সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

গল্প - ঋষি সৌরক



মফস্বলের তির
ঋষি সৌরক


বক্তৃতার শুরুতে কাউকে নমস্কার বা ধন্যবাদ না জানিয়েই তিনি শুরু করলেন,
আচ্ছা সব দেশলাই বাক্সেই কি সমান সংখ্যক দেশলাই কাঠি থাকে?

শেষের “থাকে”টা দু-তিনবার ছোট্টো ইকো হতে হতে মিলিয়ে গেলো! পিনড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গেছে অরবিন্দ সভাঘরের থৈ থৈ কণা। একটা চেয়ারও এই মুহূর্তে খালি নেই। চেয়ার বাদে মেঝের যেটুকু ক্ষেত্রফল জুড়ে শূণ্যস্থান সেখানেও সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক স্থান অধিগ্রহণ করেছেন, কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে। কোনোরকম রাজনৈতিক ভাষণের প্রতি উন্মুখ না- বরং যাদের পদধুলিতে এই সভাঘর আজ ভরে গেছে তাদের উৎসাহ নানামাত্রিক।  আন্দাজ সত্তর-ঊর্দ্ধ এই বয়োজ্যেষ্ঠ বক্তার সুললিত গম্ভীর গলায় কি এক তেজী কৈশোর লুকিয়ে আছে। জনারণ্যের থেকে বহুদূরে কামুক আলোর ছটা যাকে ছুঁতে পারে নি কখনো। অথচ কি অনায়াসে তাঁর লেখনী তাঁর নির্মাণ তাঁর ব্যক্তিত্ব আজ স্পর্শ করেছে প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়। আবালবৃদ্ধবণিতা যে রহস্যময় মানুষটির একটিমাত্র ঝলক পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকে, যেকোনো বয়স যেকোনো ঋতু র সাথে যিনি ওতপ্রোত বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেন, যাকে নিয়ে কল্পনার শেষ নেই স্থায়ী গৃহবধু থেকে প্রথম অবৈধ প্রেমের স্বাদ পাওয়া কিশোরীর – সেই মানস মুখার্জ্জী ওরফে মা.মু. আজ সশরীরে যখন উপস্থিত থাকবেন, ভিড় উপচে পড়াটা সহজাত ব্যাপার – আয়োজক রা আন্দাজ করেছিলেন। আজ অবধি কোনো সভা-কোনো শোভাযাত্রা-রিয়েলিটি শো- পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠান- ফিতে কাটা- ছায়াছবি ইত্যাদি তে প্রচুর অফার পাওয়া সত্ত্বেও তাকে দেখা যায় নি। তাঁর লেখনীর অত্যাধুনিক মোচড়, সেই মোচড়ের জায়গায় জায়গায় লুকিয়ে থাকা তীর্যক ব্যঙ্গ, কখনো প্রবল নাটকীয় পরিস্থিতি পরমুহুর্তেই অত্যন্ত স্থূল দৃশ্যায়ন সর্বোপরি অসংখ্য বিষয় যেকোনো তৎক্ষণসুলভ বাচনভঙ্গি -  এই ওঠানামার ব্যপ্তিই তার পাঠকদের আসক্ত করে রাখে।

