সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

গল্প - সুমন মজুমদার

পরিযায়ী
সুমন মজুমদার


এইতো খানিকক্ষণ বৃষ্টি শেষ হয়েছে। হাসপাতালের এই কেবিনটার জানালায় হঠাৎ রোদ্দুর এসে পড়েছে। তার আলো এত স্বচ্ছ যে দেখলে মনে হয় বৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে গেছে সূর্যের গাও। স্যালাইনের নল বেয়ে টিপটিপ করে স্যালাইন অথবা কোনো ওষুধ পড়ছে, ঠিক যেমনটি পড়ছে জানালার বাইরে গাছগুলোতেও। পশলা বৃষ্টির জল ঠিক সোনা-রূপা দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে পৃথিবী। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুর্বল উচ্চারণে কি যেন বললেন তিনি। অস্পস্ট আর ক্ষীন সেই উচ্চারণ। আমি খানিকটা ঝুঁকে এলাম তার দিকে। আবার শরীরটা খারাপ লাগছে তোমার? তিনি কথার না জবাব দিয়ে আলো ভরা জানালার দিকে কেবল তাকিয়েই রইলেন। কেমন চুপসে গেছে মানুষটার মুখ। ওষুধ ওষুধ গন্ধ ভরা এই ঘরটার সাথে যেন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি এ কদিনে।আবার কি একটা অস্পস্ট ভাবে বলে আমার দিকে অবশেষে ঘুরে তাকালেন। দিন যত যাচ্ছে ওর চোখের তারা যেন পাল্লা দিয়ে উজ্বল হচ্ছে। সেই কত বছর থেকে আছি একসাথে, কই কখনোতো এমন উজ্বল মনে হয়নি ওর চোখ। এবার তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা স্পস্টভাবেই বললেন- precious baby sweetly sleep, sleep in place. sleep in comfort slumber deep. I will rock you…


আমি খানিকটা অবাক হয়েই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-তুমি বানালে? তিনি কেবল চোখদুটো বন্ধ করে মাথা নাড়লেন, বললেন- “এটা একটা জার্মান ঘুমপাড়ানি গান। হয়তো কোনো মা তার আদরের সন্তানকে খুব শীতের রাতে কোলের উমে রাখতে রাখতে কোনো এক কালে গানটা গেয়েছিলেন। আহারে, দেখো বাইরের জগৎটা কেনো যে আজ এত ভালো লাগছে! সূর্যের আলো, বৃষ্টি, গাছের পাতা, সত্যিই কেনো যে এত অসহ্য সুন্দর লাগছে!”


খানিটা কথা বলে তাঁর হয়তো কোনো কষ্ট হচ্ছে। তিনি চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ চুপ করে রইলেন। গতকালও ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে। ক্রমেই যেন খারাপের দিকে যাচ্ছে ওর অবস্থা। যদিও এসব ওকে জানতে দেইনি আমি, তবু ভয় পাই অকারণে। কারণ ও চট করে সব কিছু ধরে ফেলে। ওকে দেখলে তাই আমার চারদিকটা কেমন ফাঁকা মনে হয়, বুকের ভেতর শূন্য লাগে। সে চোখ খুলে চাইলো আবার, গালে ঈষৎ সাদা হয়ে ওঠা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কেমন যেন অসহায় লাগতে থাকে ওর মুখ। তিনি আবার আমাকে বললেন-“আমার কবিতা কি এখনো কেউ পড়ে, নাকি না?” আমি শুধু তার হাতের ওপর হাত রাখলাম-কেনো পড়বে না অবশ্যই পড়ে। তিনি মুচকি হাসি হেসে বললেন-তুমি পড়ো, কোনো একটা লাইন শোনাতে পারবে আমার কবিতার? এটা একটা ওর চীরকালীন বদভ্যাস। হঠাৎ অন্যকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে যেন মজা পায় সবসময়।


