। চুপচাপ গিয়ে বসলাম পাশে। প্রিয়াঙ্কা দূর ঠেকে দেখে চোখের ইশারা করল। আমি না দেখার ভান করলাম। একটা খাতা বের করে লিখলাম
“আজ সন্ধ্যেয় ফ্রি আছ তো? বাবা আমাদের নাটক দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছে”।
অনিদা চমকাল লেখাটা পড়ে। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে লিখল
“এর মধ্যে এদ্দুর?”
আমার হাসি পেল। লিখলাম
“চাপ হয়েছে একটা। আমাদের দেখে নিয়েছে আগের দিন পাশের বাড়ির লোক। বাড়িতে লাগানোও হয়ে গেছে। তবে আমার বাবা সম্পর্কে চাপ নিও না। আমাদের মতই”।
অনিদা হাসল। লিখল
“যা তা ব্যাপার। কিন্তু একদিন প্রেমে মেয়ের বাবা দেখা করতে চায় এটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম না?”
হাসি চাপতে চাপতেই লিখলাম
“কোন চাপ নেই”।
অনিদা আমার দিকে হেসে কাঁধ ঝাঁকাল। এদিকে গোটা ক্লাসটাই মনে হয় লাইব্রেরীতে ঢুকে পড়েছে।
নাহ, কলেজ বাড়ি সব জায়গাতেই কেস খেয়ে গেলাম দেখছি।
১৫.
১৮ এপ্রিল, ২০০৮
অরিত্রকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত তিনদিন ধরে মেসে ফেরেনি। অনির্বাণ ভেবেছিল বাড়ি গেছে হয়ত। কিন্তু সে ভুলটা ভেঙেছে মেসের ল্যান্ডলাইনে ওর বাড়ি থেকে ফোন আসার পর। পরপর দুদিন মোবাইল ফোনটা সুইচড অফ বলার পর মেসের ল্যান্ডলাইনে করেন।
ওর বাবা মা থানায় ডায়েরি করেছেন। সে নিজেও বুঝতে পারছিল না কি বলে সান্তনা দেবে। সব থেকে আশ্চর্যজনক কথা হল ওর ঘরে জামাকাপড় আছে শুধু কলেজের ব্যাগটা নেই। সেদিন পার্বণী আর ওর বাবার সাথে যখন বেরনোর কথা ছিল তখন সে লাস্ট ক্লাস বাঙ্ক করে বাড়ি চলে এসেছিল। দেখেছিল অরিত্র খুব সাজছে। তার ডিওটা নিয়ে মাখল।
তখন ওকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল কোথায় নাকি মিটিং আছে। ক’দিন ধরেই ছেলেটার গতিবিধি তার কাছে সন্দেহজনক লাগত। আগে মেসে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে গেমস টেমস খেলত, আড্ডা মারত, ইদানীং ফিরতে অনেক রাত করছিল।
সেসব কথাই ওর বাবা-মা আর পুলিশকে যা জানে বলল সে। পার্বণী পরে জানাল সায়নের সাথে নাকি ইদানীং খুব দোস্তি হয়েছিল। কোথায় কোথায় যেত।
সেকথা সে আর পুলিশকে বলল না। সায়নের কথা ভেবেই। তবে অরিত্রর মা বাবা কে বলেছে। তারা সায়নকে ফোন করেছিল বটে কিন্তু সায়ন বলেছে ও নাকি সেদিন ছ’টা অবধি কলেজে ছিল এব্যাপারে কিছু জানে না। কলেজের কয়েকজন কনফার্মও করেছে সেটা। অবশ্য তেমন বুঝলে সায়নের কথা ওনারাই পুলিশকে বলে দেবেন।
ওর বাবা-মার চোখ মুখ একেবারে বসে গেছে। তারা জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করিয়েছিল কিন্তু তারা কিছুই খেলেন না। এমন একটা হাসি খুশি ছেলে কোথায় গেল কি করল কিছুই বোঝা গেল না।
সব হাসপাতাল ইত্যাদিতে অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই চেহারার কেউ নেই। কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে।
কলেজে, মেসে ওর সব বন্ধুদেরই পুলিশ অনেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু তেমন কিছুই জানতে পারেনি।
শুধু অনির্বাণ এটুকুই মনে করতে পেরেছে নিরুদ্দেশ হবার সময় অরিত্রর পরনে ছিল হলুদ টি শার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট। আর গায়ে তার ডিও।
মাঝখান থেকে তার ভাল লাগাগুলি কোথাও যেন গুটি শুটি মেরে পরে রইল। পার্বণীর বাবা দারুণ লোক। একেবারে বন্ধুর মত মেশেন। নাটক দেখার পরে তারা একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করল। তারপর তাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন মেসে।
পার্বণীও এখন অরিত্রর ব্যাপার নিয়ে বেশ টেন্সড হয়ে আছে। তাদেরই ক্লাসের। কোথায় গেল ছেলেটা কে জানে।
অনির্বাণের সন্দেহ হচ্ছে দুজায়গায়। যদি ও কারও সাথে দেখাই করতে যায় তাহলে কলেজের ব্যাগ নিয়ে গেল কেন? আর ওর একটা ডায়েরী ছিল। সেটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
তাহলে অরিত্র কি জেনে শুনেই কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল?