“প্রথম যখন ম্যাগাজিন করতে আসি, তখন নেহাতই কিশোর। ষোলো বছরে সবে পা দিয়েছি। ক্লাস টেন। টুকটাক লেখালেখি’র অভ্যেস তার আগে থেকেই ছিলো। যদিও যে মফস্বলে আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানের মানুষেরা “দিন আনি- দিন খাই” এই তত্ত্বেই মূলতঃ বিশ্বাস রাখতেন। আমাদেরও সেভাবেই ছোটবেলা থেকে তৈরী করা হয়েছিলো। কড়া শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায়ের মধ্যে, এবং বলা হয়েছিলো জীবনে বড়ো কিছু হতে গেলে এক এবং একমাত্র সিঁড়ি ভালো লেখাপড়া করা। অর্থাৎ লেখাপড়াটা আমাদের কাছে প্রথম থেকেই ছিলো একটা উত্তরণের পাসওয়ার্ড, ডাল-ভাত এর মত সাদা-মাটা একটা নিতান্ত প্রয়োজন; কোনো পছন্দ বা প্যাশন না। সেদিকে ফাঁকি অবশ্য কখনো দি নি, বা  বলা ভালো দেবার উপায় ছিলো না। কিন্তু যে কোনো নির্মান, তা সে যতক্ষুদ্রই হোক বা যতবৃহদ্‌, করার পর মানুষ চায় সেটা আর পাঁচজনকে দেখাতে, সেটা নিয়ে আলোচনা করতে এবং আরো ভাবতে ... এর ফলে আত্মবিশ্বাস এবং নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দ দুটোই বাড়ে। কিন্তু আমাদের মফস্বলে লোকেরা এতই অন্ধ এবং সংরক্ষণশীল ছিলেন যে তারা “দিন আনি দিন খাই” ব্যতীত কিছু ভাবতেই পারতেন না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হত। তাই ক্লাস টেন-এ যখন গোটা দুই-তিন উৎসাহী সমবয়সীদের সাথে আলোচনায় আমাদের প্রথম নিজস্ব ম্যাগাজিনের ব্যাপারটি উঠে এলো তখন সবচে বড়ো প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলো টাকা-পয়সা বা মূলধনের চিন্তাটা। কিন্তু তার চেয়েও যেটা বড়ো প্রতিবন্ধকতা বলে আমাদের মনে হয়েছিলো, সেটা হল, বাড়িতে কি বলবো? কিছুটা টাকা-পয়সার জন্য তো বাড়ির প্রতি নির্ভর করতেই হতো। আর তাছাড়া বাড়িতে একেবারেই না জানিয়ে নিজস্ব ম্যাগাজিন প্রকাশ করার মতো দুঃসাহসিক কাজ করার বুকের পাটা আমাদের ছিলো না। এদিকে ম্যাগাজিন করার ইচ্ছেটা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, নানারকম স্বপ্ন-কল্পনা-ভাবনাচিন্তার জাল বুনে চলেছি অবিরত। তিন-চার মাসের মধ্যে মাধ্যমিকের টেস্টপরীক্ষা। আমরা কাজটা শুরু করে দিলাম আস্তে আস্তে, থেমে থাকার অজুহাত গুলো কেন জানি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমরা প্রথমে প্রেসে গেলাম। বই বা ম্যাগাজিনের যেসব কমার্শিয়াল টার্ম আছে, যেগুলোর সাথে আমাদের এতবধি কোনো পরিচয়ই ছিলো না- সেগুলোর সাথে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগলো। এবং তার সাথে জুড়ে থাকা বিভিন্নরকম খরচাপাতির হিসেব প্রেসওলা যখন আমাদের একে একে শোনালো খানিকটা ব্যঙ্গ করছে বলে মনে হয়েছিল, এত টাকা-পয়সা বাড়ি থেকে আনার মত ক্ষমতা আমাদের ছিলো না। কল্পনার জগত কে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে গেলে কতটা খোঁচা খেতে হয় আমরা বুঝলাম। অনেক আলোচনা এবং কথা-বার্তার পর আমরা সিদ্ধান্তে এলাম অ্যাডভ্যাটাইজিং করবো। নিজেদের পড়াশুনো- প্রাইভেট-টিউশন – পরীক্ষার প্রস্তুতি সামাল দিয়ে আমরা অবসর সময় টুকু ঘুরতে লাগলাম দোকানে দোকানে। দুর্গাপুজোর আগে আগে যখন সবাই জামা-প্যাণ্ট কিনতে ব্যস্ত, আমাদের সারাটাদিন কাটত টো-টো কোম্পানীর মত। প্রতি জায়গায় গিয়ে একই বুলি আওড়াতে হত, আমরা নতুন একটা ম্যাগাজিন করতে চাইছি, সেটার বিষয় কি কি হবে, সেটা করলে আমাদের মফস্বলের কি কি সুবিধা হবে, অন্যান্য মফস্বলই বা কিভাবে উপকৃত হবে, আমাদের সার্কুলেশন ইত্যাদি ব্যাখ্যা দেবার পর দোকান বা কন্সট্রাকশন কোম্পানির মালিকের কাছে টাকা’র কথাটা ফেলতে হত; আপনারা অ্যাডভ্যাটাইজ দেবেন? আমরা অ্যাডভ্যাটাইজ ছাপবো আপনাদের আর তার বদলে কিছু টাকা নেবো যা দিয়ে আমাদের ম্যাগাজিনের খরচ উঠে আসবে। প্রথম প্রথম এভাবে চাইতে লজ্জা হত, কিন্তু ক্রমশ সেটা উধাও হয়ে গেল – চড়ারোদ্দুর বা বর্ষায় কয়েকমাস ঘোরার পর। আমাদেরই প্রচুর বন্ধু সেইসময়গুলোয় প্রেম করত, আড্ডা মারত, মদ খেতে যেত – আমাদেরও ইচ্ছে করত; কিন্তু ম্যাগাজিনের ভুত তখন আমাদের সেসুখে কিল মেরেছে। এক-দুটো ভদ্র দোকানদার, একজন সোনার ব্যবসায়ী এবং আমাদের মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তখন হাতে গোনা চারটে অ্যাড পেলাম, শর্ত তাদের কবিতা ছাপতে হবে। সেইসব জঘন্য রদ্দি লেখার কথা মনে পড়লে গা এখনো গুলিয়ে ওঠে। তো সে যাই হোক, যেটুকু টাকা উঠে এলো তা টোটাল ম্যাগাজিন কস্টিংযের এক-চতুর্থাংশেরও কম। দেখতে দেখতে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা চলে এল, ফলে কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখতে হল। মূলধন যে কি মারাত্মক জিনিস এবং তা আদায় করতে পায়ের ঘাম কিভাবে মাথায় ফেলতে হয় ওই বয়েসেই আমরা উপলব্ধি করলাম।  তবুও কিছুটা টাকা যে জোগাড় করলাম, এটা আমাদের একটা ভরসা দিলো, যে আমরা থেমে নেই- এগোচ্ছি। জাস্ট চলতে হবে, পথ নিজে নিজেই তৈরী হয়ে যাবে। আর হলও তাই ... একদিন বন্ধুরা মিলে সিগ্রেট ধরাতে যাবো, কিন্তু দেশলাই টা যার কাছে থাকার কথা ছিলো সে হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সবাই গজগজ করতে লাগলো। একটা আবহ তৈরী হবার পর দেশলাই এর মতো একটা গৌণ জিনিস-এর অনুপস্থিতি সেই আবহটাকে কোথাও মিইয়ে দিলো।  এরপর দিন থেকেই আমি একটা কাজ করলাম, রাস্তাঘাটে, পথচলতে, বাসে, কোনো রিক্সাওলার কাছে সুযোগ মত কয়েকটা দেশলাই কাঠি চেয়ে নিতাম। কয়েকটা দেশলাই কাঠি ধার দিতে কেও না করত না, বরং হাল্কা বাঁকা হেসে দিয়ে দিতো। ভাবটা এমনই যে, বাড়িতে জানে, ধুমপান করো? আমিও চোখ মেরে জবাব দিতাম। সেই দেশলাই কাঠিগুলো এক-এক করে জমাতে লাগলাম ... ক্রমশ আমার ওই দু-তিনজন ম্যাগাজিন বন্ধুদেরও এই কথা বললাম। প্রথম প্রথম তারা তাচ্ছিল্য করেছিলো কিন্তু ক্রমশ কয়েকমাসের মধ্যেই শীতকাল আসার আগে আগেই আমাদের সংগ্রহে প্রচুর দেশলাই কাঠি জমা হল। ফেলে দেওয়া বা পড়ে থাকা খালি দেশলাই বাক্সগুলো জোগাড় করে আমরা সেই জমানো দেশলাই কাঠিগুলো বাক্সে পুরে দিলাম। সুবিধাটা হল এটাই যে দেশলাই বাক্সে কটা কাঠি থাকে সেটা কেও গুনে নেয় না – একটা আন্দাজ সংখ্যাক কাঠি থাকলেই সেটা বিক্রি হয়। সেই সুযোগ টাকে কাজে লাগিয়ে আমরা লোকাল গুমটিগুলোয় নর্ম্যাল দামের পঁচিশ পার্সেণ্ট ছাড়ে এক-একটা দেশলাই কাঠি বিক্রি করতে লাগলাম। দেশলাই কাঠির গায়ে কোনো ছাপ মারা থাকে না, ছাপ থাকে দেশলাই বক্সে ... এলো বসন্তকাল। এলো মাধ্যমিক। ঠিক তার আগে-আগেই আমাদের ম্যাগাজিন “অনুপ্রাণ”এর টাকাও উঠে এলো হুহু করে।

