সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

গল্প - শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

ঘৃণা
শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ


আলো সাজানো হচ্ছে। ক্যামেরাম্যান ভেঙে চুড়ে দেখছে লং শটটা নিতে যে লাইটটা সেটা আরো কত সাইকোলজিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট করা যায়। মেক আপ রুমে অভিনেতা। পাশের মেক আপ রূমে অভিনেত্রী। স্ক্রিপ্টটা কিছুক্ষণ আগে দুজনেই হাতে পেয়েছেন। আজকাল আর আগের মত শ্যুটিং-এর বেশ কিছু আগে স্ক্রিপ্ট পৌঁছয় না। ভাজা হয় এবং পাতে পরিবেশিত হয়ে থাকে। অভিনেতার চোখ আটকে আছে একটি সংলাপে। অভিনেত্রীকে একটা সময় খুব ঘৃণা নিয়ে বলতে হবে,

- তুমি একটা বেশ্যা।

নাহ! বেশ চাপের ব্যাপার। ইদানীং এই অভিনেত্রীর সঙ্গে তার যা সম্পর্ক তাতে ওই আবেগটাই আনা কঠিন। অভিনেতা তুলনামূলক নতুন। অভিনেত্রীর নাম ডাক আছে বেশী। নায়িকা হিসেবে কাজ করছেন। সব হাউসের সঙ্গে কাজ করেন না। বাছা বাছা নায়ক ছাড়া রাজী হন না। ইদানীং দুজনের এতটাই মধুর সম্পর্ক যে এই ফিল্মটা করতে রাজী হয়েছেন। অভিনেতার কপাল ভাল, নায়িকার জোরে ডিস্ট্রিবিউটার নিয়েও সমস্যা হবে না। বড় হাউসের বড় বাজেটের সিনেমা না হলেও অন্তত চেন রিলিজ পাওয়া যাবে। তারপরে যদি কপাল থাকে তাহলে এই সিনেমাটাই কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। সুতরাং সম্পর্কটাকে ঠিক রাখতে বাড়তি পরিশ্রমেও অভিনেতার আপত্তি নেই।

কিন্তু এই সংলাপটা বলবে কি করে? মানে এই যে ঘৃণা লাগবে সেটা ওই মুখটা দেখলে তো তার আসে না। অথচ সিনটা ভাইটাল। এখানেই তার আবেগ ঢেলে দেওয়ার জায়গা। এত ভালবেসেছে সে মেয়েটিকে, তার প্রতিদানে তাকে দেখতে হচ্ছে মাঝরাতে মেয়েটি মাতাল হয়ে অন্যের গাড়ি থেকে নামছে। গায়ের জামা-কাপড় কিচ্ছুই ঠিক নেই। অফিসের বস তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। শরীরের কোন কোন অঙ্গ স্পর্শ না করার কথা সে কথা সকলেই জানে, কিন্তু সে সব মানামানির কোনো ব্যপার নেই। তার চরিত্রটি চাকরীহারা সেলসম্যানের। নানা দুনম্বরি করে পারেনি চাকরী রাখতে। স্ত্রী-র উপার্জনের উপর নির্ভরশীল সে। সেই স্ত্রী-কে এভাবে দেখে নিজেকে সে সামলাতে পারে না।

সন্দেহ হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই যে স্ত্রী পরপুরুষ সঙ্গ করছে। সে নিয়ে কমবেশী ঝগড়াও হয়েছে। স্ত্রী বারেবারে অস্বীকার করেছে। এখন চোখের সামনে দেখছে স্ত্রী-র এই দশা। তার জানা নেই যে স্ত্রী-কে অফিসের পার্টিতে সফট ড্রিঙ্কের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। তারপরে তাকে মদ খাওয়ানো হয়েছে জোর করে। এবং অবশ্যই একটি ধর্ষণ আছে সিনেমাতে। ধর্ষণ করার পরে বস তাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বস এতটাই প্রভাবশালী যে সে জানে তার বিরুদ্ধে স্বামী-স্ত্রী দুজনের কেউই ট্যাঁ-ফোঁ করবে না। করলে রোজগার তো ছেড়েই দেওয়া যাক, জীবন চলে যেতে পারে।