দ্বিতীয় পর্ব
৭ই জানুয়ারি ২০১১
১।
ল্যাদ হয়ে যাচ্ছ তুমি খুব আজকাল।
কেন?
দেখতেই তো পাচ্ছি। বিয়ের পর অ্যাটলিস্ট কোথাও যাও না যাও বাড়ির কাছ থেকে তো একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পার।
তুমি তো দেখছই ছুটিই পাই না আজকাল।
এর থেকে তো আইটির চাকরিটা করতে পারতে। আমি অন্তত বাকি বন্ধুগুলোর মত ফেসবুকে আমেরিকার ছবি লটকাতে পারতাম, কি দরকার ছিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট জবের?
অনির্বাণ পার্বণীকে জড়িয়ে ধরে বলল “সব জায়গায় যাব সোনা তার আগে বলত তোমার বাবা মা কবে আসবে বলেছিল?”
পার্বণী অনির্বাণের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “সে আসবে দেরী আছে, কিন্তু আমি ওসব জানি না, তুমি আমাকে এই উইকএন্ডে কোথাও নিয়ে চল। আর ভাল লাগছে না আমার এই থোড় বড়ি খাড়া জিন্দেগী”।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল “কোথায় যাবে?”
পার্বণী উৎসাহিত হল “কাছে পিঠে কোথাও চল, শান্তিনিকেতন কিংবা মুকুটমণিপুর”।
তারা দুর্গাপুরে এসছে ছ’মাস হল। স্টিল প্ল্যান্টের চাকরিতে সবে ঢুকেছে সে। ট্রেনিংএর জ্বালায় ছুটি ছাটা বিরল থেকে বিরলতম হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এবার পার্বণী না ছোড় হয়ে গেছে। বিয়ের এক বছর হয়ে গেল তাদের এদিকে কোথাও যাওয়া তো দূরস্থান নিজের বাপের বাড়ি যাওয়াটাও আজকাল ঠিক ঠাক সম্ভব হয়ে উঠছে না।
অনেক দর কষাকষির পর ঠিক হল মুকুটমণিপুর যাওয়া হবে। একটা গাড়ি ঠিক করে শনি রবি দুদিন ওখান থেকে ঘুরে আসা যাবে। এর আগে তারা অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছে কিন্তু শেষ অবধি কোথাও যেতে পারেনি। হয় শেষমুহূর্তে তার ছুটি ক্যান্সেল হয়েছে নয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং পরে গেছে।
এমনিতে দুর্গাপুর জায়গাটা খারাপ না। ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, দু তিনটে শপিং মল, পার্ক, দামোদরের তীর সবই আছে কিন্তু সব থাকলেও অনির্বাণ সারাক্ষণ অফিসে থাকার ফলে পার্বণীর বিরক্তি ধরে যায়। আর অগতির গতি ফেসবুক। তাতে প্রায় সব বন্ধুই বাইরে থাকায় তার মন খারাপ হয়ে যায়। কেউ হয়ত ক্যালিফোর্নিয়া কেউ অ্যারিজোনা থেকে সব ঝাঁ চকচকে ফটো আপলোড করছে। আর সে পচে মরছে এখানে।
ক্যাম্পাসিংএর চাকরিটা পার্বণী শেষ মেষ না করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। অনির্বাণ আই টির চাকরি পেলেও পরে সরকারি চাকরি পাওয়ায় দুর্গাপুরে পোস্টিং পাওয়ায় সে ঠিক করে অনির্বাণের সাথেই থেকে যাবে।
এখানে শীত পড়ে জাঁকিয়ে। বেড়াতে যাবার মজাটা অন্যরকম পাওয়া যায়।
পার্বণী সোয়েটার গোছাতে গোছাতে অনির্বাণকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল “কি ভেবেছিলাম কি হলাম। কোথায় কবিতা টবিতা লিখতে, এখন তো সে সবও চুলোয় নাকি?”
অনির্বাণ ল্যাপটপে কাজ করছিল। পার্বণীর টিপ্পনীর জবাবে বলল “আর তো মাস তিনেক। ট্রেনিং পিরিয়ডটা শেষ হতে দাও। তারপর দেখ কবিতায় বান আসবে কেমন”।
পার্বণী স্যুটকেসটা বন্ধ করে বলল “বান আসবে না বাল আসবে কে জানে”।
এই কথায় দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়ল।
অনির্বাণ বলল “তুমি তো আগে এত খিস্তি মারতে না”।
পার্বণী বলল “মারতাম তবে তোমার সামনে না। আর আজকাল তো খিস্তির চাষ হচ্ছে মাথার ভেতরে ঘরে থাকতে থাকতে। টিভি আর ফেসবুক কাঁহাতক সহ্য হয় বলতো?”
