সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

গল্প - সৌমিত্র চক্রবর্তী



এ শহর প্রান্ত
সৌমিত্র চক্রবর্তী



তক্তপোষের ওপর এক হাঁটু মুড়ে অন্য পা টা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল রনিআনমনে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের কোনের চামড়া খুঁটে খুঁটে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছিল, যদিও অত মোটা চামড়া একটু খোঁচা হয়ে উঠে আর ছাড়ছিল নাবেশি জোরে টানলে লাগছিল, আর তখনই চমকে হাত সরিয়ে আনছিল ওকিন্তু আবার একটু পরেই হাতটা সেখানে চলে যাচ্ছিল অজান্তেই সামনে উঁচু একটা পড়ার টেবিলের ওপর রাখা টিভি তে ইস্টবেঙ্গলের খেলা হচ্ছে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গেবেশ বেগ দিচ্ছে দলটারনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সাপোর্টারসুযোগ পেলেই ক্লাবহাউসের টেন্টে ঢুকে পড়েভাবও জমিয়ে নিয়েছে কয়েকজনের সঙ্গেএখন সবই তেলের যুগখিক খিক করে আপনমনেই হেসে উঠল ওপুরনো সাবেকী ঢঙের দোতলা বাড়ীতৈরী করেছিল রনির ঠাকুরদাজায়গায় জায়গায় পলেস্তারা চটে গিয়ে ইট দাঁত বার করেছেকোথাও নোনার স্পষ্ট ছোপছাদের বেশিরভাগ অংশই শ্যাওলার মোটা আস্তরণের দখলেকতদিন যে রঙ হয়নি ঠিক মনেও করতে পারে না কেউকালিঘাটের এই অঞ্চলটা এখনো পড়ে আছে সেই মান্ধাতার আমলের ভাবনা চিন্তায়ওপরে ওপরে বড় রাস্তার ধারে অনেক চকচকে দোকান, শোরুম, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট হলে কি হবে, গলির মধ্যে কিম্বা মন্দিরের সামনের জগতের মানুষগুলো এখনো সাবেক ঘি এর গন্ধ শুঁকেই দিন কাটায়এখানে মার্জিত সুরে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনাচিৎকার করে হামেশাই একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করা আর সেই কুৎসিত কোলাহল উঁকিঝুকি মেরে উপভোগ করা এখানকার স্বাভাবিক দস্তুর এখানে সম্প্রতি যারা বাড়ী করেছে, তাদের এই পুরনো বাসিন্দারা বহিরাগত উপদ্রব মনে করে তাচ্ছিল্য করেরনি নিজেও ওই ভাবধারার শরিকসেখানে সে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিকনিজেরটুকু গুছিয়ে নিতে পারলেই হলএত বড় বাড়ীর দেখভাল করার মত কেউই আর নেইশরিকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেপড়ে রয়েছে রনি আর তার জ্যাঠতুতো ভাই অনীকসে এখনো বিয়ে থা করেনিআর করবেও না মনে হয়প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই অনীক সল্টলেকে একটা সরকারী অফিসের কেরানিবাড়ী বা সংসার সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহই নেইসন্ধের অনেকপরে বাড়ী ফিরে সোজা একখানা বোতল খুলে বসেসাথে অফিসফেরতা আনা টুকটাক খাবার আর একটা বই কিম্বা নতুন কেনা ট্যাবএ বাড়ীর ঐতিহ্য যদিও সেরকম কিছুই নেই কিন্তু সেসম্পর্কে তৈরী করা কিছুটা টনটনে অহংকার তার মধ্যেও আছে গোওওল যাহ! টালিগঞ্জ গোল দিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গলকেনড়েচড়ে বসল রনিবিড়বিড় করে গাল দিল কাউকেএই পুচকে দলগুলোর কাছে গোল খাওয়ার আগে এরা আত্মহত্যা করে না কেন? চোখদুটো ঈগলের মত তীক্ষ্ণ করে তক্তাপোষ থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকল সেপারলে হয়তো টিভির মধ্যে ঢুকেই পড়ত