আমার লেখা এখন আর কেউ পড়ে না। অবশ্য পড়বার প্রয়োজনওতো নেই। সাহিত্যমহল কখনো আমাকে কবির মর্জাদা দেয়নি। আমার লেখাগুলো নাকি ঠিক কবিতা হয়ে ওঠে না। ওরা মজা করে বলে ছন্দের মিল আর প্রগলভতা। অবশ্য মহুয়া তাদের চেয়ে আলাদাই ছিলো। একমাত্র ওই আমাকে কবি বলে ডাকতো। আবার রাগও করতো খুব-বলতো আমি নাকি একেবারেই জীবনবাদী নই। কেমন অস্বচ্ছ আর মৃত্যুর ধুসরতা ঘিরে থাকে আমার সব কবিতায়। তিনি আবার বড় করে শ্বাস টানেন, ওর রক্তশূণ্য ঠোঁটগুলো দেখে মনে হয় যেন ভিষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। আমি চেয়ার ছেড়ে ওর বিছানার পাশে বসলাম। চুলে আঙ্গুল বোলাতে যাবো এই সময় আবার চোখ খুলে তাকালো ও। “আমার খোঁজে কি কেউ এসেছিলো ফুল নিয়ে? হলুদ কর্ণিকা আর নীল জারুল, কেউ আসেনি তাইনা? ওরা আমাকে বর্জন করেছে, আর করবেই বা না কেনো, অসামাজিক, রগচটা এক জীবনবিমুখ মানুষের সঙ্গ কেই বা আশা করে। আচ্ছা, মহুয়াকে খবরটা দিয়েছো?” আমি কোনো কথা না বলে কেবল মাথা নাড়লাম।


মহুয়া, মহুয়া গাঙ্গুলী এখন থাকে আমেরিকার সুদূর ফ্লোরিডায়। বহু কষ্টে খুঁজে পেয়েছি ওর হদিস। এখানে ওকে যখন গুরুতর অসুস্থাবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, তার প্রায় দুদিন পর মহুয়াকে চিঠি পাঠিয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু সত্যিই কি মহুয়া গাঙ্গুলীর মনে আছে ওর কথা, একবার কি দেখতেও আসবে না এই বুড়ো মানুষটাকে! না, মহুয়া আসেনি, তবে গত পরশু হাসপাতালের ঠিকানায় ফ্লোরিডা থেকে একটা চিঠি এসেছে। আমি উঠে গিয়ে বেড সাইড ড্রয়ার থেকে খামটা বের করলাম- মহুয়া তোমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। কথাটা যেন ম্যাজিকের মত কাজ করলো। তিনি চোখ মেলে তাকালেন আমার দিকে। আমি খামটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নিলেন। হঠাৎ করে ছোট্ট কোনো বালক যেমন গুপ্তধনের সন্ধান পেলে খুশিতে আলোকিত হয়ে ওঠে তেমনি ওর চোখে মুখেও কেমন যেন আলো খেলে গেলো। তিনি চিঠিটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন, মুখবন্ধ সাদা একটা খামের চিঠি। মহুয়া এখন আমেরিকা থাকে, ফ্লোরিডায়-ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বল্লাম আমি। তিনি কয়েকবার বিড়বিড় করে বলেলেন-আমেরিকা..আমেরিকা। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ একটা তীর ছুঁড়ার মত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন-তোমার বয়স কত হলো? আমি কোন জবাব দিলাম না অথচ তিনি বলেই চল্লেন- “আমার বয়স কত হলো জানো? একষট্টি। ভেবেছিলাম ষাট বছরের বেশি বাঁচবো না, অথচ দেখো কেমন বেহায়ার মত এক বছর বেশি বেঁচে ফেলেছি। আগে যখন শরীরে জীবনের জোয়ার ছিলো তখন কেবল চাইতাম জীবন নামের নোংরা পোশাকের মত জিনিষটাকে যত তারাতারি সম্ভব গা থেকে খুলে ফেলতে। তবু দেখ কেমন আঠার মত লেগেই রইলো। আহাওে, সেদিন যদি আর খানিকটা সাহস পেতাম!” তিনি আমার হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন-


যে সমুদ্র যায় চলে দূর সীমানায়

কি কথা তার সাথে এত তোমার?

ফেনায় ফেনায় ছলনার ঢেউ

ভুল জাহাজে সওয়ার ভুল রাজপুত্র

তবু অলক্ষ্য নোনা জল গন্ধ শুঁকে শুঁকে

খেলনা জাদুর আয়নায়, ও কালো চাঁদ

তুমি কার মুখ দেখো!


এটা কার কবিতা তোমার, আমি কি লিখে রাখবো? তিনি কেবল আমার দিকে ধিরে ধিরে তাকালেন-না লিখো না। জানি না এটা কার, হয়তো আমার আবার হয়তো কারো নয়। কিংবা আদৌ এটা কোনো কবিতা কিনা! শুধু মাথার ভিতর যেন হঠাৎ হঠাৎ দূর সমূদ্রের ঢেউ খেলে যায়। আমি সারা জীবন আমার লেখায় কেবল মৃত্যুর গন্ধ শুঁকে বেড়িয়েছি। মনে আছে, আমি তোমাদের বলতাম-“আমার আয়ু ষাট বছর। আমার ষাটতম জন্মদিনে পৃথিবীতে আমি শেষ নিশ্বাস নিতে চাই। অথচ দেখো আরো এক বছর কেমন বেশি বেঁচে ফেল্লাম।