অনির্বাণ বলল “এক কাজ করতে পার তো, বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পার”।
পার্বণী অনির্বাণের গাল টিপে নাকি সুরে গেয়ে উঠল “তুঝে না দেখু তো চ্যায়ন মুঝে আতা নেহি হে”।
অনির্বাণ পার্বণীকে কাছে পেতেই এই সুযোগে জড়িয়ে ধরে বলল “কাল না গেলে হয় না? মঙ্গলবার একটা পরীক্ষা আছে”।
পার্বণী জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল “না না না, আমি কিচ্ছু জানি না, কালই যাব”।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “ঠিক আছে। যথা আজ্ঞা”।
২।
৮ই জানুয়ারি, ২০১১
যাবে না যাবে না করেও শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে অনির্বাণের বেশ ভাল লাগছিল। বিশেষ করে দুর্গাপুর ব্যারেজ পার হবার পর বেশ খানিকটা স্ট্রেস কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল তার। পার্বণীর চোখ মুখ বদলে যাচ্ছিল। শিশুর মত তার প্রশ্ন শুরু হয়ে গেছে। “ওটা কি?” “ওই যে নদীতে ভেসে যাচ্ছে ওটা কি কচুরিপানা”?
যেন অনির্বাণ সবকিছু জানে। সেটা পার্বণীকে বলেও ফেলল সে “দেখ তুমিও যা জান আমিও তাই, খালি খালি জিজ্ঞেস করে কি হবে”?
পার্বণী অনির্বাণের হাতটা একটু চাপ দিয়ে বলল “তা কি করে হবে, তুমি আমার হাবি না? তুমি সব চেয়ে বেশি জানবে”।
হেসে ফেলল অনির্বাণ পার্বণীর কথা শুনে। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া সত্ত্বেও তার দিকের কাঁচ খুলেই রেখেছে পার্বণী অতি উৎসাহে। অনির্বাণ বেশ কয়েকবার বলে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। ব্যারেজ পেরতে বেশ সময় লেগে গেল তাদের। রাস্তা সরু। তার ওপর প্রচুর গাড়ি। ধীরে ধীরে পার হচ্ছে।
এ জায়গাটা স্টিল টাউনশিপের মত ঝা চকচকে নয়। একটা গ্রাম্য ব্যাপার আছে চারদিকে। অনির্বাণ বলল “এককালে দামোদরকে বাংলার দুঃখ বলা হত জান তো?”
পার্বণী মুখ টিপে হাসল।
অনির্বাণ অবাক হল “কি?”
পার্বণী বলল “যেই বললাম সব জান অমনি জ্ঞান দেওয়া শুরু হয়ে গেল না? এরপর নিশ্চয়ই বলবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই নদ সাঁতরে পার হয়েছিল?”
অনির্বাণ হেসে ফেলল। “ হ্যাঁ, সেটাও প্রোগ্রামে ছিল আর কি”।
পার্বণী বলল “আমরা ব্রেকফাস্ট করে নি এবার কি বল?”
অনির্বাণ বলল “দাঁড়াও, আরেকটু যাই, বাবলু বাবু আর কতক্ষণ লাগবে?”
ড্রাইভার ছেলেটার নাম বাবলু। ও বলল “কিছুই আসি নি স্যার, এখনও অনেক দেরী”।
পার্বণী বলল “ভাল হয়েছে, অ্যাটলিস্ট কিছু তো দূরে হোক, সবই বাড়ির কাছে হবে নাকি?”
অনির্বাণ বলল “সে অবশ্য ঠিক। দূরের জিনিস সব সময় ভাল”।
পার্বণী ব্যাগ থেকে ফ্রুট কেকের প্যাকেট বের করে বলল “একটা করে খেয়ে নিই চল”।
অনির্বাণের সকালে পেট পরিষ্কার হয় নি। সে দ্বিধা করছিল। শেষ পর্যন্ত বলল “তুমিই খাও, আমার ক্লিয়ার নেই, শেষে কেলো হয়ে যাবে”।
পার্বণী মুখ ভ্যাংচাল “উফ টোটাল ঝুল কেস তুমি। কি করে যে অত কবিতা আওড়াতে কে জানে!”
অনির্বাণ পার্বণীর সোয়েটারএর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পেটে একটা চিমটি কেটে বলল “কবিতার ভাই হয়েছে”।
পার্বণী বলল “নাম কি?”
