মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

ছোটগল্প – বিমোচন ভট্টাচার্য

তারাপদ
বিমোচন ভট্টাচার্য



এক

সকাল থেকেই মনটা ভালো নেই তারাপদর ।তারাপদ , মানে তারাপদ সামন্ত . বিধান নগর দক্ষিন থানার সাব-ইন্সপেক্টার ।প্রবল ধার্মিক তারাপদ যে কি করে পুলিশে চাকরি পেয়ে গেল তা সে আজও বুঝতে পারে না । শরীরটা শক্তপোক্ত ছিল আর ছিল দারুন সাহস, তাই আপ্লাই করেছিল , চাকরিটা হয়ে যাওয়াতে বাড়ির সবাই খুব খুশি হয়েছিলেন আর তারাপদ অবাক ।
তারাপদর মন ভালো নেই কারণ আজ একমাস হয়ে গেল বাড়ি যাওয়া হয়নি ওর । বেশ কয়েকবার বড়বাবু কে বলেও কিছু লাভ হয় নি , আজই আরও একবার বড়বাবুর ঘরে ঢুকেছিল, শুনলো বড়বাবু ফোনে কাকে যেন বলছেন-
-কি করতে যে পুলিশে চাকরি নিলাম , শালা, পনের দিন হয়ে গেল বউ এর মুখ দেখিনি ...শোয়া তো দুরের কথা ।
না , আর কিছু বলার সাহস পায় নি তারাপদ , স্যার ই যদি পনের দিন বউ এর মুখ না দেখে থাকেন তাহলে তারাপদর এক মাস আর এমন কি ।কিন্তু শালা বউ কে যে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, তার চেয়েও বেশি ইচ্ছে করছে আড়াই বছরের ছেলেটাকে দেখতে .. কোয়ার্টার এর জন্যে আপ্লাই করেছিল তারাপদ , সে এখনো পাওয়া যায় নি ।
তপন ঢুকলো ঘরে ।দু জনে এক ই সঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছিল , এই থানায় আবার ওর সঙ্গে দেখা অনেকদিন পর । সব ভাল তপনের শুধু মুখটা ভীষণ খারাপ. ঘরে ঢুকেই বলল -
- কি বে গান্ডু, মুখতা ঐরকম শুকনো পোঁদের মত করে বসে আছিস কেন ? বউ এর জন্যে মন খারাপ ?
-দূর শালা। তারাপাদ উত্তর দেয়, -আর ভাল লাগছেনা. দেব শালা চাকরি ছেড়ে, আজ আবার বাইপাস এ ডিউটি রাত্তিরে ......


দুই


বাংলা মদের দোকানে বসে ছিল কাদের ।একটা পাঁইট নিয়ে বসেছে এমন সময় পকেট এর মোবাইল বাজলো ।পকেট থেকে বের করে দেখে সুখেন ।এই সময় সুখেন ?আজ দোকানে উদোম ভিড় , কোনো রকমে একটা টুল জোগার করে বসেছিল কাদের ।
-কি ব্যাপার বল , কাদের বলে ।
- কোথায় তুই?
- সবে পাঁইট নিয়ে বসেছি।
- একটার বেশি খাসনা । ওদিক থেকে সুখেন বলে, গলাটা গম্ভীর -বটতলায় চলে আয় এক্ষুনি , দাদা ডাকছেন ..।
তাড়াতাড়ি বোতল শেষ না করেই বাইক নিয়ে চট করে পৌছে গেল কাদের । দেখে , সত্যি ই দাদা বসে আছেন । অনেকদিন পর দাদা কে দেখল কাদের ।
- কি রে কাদের , কেমন আছিস ? দাদার মুখে হাসি ।
-ভালই আছি দাদা , আপনাদের কৃপায় ভালই আছি , সামনে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে কাদের ।
-একটা কাজ আছে করবি ?
- কি যে বলেন দাদা, আপনি বলছেন আর আমি করবনা ।কাদের গদগদ হয়ে বলে ।
- শোন, দাদা শুরু করেন - কুড়িটা মটোর বাইক আছে , চোরাই,সেগুলো । বারুইপুর এ পৌছে দিবি , লরি লাগানো আছে , রাত দেড়টা নাগাদ বেরোবি ,বারুইপুর এ ডেলিভারি দিয়ে রতনের গাড়িতে ফিরে আসবি ।তোর সঙ্গে শম্ভূ আর চেলুয়া থাকবে ।
ঘড়ি দেখল কাদের ।সাড়ে নটা বাজে ।ডিসেম্বর মাস , এর মধ্যেই বেশ রাত মনে হচ্ছে । দেড়টায় বেরোলে ভিআইপি আর বাইপাস ধরে টানা চালালে তিনটে-সাড়ে তিনটের মধ্যে পৌছে যাবে বারুইপুর ।কাল দশটায় আবার থানায় হাজিরা দিতে হবে ।আগের কেসটায় এখনো ফেঁসে আছে কাদের ।দাদা যেন বুঝতে পারলেন দাদা কাদের কি ভাবছে।
বললেন
- কি রে ? সেই কেসটার কথা ভাবছিস তো ? প্রায় সেটেল করে ফেলেছি রে , তুই নিশ্চিন্তে যা আমার বলা আছে , তবে নতুন ব্রিজ টা দিয়ে যাস না, ভিআইপি , বাই পাস ধরে যাবি , আমার সব বলা আছে ।