উফ! অনেক দেরী হয়ে গেলআরো জোরে পা চালাল সম্পাতিএই কলকাতার ফুটপাতে তাড়াতাড়ি হাঁটাও যায়নাএখানে গর্ত, সেখানে নোংরা আর হকারের দৌরাত্য ধুস শালাএখানে কেউ থাকে! বিড়বিড় করল আপনমনেইটালিগঞ্জ ট্রামডিপোর মোড়ে এসে রাস্তা পেরোনোর জন্যে দাঁড়িয়ে গেলহুশ হুশ করে গাড়িগুলো প্রায় গায়ের ওপর দিয়েই চলে যাচ্ছেএই হতভাগা দেশে কোনো সিস্টেম তৈরী হলোনা এখনোআর হবেও না কোনোদিনএদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও কোনো ট্র্যাফিক পুলিশের চিহ্নও দেখতে পেলনা সেথেমেছেচটপট পা চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এপাড়ে মেট্রোর সাইডে এলঘড়িটা দেখল একবার, বিকেল চারটে বাজে প্রায়সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরা যাবে কি? সামনে একটা বাস থেকে কন্ডাকটর চিৎকার করে যাচ্ছে- হাওড়াহাওড়াহাওড়া! আর না ভেবে পাদানিতে পা রাখল ও, আর আশ্চর্য উঠেই সিট পেয়ে গেলকলকাতার পুরনো আমলের এই বাসের সিটগুলোও একেবারেই পছন্দ নয় তারসেই মান্ধাতার আমলের দুদিকে লম্বা লাইন করে বসার সিটঅন্যদেশের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, এই পশ্চিমবঙ্গের অন্য শহরে কিম্বা গ্রামাঞ্চলেও এই বাসগুলো আর দেখা যায়নাবিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উঠলো সম্পাতির আসলে এখন যা দেখছে তাতেই বিরক্ত লাগছেদুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমনো উচিৎই হয়নি তারমোবাইলে একটা আলার্ম দিয়ে রাখতে হতসিগন্যালে আটকেছে বাসটাঅধৈর্য হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে দেখল সেকাতারে কাতারে গাড়ি দাঁড়িয়ে সামনেকাল দেশপ্রিয় পার্কে অনেকক্ষণ বসেছিল শাখার সঙ্গেসেই একই টুকটাক কথা হতে হতেই শাখা অনর্গল হয়ে গেলনিজের কথা, ছেলেবেলার কথা, ওর বাবার কথা, মায়ের কথা, জেঠুমনি, পাশের বাড়ির তাতাই এর কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলঘটিগরমের ঠোঙা থেকে একটু একটু খেতে খেতে মন দিয়ে শুনছিল সম্পাতিখুব মন দিয়ে কিছু শুনলেই তার চোখের সামনে ছবিগুলো পরিস্কার ফুটে ওঠেসিনেমার মত সব ঘটে যাওয়া অতীত সরে সরে যায়, পিছলে যায়একাত্ম হয়ে যায় তখন সে
শাখার হাতের তালুটা বেশ শক্তওর শ্বশুরবাড়ির প্রায় সব কাজই তাকে করতে হয়আসলে ও বাড়িতে শাখার জায়গা কাজের লোকের প্যারালালওর স্বামীটা একেবারেই অপদার্থমোটামুটি সবকিছুই শোনা হয়ে গেছে সম্পাতির
হাত তুলে কুলফি ডাকলো ওদুটো দিতে বলে একটা সিগারেট ধরালোঘাসের সামান্য রেখার ওপরে বসে আছে ওরা দুজনপার্কের বাইরের রাস্তার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে এখান থেকেএদিক ওদিক গাড়ি চলে যাচ্ছেআচ্ছা এখানে পাখি আছে?