তাতে কি হয়েছে, তোমার আয়ু আরো অনেকদিন। কিচ্ছু হবে না তোমার।

ডাক্তার কি বলেছে আমি মরে যাচ্ছি? আমার কাছে লুকিয়ো না, মৃত্যু নিয়ে আমি ভয় পাই না। একসময় এই মৃত্যু কত আকাঙ্খিত ছিলো জানো? রাতের পর রাত একটা সাদা খাতায় আমি বারবার মৃত্যুর নাম লিখেছি। হাতের টিকটিক করে নড়ে চলা নাড়িটা ঝকঝকে একটা ব্লেডে ফেঁড়ে ফেলবো বলে এক ধ্যানে বসে থেকেছি। হাত ভর্তি ঘুমের ওষুধ দেখে দেখে কত কি ভেবেছি কতদিন। তখন মনে হতো, এই তো আমার থেকে মৃত্যু মাত্র এই খানিক দূরে।


তিনি আবার চোখ বন্ধ করে ফেলেন, বড় বড় শ্বাস পড়ে তার। স্যালাইন পরবার টপটপ শব্দও যেন হঠাৎ ঘরের ঘরের ভেতর জীবন্ত মনে হয়। তিনি আমার হাত চেপে ধরেই আছেন। মহুয়ার চিঠিটা বুকের ওপর শ্বাসের সাথে উঠছে আর নামছে।


বন্ধু, গত কয়েক বছর আগে ঠিক মধ্য বর্ষার এক অস্থির সন্ধ্যায় মহুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। একটা ছবি প্রদর্শনীতে ওর আঁকা কিছু ছবি দেখতে গিয়েছিলাম অনেকটা বেখেয়ালেই। অথচ রঙের মিশেলেও যে ক্যানভাসে জলের আসল ধাঁচ নিয়ে আসা যায় সেটি সেই প্রথম দেখেছিলাম আমি। একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো মহুয়ার সাথে। আমাকে ও জিজ্ঞেস করেছিলো ওর কোন ছবিটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে? বড্ড চঞ্চল ছিলো মেয়েটা। মাঝে মাঝে ওকে আমার মনে হতো ফড়িং। ধরতে গেলেই কেমন উড়ে যায়, আর ধরা পড়লেও উড়ে যেতে তার কি ছটফট। তারপর কেমন করে যেন ওর আর আমার অদ্ভুত পথচলা। আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই, বন্ধন নেই তবু আমরা কেবলই চলেছি আর চলেছি। যেন অনেক কাছাকাছি আর অনেক পাশাপাশি। আমি তখন পঞ্চান্নতে পা দিয়েছি আর মহুয়া বাইশ বছরের এক উদ্দাম চিত্রকর। আমার বারান্দায় কখনো কখনো ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম খুব মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছে ও। নতুন ওঠা সূর্যের মিষ্টি আভা ওর চুলের ফাঁকে ফাঁকে ঝলকাতো। ও যখন ক্যানভাসে একটানা ব্রাশ চালাতো , কি যে সুন্দর লাগতো ওকে। কখনো কখনো কফির কাপ হাতে আমি এসে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম ওর ছবি। আমাকে দেখে মহুয়া তার আঙ্গুলে লেগে থাকা হলুদ রঙ দিয়ে আমার গালে আঁচড় দিয়ে বলতো-“ কি বুড়ো কবি, এই ছবিটা কেমন হয়েছে বলুনতো? একটা সবুজ বনের মাঝে আকাশী শাড়ি পড়া মেয়েটা রৌদ্রের আলোছায়ে পাতা কুড়োচ্ছে আনমনে। ওর শাড়ির রঙটা কি আরেকটু হালকা করবো?” আমি কেবল অপলক চেয়েই থাকতাম ওর দিকে। আমি চাইলেও কখনো উচ্ছল হতে পারিনি, তাই মহুয়ার ওই উচ্ছলতা আমার ভালো লাগতো। মহুয়া কখনো বারান্দাময় রৌদ্রের বন্যায় ছটফট করতো তুলি হাতে, যেন যৌবন আর প্রানের অহঙ্কারে সে ঝট করে এঁকে ফেলবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো কবির কাব্য। মাঝে মাঝে পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে বলতো- এই যে বুড়ো কবি, এই ছবিটার সাথে মিলিয়ে এক্ষুনি আপনাকে একটা কবিতা লিখতেই হবে। আমার ছবি, আপনার কবিতা, আমরা দুজন যুগলবন্দি ছবিতা হয়ে যাব। কই শুরু করুন। মহুয়া কখন যে কাগজ কলম এনে রাখতো বুঝতেই পারতাম না। কি লিখবো, কি লিখবো করে ভেবে সারা হতাম, তবু লিখতেই হত।