অনির্বাণ মাথা চুলকে বলল “ভাই না বোন, নাম পার্বণী”।
পার্বণী এবার অনির্বাণকে একটা রাম চিমটি কাটল। বলল “আমার নাম নিয়ে নো ইয়ার্কি”।
ব্যারেজ পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল মসৃণ গতিতে। রাস্তা এদিকটা এখনও পর্যন্ত টু লেন হলেও বেশ ভাল। ঝাঁ চকচকে নীল আকাশ আর গাড়ির ভেতর বহুদিন পরে কোথাও বেরতে যাবার আনন্দে টগবগ করে ফোটা দম্পতিকে উৎসাহী করে তুলছিল।
পার্বণী বলল “কলেজে তোমার ক্লাস না করাটা এরা মনে হচ্ছে সুদে আসলে তুলে নিচ্ছে”।
অনির্বাণ বলল “যা বলেছ। প্রচুর চাপ। আর প্ল্যান্ট ভিসিট মাঝে মাঝে যখন করছি তখন ঘোর লেগে যাচ্ছে কি বিরাট সব ব্যাপার স্যাপার”।
পার্বণী বলল “বেশ হয়েছে। তখন খালি বাঙ্ক আর কবিতা। এবার দেখ কেমন লাগে”।
এই কথাটার সাথে সাথেই একটা শব্দ হল। আর বাবলু গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। অনির্বাণ উৎকণ্ঠিত হল “কি হল?”
বাবলু শুকনো মুখে বলল “পাংচার”।
একেবারে দুদিকে ধুধু মাঠের মাঝখানে গাড়িটা পাংচার হয়ে যাওয়ায় অনির্বাণের মুখ থেকে আপনা আপনিই বেরিয়ে গেল “ধুস শালা”।
পার্বণী বলল “বিরক্ত হোয়ো না তো। ও পাংচার সারতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
অনির্বাণ বলল “দেখ স্টেপনি আছে কিনা”।
মুখের কথা বেরল না বাবলু এসে মাথা চুলকে বলল “স্যার স্টেপনি নেই”।
এবার পার্বণীর মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল “কি হবে?”
বাবলু বলল “আমি বাসে করে যাচ্ছি ঠিক করে নিয়ে আসছি, ততক্ষণ আপনারা গাড়িতেই বসুন”।
-কতক্ষণ লাগবে?
বাবলু বলল “এক ঘণ্টা তো লাগবেই ম্যাডাম”।
একটা বাঁকুড়ার দিক থেকে আসা গাড়িতে চেনা ড্রাইভার দেখে টায়ারটা নিয়ে বাবলু চলে গেল।
অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে পার্বণী বলল “হাগু পেয়েছে? পেলে ওই মাঠে গিয়ে কর”। বলে ফিক করে হেসে ফেলল।
অনির্বাণ গোঁজ হয়ে বসে রইল গাড়ির ভেতর।
রাস্তার মাঝখান দিয়ে তাদের গাড়িটাকে মাঝে মাঝে ভাইব্রেট মোডে রেখে ট্রাকগুলি চলে যাচ্ছে। বাসও যাচ্ছে দুয়েকটা। শীতকাল বলে ট্রেকারে গাক গাক করে গান বাজাতে বাজাতে কিছু মস্তিখোর পাব্লিক যাচ্ছে।
মিনিট বিশেক যাবার পর অনির্বাণ শুকনো মুখে পার্বণীকে বলল “কি করি বলতো?”
পার্বণী উৎসুক মুখে তাকাল।
“কি হয়েছে?”
অনির্বাণ করুণ মুখে বলল “আমার খুব জোরে পেয়ে গেছে, আমি আর আটকে রাখতে পারছি না”।
পার্বণী বলল “এক কাজ কর তবে, এই জলের বোতলটা নিয়ে মাঠেই যাও না হয়”।
অনির্বাণ শুকনো মুখে বলল “আর দশ মিনিট দেখি। নইলে তাই করতে হবে মনে হচ্ছে”।
পার্বণী টেন্সড হয়ে পড়ল এই সময়। চারদিকে বেশ একটা ধু ধু ব্যাপার আছে। ফাঁকা জমি চাষের মাঝে মধ্যে। এই জায়গায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই।
আরও দশ মিনিট বাদে গাড়ি থেকে নেমে মাঠের দিকেই দৌড়ল অনির্বাণ। পার্বণী গাড়িতে একা একা বসে রইল।
৩.
৮ই জানুয়ারি ২০১১
একটা গোপন ডেরা, জঙ্গলের মধ্যে
সময়ঃ সকাল ১১টা
কণিস্ক পার্থ আর দীপ বসে আছে একটা তাঁবুর ভেতরে।
কণিস্ক গম্ভীর মুখে বলল “বয়েজ আজকেই যা করার করতে হবে। গভর্নমেন্টকে সমঝে দিতে হবে যে আমরা এখনও ফেলনা নই”।
পার্থ তাঁবুর ভেতর বসে যথারীতি দাড়ি চুলকাচ্ছিল। বলল “নই তো। ওই ইঞ্জিনিয়ারটা আর বউ দুটোকেই তুলবে তো?”
কণিস্ক বিরক্ত হয়ে বলল “ক’বার তোকে বলতে হয় বল তো? জ্বালিয়ে খেলে মাইরি”।
দীপ বলল “কিন্তু এ তো সামান্য একটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি। একে তুলে লাভ কি?”
কণিস্ক আরও বিরক্ত হয়ে বলল “তাছাড়া আসছে কে? কোন ইয়ে আসছে? সময়টা কম বুঝতে পারছিস না তোরা?”