এবারে মাত্র দুদিনের জন্যে এসেছিল সেচাকরীসূত্রে সম্পাতি থাকে বীরভূমের রামপুরহাটেলালমাটির দেশে প্রচুর খোলামেলা জায়গা, পাখপাখালি তাকে অভিভূত করে দেয়আজন্ম এই কলকাতার মানুষ সেপড়া কমপ্লিট করে প্রথম চাকরী পেয়ে বাইরে গেছিল, তাও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেলকিন্তু সেও কাঠখোট্টা গুজরাতের এক শহর, মেহসানাবাংলার প্রাম যে একেবারেই দেখেনি তা নয়দু একবার বন্ধুদের সঙ্গে আশেপাশের গ্রামের কোনো ট্যুরিস্টস্পটে গেছে পিকনিক করতে কিম্বা বেড়াতেকিন্তু আপাদমস্তক গ্রাম কে এভাবে উপভোগ করা, শরীরে মনে মেখে নেওয়া আগে কখনো হয়নি
রামপুরহাটে সে যেতেও চায়নিকিন্তু নতুন এই চাকরীটা বেশ বড় কোম্পানীতে, আর অফারটাও বেশ শাঁসালোকলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে শুনে কি হয় দেখি একবার গোছের মনোভাব নিয়েই গেছিল সেআর গিয়েই জাস্ট প্রেমে পড়ে গেছে জায়গাটার
শাখার সঙ্গে ওর আলাপ ফেসবুকেসন্ধের পরে ওখানে বিশেষ কিছুই করার থাকেনাওখানে খুব একটা বন্ধুও নেই তারকাজের সূত্রে যা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপতার বেশি কখনোই এগোয়নি কোনো সম্পর্কতাই সময় কাটাতে সন্ধের পরে ফেসবুক খুলতে শুরু করেছিল সেপ্রথম প্রথম শুধু পড়ত, দেখততারপর গুড ইভনিং, গুড নাইটআর এভাবেই কিভাবে কখন যেন আলাপ হয়ে গেল শাখার সঙ্গে এখন আর ঠিক মনেও করতে পারবে না সেসেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটে কেটে যেতকখনো মেয়েদের সাথে সেভাবে না মেশার জন্যে ওদের মন, চাহিদা, কল্পনা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সম্পাতিরকথায় কথায় জল গড়িয়ে সম্পর্ক কখন যেন গাঢ় হয়ে গেলশাখার হাতের আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে সম্পাতি
পঁয়তাল্লিশ ছুঁল সে এই লাস্ট জুনেবাড়িতে দাদা আর বউদিদাদার মেয়েরা বিয়ে হয়ে বিদেশেএখানে আর ফিরে আসার চান্স খুবই কমদাদাও রিটায়ারমেন্টের পরে ক্লাব নিয়েই মেতে থাকেআগে আত্মীয়রা বিয়ের কথা বলত ওকেঠাট্টা তামাশাও করতএখন ওরাও ফেডআপ হয়ে  ছেড়ে দিয়েছে ওসব বলাধরেই নিয়েছে এরকমই অবিবাহিত হয়েই থেকে যাবে সম্পাতিআসলে এতদিন মেয়েদের সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহ ছিল না ওরমেয়ে মানেই বাধা এই ধারণাটা ওর বদ্ধমূল ছিলআস্তে আস্তে শাখার সঙ্গে আলাপের পরে সব কেমন যেন পাল্টে গেলসাদাকালো স্কেচের ওপরে রঙের আলতো টান লাগতে শুরু হল
শাখার জীবনটা ওর খুব অদ্ভুত মনে হয়ওর বাপের বাড়িও কেমন যেন উদাসীনদুই বাড়িই প্রাচীন মানসিকতার কূপমন্ডুকতায় পড়ে আছে এখনো এই একুশ শতকেওকলকাতা শহরটাকে সম্পাতির মাঝেমাঝে গ্রাম মনে হয়যতই ঝাঁ চকচকে হোক ওপরটা, ভেতরে ভেতরে মানসিকতা পড়ে আছে সেই মধ্যযুগেইশাখার বাপের বাড়িতে যেমন মনে করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আপদ নেমে যায় ঘাড় থেকেতেমনি শ্বশুরবাড়িও মনে করে বাড়ির বউএর কদর কাজের লোকের বেশি নয়আশ্চর্য, এদিকে লোকটা কিন্তু শাখার রোজগারেই বসে বসে খায়
-“উঠবে না? অনেক রাত্রি হলো তো! না ফিরলে আবার চিৎকার ...