কেতকি গন্ধ শাড়ি, ফুল, নাভীমূলে

তবুও আকাশ কালো সবুজ বনে

তোমার হরিতকি চুলে।


লেখাটা যখন বাড়িয়ে দিতাম মহুয়ার দিকে , ও সেটা কয়েকবার আবৃত্তি করে শোনাতো। তারপর আঁকা ছবিটার নিচে ছোট্ট করে ওর আর আমার নামের অধ্যাক্ষর দিয়ে তারিখ লিখতো। বলতো-বুড়ো কবি কি যে লেখেন এই সব, ছবির মেয়েটার শাড়িতে আপনি কেতকি গন্ধ পেলেন! আমি বলতাম, ছবির মেয়েটাকে তোমার মত মনে হয়েছিলো মহুয়া, তুমি কি জানো তুমি কেতকিগন্ধি! মহুয়া হাসতো আর কেবলই হাসতো। হাসতে হাসতে ওর চোখে জল চলে এলে বলতো-আপনি তো কেতকি গন্ধ আর হরিতকি চুল নিয়ে আছেন, এই ছবিটা দেখলে আরেক বুড়ো কি লিখতো জানেন? কোন বুড়োর কথা বলছো, আমি অবাক হতাম ওর কথা শুনে। ও আবার হাসতে হাসতে বলতো-কেন বুড়ো রবীন্দ্রনাথ। এই সক্কালে বারান্দার রোদে সামান্য ক্ষতি সহ্য করেইতো আমার মত কেতকিগন্ধি একটা মেয়েকে দেখেই বুড়োটা লিখেছিলো-

বহে মাঘ মাস, শীতের বাতাস, স্বচ্ছ সলিলা বরুণা

পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে, শিলাময় ঘাট চম্পকবনে

স্নানে চলেছেন শত সখি সনে, কাশীর মহিষী করুনা।

ছবিটা দেখে কি তাই মনে হয় না? একটা মেয়ে একা চম্পক বনে পথ চলছে। কখনো কখনো আমি মহুয়াকে জিজ্ঞাসা করতাম-মহুয়া তোমার ভয় হয় না, কিংবা সংকোচ? এই যে আমি বয়সে তোমার দ্বিগুনের চেয়ে বড়, কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো বাধা নেই, তবু প্রতিদিন তুমি আমার কাছে আসো। লোকে এখনি কানাঘুষা শুরু করেছে। মহুয়া যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে পরে বলতো-কেনো আপনি ভয় পাচ্ছেন? দেশের নাম করা কবির নামের সাথে অচেনা একটা মেয়ের নাম জড়িয়ে মানুষ রস যে আস্বাদন করছে, সেই ভয়? ওর এই প্রশ্নে পাল্টা জবাব আসলে কি দেয়া উচিত বা আদৌ দেয়া দরকার কিনা আমি ভেবে পেতাম না। মহুয়া তেমনটি ছিলো না, ও বলতো-এসব আমি থোড়াই কেয়ার করি।


