সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

গল্প - তমাল রায়

ফ্লাইং সসার
তমাল রায়



যারা সেভাবে গান কে চেনেনি,তবলা নহবত অথবা মুঝরো তে অবহেলা বা আতিশয্যে অংশগ্রহণ করেনি তারাও তো বেঁচে ছিল আমাদের পাশের পাড়ায়।যেমন অম্বিকেশ। রাত কে দিন বা সকাল কে সন্ধ্যে করার মত কোনো সক্ষমতাই তার ছিল না।তিনি হাঁটতেন সোজা। লম্বা পা ফেলে।যেমনটা হাঁটতেন ছবি বিশ্বাস বা অমিতাভ বচ্চন। অম্বিকেশ এর স্ত্রী যখন উল্টোদিকে ফিরে, সে তখন পেছন ফিরে টিভি দেখছে । স্টার জলসার মেয়ে গুলো কে ওর ভাল লাগত খুব। কি মিষ্টি ! রোববার খাসীর মাংস আনতো। বেশ পেঁয়াজ,রসুন আদা দিয়ে কষে ঝাল ফাল দিয়ে হেব্বি করে খেতো। আবহাওয়ার খবরে তার কোনো আগ্রহ ছিলো না। পশু,পাখী তার একদম বিশ্রী লাগতো।যারা চুল টুল রঙ করে তাদের ও বিশ্রী লাগতো খুব। মদ খেতো না তা নয়।তবে মাঝে সাঝে। একটা ওল্ড মঙ্কের নিব আনলেই কাজ হয়ে যেতো।তারপর দিল লাগি হয়ে গেলে মাথার ভেতর থেকে অক্ষর গুলো সব পাখী হয়ে উড়ে যেতো।গান তো সে শোনে না।নাচ তো সে দেখে না,পাঠ্য সিলেবাসের সব কিছুই অজানা হওয়া সত্ত্বেও সে বেঁচে ছিল এত গুলো বছর তাই ভেবেই তার খুব আনন্দ হত।আর সে কাঁদতে বসতো পা ছড়িয়ে।আর কি অদ্ভুত তখন তার ভেতর থেকে যে শব্দ বেরিয়ে আসতো তাতে যেন সুরের ছোঁয়া...চোখ থেকে পড়া জলের ফোঁটাগুলো মাটিতে ঝরে পড়েই শুরু করতো নাচ ধিন্তা ধিনা। আর সে একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে খুঁড়তে বসতো মাটি,কেন

কে জানে!

অথচ দ্যাখো নুনের দাগ রয়ে গেলো জাহাজের গায়ে।বালিতে যত দূর চোখ মেলবে আদিগন্ত তৃষ্ণা। যদি জেনেই থাক কতদূর যেতে হবে অপেক্ষা কিসের?

অম্বিকেশ আপাততঃ নিজেরই আস্তানায় যেন চেনা অতিথি । চেনা জানার বাইরে যে দুনিয়া সেখানে সে অচল পয়সা,তা সে ও জানতো । তাই খবরের কাগজ সে পড়ত না। লাভ ? সিনেমা দেখে না।সিনেমার লোক গুলো ও তাকে চেনে না। চিঠি তো সে কবে ই বন্ধ হয়ে গেছে জং ধরা তালার মত। মা লিখতেন দেশের বাড়ী থেকে।মা নেই কোথাও। মরা মাছেদের গায়ে হাত রেখে উত্তাপ খোঁজ করত সে । বড্ড ঠান্ডা অথবা গরম তাকে বিচলিত করত না অনেক দিন । কেবল রাত গভীর হলে পেছন ফিরে শুয়ে থাকা বৌ কে না জানিয়ে নেমে আসত সে। হাতে নকশা কাগজ। ভাঁজ খেয়ে খেয়ে ছিঁড়ে যাওয়া অংশ গুলো কে নিয়ে সে জুড়তে বসে যেতো । যার কিছুটা পর সে হাতে নেবে স্ক্রু ড্রাইভার আর মাটি খুঁড়বে । খুঁড়েই যাবে । তাসের নেশা তার নেই কখনোই।কিছু পুরানো ছবি আছে যা নিয়ে সে পাশাপাশি সাজাত যেভাবে পেশেন্স খেলে কেউ। দুধ সেই ছোট্টো বেলা থেকেই তার না পসন্দ। একটা পুরনো রেডিও ছিল, মাকড়শার জালে বন্দী । সেটা ওর ঘরের শোভা বাড়াত কি না বলতে পারবো না তবে সেও ছিল । যেভাবে ছিলো বন্ধ হওয়া ঘড়ি,রাত তিন’টে থেমে। ভারত নামে একটা দেশ আছে এ তথ্য তার জানা,যা জানা ছিলনা তা হল দেশ শুধু মাত্র একটা ভৌগোলিক অঞ্চল। মানুষ নয়। দিদি তো চলে গেছে কবেই কৃষ্ণ নগর,পুতুলের দেশ।পরে আছে হারমোনিয়াম। বাজে না।এত না বাজা, না চলা,না অস্থিরের সাথে তার এ নিত্য সংসার-এ সে আর তার পেছন ঘুরে থাকা স্ত্রী।