কাদের মনে মনে তৈরী হল কাজটা করার জন্যে ।


তিন

বিষ্টু মন্ডল । রাজারহাট থানায় প্রায় দশ বছর হয়ে গেল ।প্রায় সকলেরই বদলি হয় কিন্তু বিষ্টু ফেভিকল হয়ে সেঁটে আছে এই থানায় ।প্রায় সব ওসি এই বিষ্টু কে চটান না , থানা ভালো চলছে , আমদানিও ও ভালো , বিষ্টুই ওই দিকটা দেখাশোনা করে ।দেশে তিনতলা বাড়ি করেছে , জমি জমাও বেশ ভালো রকম হয়ে গাছে , শুধু দু বছর আগে বউ এর নামে একটা যাত্রা পার্টি খুলেছিল চিত্পুর এ , শুওরের বাচ্চারা একেবারে পথে বসিয়ে ছেড়েছিল ওকে ।সেই থেকে এখন কাউকে ছাড়েনা বিষ্টু , রাস্তায় ভিখারীর কাছ থেকেও হপ্তা নেয় এখন ।
আজ ওকে দাদা ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন ।যেতেই হয়েছিল, নাহলে এমনি তে ওর কাছেই আসতে হয় সবাইকে, কিন্তু দাদা ।ওরে বাবা ।ঘরে আরও অনেক লোকজন ছিল , সবাইকে বার করে দিয়ে দাদা তাকালেন বিষ্টুর দিকে । তাকান দেখেই বিষ্টু বুঝে গেল কেস গামাক্সিন ।কিছুক্ষণ পর দাদা বিষ্টু কে বললেন -
-কি ব্যাপার বিষ্টু ? কাদের এর কেস টা এখনো ডিসমিস হলনা কেন ?
- এইবার মনে হচ্ছে হয়ে যাবে দাদা . বিষ্টু অতি উত্সাহে বলে ওঠে,-ওই গারেজের ছেলেটা, যেটা সব চেয়ে খচ্চর, ওটাকে মানেজ করে ফেলেছি, পরের হেয়ারিং এই কাদের খালাস পেয়ে যাবে।
দাদা একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন বিষ্টুর দিকে , তারপর বললেন -
-দ্যাখো বিষ্টু , যত টাকা আমি তোমাদের দিই, সেটা যদি ওই ছেলেটাকে দিতাম তাহলে এতদিনে কেস টা উঠে যেত কিন্তু আমি চেয়েছিলাম কাদের বেকসুর খালাস পাক ... আর হ্যা.. কাদের কে আজ একটা বিশষ কাজে বারুইপুর পাঠাচ্ছি ।দেখো রাস্তায় যেন কোনো অসুবিধে না হয় ওর ।
- দাদা , বিষ্টু বলতে যায়,-কাদের কেই পাঠাবেন .. ও যদি আর একবার ধরা পড়ে...
- তাহলে আর তোদের এত কাঁড়ি কাঁড়ি মাল্লু দিচ্ছি কেন রে শুয়োরের বাচ্ছা ।আজ যদি কাদের ধরা পড়ে তাহলে মনে রাখিস কাল আর তুই রাজারহাটে থাকছিস না ।
- ঠিক আছে ।

পায়খানা পেয়ে গেল বিষ্টুর , এই প্রথম দাদার মুখে তুই আর শুওরের বাচ্চা শুনলো বিষ্টু ।