এতক্ষণ একটানা কথা বলায় ওর মুখ হঠাৎ কেনো যেন নীল হয়ে উঠেছে। তিনি হাঁপাতে লাগলেন, আমি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারকে খবর দিলাম। ততক্ষণে তিনি আরো জোরে হাঁপাচ্ছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে খানিক্ষণের মধ্যেই ওর চোখ লাল হয়ে উঠেছে। ডাক্তার তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলেন, আর একটা ঘুমের ইনজেকসন দিয়ে দিলেন। এভাবে আর কতদিন? ডাক্তার জানালেন তাদেরো আসলে কিছু করার নেই অপেক্ষা ছাড়া। দিনদিন অবস্থার ক্রম অবনতি হচ্ছে, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে কোনো আশার কথা। আমি কি করবো বা কোথায় যাবো অথবা আমারই বা কি করার আছে ওর জন্য! ওর অপ্রকাশিত কবিতাগুলো কোথায় আছে, কিভাবে আছে কে জানে? হঠাৎ নিজের কাছেই আমার লজ্জা লাগতে থাকে। একটা মানুষকে মৃত্যু মুখে রেখে কি ভাবছি আমি। আর কেনই বা ভাবছি ও মরে যাবে, পৃথিবীতেতো মিরাকল বলে একটি কথাও প্রচলিত আছে। ভালো হয়ে হয়তো আবার লিখতে শুরু করবেন তিনি। লোকে একসময় পাগলের মত পড়তো ওর কবিতা। আমারো ভালো লাগতো, অবশ্য তা যে পাগলের মত পড়তে হবে এমন নয়। কতগুলো গোঁ ধরা লোকজন ছিলো ওর কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত। ওর কবিতায় এক ধরনের নিস্তেজতা, আর ঝিমুনিভাব ধরা রোমান্টিসিজম আছে। আর আছে অর্নথক মৃত্যুচিন্তা, যা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। হয়তো এ কারণেই লোকে পড়ে, যেমন দেখতাম আগ্রহ নিয়ে পড়তো মহুয়া গাঙ্গুলী। অবশ্য ওর শেষের দিকের লেখাগুলো যেন একটু একটু কওে প্রান ফিরে পাচ্ছিলো। তবু ভাবতে অবাক লাগে এই ভেবে যে কোনো লোকটা সকল বাঁচার মধ্যেও বেঁচে থেকে মৃত্যুর প্রত্যাশি! মৃত্যু কি সত্যিই এত রহস্যময়। অথচ সব মানুষই তো বাঁচতে চায়। জীবনের শেষ মুহূর্তেও আঁকড়ে ধরতে চায় বেঁচে থাকার যাবতীয় রশি। মাঝে মাঝেই তিনি বলতেন, তার নাকি স্বেচ্ছামৃত্যুর রাশি। অনেকদিন থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে ঠিক তার ষাটতম জন্মদিনে সে মরতে চায়। পৃথিবীতে নাকি তার মত নিরর্থক মানুষের কাছে ষাট বছর বেঁচে থাকা পর্যাপ্ত সময়। আমাকে একবার বলেও ছিলো, মানুষের জন্য ষাট বছর বয়সই নাকি আত্মহত্যার শ্রেষ্ঠ সময়। উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছিলেন... নাম। আর রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেই গেছেন-কবি মাত্রের উচিত পাঁচ বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, কারণ কবিরা ক্ষণজীবী। সে তুলনায় তার ষাট বছর নাকি ঢের সময়। সব সময় নিজের স্বপক্ষে যুক্তি পাল্টা যুক্তি দাঁড় করাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার অনিয়ন্ত্রিত জীবন আর নিজের সঙ্গে স্বেচ্ছাচার আমার কাছে পাগলামিই মনে হতো। তবু মাঝে মাঝে ভয় করতো, সত্যিই যদি..অবশ্য সময়টা পাল্টে দিয়েছিলো মহুয়া, মহুয়া গাঙ্গুলী। কবিতায় যার রমরমা রোমান্টিসিজম, ভক্তদের আনাগোনা আর বই মেলায় মুদ্রন পূনঃমুদ্রণের ঢল সেই তাকে নিয়েই হঠাৎ চারদিকে কেমন ছি ছি পড়ে গেলো। সবাই যেন আশাহত, দুখিঃত। অথচ সেসময়ই আমি প্রথম তার মধ্যে প্রানের আভা লক্ষ্য করি। তার কবিতায় যেন একটু একটু করে সাড়া পাওয়া যেতে থাকে জীবন নিউক্লিয়াসের। তবু সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিতো তাকে দেখে। তার বয়সী একজন সম্মানিত কবি কিনা অর্ধেকের চেয়ে কম বয়সী একটা মেয়ের কাছে আনন্দ খুঁজে পায়! সমাজ এই অসমতা মেনে নেয় কিভাবে! বক্তৃতায়, সাহিত্য সভায় তুলোধুনো হয়ে গেলো সকল ছন্দ। পত্রিকার পাতা জুড়ে রগরগে খবরের কাটতি। তারপরও তিনি লিখলেন, কিন্তু অজানা কারণে সেগুলোর প্রতি আর কারো আগ্রহ রইলো না। সমালোচকরা তীর ছুঁড়েছেন একের পর এক, বন্ধুরা সব ডালা ভরা হেমলক নিয়ে প্রস্তুত আর কবিতা হয়ে পড়লো বাতিল, অমুদ্রনযোগ্য। আমি শেষ কয়েকটা বই দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম, তবু যার প্রতি ব্যবসালক্ষী নিজেই বিমুখ তাকে আর আমার মত ধুলেমাটির মানুষ কিই বা দিতে পারে। তবু মহুয়া গাঙ্গুলী আর ছবি, কবিতা রইলো ওকে ঘিরে। কিন্তু সেই মহুয়া গাঙ্গুলীও তো সইলো না ওর। তাহলে কি আজ ষাট পেরিয়ে মধ্য একষট্টিতে সত্যিই মৃত্যু ওকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে! কেমন অবুঝ, অভিমানী, নিঃস-রিক্ত এক কবি শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখটা যেন রক্তশূন্য, কপালের পাশে একটা রগ ফুলে উঠেছে। অথচ সাদা চাদরে ঢাকা বুকের ওপর নিশ্বাসের সাথে উঠছে নামছে চিঠি, মহুয়া গাঙ্গুলীর চিঠি।