আজ ষাট বছর পেরিয়েও সেই শুরুর দিনের কথা আমি ভুলিনি, সেই দিনগুলো ছিলো রোমাঞ্চে আর অদম্য চ্যালেঞ্জে ভরা... এর মাঝেই আমাদের ম্যাগাজিন অনেকবার শ্লথ হয়ে পড়েছে নানান প্রতিবন্ধকতায়! কখনো ষান্মাষিক কখনো বার্ষিক কখনো বা দ্বিবার্ষিক থেকে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু কিশোর বন্ধুরা পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যা ইচ্ছেশক্তিকে আটকাতে পারে ...   ” 

হাততালিতে ফেটে পড়ছে অরবিন্দ সভাঘর-এর মস্ত হল ... “অনুপ্রাণ” এর শততম সংখ্যা’র মোড়ক উন্মোচন করছেন “বিশ্বব্যাপী বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি”-এর সভাপতি ।
একটি প্রশিক্ষিত মেয়ে দু’হাতভরে এনেছে পদক, একটি উত্তরীয় এবং মানপত্র। ঘোষকেরা আরেকবার ঘোষণা করছেন এবছরের বাংলার সেরা ব্যক্তিত্ব মানস মুখার্জ্জী ওরফে মা.মু. র জন্য আরো একবার জোরে হাততালি – হলের ফেটে পড়া তালির আওয়াজ আর তরুণ কবিদের সোল্লাসে পৃথিবীর সমস্ত আওয়াজ আজ গৌণ মনে হচ্ছে