না, ব্যাপারটা দেখতেই হচ্ছে ।


চার

বেরোনোর তোড়জোড় শুরু করলো তারাপদ ।সকালে তপন বলেছিল-
- আর কে যাচ্ছে তোর সঙ্গে , রাত্তিরে বাইপাস কিন্তু সাংঘাতিক ...এত জোরে মোটর বাইক চালায় ছোকরা গুলো , আর পেছনের মেয়েগুলো , একেবারে চেপ্টে ধরে থাকে ছেলেগুলোকে।
- ছটা হোম গার্ড দিয়েছে বড়বাবু ।
-হোম গার্ড ? হো হো করে হেসে ওঠে তপন ।
-হাফ গান্ডু বল ।
- ওরা আমাদের কি বলে জানিস তো ? বলে স্যার আমরা হাফ হলে আপনারা কিন্তু ফুল গান্ডু ...।
- ছাড় ওদের কথা । কাল সকালে ফিরে আমার সঙ্গে দেখা করিস । তপন এর পছন্দ হলনা কথা টা ।
রাত প্রায় বারোটা নাগাদ স্টেডিয়াম এর সামনে পৌছল তারাপদ ।ব্যারিকেড গুলো একটা নাগাদ লাগালেই হবে ।ডিসেম্বর এর মাঝামাঝি , এর মধ্যেই বেশ শীত শীত লাগছে এই সময় ।এক এক সময় বেশ আশ্চর্য্য লাগে তারাপদর । কি ছিল আর কি হল বাইপাস ।এই রাত প্রায় বারোটার সময়ও কত গাড়ি আর মোটর বাইক এই রাস্তায় ..
প্রায় রাত আড়াইটে নাগাদ ওয়ারলেস এ এলো খবর টা । তার আগেই রাত একটা নাগাদ ব্যারিকেড গুলো লাগিয়ে রুটিন চেক শুরু করে দিয়েছিল ওরা ।ওয়ারলেস বলছে যে একটা লরি সিগনাল ভেঙ্গে তোমাদের দিকে যাচ্ছে ... আটকাও ওকে । ব্যারিকেড গুলোকে তিন ভাগে সাজিয়ে নিল তারাপদ ।এমনিতে সাদাসিধে তারাপদ এই সময় গুলো তে একেবারে পাল্টে যায় , ছোটবেলা থেকেই ওর ভয়ডর একটু কম ।হোম গার্ড গুলোকে সতর্ক করে পিস্তল টা হাতে করে দাঁড়ালো ও ।

কিছু পরেই হুড়মুর করে এসে পড়ল লরিটা ।দূর থেকে হেড লাইট দেখেই মনে হয়েছিল ।ব্যারিকেড গুলোর পেছনে দিকে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা ।ভাগ্গিস তখন রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি ছিলনা । ব্রেক করতে চেষ্টা করেও পারল না কাদের ।ব্যারিকেড গুলোয় ধাক্কা খেতে খেতে একদিকে কাত হয়ে গেল লরি টা ।কাদের রা তিন জন লাফিয়ে নেমে ছুটতে শুরু করলো বেলেঘাটার দিকে । অন্য সময় হলে পালাতো না কাদের ,এখান থেকে দাদাকে ফোন করে দিলেই চলত .. কিন্তু আগের কেস তা এখনো ঝুলে আছে আর তা ছাড়া আসার সময় আর এক বোতল বাংলা টেনে এসেছে , ছুটতে ছুটতে দেখল পেছনে একটা পুলিশ ছুটে আসছে প্রচন্ড জোরে ... চেচাচ্ছে -- দাঁড়া .. দাঁড়া .. নাহলে গুলি করে দেব ..।
দাঁড়িয়ে পড়ল কাদের রা তিনজনেই ।

তারাপদ পৌছল সঙ্গে সঙ্গেই .. তিনটেকেই ধরে নিয়ে চলল পুলিশের গাড়িটার কাছে .। তিনটেকে গাড়ির ভেতরে পুরে , তালা লাগিয়ে ফোন করলো বড়বাবু কে .বড়বাবু সব শুনে বললেন-
-ওখানেই থাক , আমরা আসছি এক্ষুনি।
তারপর তো হই হই ব্যাপার ।সব বড় কর্তাদের খবর দিয়েছেন বড়বাবু ।খুব পিঠ চাপড়ানি পেল তারাপদ .ছটা হোম গার্ড নিয়ে এত বড় কাজ ...লোক তিনটেকে নিয়ে চলে গেলেন ওঁরা ।তারাপদ ডিউটি শুরু করলো আবার ।
ঘড়িতে তখন তিনটে পাঁচ .....