হঠাৎ কখন নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। এই মধ্যরাতে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙলো। দেখি তিনি জেগে আছেন, মুখে নেই অক্সিজেন মাস্কটা।


তুমি কি আমাকে একটা চিঠি লিখে দিতে পারবে, কিংবা কবিতা? যাই হোক না কেন আমি বলে যাব আর তুমি লিখবে। আমি কোনো কথা না বলে ব্যাগ থেকে খাতা কলম নিয়ে আসি। তিনি ক্লান্ত আর লম্বা একটা শ্বাস নেন, তারপর বলে চলেন-

প্রিয় ছোট্ট কুঁড়ি

ডাক্তারের ঘুমের ওষুধও বোধয় বেশিক্ষণ ঘুম পাড়াতে পারলো না আমাকে। একটু নাহয় জেগেই থাকলাম, তারপরতো কেবল অনন্ত ঘুম। তোমার চিঠিটা এখনো খুলিনি। খামটাকে মনে হচ্ছে বড্ড মূল্যবান, যেন ওটা খুলতে হবে খুব আয়োজন করে। আমার এসব কথা শুনলে তুমি ভিষণ রাগ করতে। বলতে আমি নাকি একটা মৃত্যুবাদী কবি। শুনেছি তুমি এখন ফ্লোরিডা। ঠিক এই মুহূর্তে কি করছো তুমি? কেনো যেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। মানুষের কখন কত কি অদ্ভুত ইচ্ছে হয়! তুমি কি এখন ছবি আঁকছো, ফ্লোরিডায় কি এখন সকাল? খুব ভোরে তোমার ছবি আঁকার অভ্যাস ছিলো। তোমার মনে আছে এক সকালে তুমি হঠাৎ করেই হাজির হলে আমার বাসায়। তারপর ঘরকুনো আমাকে টেনে নিয়ে গেলে খোলা মাঠে শিশিরের মাঝে খালি পায়ে হাঁটবে বলে। সেদিন তোমাকে দেয়া শেফালি ফুলটা কানে গুঁজতেই কি যে সুন্দর লাগছিলো। গাছের সেই ঘন শাল বনটার কথা মনে পড়ে? শ্যাওলা ধরা সবুজ মাটি, চারদিকে কেবলই গাছ আর লতাগুল্ম। আমার কি একটা কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলে। তারপর কি মনে করে একটা ঝাঁকড়া গাছ দেখিয়ে আমাকে বলেছিলে-ওইটা নাকি আমি। আমার স্থবিরতা, নিস্পৃহতা, নিস্তেজতা নাকি গাছের মতন। তোমার ভাষায় আমি একটা আসলে বুড়ো গাছ। তোমাকে আমি নাম দিয়েছিলাম ছোট্ট কুঁড়ি। সেই যে ছোট্ট বন পাকুড়ের চারা ঠিক ওর মত। চকচকে টিয়া রঙের পাতা তোমার। ছোট্ট কুঁড়ি, ওখানেতো বরফ পড়ে তাইনা, তুমি কখনো বরফের ছবি আঁকোনি? তুষার জমে সাদা হয়ে যাওয়া পাইন কিংবা বরফের ওপর কালো ছায়ার নিশ্বাস? কি রঙ দিয়েছে তাতে, দূরে কি দেখা যায় কোনো পাহাড়ের ছায়া! কেন যেন এইসব অকারণ বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। আজ এতদিন পর তোমাকে লিখছি, ভেবেছিলাম তোমার জন্য একটা কবিতা লিখে রেখে যাবো। অথচ কিছুই মনে আসছে না, কিচ্ছু না।