শাখার কথায় হুঁশ ফিরলো সম্পাতির
-“হ্যাঁ চল
টেনিস কোরটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শাখার ডানহাতের তালুটা বাঁ হাত দিয়ে মুঠো করে ধরলো সেশাখাও আঁকড়ে ধরলো ওর হাতকালিঘাটের গলিতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে শাখাকে
নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন, অথচ হিমের কোনো রেশ নেই এই মহানগরে


একটা মানুষের আইডেনটিটি কি? একটা ভোটার আইডি? একটা আধার কার্ড কিম্বা প্যান কার্ড, পাসপোর্ট? কয়েকটা কাগজের টুকরো বা কয়েকজন সাক্ষী কি একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে? আইডির ফটো থেকে চেনা যায় মানুষটা কেমন?
সে বা তার বাবা, মা কেউই তো রনি কে চিনতে পারেনি কখনোবিয়ের আগে প্রায় বছর তিনেক একটানা ওদের সিথির বাড়িতে যেত রনিভুরিভুরি মিথ্যে বলতো সেসময়সে নাকি বিশাল আর্টিস্টপ্রেসিডেন্সির ছাত্র, প্যারিসের ডিপ্লোমা আছেবড় বড় এক্সিবিশন করে সে, যেগুলো উদ্বোধন করেন বিশাল মাপের বিশিষ্ট মানুষেরাঅবাক হয়ে সেসব শুনত ওদের বাড়ির সবাইওর বোন তো রীতিমত ফ্যান ছিল রনিরতারপর যেদিন রনি বিয়ের প্রস্তাব দিল ওদের বাড়ির সবাই যেন হাতে চাঁদ পেলও নিজেও বিভোর হয়ে গেছিল এক বিশাল আর্টিস্ট কে নিজের করে পাবে ভেবেআগুপিছু কোনো খবর না নিয়েই এক অশুভক্ষণে বিয়েটা হয়ে গেল তার
হ্যাঁ, তার বিয়েই বলবে সেকারন রনি কোনোদিনই নিজেকে বিবাহিত ভাবেনিবিয়ের কিছুদিন পরেই এটা বুঝতে পেরেছিল শাখাআসলে রনির দরকার ছিল ওর মা কে দেখাশোনা করার জন্যে একটা বিনে মাইনের আয়া আর রান্নার, বাসন মাজার কাজের লোকবিনেমাইনের, কারন রনির কোনো রোজগার ছিলনাসব মিথ্যে কথা বলেছিলসে আদৌ শিল্পী নয়, বলতে গেলে কিছুই নয়পড়াশোনাও মাধ্যমিকের গন্ডীর এদিকেআর রীতিমত দুশ্চরিত্রপ্রথম যেদিন একতাড়া চিঠি ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে হাতে পেল, সেদিন ছুটে গিয়ে রনিকে জবাবদিহি করেছিল স্ত্রীর অধিকারবোধ নিয়েইকিন্তু রনি চিঠিগুলো হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যখন সপাটে গালে চড় মারলো, যেন বাজ পড়েছিল ওর মাথার কোষের মধ্যেইরনির বাকী চিৎকার আর ওর মাথায় ঢোকেনিপরে যতবারই ফোনে মা বাবাকে এসব কথা বলেছে, তাঁরা গম্ভীর হয়ে অ্যাডজাস্ট করতে বলেছেন ওকে
কতভাবে অ্যাডজাস্ট করতে পারে একটা মেয়ে?