এমন একটা মহানাটকীয় ব্যপার-স্যপার। সেখানে তাকে বলতে হবে,

- তুমি একটা বেশ্যা।

বলতে বলতে সে আয়নাতে একটা ফুলদানী ছুঁড়ে মারবে।

কিন্তু বলবে কি করে? মুখটা দেখলেই তো আসে না এটা। প্রথমে লং-এ শটটার টেক হবে। তারপরে তাদের ক্লোজ শট আলাদা আলাদা। অস্থির লাগলো অভিনেতার। বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালো। ইদানীং সে সিগারেট খুব কমিয়ে দিয়েছে। তবু একটা ধরালো। সিগারেটটা টান দিতেই মনে হল এককালে থিয়েটার করেছে। অল্প-স্বল্প কিছু শিখেছিল সেখানে। স্তানিস্লাভস্কির একটা মেথড আছে। সেটা কাজে লাগালেই তো কিছুটা হবে! বাকীটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, লাইট, এডিট দিয়ে ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু এই শটটা বারবার দেওয়া যাবে না। লং-এর শটটাই রাখলে হয়ে যাবে। একই স্মৃতি বারেবারে টেনে এনে একই ফলাফল হবে কী না কে জানে! অথচ সে বললে নির্দেশক শুনবে বলে মনে হয় না। তো অভিনেতা চললো তার মুশকিল আসানের কাছে। অভিনেত্রী সব শুনে মিষ্টি হাসলেন। বললেন,

- এমন পাগলামো করলে কাজ করবে কি করে?

বলতে বলতে অবশ্য মেক আপ রুমেই হেয়ার ড্রেসারের সামনেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। তার কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন তিনি বুঝিয়ে দেবেন নির্দেশককে। তাঁর নামে সিনেমা চলবে, আর তিনি বললে সে কথা রাখা যাবে না তা হতে পারে না। সুতরাং শটের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

খানিকক্ষণ পরে -

অল লাইটস...সাউন্ড...রোল ক্যামেরা...অ্যাকশন...

অভিনেতা যখন কিশোর, তখন পাশের বাড়িতে থাকতো রূমকীদি। ডাক্তারকাকুর মেয়ে। মা নেই। রুমকীদি কোনো কোনো দিন বারান্দায় এসে দাঁড়াতো বিকেলে। পড়ন্ত আলোয় তাকে পরীর মত মনে হোতো অভিনেতার। রুমকীদিদের বাথরুমটা তাদের শোয়ার ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যেত। কিছু কিছু গরমের ছুটির দুপুরে রুমকীদি বাড়ি থাকলে কিশোর শোয়ার ঘরের জানলাটায় এসে দাঁড়াতো। মাকে এড়িয়ে সাবধানে আসতে হোতো। বাথরুমের জানলার কাচের ওপারে রুমকীদির স্নানের শব্দ পেতো। ধীরে ধীরে একদিন আবিষ্কার করলো কাঁচের যে ফাঁক রয়েছে সেটা দিয়ে দেখা যায় কিছুটা, যদি সে ছাদের আলসেতে গিয়ে বসে। সেখানেও কয়েকদিন বসতো গিয়ে। রুমকীদির উরু অব্দি পা-টা দেখতে পেত। বেশীরভাগ দিন অবশ্য হাঁটু অব্দিই দেখা যেত। নাহ, তার বেশী সে কোনোদিন কিছু দেখতে পায়নি।

একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে এসে শুনেছিলো রুমকীদিকে ডাক্তারকাকু রিকশার পাদানিতে বেডকভার চাপা দিয়ে নিয়ে গিয়েছে মিত্র ডাক্তারের বাড়ি। শুনে সে খুব অবাক হয়েছিলো। সে আবার কী কথা! তপু, তার চেয়ে বছর ছয়েকের বড়, বাকী খবরটা দিয়েছিলো। রুমকীদির সঙ্গে ওদের অ্যালসেশিয়ানটাও ছিল। দুজনকেই এক চাদরের তলায় চাপা দিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিছু বুঝতে পারছিলো না সে।