তিনি ধিরে ধিরে নিজেই একা একা শুয়ে পড়েন বিছানায়। চোখ বন্ধ করেও বিড়বিড় করে কি যেন বলেন। আমি তার কপালে হাত দিয়ে দেখি ও ঘামছে। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? তিনি মাথা নাড়লেও বোঝা যায় যে কষ্ট হচ্ছে ওর। আমি অক্সিজেন মাস্তকটা মুখে লাগিয়ে দিলাম। তিনি চোখ খুলে কেমন ঘোলা দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে আর বার কয়েক বড় বড় নিশ্বাস নেন। আমি ঘড়ি দেখলাম, ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। তিনি আমার অস্থিরতা দেখে কষ্টের মধ্যেও মুচকি হেসে বলেন-“সময় বড্ড ছলনা করে মানুষের সঙ্গে। তুমি যখন সময় ধরে রাখতে চাইবে তখন সে ফুরোবে আর ছেড়ে দিলে কখন যে উড়াল দেবে কোন দিকে খুঁজেও পাবে না।” আমি হাসপাতালের ডিউটি রত ডাক্তারকে ডেকে আনি। তিনি ওর পালস দেখেন, ইসিজি মনিটরে হার্টবিট চেক করেন। সেখানে তুলি টানা ঢেউয়ের মত উঁচু নিচু রেখা। এই রেখাগুলোই কি একজন মানুষের জীবনের মাপকাঠি! ডাক্তার আবার তাকে ইনজেকসন দেন, কিছুক্ষণ পর মনিটরের আঁকা বাঁকা রেখাগুলো যেন খানিকটা গতি ফিরে পায়। মুখে অক্সিজেন মাস্ক নিয়েই কেমন অসহায়ের মত তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। তার ঈষৎ কাঁপা কাঁপা হাত যেন আমাকেও কিসের ঘোরে টানতে চায়। জানালার বাইরে ফ্যাকাশে কালচে সাদা আলো। তিনি নিজেই মুখের মাস্ক খুলে বলেন-আমি আর কিছু দিন বাঁচতে চাই, আর অন্তত কিছু দিন। সারাজীবন ছাইভস্ম লিখেছি, “একটা কেবল নতুন কবিতা লিখতে চাই। আর একবার হাঁটতে চাই ঘাসের বনে মহুয়ার সঙ্গে। আর একবার দেখতে চাই ওর আঁকা কোন ছবি কিংবা মেঘ, তারা, রৌদ্রের বন্যা। পারবে না আমাকে আর কটা দিন বাঁচিয়ে রাখতে?” আমি তার কথার ঠিক কি উত্তর দেব বুঝতে পারি না। কেবল ধরে রাখা দুর্বল হাতটাতে ছোট্ট করে ভরসার একটা চাপ আর মুচকি হাসলাম। বাইরের ফ্যাকাশে আলোয় কয়েকটা পাখি ডাকছে থেকে থেকে। তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন, তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না? আমার ঘরের টেবিলে একটা কবিতা রাখা আছে, ওটা তোমার জন্য। বাইরে তখন ফ্যাকাশে কালচে সাদা ঘোলা দুধের মত রঙ নিচ্ছে। তিনি কথা বলতেই থাকেন আর আমি একমনে তাকিয়ে থাকি জানালার বাইরে। তিনি আমাকে মহুয়ার চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলেন- একটুু পড়ে শোনাবে এটা। সাদা খামে আঁটা চিঠি, ওপরে দ’ুতিনটা সিল, স্টাম্প। ধিরে ধিরে খামটা ছিঁড়ি, সাদা কাগজে কালো হরফ চিঠি। মহুয়া গাঙ্গুলীর চিঠি-


এই যে বুড়ো গাছ,

কেমন আছেন? অবশ্য আমি জানি যে আপনি ভালো নেই, ভিষণ অসুখ নিয়ে নাকি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমি দুঃখিত যে আপনাকে বলে আসিনি বা এতদিন যোগাযোগও করিনি। শুধু জেনে রাখুন আপনাকে দেখতে আসার উপায় বা স্বামর্থ কোনটাই আমার নেই। এখন আমি কোথায় থাকি জানেন? ফ্রি পোর্ট টাউন, জায়গাটা দূর আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যে। আমার বাসা মাউন্ট ডোরা লেকের কাছে। জায়গাটা খুব একটা পরিচিত নয়, তবে সত্যিই অসাধারণ সুন্দর। অন্তত আপনার কবিতা লেখার জন্যতো অবশ্যই। একপাশে পর্বত আর তার নিচেই স্বচ্ছ জলের লেক। মাঝে মাঝে ওখানে বড়শি পাতি আমি আর রিচার্ড। একবার খুব বড় একটা স্যামন উঠেছিলো আমাদের ছিপে। আমার বাড়ির উঠোন জুড়ে একটা বড় ব্লাক অলিভ গাছ আছে, ঠিক দেখতে আপনার মতন বুড়ো আর স্থবির। মাঝে মাঝে ওর ছায়ায় ইজেল ফেলে আমি ছবি আঁকি। কখনো কখনো কফি কাপ হাতে রিচার্ড এসে যোগ দেয়। কফিটা রিচার্ডের বড্ড প্রিয়। ও আপনিতো রিচার্ডকে চেনেন না। ও আমার বয় ফ্রেন্ড। ফ্রি পোর্ট টাউনের এই বাসাটায় আমরা দুজন থাকি। আমাদের একটা নাক থ্যাবরা কুকুরও আছে, নাম পিগি। অনেক দিন আপনার কবিতা পড়ি না। নতুন কতগুলো কবিতা লিখেছেন, তাতে কি আমি আছি আপনার ছোট্ট কুঁড়ি? রিচার্ডকে আমি আপনার কবিতা অনুবাদ করে শুনিয়েছি। সেই যে-