দীপ বলল “হুম। তাহলে দুপুর নাগাদ ঢুকলেই অ্যাটাক তাই তো?”
কণিস্ক হাত তুলল “ইয়েস গাইজ”।
পার্থ বলল “সিকিউরিটি থাকবে না তো কোন?”
কণিস্ক বলল “ভুল ভাল কথা বলিস না তো, সিকিউরিটি কেন থাকতে যাবে। একটা ট্রেনী ইঞ্জিনিয়ার”।
পার্থ দাঁড়িয়ে পরে বলল “তাহলে এই অপারেশনটা আমি করব”।
দীপ বিড়বিড় করে বলল “সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনত, তেড়ে মেরে ডাণ্ডা করে দেব ঠাণ্ডা”।
৪।
৮ই জানুয়ারি ২০১১
রাত ৮টা
ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনির্বাণ বসল সোফায়। বেশ কিছু পর্যটক রয়েছে এখন। পার্বণী বলল “রাতে মাংস খাচ্ছ না তো? তোমার যা অবস্থা দেখছই, পিলেরুগী কোথাকার। পটল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খাও বরং”।
অনির্বাণ রাগ রাগ মুখ করে বলল “মাংসই খাব। এমন কিছুই হয় নি। সকালে পেট খারাপ ছিল না, শুধু পুরো ক্লিয়ার ছিল না বলে রাস্তার মাঝখানে পেয়ে গেছিল”।
পার্বণী বলল “কাল সকাল সকাল বেরব তবে”।
অনির্বাণ কম্বলের ভেতর ঢুকে জমিয়ে বসল। বলল “এই শীতে আমি আর ভোরে উঠতে পারছি না। আর কি বেরনোর দরকার। হানিমুনে আসলে আবার বেরনোর দরকারটা কি বলত?”
পার্বণী রেগে গিয়ে বলল “আমি ওসব জানি না, কালরাতে প্রিয়াঙ্কা বলে দিয়েছে ঝিলিমিলি না দেখে যেন না ফিরি”।
অনির্বাণ বলল “যাব তো, সকাল দশটার পরে যাব না হয়”।
পার্বণী বলল “তাহলে পাহাড়ে উঠবে কখন? বিকেলে ফিরবে না?”
একটা ছেলে চা দিতে এল। অনির্বাণ তাকে বলল “তোর নাম কি রে?”
ছেলেটা দাঁত বের করে বলল “ভরত”।
অনির্বাণ বলল “পাহাড়ে উঠে কি লাভ রে?”
ছেলেটার বয়স বেশি না। পনেরো ষোল হবে। বলল “একটা মন্দির আছে”।
পার্বণী উৎসাহিত হল “হ্যাঁ আমি শুনেছি ওখানে একটা বহু প্রাচীন জৈন মন্দির আছে। কেউ যায় না ওখানে। একটা মেলাও হয় ওখানে”।
ছেলেটা বলল “মেলা দেরী আছে গো বাবু”।
পার্বণী তবু উৎসাহ হারাল না, বলল “না তাও যাব, তুমি সকাল সকাল তুলে দিতে পারবে আমাদের?”
ছেলেটা বলল “ক’টায় তুলতে হবে”?
পার্বণী বলল “ছ’টা, তখন চা-ও দেবে”।
ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে গেল।
অনির্বাণ বলল “দুদিন থাকতে এসেছি কোথায় ল্যাদ খাব তা না, তোমার এই জ্বালাতন শুরু হয়ে গেল”।
পার্বণী বলল “বেশ হয়েছে, এই ল্যাদ খেয়ে খেয়েই তো কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না,এবার এসছি যখন এভাবেই ঘুরব, আর জায়গাটা কি সুন্দর, আমার তো মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই সারাজীবন,পশ্চিমবঙ্গের ভেতর এত দারুণ জায়গা আছে জানতাম না আগে সত্যি”।
অনির্বাণ হতাশ হয়ে বসে রইল।
৫।
৯জানুয়ারি সকাল ১০টা
তাঁবুর ভেতরে পায়চারি করছে অনির্বাণ । ক্যাম্প খাটে টেন্সড মুখে পার্বণী বসে আছে।
সে বলল “কি হল, এত হাটো কেন?”
অনির্বাণ দাঁত খিচাল “হাঁটব না তাহলে কি নাচব? কি দরকার ছিল এই আজগুবি প্ল্যানগুলি করে। নাও এবার ঠ্যালা সামলাও”।
পার্বণী বলল “আচ্ছা এরা বাথরুম কোথায় করে?”
অনির্বাণ কাঁধ ঝাঁকাল “তার আমি কি জানি?”
পার্বণী হঠাৎ হেসে বলল “এটাও কিন্তু একটা চরম অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে যাই বল”।
অনির্বাণ খচল এবারে “আমার পরশু ইম্পরট্যান্ট টেস্ট আছে আর তুমি বলছ অ্যাডভেঞ্চার!”