খোবলানো দেওয়াল আর তড়িদ গতিতে ছুটে যাওয়া দেওয়াল সম্রাট টিকটিকি আর কিছু ভন ভন করা মাছি নিয়ে অম্বিকেশ বেশ ভাল ছিল ।যেমন থাকে রবিবার । এ কাহিনী তে একটা টুইস্ট আনার জন্য নয় স্রেফ কাহিনীর অপ্রয়োজনেই যে কথাটা না বললে নয় তার একটা খুব ফিকে গোলাপীর মত রঙ ছিল যার নাম প্রেম । যে অনায়াসে এ কাহিনীকে বদলে দিতে পারে বর্ণময় প্যালেটে।এরপর সে ঘরে ফিরে আস্তে পারে কিছু নৈর্বক্তিক হলুদ গোলাপ যা দুপুর তৈরী করেছিল কাহিনীর মত।রং বেরঙের পাখী যা সকাল কে বলেছিলো একটু দাঁড়াও আমি আসছি । কিছু কালো স্লেট সাদা খড়িতে যে রাত ঘনাতে দেয়নি এ অনিশ্চিত ঘরে ।ঘর ও তো কত অনিশ্চিতের যোগফল ? আর দরজার বাইরে অবিরাম বৃষ্টি কণা ! একটু আগেই তার স্ত্রী পাস ফিরেছিলো। উঠে বসে প্রথমেই তার দিকে দৃষ্টি বিনিময়ের মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠে চা তৈরী করেছিল।গুণ গুণ করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ফিতে দিয়ে চুল বাঁধছিলো সে । হাত দুটো পেছনে রাখা এ নৈসর্গে উন্নত হয়ে উঠেছিল অপরুপ আন্দিজ পর্বত মালা। আর অম্বিকেশ চুপি সাড়ে এগিয়ে এসেছিলো তার দিকে পেছন থেকে সে নৈসর্গ উপভোগে,যার পর বৃষ্টি নামলো।অবিরাম প্লাবনমুখী সে বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা,ভেসে যাচ্ছে সুখ,সমৃদ্ধি,অবকাশ যাপন... এরপর হেলিকপ্টার আসবে তাদের রেসকিউ করতে। খাট নড়তে নড়তে জলে ভাসল,আগল খোলা দরজা দিয়ে এসে পড়ছে বিদ্যুৎ রেখা।জেগে আছে কেবল দুটো দ্বীপ রাষ্ট্র।পরস্পরের দিকে। হয়ত সেটা কোনো রবিবারের সকাল।তাই ছুটি। একটু পরেই দেবে ছুট অসীমে। মৌসুমী আকাশে তখন প্লাবন নামলো। এরপর দুপুরের খাবার দাবার।বাবু হয়ে বসা।আর গোটা গোটা হরফে লেখা-‘ আপনার যাত্রা শুভ হোক।‘

আপাততঃ সে খুঁড়ে চলেছে মাটি স্রেফ একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে। অম্বিকেশ। কালী পূজোর রাতে যেমন বেড়ে যায় পোকার উপদ্রব,আর হাত নেড়ে যেতে হয় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত সেভাবেই কিছু অনিয়ন্ত্রিত প্রশ্ন কে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়েছে সে আগেই।এবং যাত্রা শুরু করেছিল একটা সেতুর ওপর দিয়ে ওপারে। সাথে এক জ্ঞান তাপস পরিব্রাজক দীপংকর অতীশ।যিনি পেছনে তাকাতে গেলেই বলে উঠছিলেন বজ্র নিনাদে - পথ চলতে পেছনে তাকাতে নেই অম্বিকেশ।

এখন সে পাখীর মত ডানা লাগিয়ে উড়ে চলেছে সেতুর ওপর দিয়ে,যা ফেলে এলো,যা সামনে আসবে তা সম্মন্ধে প্রকৃত কোনো ধারণা না রেখেই। একটু আগেই সে জ্ঞান তাপস জানিয়েছেন ‘ এটাই জীবন ’।

এখনো গান না জেনে,তবলা এবং মুঝরো কে না জেনেই আনন্দে বা আতিশয্যে অথবা অবহেলায় সে বেঁচে নিচ্ছে, আমাদের পাশের পাড়ায়।কেবল মনে পরে যাচ্ছে একটু আগেও সে যখন ঘরকে বানিয়ে নিয়েছিলো সমুদ্র সৈকত,আর জাহাজ আসছিলো না কিছুতেই সে খেলতে শুরু করেছিলো ফ্লাইং সসার,যা কখনো বা সুদর্শন চক্রের মত কেটে দিয়েছিলো কোনো এক বিশ্বাসঘাতিনীর গলা,আর ফিনকি দিয়ে রক্ত...

খেলাটা চলছিলো অনেকক্ষন।আর তার স্ত্রীর দিকে পেছন ঘুরে । সে দেখে চলেছিল টিভি। অথবা টিভি টাই দেখে চলেছিল এ অদ্ভুত রিয়ালিটি শো। যেখানে অম্বিকেশ নামক কোনো এক অমৃতস্য পুত্র হেঁটে চলেছিলো সেতুর ওপর দিয়ে,আগে বা পরে কি ছিল আর কি হবে না ভাবতে ভাবতেই । আসলে সে ভাবছিলো না কিছুই।আর একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সে খুঁড়ে চলেছিল মাটি। যা তার শাপ মোচনের প্রতীক্ষায় । স্ত্রী ও হয়তবা । স্ত্রী তখনো পাশ ফিরে...আর সে?