কিন্নর পাখির দেশে, উত্তর-পশ্চিম অবশেষে

কোথা আর যাব প্রিয়তমা

নির্লিপ্ত জল সাক্ষি, নদী নেত্র ময়ুরাক্ষী

প্রমিত প্রেম হয়ে আছে জমা।

রিচার্ডতো হেসেই খুন, বলে-ট্যাগোরের অনুবাদ তবু বোঝা যায়, কিন্তু আপনারটা বড্ড কিম্ভুতকিমাকার। ও কবিতার কিংবা ছবির কিছুই বোঝে না। অবাক হয়ে বলে-সত্যিই আমাদের দেশে জল নির্লিপ্ত আর কিন্নর কণ্ঠের পাখি আছে কিনা! কি হাস্যকর তাইনা, তবু ওর সবচেয়ে ভালো গুন কি জানেন? রিচার্ড বড্ড সরল। যতদূর জানি আপনি এখন মধ্য একষট্টিতে। ষাটের সঙ্গে কত কিছুই যখন পেরিয়ে গেছে, তখন এত সহজে কেনো চলে যাবেন? বুড়ো গাছ আমার, আপনাকে ভালো হয়ে উঠতেই হবে। রিচার্ড আপনাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে। ও বলেছে আপনি এখানে আসলে ডোরা লেকের পাশে রাতের বেলা ও আপনাকে গিটারে লেনানের গান শোনাবে। আর আমি আসছে উইন্টারে আপনাকে ফ্লোরিডা দেখতে চাই। রিচার্ডের একটা ছোট্ট কাঠের নৌকা আছে। আমরা তিনজন উইন্টারের ইছামতি বাতাসে ডোরা লেকে ঘুরবো। আর সেই সঙ্গে আমার রান্না করা প্রচুর ঝাল টোমাটো সস দিয়ে টুনা কারি। এখানে এসেই এই স্পেসাল রান্নাটা শিখেছি। আপনি আসছেন তো বুড়ো গাছ?


ও বলতে ভুলে গেছি। আমাদের ছোট্ট লনে আমি একটা ডেইজি ফুলের গাছ লাগিয়েছি। আশা করছি আপনি যখন আসবেন, তখনই ওর প্রথম ফুলের দেখা মিলবে। আমার আর রিচার্ডের প্লান হলো আপনাকে ওটা দিয়েই এয়ারপোর্টে স্বাগতম জানাবো। আপনাকে কিন্তু ডেইজি নিয়ে একটা কবিতা লিখতেই হবে। উইন্টারের আশায় থাকলাম।

চিঠিটা শেষ করে দেখি তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই প্রথমবার ওর চোখে জলের আভাস দেখলাম। কেমন নেতিয়ে পড়েছেন যেন বিছানায়। ইসিজি মনিটরে আবার কালো কালো ঢেউগুলো থেমে থেমে বইছে নদীর মত। জানালার বাইরে এখন তীব্র সাদা আলো। সেই আলোতে ওর ফ্যাকাশে মুখটা যেন আরো ফ্যাকাশে দেখায়। কথা বলতে কেমন হাঁপিয়ে উঠছেন। তবু আমাকে কাছে ডেকে দুর্বল হাতে জানালার দিকে আঙ্গুল তুললেন।


পৃথিবীটা কেনো যেন আজ বড় সুন্দর লাগছে। একটা কবিতার মত। না, ছন্দের মিল দেয়া ছোট্ট বেলায় পড়া ছেলে ভোলানো ছড়ার মতন মিষ্টি। লি পো’র alone looking at the mountain মতো একা একা অবিস্তৃত পরাবাস্তব স্বপ্নের জগৎ-

All birds have flown up and gone
A lonely cloud floats leisurely by
We never tire of looking at each other
Only the mountain and I.

আসছে উইন্টার কেমন হবে সেই বরফের দেশ? ডেইজির পাতাগুলো কি টিয়া সবুজ আর ডোরা লেকের জলে কি ছায়া দেখা যায়? জীবন, আহ জীবন! হে ঈশ্বর আর একবার যদি জীবন ফিরে পেতাম!



উৎসর্গ: হুমায়ূন আহমেদ