পার্বণী গুছিয়ে বসে বলল “তাতে কি? পেপারে খবর বেরবে, নিউজ চ্যানেলে দেখাবে, তুমি আমি ফেমাস। আর তোমার কোম্পানিও তখন তোমাকে বীরের সম্মান দেবে”।
অনির্বাণ ক্যাম্পে এসে বসল। এই শীতের মধ্যেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমছিল। বলল “যদি বেঁচে ফিরতে পারি তো”।
পার্বণী অনির্বাণের পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বলল “চাপ কিসের? মধু কবি তো বলেই দিয়েছে জন্মিলে মরিতে হবে এটসেটরা এটসেট্রা। আচ্ছা এদের বল না একটু কফি খাওয়াতে যা শীত ঠাণ্ডা লাগছে”।
অনির্বাণ বলল “পিকনিকে এসছ নাকি? এই জায়গায় কদিন থাকতে হয় দেখ এবার”।
তাঁবুর ভেতরে পার্থ ঢুকল। দাড়িতে হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাদের দেখে অনির্বাণকে বলল “এই তুমি ফেসবুকে আছ না?”
অনির্বাণ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। বলল “হ্যাঁ”।
পার্থ উৎসাহিত হল “হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি দেখেছি তোমায়। ওই আদরের নৌকায় তোমার একটা কবিতা পড়েছিলাম মনে হয় আগের মাসে”।
পার্বণী ফিক করে হেসে ফেলল। অনির্বাণ ভাবল এবার ম্যানেজ করা যেতে পারে। বলল “আচ্ছা আমাদের ক’দিন আটকে রাখা হবে?”
তার কথা শেষ না হতেই দীপ আর কণিস্ক ঢুকল তাঁবুর ভেতরে। কণিস্ক পার্থর দিকে তাকিয়ে বলল “খেজুর করতে এসছিস নাকি এখানে?”
পার্থ দীপকে বলল “আরে এই সেই ছেলেটা যার কবিতাটা তুই আমাকে শেয়ার করলি,তারপর কণিস্কর দিকে তাকিয়ে বলল “কণিস্কদা ছেলেটা দারুণ কবিতা লেখে”।
দীপ চোখ কপালে তুলল “ওহ, তুমিই সেই অনির্বাণ। বাহ বাহ, তোমার হবে”।
অনির্বাণ আর পার্বণী অবাক হয়ে এদের কথোপকথন শুনছিল। এদের দেখে বোঝাই যাচ্ছে কলকাতার গন্ধ এখনও এদের গা থেকে যায় নি।
কণিস্ক ওদের থামাল “ঠিক আছে, কবিতা লিখেছে ভাল করেছে। শোন বাপু অনির্বাণ, তোমাকে এখানে আটকে থাকতে হবে কিছু করার নেই। গভর্নমেন্টের কাছে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট দাবী আছে। সেগুলি আমাদের চাই। আর হ্যাঁ, যদি গভর্নমেন্ট যদি সেগুলি না মানে তাহলে তোমাদের ওপর গুলি চালাতে কিন্তু আমরা পিছপা হব না। ইন ফ্যাক্ট আমাদের ওপর সেরকমই ইন্সট্রাকশান আছে”।
অনির্বাণ এতক্ষণ আশার আলো দেখছিল। এখন তার মুখটা শুকিয়ে গেল। বলল “কিন্তু আমাদের দোষটা কি?”
কনিস্ক চোখ পাকাল “দোষ মানে? পুরোটাই দোষ, তুমি সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোক, আমাদের শ্রেণীশত্রু”।
পার্বণী রেগে বলল “শ্রেণীশত্রু মানে আবার কি? আপনি তো দেখছে অ্যালেন সলির প্যান্ট পড়েছেন। আপনি তাহলে তো আরও বড় শ্রেণীশত্রু। তাছাড়া, বাবা মা লোন নিয়ে ছেলেকে পড়াশুনা করাবে ছেলে কি করবে তার জায়গায়? ভিক্ষা করবে? না চাকরি করবে?”
কণিস্ক কটমট করে পার্বণীর দিকে তাকিয়ে বলল “অত জবাব আমি দিতে পারব না, গভর্নমেন্টের জন্য ওয়েট করব, তারপর ইন্সট্রাকশান ফলো করব। চল তোরা”।
বেরিয়ে গেল ওরা। যাবার সময় পার্থ হাত নেড়ে গেল।
অনির্বাণ পার্বণীকে বলল “কি দরকার ছিল এটার?”
পার্বণী বলল “কি দরকার মানে? তুমি কি ভেড়া? ওই মালটা ভাট বকে যাবে আর শুনবে?”
অনির্বাণ হাত জোর করে বলল “আচ্ছা মা, ঠিক আছে, ঠিক আছে”।
৬.