রাত্রির এই নির্জন সময়ে একা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল শাখাএই ছাদ আর এই রাত্রি ওর বন্ধু, ওর আশ্রয়যখনই কোনো মানসিক বিচ্যুতি ঘটে ওর, পালিয়ে আসে এই ছাদেএখনো পর্যন্ত কোনো ইস্যু হয়নি ওররনি ওকে যেমন আজ পর্যন্ত হাতে তুলে কোনো উপহার দেয়নি, তেমনি দিতে পারেনি স্বামী-স্ত্রীর সেরা উপহারআসলে বহুগামিতায় নানারকম রোগের শিকার হয়ে পড়েছে সেযে কয়েকবার  সে রনির কামনার শিকার হয়েছে, লক্ষ্য করেছে তার আগে রনিকে ওষুধ খেতে হয়েছেতবুও কখনোই শেষরক্ষা করতে পারেনি সেনিজের কামনাটুকু চরিতার্থ কোনোরকমে করেই ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের তক্তাপোষের ওপরেওপরে সেই বিছানায় শোবার অধিকার ছিলনা শাখারএখন অবশ্য সেই ঘর ছেড়ে দোতলায় একচিলতে চিলেকুঠুরিই তার জায়গাছোট্ট, তাহলেও অন্তত একা নিজের মুখোমুখি হতে পারে এখানে সেআর খুব বিচলিত হলে, কিম্বা নির্ঘুম এইসব রাতে চলে আসে ছাদেতাকিয়ে থাকে আকাশের তারাদের দিকেকথা বলে ওদের সঙ্গে, নিজের সঙ্গেও
আজও গায়ে হাত তুলেছিল জানোয়ারটাআঁকছিল শাখাছোট থেকেই আঁকার শখ তারকিন্তু এখানে এসে সব জলাঞ্জলি দিতে হয়েছেরনি তো কিছু রোজগার করেনাঅথচ তার চাহিদা আকাশ ছোঁয়াপ্রথম প্রথম বাবার কাছে হাত পাততে হতকিন্তু তারপর বাবার বিমুখতা আঁচ করে এখন নিজেই টিউশন শুরু করেছেপড়ানোর আর আঁকারমোটামুটি চলে যায় এতেইকিন্তু যা পায় তার বেশিরভাগটাই রনি কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যায়কোনোরকমে কিছু বাঁচিয়ে সংসার চালাতে হয় তাকেঅথচ সেই আঁকাটাই সহ্য করতে পারেনা জন্তুটাহয়তো তার নিজের বলা মিথ্যেগুলো মনে পড়ে যায়আজ যখন একমনে আঁকছিল, কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল রনি, বুঝতে পারেনিসাধারণত ওকে লুকিয়েই ছবি আঁকে সেহঠাৎ কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে হাতে জোরে একটা ঘুষি মেরে বসলো রনিযন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল সেএখনো হাতের কব্জির ওপরটা ফুলে আছেদুচোখ ভরে জল এল শাখারওপরে তাকিয়ে বলল, আর কত?