তপু বুঝিয়ে দিয়েছিলো। তাদের বড় শিক্ষক তখন ফুটপাথের চটি হলুদ বই। সে শিক্ষালয়ে তপু তার চেয়ে অনেক উঁচু ক্লাসে পড়ে। ইস্কুলে যায় না, কিন্তু তা বলে তার জ্ঞান আহরণ থেমে নেই। রুমকীদি দুপুরবেলা অ্যালসেশিয়ানটার সঙ্গে করছিলো।

'করছিলো' শব্দটা চট করে মাথায় ধাক্কা দেয় অভিনেতার।

করা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কুকুরের ওইটা তো, বেরোচ্ছিল না। তপু মনে করিয়ে দিয়েছিল ভাদ্র মাসে কুকুর-কুকুরীর সঙ্গম দৃশ্যের শেষে দুজন দুদিকে মুখ করে আটকে থাকে যেমন, সেই তার কথা। মাথায় কেমন একটা যেন খুন চেপেছিলো তার। কুকুর? শেষে কুত্তা? অন্য কেউ নয়, সে তো নয়ই, কুত্তা? খানকী মাগী!

- তুমি একটা বেশ্যা।

আছড়ে পড়লো ফুলদানিটা আয়নায়। অভিনেত্রীর মুখ-চোখে অসম্ভব বিহ্বলতা। কাঁপতে শুরু করলেন তিনি। তারপরে আচমকাই পড়ে গেলেন ফ্লোরে।

অসুস্থ। শ্যুটিং প্যাক-আপ। অভিনেতার সম্বিত তখনো পুরোটা ফেরেনি। একটা চেয়ারে বসে সে সব দেখছিলো। কিন্তু কিছু যেন তার মাথায় দাগ কাটছিলো না। গাড়ি চলে গেলো অভিনেত্রীকে নিয়ে। তার মাথার ভেতরে একটা রাগ, চব্বিশ বছর ধরে পুষে রাখা রাগ শুধু গুমগুম করছিলো।

তার পরে অভিনেত্রীর বাড়িতে সে ঢুকতে পারেনি। ফোন ধরেনি তার। অভিনেত্রী অসুস্থ বলে শ্যুটিং বন্ধই ছিলো। এমন কী হেয়ার ড্রেসার সবিতাও তাকে সোজা বলে দিয়েছিলো সে কোনো কথা বলবে না। পরিচালক তাকে দেখে উঠে চলে গিয়েছিলেন স্টুডিও পাড়াতে। প্রযোজক দেখা করেননি। প্রযোজনা সঞ্চালক একমাত্র তাকে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলো,

- এ সিনেমা আর হবে বলে মনে হয় না। তুমিও হবু নায়কই না রয়ে যাও আজীবন।

পনেরোদিন ধরে এ সব চলার পরে সে কলকাতা থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিল তার দেশের বাড়ি আসানসোলে। পরের পরের দিন একটা এস এম এস এসেছিলো।

' এত ঘৃণা তোমার? তুমি যদি জানতেই যে আমি অনেকের সঙ্গে শুই এসেছিলে আমার কাছে? সিনেমায় হিরো হয়ে গেলে লাথি মারতে না? সে চান্স আমি দেবো না তোমাকে। শুধুমাত্র তোমার মত একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে শুয়ে বেড়ালেই আমার কেরিয়ার চলবে না। প্রেম? তোমার মত গান্ডুর সঙ্গে? ফাক অফ্‌! ফাক অফ্‌ ফর এভার!'

উত্তর দেয়নি সে।

তার তিনদিন পরে ফোন এসেছিলো। প্রযোজনা সঞ্চালকের ফোন। তার জায়গায় অন্য একজনকে নায়ক নেওয়া হয়েছে। সিনেমা আবার ফ্লোরে। অভিনেত্রী কাজে ফিরেছেন। সে যেন আর না আসে ওই ফ্লোরে। এটাই অভিনেত্রীর শর্ত। এলে কেরিয়ারে তার আরো ক্ষতি হবে। সিনেমাটা মিটে যাক, অন্য কাজে তাকে লাগানোর চেষ্টা করে দেখবে প্রযোজনা সঞ্চালক। তদ্দিন...