৯ই জানুয়ারি, মাঝরাত
এইরকম যে ঘটতে পারে অনির্বাণ বা পার্বণী কেউ কোনদিন ভাবতেও পারেনি। দুপুরে খেতে দিয়েছিল পাউরুটি আর ডিমসেদ্ধ। পার্বণী “ভাত আছে” নাকি জিজ্ঞেস করায় একটা ছেলে এসে একটা বাটিতে করে মেঠো ইঁদুর পোড়া দিয়ে গেছিল। সেটা দেখে পার্বণী ওখানেই বমি করে দেয়।
বিকেলের দিকে অন্য তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের চোখ বন্ধ করে।তাঁবুর বাইরে সবসময় পাহারা থাকে। সকালটা যদিও ভালভাবে কেটেছিল কিন্তু রাত গড়াতেই জঙ্গলের তুমুল ঠাণ্ডা তাদের অস্থির করে দেওয়া শুরু করল। তাদের ক্যাম্পের ওপর দুটো কম্বল রাখা। গায়ে তাদের শীত রক্ষার জন্য কোট আছে বটে কিন্তু সেটা একেবারেই কোন কাজে লাগছে না বোধ হচ্ছে।
অনির্বাণ পার্বণীকে বলল “রাতে আর বমি টমি কোর না। তাহলে না আবার বাইরে বের করে দেয়”।
পার্বণী বলল “কি করব, হঠাৎ করে ওরকম ইঁদুর দেখলে আর ঠিক থাকা যায়?”
অনির্বাণের রাগ হচ্ছিল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল এই খাবারগুলি ইচ্ছা করেই তাদের দেওয়া হচ্ছে। সকালে কণিস্কর মুখে মুখে কথা বলারই শাস্তি এটা।
রাতে তারা খেল না। পাউরুটিই দেওয়া হয়েছিল আরেকবার। অনির্বাণের মনে হচ্ছিল পার্বণীর অসুস্থ লাগছে।
পার্বণী শুয়ে পড়ল। সকালের উৎসাহটা অনেকটাই কমে গেছিল তার।
ক্যাম্পের নীচে একটা জলের বোতল থেকে জল নিয়ে পার্বণীর মাথায় সামান্য দিল অনির্বাণ। পার্বণী আঁতকে উঠে বসল “কি করছ?”
অনির্বাণ ম্লান হাসল “এবার অ্যাডভেঞ্চারটা ভাল লাগছে তো?”
পার্বণী বলল “কি আর হবে, ম্যাক্সিমাম আমাদের মেরে ফেলবে, অত চাপ নিয়ে লাভ আছে কি?”
অনির্বাণ বলল “আমার তো মনে হয় গুলি করে মারার আগে এই ঠাণ্ডাই আমাদের মেরে ফেলবে”।
পার্বণী হঠাৎ অনির্বাণের হাতটা ধরল। বলল “তোমাকে একটা কথা বলি”?
অনির্বাণ অবাক হল। “কি?”
পার্বণী বলল “আজ সকালে পাহাড়ে যাচ্ছিলাম কেন জান?”
অনির্বাণ বিরক্ত হয়ে বলল “না, যা বলবে একবারে বল না, এত ভূমিকা কিসের?”
পার্বণী মুখ ফিরিয়ে বলল “তাহলে বলব না যাও”।
অনির্বাণ আরও বিরক্ত হল “কি পেয়েছ বল তো? সকাল থেকে এই চলছে পুরোটাই তোমার জন্য আর তোমার এখন মান অভিমানের পালা শুরু হল?”
পার্বণী রেগে মেগে বলল “আমি কনসিভ করেছি। বুঝলেন? সেই সারপ্রাইজটা দেবার জন্য পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাচ্ছিলাম তোমায়”।
অনির্বাণ খুশি হবে না দুঃখ পাবে বুঝতে পারছিল না। বলল “সে কি? এত বড় একটা কথা তুমি দুর্গাপুর থেকে পেটে চেপে আসছ”?
পার্বণী বলল “সে তুমি কি বুঝবে? কোথাও নেবে না, সারাদিন বাড়িতে পচিয়ে মারবে, এই জন্যই তো এত জোর করেছিলাম বেড়াতে আসার জন্য”।
অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল পার্বণী। অনির্বাণ বুঝতে পারল একটা খুব বড় কেলো করে ফেলেছে সে।
পার্বণীকে এবার বোঝানো শুরু করল সে। কিন্তু অনেক অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও পার্বণী শক্ত হয়ে শুয়ে থাকল।
হঠাৎ বাইরে থেকে একটা চাপা গলার আওয়াজ এল “অনির্বাণদা ও অনির্বাণদা বাইরে এস শিগগির”।
গলার আওয়াজটা শুনে অনির্বাণ আর পার্বণী দুজনেই চমকে উঠল। পার্বণী বিছানায় উঠে বসে অনির্বাণের হাতটা শক্ত করে ধরল। অনির্বাণ উঠতে গেলে বাঁধা দিল। সেই বলল “ভেতরে আয়”।
প্রায় তিন বছর পরে অরিত্রর দেখা পেল তারা। অনির্বাণ বা পার্বণী কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি এইভাবে এই জায়গায় অরিত্রর দেখা পাওয়া যাবে।হ্যাজাকের আলোতেও অতটা না বোঝা গেলেও মুখে হালকা দাঁড়ি, গায়ের রঙে বেশ খানিকটা কালশিটে পড়ে গেছে এটা বোঝা যাচ্ছিল।
অনির্বাণ বুঝতে পারছিল না কি বলবে। পার্বণীই মৌনতা ভাঙল “কি রে তুই? এখানে কি করছিস? জানিস তোকে কত খোঁজা খুঁজি হয়েছে?”