নিজের শৈশব, যৌবন সব যখন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিল ঠিক সেই সময়েই সম্পাতির সঙ্গে ওর পরিচয়আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষটার, ওর সঙ্গে কথা বললে সব ভুলে যায় সেতার নিত্যকার ক্লেদ, গ্লানি, ক্ষোভ কিছুই লুকায়নি সে সম্পাতির কাছেপ্রায় একবছরে আস্তে আস্তে কখন যেন সে তার আশ্রয় হয়ে উঠেছেরোজ ফোনে কথা হয় দুজনেরকিন্তু একটাই মুস্কিল বড় অবুঝ আর অভিমানী সম্পাতিওকে বোঝাতে হয় সবকিছুআর এই বোঝানোতে এই এতদিন পরে তৃপ্তি পায় শাখাএতদিনে সে পূর্ণ নারী হয়ে উঠছে


ওয়ালেটটা খুলে দেখল রনিমাত্র পঞ্চাশ টাকা পড়ে আছেমাগীটা এখন কিছুতেই হাত উপুড় করতে চাইছে নাকি ব্যাপার কিছুই আঁচ করতে পারছে না সেকোনো চক্কর চালাচ্ছে নাকি? কয়েকবার বন্ধ দরজায় আড়ি পেতে মনে হয়েছে কারো সাথে কথা বলছে ফোনেএইসব বুদ্ধি নিশ্চয় সেই নাগরই দিচ্ছেরাগে গা কিসকিস করে উঠলো রনির
শালীকে বিয়ে করে আনার পরে বেশ বাধ্য ছিলবাপরে! অনেক ভুজুং ভাজাং দিতে হয়েছে ওর বাপ মা দুটোকেহেব্বি মালকড়ির টোপ দিয়ে তবে কাজ হাসিল হয়েছিলমাগীটাকে প্রথম দেখেছিল ওদের পাড়ায় একটা ছবির একজিবিশনেওখানেই মাথায় বুদ্ধিটা আসেতারপর আর্টিস্ট সাজতে ওর বেশিক্ষণ লাগেনিআর টুপি পরানো ওর কাছে জলভাতকিন্তু সেই বাধ্য মেয়েটা কি করে যে গত একবছরে পাল্টে যেতে শুরু করল, তার থই খুঁজে পায়না সেযে মালটা এইসব বুদ্ধি দিচ্ছে হাতের কাছে পেলে সেটাকেও ঠ্যাঙাত সেনিজের পিপের মত পেটটা সামনে বিছিয়ে ভাবতে বসলো রনিকিভাবে এখন কিছু হাতানো যায়সন্ধেয় মনিকার সঙ্গে মোলাকাতের টাইম দেওয়া আছেখালি হাতে তো যাওয়া যায়নাঅলরেডি যা গয়না ছিল চুরি করে ঝেড়ে দিয়েছে সেআলমারীতে দামী শাড়ীগুলোরও একই অবস্থাএখন...!
এখন চারদিকেই খারাপ সময় চলছে তারক্লাবে ওর ব্যাকিং সতুদাটা পট করে অ্যারেস্ট হয়ে গেল একটা কুকর্মতে ফেঁসে গিয়েমনিকাকে ইমপ্রেস করার জন্যে যে পঞ্চাশ কপি বই নিজের নামে ছাপিয়েছিল এর তার বই থেকে ঝেড়ে, সেই প্রেসের মালিক রন্তু আজ রীতিমত শাসিয়ে গেছে টাকা পেমেন্টের জন্যেদুপুরে টাকা চাইতে গিয়ে দেখে ছোটোলোকের মেয়েটা আবার ছবি আঁকতে বসেছেদেখেই ধাঁ করে মাথা গরম হয়ে গেছিল ওরকতবার বলেছে, বারন করেছে সে, তবুও আবার! এই ছবি আঁকলেই মনে হয় মেয়েটা তাকে বিদ্রূপ করছেছবিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল আর মেরে বসেছিল এক ঘুষি
আফশোষে হাত কামড়াল রনিইসতখন মাথা গরম না করে কোনোরকমে কাজ হাসিল করে নিলে এখন আর এই চিন্তায় থাকতে হত না তাকেএতটা বোকামি তো কখনো করেনা সেএখন কি করা যায়? পাড়ায় সবাই ওকে চেনেসবাই মোটামুটি জেনে গেছে ওর কীর্তিকলাপএখন আর কেউই ধার দিতে চায় না ওকেনানান অজুহাতে এড়িয়ে যায়সতুদা থাকলে এইসময় কিছু পাওয়া যেতকিন্তু...
ডিওর ক্যান থেকে স্প্রে করল অকারণতারপর মেসেজ করল মনিকাকে, “শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ লাগছেআজ যেতে পারব নাপ্লিজ কিছু মনে কোরোনা সোনা


মাথা গরম হয়ে আছেট্রেনে আসতে আসতেই সব শুনেছে সেআরো মাথা গরম হয়েছে দুপুরে মেরেছে জানোয়ারটা, হাত ফুলে আছে এখনো, কিন্তু শাখা ডাক্তার দেখায়নি শুনেফোনেই প্রচন্ড রাগারাগি করেছে সেশাখা কথা দিয়েছে কাল সকালেই ডাক্তার দেখাবে
আরেকটা কথা বলেছে সম্পাতিএকটা এফআইআর করতে থানাতেপ্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না শাখাকিন্তু এভাবে মার খাওয়া বন্ধ করার যে আর অন্য কোনো রাস্তাই নেই সেটা বুঝিয়ে বলার পরে নিমরাজি হয়েছে, কিন্তু ড্রাফট টা এখন করে দিতে হবে সম্পাতিকে এই শর্তে
মেসের ঠাকুর চন্দন খাবার দিয়ে গেলপ্লেট টা খুলে দেখল ও, রুটি, বেগুনের তরকারি আর একটা ওমলেটখাওয়ার ব্যাপারে কোনো খুঁতখুঁতে ভাব নেই সম্পাতিরযা পায় তাই খায়হাত ধুয়ে বসে পড়ল সে
এমনিতে জীবনে খুব বাস্তববাদী সেকখনো আবেগের বশে কোনো কাজ করেনাযোগ বিয়োগ গুন ভাগের চাকরী করতে করতে তার মধ্যে আসেনা কাশফুলের রোমান্টিকতাসব আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কও একেবারে নিখুঁত দেনাপাওনার হিসেবমততাহলে শাখার মধ্যে কি এমন খুঁজে পেল সে, যাতে এত কাছাকাছি চলে গেল সে স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে? শাখার ক্ষেত্রেও ঠিক একই প্রশ্ন কাজ করেস্বভাবগত ভাবেই শাখা খুব রোমান্টিক, ঠিক তার উলটোসর্বদা একা থাকতে থাকতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে মেয়েটাছবি আঁকে, কবিতাও লেখেযদিও দু একটা ওর কবিতা শাখার ফেসবুকের ওয়ালে দেখেছে সম্পাতি, লাইকও করেছে, কিন্তু বোঝেনি কিছুইআসলে ওসব কবিতা বা ছবি টবি বোঝার মত অত সূক্ষ্ম বোধ নেই তারতার শুধু শাখাকে ভালো লাগেসারাক্ষণ শাখাকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করেআচ্ছা, এটাই কি প্রেম? আপনমনেই মুচকি হাসলো সে
  খাওয়া শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ল্যাপটপ টা খুলে বসল ওওয়ার্ডে লিখতে শুরু করল, “ টু দ্য অফিসার ইন চার্জ, কালিঘাট পোলিশ স্টেশন...


জীবনে এই প্রথম নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছেআজকের সকালটার রঙ অন্যদিনের থেকে একেবারেই আলাদাদেওয়ালে, আশেপাশের আসবাবগুলোতে হাত বোলাচ্ছিল ওকতদিন! কতদিন হলো এই পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো, এই দাগ ধরা রঙ চটা দেওয়াল ওর সঙ্গীপ্রায় বারোটা বছর একটানা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দিল সেনিজেই আশ্চর্য হয় শাখাএকযুগ! এতদিন সে এই অন্ধকূপে কাটিয়েছে!
আজ ঘুম থেকে ঊঠেই ছাদে গেছিল সেকাল রাতে ভালো ঘুমও হয়নিহাতের যন্ত্রণা তো ছিলই, আর ছিল দুশ্চিন্তাকখনো একা বাড়ির বাইরে যায়নি সেস্টুডেন্ট লাইফেও যখন ইউনিভার্সিটি তে যেত তখন সঙ্গে থাকত বোনএখানে টুকটাক কোথাও বেরোতে হলে পাড়ার কোনো মেয়েকে ডেকে নেয় সেঅথচ সম্পাতির জেদে সকাল হলেই যেতে হবে থানায়একটু একটু রাগও হচ্ছিল সম্পাতির ওপরেএকদিন থেকে যেতে পারত না সে? এরকম ভাবে তাকে বাঘের গুহায় ঠেলে দিয়ে উনি কোন চুলোয় বসে বসে পা নাচাচ্ছেন! 
ওর খুব প্রিয় টবগুলোর গায়ে, টবে এতদিন যত্ন করে লাগানো ছোট্ট গাছ গুলোর গায়ে আলতো করে ভালোবাসার হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল সেগাছেরা ভালোবাসা বুঝতে পারেপরিস্কার বোঝে শাখা, সে আদর করলেই গাছেরা তার দিকে ঝুঁকে পড়েতার হাতের আঙুলে ওরাও আদর করেআজ ওদের আদর করতে করতে চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েকফোঁটা ঈষদুষ্ণ জল ঝরে পড়ল
সকালে যখন বাড়ী থেকে বেরোল, রনি তখনো নাক ডাকছেএই নাকডাকাও আগে একেবারেই সহ্য করতে পারত না সেকিন্তু পরিস্থিতির চাপে মানুষকে কত কিছুই সহ্য করতে হয়এই পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে সহ্য করা কাকে বলে, তা প্রতিদিনই একটু একটু করে জেনেছে ওরোজ সকাল হলেই একটা ভয়ংকর আতঙ্ক চেপে ধরত তাকেকোন দিক থেকে কি বিপদ আসবে তা আঁচ করার মত প্যাঁচালো বুদ্ধিবৃত্তি নেই তারছিলনা কোনোদিনইএকবার কথায় কথায় কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলে ফেলেছিল এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার কথাশুনেই রেগে আগুন হয়ে বাবা বলেছিলেন, এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে যেন সে গঙ্গায় ডুবে মরেবাবার ঠুনকো আভিজাত্যের মোহ যে তার চেয়েও দামী এটা বুঝতে পেরে সেদিন থেকেই সে আরো কঠিন হয়ে গেছিলবুঝে গেছিল সব সহ্য করতে হবে তাকে এভাবেই যতদিন না মৃত্যু এসে তাকে আদর করে নিয়ে যায়হঠাৎই কোথা থেকে তার এই শপ্ত জীবনে টুপ করে ঝরে পড়ল সম্পাতি
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের চার্জে একটু আগেই পাড়ার সকলের চোখের সামনে রনি কে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে পুলিশফাঁকা বাড়ির দরজায় তালা দিল শাখা, চাবিটা ওপাশে ঘুরে অনীকের হাতে দিয়ে এলসে এখনো ঘুমের দেশেই ছিলকাল রাতে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিলঘুমঘুম চোখে কিছু না বুঝেই চাবি হাতে নিয়ে ফের বিছানায় লম্বা হল  বাড়ির এদিকটায় যে এতকিছু ঘটে গেল তার কিছুই জানেনা ওজানতে পারলে হয়তো বাড়ির প্রেস্টিজ চলে গেল বলে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে নিতএই অপদার্থ পরজীবীদের সম্মানবোধের আড়ম্বর যে কোন ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই বুঝে উঠল না সে এতদিনেও
বুক ভরে একটা পূর্ণ শ্বাস টানল শাখাস্যুটকেস টা হাতে তুলে নিলআর এখানে নয়জীবনটা এবার অন্যভাবে নতুনকরে শুরু করতে হবে