পাঁচ

দুপুর দুপর গ্রামে পৌছে গেল তারাপদ ।সবাই তো তারাকে দেখে খুব খুশি ।তারাপদর মনে পড়ছিল আজ সকালের কথা ।ডিউটি শেষে থানায় ফিরতেই বড়বাবু ডেকে পাঠালেন ।বললেন -
-তারা , তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ ।তুমি তো অনেক দিন ধরে বাড়ি যাবে বলছিলে . তা কাল বড়সাহেব কে বললাম তোমার কথা ...উনি তো এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন ।যাও, আজ ই চলে যাও বাড়ি ..বড়বাবু থামলেন , একটু হেসে আবার বললেন - তবে দেখো , আজ বুধবার ..সোমবার কিন্তু জয়েন করতেই হবে .. মনে রেখো ..।
আর দেরী করেনি তারাপদ ।ওদের গ্রামটা কিন্তু এখনো বেশ গ্রাম ই আছে .. প্রচুর গাছপালা..তারাপদর এখনো খুব ই আমোদ হয় গ্রামে এলে..বউ এর কথা না বললেও হয় , সেও তো খুব ই খুশি তারাকে দেখে , কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগলো ছেলেটাকে প্রায় একমাস পরে সামনে পেয়ে .তারপর বউ এর সঙ্গে রাত তা যে কি করে কেটে গেল বুঝতেই পারল না তারাপদ ।
পরদিন সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গেল তারাপদর ।খবরের কাগজ টা হাতে নিয়ে মনে হলো আজ নিশ্চয় বেরিয়েছে খবরটা । খবর টা পাওয়া গেল পাঁচের পাতায় ।
লরিটাকে পেছনে রেখে একটা ছবি বেরিয়েছে ..ছবিতে মাঝখানে ডি সি সাহেব, আরো তিনজন , এ ছাড়া ওদের বড়বাবুও আছেন।খবরটা এই রকম --

" বিশ্বস্ত সুত্রে খবর পেয়ে পুলিশের এক আধিকারিকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল একটি আন্তর্জাতিক মোটর বাইক চক্রের দু জনকে ধরে ফেলেন বমাল ,এয়ার পোর্ট এর কাছ থেকে পেছন পেছন ধাওয়া করে বেলেঘাটা মোড়ের কাছে ওদের ধরেন পুলিশের দলটি । . মোট কুড়িটি চোরাই মোটর বাইক ধরা পড়ে , এগুলিকে বারুইপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল .তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশে পাচার করা হত ।দু জনকে ধরা গেছে , বাকিরা পালিয়েছে , ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুরো দল টিকে ধরে ফেলা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। ঘটনাটিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন বড় কর্তারা" ।

মুখটা কীরকম বিস্বাদ হয়ে গেলে তারাপদর । বাকি চারদিন কোনো রকমে বাড়িতে কাটিয়ে সোমবার থানায় এসে যোগ দেয় সে । থানায় কেউ ই তার সঙ্গে বিশেষ কথা বলছিল না ।মাঝে তপন শুধু একবার দেখা করে বলল -
- না রে,তোকে একেবারে বাদ দেয়নি । মোট তেরোজনের নাম বেরিয়েছে , তার মধ্যে তেরো নম্বর তুই .. বড়বাবু বারো ,,প্রথম দিকে যাদের নাম তারা ওই রাত্তিরে হয় বউ না হয় অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছিল ।
সন্ধের সময় বড়বাবু দেকে পাঠালেন ।একটু ম্লান হাসলেন ...বললেন -
- তারা , বাড়ি থেকে ফিরে ফ্রেশ লাগছে তো ?আজ কিন্তু তোমার নাইট ডিউটি ...বাইপাস এ ।

হোম গার্ড গুলো ঠিকই বলে ।।মনে মনে ভাবলো তারাপদ , ওরা তো তবু হাফ ... আমরা শালা ফুল গাণ্ডু ...।


** গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ।কোনো চরিত্র বা ঘটনা যদি কোনো মানুষের সঙ্গে বা কোনো ঘটনার সঙ্গে মিলে যায় তা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।থানা দুটির নাম ব্যবহার করেছি জায়গা গুলোর সঠিক বিবরণ দিতে পারব বলে। কল্পনা থেকেই আরো দুটো খবর,কাদের পরদিন সঠিক সময়ে রাজারহাট থানায় হাজিরা দেয়. ওই মামলাটি থেকেও বেকসুর খালাসও পেয়ে যায় সে ।প্রায় দশ বছর পর বিষ্টু মণ্ডল বদলি হয়ে যায় গোয়ালপখোরে ।রাজারহাট এর রাজার হাল ছেড়ে ।