অরিত্রকে দেখে সেই কলেজ লাইফের চঞ্চল ছেলেটা মনে হচ্ছিল না অনির্বাণের। দেখে স্পষ্টই বোধ হচ্ছিল ওর বয়সটা যেন কুড়ি বছর বেড়ে গেছে।
অরিত্র বলল “কি বলি বলত। এদের পাল্লায় পড়ি আমি তখন। পলাশমিতা নামে এক মেয়ের টোপে। সেই থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ছত্তিসগড়”।
অনির্বাণ বলল “বাড়িতে একটা খবর তো দিতে পারতিস?”
অরিত্রর চোখ ছল ছল হল। বলল “কি করে দেব। তখন আমি স্ট্রিক্ট নজরে। আমার পরীক্ষা হচ্ছে। সে সব ভয়ঙ্কর দিন গেছে। আর এখন যোগাযোগ করে কি হবে আর, কোনদিন তো পুলিশের গুলিতেই মরতে হবে। বাবা মার কাছে মরে তো গেছিই। আর বেঁচে আছি জানলে এক্সপেক্টাশন তৈরি হবে। সত্যি বলতে কি এখন আর সভ্য সমাজে ফিরে বাঁচার উপায় নেই অনির্বাণদা”।
অনির্বাণ কি বলল বুঝতে পারল না। সে বুঝতে পারছিল হারিয়ে যাবার আগে অরিত্রর যাতায়াতগুলিই তাকে শেষ পর্যন্ত এই ট্র্যাপে ফেলে দিয়েছিল। হঠাৎ করে সাজ পোশাক বেড়ে গিয়েছিল। কখনও রোজ ক্লাস করা শুরু করল, তারপরেই আবার ডুব দিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াত। কথার খেই হারিয়ে ফেলছিল সে। মনে প্রচুর প্রশ্ন আসছিল কিন্তু কোনটা আগে করবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারল না।
অরিত্রই বলে চলল “শোন আমি যে জন্যে এখন এসছি। এই সময়টা কণিস্ক দীপ আর গার্ডগুলি কেউ নেই। প্রায় আধঘণ্টা সময় আছে হাতে। তাঁবুর পেছনদিকটা বরাবর হাঁটা শুরু কর। আলো দেখতে পাবে বেরিয়েই, ওই বরাবর হাঁটলে একটা পুলিশ চৌকি দেখতে পাবে। ততক্ষণ আমি এদের ব্যস্ত করে রাখছি।একঘণ্টা মত লাগবে পৌঁছতে যদি তাড়াতাড়ি যাও যত তাড়াতাড়ি পার পালাও”।
পার্বণী বলল “আর তুই? তুইও চল আমাদের সাথে”। হঠাৎ মুক্তির আনন্দে পার্বণী ঝলমল করে উঠল। কিন্তু অরিত্রকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতেও ইচ্ছা করছিল না তাদের।
অরিত্র ম্লান হাসল। “আমি এখন চাইলেও যেতে পারব না রে... আর কিছু করার নেই আমার”।
“আর সেই মেয়েটার খবর কি? যার জন্য সবকিছু ছেড়ে তুই এখানে?”
অরিত্র হাসিটা বজায় রেখেই বলল “কে জানে হয়ত কোন এন আর আই এর ঘর করছে এখন, তোরা আর দাঁড়াস না, পালা এখনি, অরুণজি খুব মুডি লোক, কখন কি মনে হবে দিল হয়ত গুলি করে, এই রাস্তাটা বরাবর যা চলে আর কোথাও দাঁড়াবি না, এদের নেটওয়ার্ক সাংঘাতিক, একবার ধরা পড়লে আর দেখতে হবে না”।
অনির্বাণ জুতো পরে নিল তাড়াতাড়ি। পার্বণীকে নিয়ে বেরতে বাস্তবিকই দেখা গেল এখন আর কোন গার্ড নেই। দূরে একটা তাবু থেকে হই হল্লা ভেসে আসছে।
জঙ্গলের অন্ধকারে মিশে যাবার আগে সে জিজ্ঞেস করল অরিত্রকে “তোর বাবা মা কে কিছু বলতে হবে?”
অন্ধকারের মধ্যে অরিত্রর মুখটা দেখা গেল না। শুধু একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল “না”।
তারপরে তারা ছুটতে শুরু করল।
আলোর উদ্দেশ্যে...
1 comments:
অভীক জিও লেখা লিখেচিস।যশোধরাদি,বিকাশদার লেখাও ভাল লেগেছ।এই সংখ্যার সব লেখাই হুররে লেখা...
হিপ হিপ হুররে এ এ...
রঙ্গীত মিত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন