ষষ্ঠীর
দিন কৈলাসে
অমিতাভ প্রামাণিক
অমিতাভ প্রামাণিক
কৈলাসে শিবের বাড়িতে আজ
থ্রী ইডিয়ট্সের পার্টি । বৌ-বাচ্চা পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে, শিবের তাই এখন পোয়াবারো
। নন্দীকে বলা আছে সুপার রিফাইণ্ড কয়েক জালা চুল্লু
বানিয়ে রাখার জন্যে । ভৃঙ্গী গেছে উপযুক্ত চাটের ব্যবস্থা করতে । ষাঁড়টার এখন কোন কাজ নেই, সে বসে বসে ঢুলছে, আর মাঝে মাঝে হাই তুলে
জাবর কাটতে কাটতে ভাবছে - নে যত খুশি বাওয়ালি করে নে, মা এসে যখন ঝ্যাঁটা দিয়ে
পিটিয়ে তোদের ঝাল ঝাড়বে কৈলাসে কেলেংকারি করার জন্যে, তখন বুঝবি কত প্যাডিতে
কত রাইস ।
এ রকমই এক পার্টিতে মাল-ফাল
খেয়ে গুলতানি মারতে মারতে তাদের মনে বিচিত্র এক সাধ জেগেছিল কয়েক যুগ আগে । তাদের মানে ঐ থ্রী ইডিয়ট্সের – ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের
। তিন পাত্তি খেলতে খেলতে একসময় একজন বলল - চল, আমরা তিনজন মিলে একটা বিজনেস
চালু করি ।
বাকি দুজন কোরাসে বলে উঠল
- কীসের ব্যবসা, কীসের
ব্যবসা ?
বিষ্ণু বলল, কীসের আবার ? আমাদের যা কোর এক্সপার্টাইজ, তার ওপরেই কিছু ।
সেটা কী ? আমি তো সৃষ্টি করা ছাড়া
আর বিশেষ কিছু পারি না, ব্রহ্মা খানিকটা হতাশ হয়ে বলে উঠল ।
বিষ্ণু বলল, কোই বাৎ নেহী । ওটারই বিজনেস চালু করা যাক । তুই
একটা ডিম পাড়, বেম্মো
। ব্রহ্মার আণ্ডা, আমরা তাকে বলব, ব্রহ্মাণ্ড । এমনভাবে পাড়, যেন ছোট্ট একটা পিঁপড়ের ডিম, তারপর সেটা বড় হতে হতে
পায়রার ডিমের মত, তারপর
মুরগীর, তারপর
হাঁসের, তারপর
অস্ট্রিচের ডিমের মত বড় হতে থাকে ।
শিব মুখ ভেংচে বলল, বড় হতে থাকে ! শালা ডিম কি জাঙিয়ার ইলাস্টিক, যে ক্রমে ক্রমে বড় হতে
থাকবে? বড় হতে
হতে ছিঁড়ে যাবে না ?
বিষ্ণু বলল, যাক না ছিঁড়ে । কোন ব্যাপার না । আমি
আছি কী করতে, ঠিক
সামলে নেব। ছিঁড়ে যদি যায়, তো খানিক আওয়াজ টাওয়াজ
হবে, এনার্জি
বেরোবে, ঐসব
দিয়ে আমি বেশ কিছু নীহারিকা, ব্ল্যাক হোল, টাইম, ম্যাটার, লাইফ এইসব বানিয়ে ফেলব ফটাফট । সিন্নি বানানোর মতই তো এসব অনেকটা । দুধ-কলা-সন্দেশ
সব চটকে দিলে খেতে বেশ মাখোমাখো কেমন হয় বল দিকিনি ?
সিন্নির কথা উঠতেই শিব
আবার খচে গেল । সিন্নি তার মোটেও পছন্দ না, সত্যবাদী বিষ্ণু নারায়ণ
হয়ে ঐসব সিন্নি ফিন্নি খায়, তার ফলে পেটে তার নাদু ভুঁড়ি গজাচ্ছে, শালা ডায়াবেটিস হয়ে মরবে, তখন বুঝবে । শিব একবার সিন্নি জিনিসটা ট্রাই করেছিল, অখাদ্য খেতে, যেন মৌচাকের মধুর মধ্যে
আদ্ধেক মোম গুলে দেওয়া । আর খেলেই পেটে গ্যাস । সে বলল, নো সিন্নি ! কেন, গ্যাঁজা-চরস এসব থাকবে
না ?
থাকবে না কেন ? সব থাকবে রে শিবে, বিষ্ণু সান্ত্বনা দিল তাকে
।
হ্যাঁ, ভালো চাস তো ওগুলোই বেশি
রাখিস, আর মালের
সাথে চাট । পছন্দ না হলে আমি সব গুঁড়িয়ে দেব, বলে দিলাম, শিব ফুট কাটলো । তোর ঐ ম্যাটারের মটর ঝরঝরে করে দেব, লাইফ হেল করে ছেড়ে দেব
।
ব্রহ্মা বলল, যা শ্লা, সব গুঁড়িয়ে দিলে বিজনেস
চলবে কী করে ? লালবাতি
জ্বেলে দিয়ে ঘরে ঢুকলে তো মুড়ো ঝ্যাঁটা পিঠে পড়তেই থাকবে । বৌগুলোকে
তো চিনিস ।
তাই তো, তবে কী করা যায় ! শিবকে
নিয়েই ঝঞ্ঝাট, ও ব্যাটা
ভাংচুর ছাড়া তো কিছুই শেখেনি । কখন যে ওর রাগ চেপে যায়, আগের থেকে কেউ বুঝতে পারে
না । না হলে আগের পক্ষের শ্বশুরের ওপর ক্ষেপে মরা
বৌয়ের বডি কাঁধে নিয়ে কাউকে নেত্য করতে শুনেছে কেউ ?
বিষ্ণুই ফয়শালা করলো এর
। ভাঙে তো ভাঙুক শিব । ফের
চালু হবে আবার । ব্রহ্মা আবার কোঁৎ পেড়ে ডিম নামাবে, ফিরফিত্তি চালু হবে সব
। বিজনেসে আপ ডাউন থাকেই, মাত্তর এক পিস ডিম দিয়ে
কত আর বিজনেস করা সম্ভব ?
শিব বলল, কদ্দিন চলবে এই ব্যবসা
?
বিষ্ণু বলল, কেন, অনন্তকাল চলবে । তোর কী অসুবিধে ? যখন ভাল্লাগবে না, ডমরু বাজিয়ে নিয়ে দিবি
ত্রিশূলের খোঁচা, ভেঙে
গেলে আবার বেম্মো পঁক করে আর এক পিস আণ্ডা নামাবে ।
শিব বলল, ঠিক আচে । কিন্তু দ্যাখ শালারা, আমি অঙ্ক বুঝিনা ভালো। আমায়
ঠকাবি না কিন্তু । আমাদের সবার সেম সেম শেয়ার, থার্টি থ্রী পার্সেন্ট
করে ।
ব্রহ্মা বলল, থার্টি থ্রী করে হলে তো
তিনটে মিলে নাইন্টি নাইন হয় রে শিবে । বাকি এক পার্সেন্ট ? ও তাইতো, দেখলি বেম্মো, বললাম না, আমার ম্যাথ্সে চিরকাল
ভয় । না, না, থার্টি থ্রী না, থার্টি থ্রী পয়েন্ট থ্রী
থ্রী করে, তাইতো
?
উঁহু, তাহলেও তো নাইন্টি নাইন
পয়েন্ট নাইন নাইন হল । বাকি পয়েন্ট জিরো ওয়ান ? ব্রহ্মা উদ্বিগ্ন মুখ করে
বলল । একশো কে তিন দিয়ে ভাগ করে চলেছি, শালা মিলছেই না । এই দ্যাখ খাতায় । পয়েন্টের
পরে এতোগুলো তিন এসে গেল, শালা তিনের শেষই হচ্ছে না রে –
বিষ্ণু এতক্ষণে মুখটা সবজান্তার
মত করে বলল, ঐটাই
তো । কোনদিন শেষ হবে না । বললাম
না, আমাদের
বিজনেস হচ্ছে অনন্তকালের জন্যে । চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে । ঐ একশোকে
তিন দিয়ে ভাগ করে ভাগফলের মত ।
সেই বিজনেস শুরু হয়ে গেছে
কতকাল হয়ে গেল । বিষ্ণুই তার প্রফিট অ্যাণ্ড লসের হিসেব দেয়। ডিভিডেন্ড পেয়েই কারো না কারো ঘরে পার্টি শুরু হয়ে যায় । কারো বৌ বাপের বাড়ি যাচ্ছে জানতে পারলেই স্পেশ্যাল ডিভিডেন্ড
অ্যানাউন্স করা হয়, কেননা তার বাড়ি ফাঁকা পাওয়া যাবে হৈ হৈ করার জন্যে । এটাতেও তাই হয়েছে ।
বিষ্ণু মালটা ভালোই টানে, তবে চাটের জন্যে তার ফ্রায়েড
জিনিস বেশি পছন্দ না । ও একটু ফললোভী, শশা-বেদানা-আঙুর এইসব দিয়েই
ও মাল টানতে পছন্দ করে । নিজের বাড়ির পার্টিতে ফ্রুট স্যালাড করে রাখে
তিন চার রকম, শিব
সে সব ছুঁয়েও দেখে না। আজ শিবের বাড়িতে ঠেক, বিষ্ণু এসেই ফল খুঁজতে
রান্নাঘরে ঢুকল । একটু পরেই বেরিয়ে এসে শিবকে বলল, তোর কিঙ্কর দুটো গেল কোথায়
রে, শিবে
?
কিঙ্কর ? সে আবার কী ? খায় না মাতায় দ্যায় ? শিব অসহায়ভাবে বলে উঠল
।
বিষ্ণু বলল, উফ্, তোরে নিয়ে আর পারিনে। কিঙ্কর মানে চাকর ।
নন্দী-ভৃঙ্গী ? কেন, কী চাই তোর ? ওরা একটু বাইরে গেছে, আমাকে বল না, শিব বলল ।
বিষ্ণু বলল, কিচেনটা যা কিচাইন করে
রেখেছিস, একদিনেই
এই হাল । আমি দেখলাম কতগুলো উচ্চিঙ্গট ঘুরে বেড়াচ্ছে আর
ঊর্ণনাভ বাসা বাঁধছে । একটু সম্মার্জনীটা খুঁজে দিবি, শিবে ?
শিব ফটাস করে খচে গেল । সে ম্যাথ্স্ জানে না বলে ভয়ে ভয়ে থাকে, তাকে না ঠকিয়ে দেয় এরা
। এখন আবার কী সব সংস্কিতো ঝাড়ছে । সে বলল, কী হচ্ছে ? কী চাই কী তোর, বাংলায় বলনা । দাঁতের মাজন ?
বিষ্ণু বলল, না হে, সম্মার্জনী, মানে ঝ্যাঁটা । রান্নাঘরের কোণে দেখি একগাদা উচ্চিঙ্গট, মানে উচ্চিংড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে
। ঊর্ণনাভ মানে জানিস না ? মাকড়সা !
মাকড়সাকে মাকড়সা বললেই
পারিস, সম্মিঙ্গট
না কী বললি, ওসব
বলার দরকার কী ? আমাকে
ঝুলিয়ে দিয়ে যাবি কোথায়, সুমুন্দির পুত ? সব গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেব, তখন বুঝবি ।
বিষ্ণু বলল, না রে ভাই, তোকে হ্যাটা করার জন্যে
বলছি না । মর্ত্যে এখন এই ভাষায় বই লেখা চালু হচ্ছে । এতদিন মুখে মুখে গুরু শিষ্যকে শেখাত, এখন লিখে রাখা শুরু হচ্ছে
। আমার চর্চা নেই, ভক্তরা আশির্বাদ টাশির্বাদ
চায়, তখন
ওদের ভাষাতেই তো কথা বলতে হয় । তাই একটু প্র্যাকটিশ করছি । তোরাও টুকটাক শেখ, না হলে মুশকিলে পড়বি । মর্তে
মানুষ বলে এই যে জীবটা, ওরা বেশ ফটাফট নতুন নতুন জিনিস শিখে ফেলছে । কোনদিন আমাদের নিয়ে টানাটানি না শুরু করে দেয় ।
কী ? আমাদের নিয়ে টানাটানি শুরু
করবে ? মুণ্ডু
ছিঁড়ে ডুগডুগি বাজাবো, শিব বলে উঠল ।
শিবে, তোরে লইয়া আর পারা যায়
না । কথায় কথায় শাসাস তুই, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা
। এত অচিকীর্ষু কেন তুই ? গোমায়ুর মত আমার দিকে অমন
করে তাকাচ্ছিস, আমি
কি তোর অক্ষিবিকূর্ণন দেখে ভয় পাই নাকি ?
শিব বলল, আমাকে গোময় বললি ? আমি গোবর ? অচিকিৎসা না আর একটা কী
বললি ?
বিষ্ণু বলল, অচিকীর্ষু রে, অলস । তোর তো নড়তে চড়তে সন্ধ্যে হয়ে যায় । গোময়
না, গোমায়ু, মানে শেয়াল ।
ঝামেলা বেধেই যেত অকুস্থলে
নন্দী বিশাল জালায় ভরে কালীমার্কা বাংলা চুল্লু এনে হাজির না করলে । একটু পরে ভৃঙ্গীও এসে হাজির হল । তার
ক্যারিব্যাগে হরেক কিসিমের চাট । বিষ্ণু ফট করে একটা আপেল তুলে নিল । রান্নাঘর থেকে একটা কাঁচের গ্লাসে ভৃঙ্গী বিষ্ণুকে এনে দিল
একগ্লাস দুধ । বিষ্ণু চুমুক মেরেই বলল, আহ্, ধারোষ্ণ দুগ্ধপানের কী
শান্ তি!
ব্রহ্মা এতক্ষণ চারখানা
মাথা নাড়িয়ে বিষ্ণু আর শিবের তু তু ম্যায় ম্যায় দেখছিল । সবার
হাতে গ্লাস এসে যেতে চীয়ার্স বলে শুরু করল, তাহলে হিসেবপত্তর করে ফেলা যাক, না কী ? বিষ্ণু, তুই মানুষ না কীসের কথা
বলছিলি । তারা কী বস্তু ? আমাদের নিয়ে টানাটানি কেন
করবে তারা ?
বিষ্ণু বলল, বস্তু নয়, জীব, মানে তাদের প্রাণ আছে ।
ব্রহ্মা বলল, প্রাণ আছে মানে? প্রাণ আবার কী ?
বিষ্ণু বলল, প্রাণ মানে ঐ যে রে, ইয়ে, মানে ওরা চলাফেরা করতে
পারে, কথা
বলতে পারে, ছেলেপুলের
জম্ম দিতে পারে ।
ব্রহ্মা বলল, গুবলেট কেস তো রে বিষ্ণু
। এত কিছু করতে পারে ওরা ? আমি তো জানতাম আমিই একমাত্র
জন্ম দিতে পারি । ওরাও পারে ? তাহলে তো ওরাও অনন্তকাল চলতে থাকবে । আমাদের বিজনেস খেয়ে নেবে না তো ? কী চায় ওরা ?
বিষ্ণু বলল, কী চায় সেটা ওরা নিজেরাই
জানে না । আমি ওদের মনে পারবশ্যের কঞ্চুক লাগিয়ে দিয়েছি
।
শিব বলে উঠলো, প্লীজ বিষ্ণু, তোর ফাজলামি রাখ । ওসব ভাষা পরে প্র্যাকটিশ করিস । গোদা
বাংলায় বল ।
পারবশ্য মানে পরাধীনতা, আর কঞ্চুক হল খোলস, বিষ্ণু বলল । কাঁচুলি রে, সেটা তো তুই ভালোই বুঝিস, শিবে, শালা ডুবে ডুবে জল খাস, তোর বাবাও টের পায় না ।
শিব লজ্জা লজ্জা ভাব করে
বলল, হ্যাঁ, তো পরাধীনতার কাঁচুলিটা
আবার কী ? সেসব
কেন পরাতে গেলি ?
বিষ্ণু বলল, এই মানুষ নামের জীবটা, বুঝলি, কত কী জেনে গেছে । ওরা ভাবে ভগবান বলে একটা সামথিং আছে, সে হচ্ছে এক এবং অদ্বিতীয়
। আর ওরা নাকি সবাই তারই অংশ । যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ-লসাগু-গসাগু-ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস
এসবও শিখে গেছে তারা ।
ব্রহ্মা বলল, মরেচে, এতসব অঙ্ক শিখে গেছে, আমাদের কোন সমস্যা সৃষ্টি
করবে না তো ? আই মীন, তুই তো অঙ্কে এক্সপার্ট
রে বিষ্ণু, অঙ্ক
কষেই তো ব্রহ্মাণ্ডটা চালাচ্ছিস ।
শিব বড় এক সিপ মাল টেনে
বলল, গুঁড়ো
করে ছেড়ে দেব, শুয়োরের
বাচ্চা, আমায়
চেনে না ।
ব্রহ্মা বলল, দাঁড়া না শিবে, কথায় কথায় শুধু গুঁড়ো করে
দেব, গুঁড়ো
করে দেব । তুই শালা একদম সুমিতের মিক্সার-গ্রাইণ্ডার! চুপ
করে শুনতে দে না । হ্যাঁ, বিষ্ণু তুই বল ।
দ্যাখ, কেসটা আমারও ঠিক ক্লীয়ার
না, বিষ্ণু
বলল । এই যে বেম্মো তুই ডিম পাড়িস, ওটা তো তোর সহজাত, এর জন্যে হিসেব করতে হয়
না তোকে, ফটাস
করে পেড়ে দিস । শিবেও তেমনি ত্রিশূল বাগিয়ে খোঁচা দিলেই সব ঝুরঝুর
করে ভেঙে যায়, ওকেও
বেশি মাথা ঘামাতে হয় না । এখন কেউ যদি এইসব হিসেব কষে করে ফেলতে পারে, তবে তাকে একেবারে ফ্যালনা
ভাবা ঠিক না ।
ব্রহ্মা একটু উদ্বিগ্ন
মুখে বলল, তোর
কি মনে হয়, বিষ্ণু, অঙ্ক কষে এইসব পাওয়া যায়
?
বিষ্ণু বলল, হুম, যায়, এই আমার দিকে লক্ষ্য কর
। এই যে দেখছিস আপেলটা, কটা আপেল এখানে ? একটাই তো । এই দ্যাখ, আমি এটা ছুরি দিয়ে ঠিক হাফ করে ফেললাম । এই প্লেটের ওপর রাখলাম এই হাফটা । ওকে
? এবার
বাকি হাফটা নিয়ে সেটারও ঐ রকম দুটো হাফ করলাম । সেই
দুটো হাফের মধ্যে একটা হাফ ঐ প্লেটে তুলে রাখছি । তাহলে
প্লেটে হল গিয়ে অরিজিন্যালের হাফটা, প্লাস এই হাফের হাফ, মানে অরিজিন্যালের সিকি, সব মিলিয়ে তিন পোয়া হল, তাই তো । আর আমার হাতে বাকি এক পোয়া । আমি
সেটাকেও কেটে হাফ করলাম, আর আগের মতই তার একপিস তুলে দিলাম প্লেটে । তাহলে আমার হাতে থাকল ওয়ান এইট্থ্ আর প্লেটে টোটাল হল সেভেন-এইট্থ্
। এবার এই ওয়ান-এইট্থ্কে যদি আবার হাফ করি –
শিব বলল, শালা খাওয়ার জিনিস নিয়ে
ঢ্যামনামি না করে পোস্কার করে বলতো কী বলতে চাইছিস ?
বিষ্ণু বলল, বুঝতে পারছিস না, না ? আমি এক এক করে প্লেটে যে
টুকরোগুলো রাখছি, সেগুলো
অরিজিন্যালের কী ? প্রথমে
রাখলাম হাফ, নেক্স্ট্
ওয়ান ফোর্থ, নেক্স্ট্
ওয়ান-এইট্থ্, তারপর
ওয়ান-সিক্সটীন্থ্, এভাবে চলতেই থাকবে, কোনদিন শেষ হবে না, সেটা তো বুঝছিস ?
ব্রহ্মা বলল, হ্যাঁ, এটা বুঝলাম, তো এর থেকে কী প্রতিপন্ন
হয় ?
বিষ্ণু বলল, খেয়াল করে দ্যাখ, কতগুলো জিনিস এ থেকে প্রমাণ
হচ্ছে । এক, এই ঘটনা চলবে অনন্তকাল ধরে, কোনদিন শেষ হবে না, কেননা আমার হাতে তো এক
পিস থেকেই যাবে, যেটা
আমি আবার হাফ করবো, সেটা যত সরু পিসই হোক । দুই, প্রতিবারের পিস হবে আগের
পিসের হাফ, মানে
আগেরটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । বাবার হাফ ছেলে, ছেলের হাফ নাতি, এই রকম, বুঝলি তো । মানে সব একটার সাথে আর একটার, যাকে বলে রক্তের সম্পর্ক
। আর তিন, এটা ভালো করে বোঝ, যদিও এই চলতে থাকা কোনদিনই
শেষ হবে না, তবুও
এর নীট রেজাল্ট হচ্ছে, সবকটা মিলে এরা হচ্ছে সেই অরিজিন্যাল আপেল, যেটা ছিল গোটা একটাই । মানে এক এবং অদ্বিতীয় । আর সব
পিসগুলো তারই অংশ। কী বুঝলি? মানুষ এই সব অলরেডি ভেবে বসে আছে ।
ব্রহ্মা বলল, গুবলেট কেস তো রে, বিষ্ণু । তুই বলছিস, মানুষের এত পাওয়ার অলরেডি এসে গেছে, যে ওরা সৃষ্টি-রক্ষা-ধ্বংস
সবকিছু করতে পারে ? সেই অঙ্কটাও ওরা জেনে গেছে ? তবে তো আমাদের বিপদ ।
বিষ্ণু বলল, না, না, পাওয়ার কতটা এসেছে তা বলা
মুশকিল । তবে এসবের উত্তর খুঁজছে ওরা । বৌদিকে একটা ফোন কর না শিবে । উনি
তো ওদিক পানেই গেছেন । ওর কাছ থেকেই জেনে নেওয়া যাবে ।
বৌদিকে ফোন করার দরকার
হল না, তার
আগেই ঝনঝন করে শিবের সেলফোন বেজে উঠল, স্ক্রীনে বৌদিরই নাম্বার । শিব ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তীব্র ঝঙ্কার ভেসে এল, তোমাদের জ্বালায় কি বাপের
বাড়ি এসে দু’দণ্ড হাত পা ছাড়ানোর উপায় নেই ? সবে বোধন শুরু হয়েছে, আমার এখন কি অন্য কোথাও
মন দেওয়ার উপায় আছে ?
শিব মিনমিন করে বলল, কেসটা কী দুগ্গা ? খেপে যাচ্চ কেন ?
দুর্গা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, খেপে যাচ্ছি কি সাধে ? নির্ঘাৎ মালের আসর জমিয়েছ
বাড়িতে, তাই
তো ? বেচারি
ষাঁড়টাকে সারাদিন না খাইয়ে রেখেছ ! নন্দী কই, ভৃঙ্গী কই, বেলন দিয়ে ওদের পিটিয়ে সিধে না করেছি কি আমার
নাম দুগ্গা না । আসার আগে আমি ষাঁড়টার সামনে আমার পুরনো নোকিয়া
ফোনটা ফেলে রেখে বলে এসেছি, ওর যত্ন-আত্তি ঠিক ঠাক না হলে যেন ফোনটা টিপে আমাকে একটা
মিস্ড্ কল দেয় । এখুনি এল সেই কল ।
বেকুব শিব হতচকিত মুখে
পার্টনারদের মুখের দিকে তাকাল । তারপর গলা নামিয়ে বলল, আমি এখুনি ওকে খড়-বিচুলি
দিচ্ছি । তুমি কেমন আছ, দুগ্গা ? কেতো-গণা-লক্খী-সরো ওরা ?
দুর্গা বলল, সব ঠিক আছে । এখানে ব্যাপক লাইটিং হয়েছে । এবারের
থিম হচ্ছে মঙ্গলগ্রহে স্পেসশীপ নিয়ে ট্যুর, চন্দননগরের সব লাইট পার্টিই এর ওপরে ফাটাফাটি
ক্রাফ্ট্ বানিয়েছে ।
শিব বলল, মানে ?
বিষ্ণু আর ব্রহ্মা হাঁ
করে তাকিয়েছিল শিবের দিকে । ওরা দুর্গার কথা ডাইরেক্ট শুনতে না পেলেও বুঝতে
পারছিল মোটামুটি । বিষ্ণু ফোনটা শিবের হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল, বৌদি, হ্যালো, আমি বিষ্ণু বলছি, লাইটিং নিয়ে কী বললেন ?
কথা শেষ হওয়ার আগেই বাকিদের
দিকে মুখ করে বিষ্ণু বলল, মানুষ এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে পাড়ি দেওয়াও শিখে গেছে রে
! আখেটিকের মত ওদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখতে হবে, নিদিধ্যাস করতে হবে, তোরাও তোদের দিদৃক্ষা বাড়া
। কেস বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে রে বেম্মো-শিবে !
শিব প্রচন্ড রেগে গিয়ে ত্রিশূলটা তুলে ধরে বলল, আবার সেই খটোমটো কথা বলছিস! আখের ক্ষেতে নির্দ্বিধায় ঢুকে গিয়ে দুধে ক্ষীর বাড়াতে হবে না কী বললি?
উফ, তোকে নিয়ে আর পারি না রে শিবে, বিষ্ণু বলল, আখের ক্ষেত না, আখেটিক, মানে শিকারীর চোখে মানুষদের কাজকর্ম নিদিধ্যাস, অর্থাৎ কিনা নিরন্তর বিচার করতে হবে। তোরা দিদৃক্ষা মানে দেখার ইচ্ছে না বাড়ালে পারবি না।
শিব বলল, থাক, আমাদের তিতিক্ষা ফিতিক্ষা না করলেও চলবে। তুই বরং পৃথিবীতে গিয়ে দুগ্গার সাথে যোগাযোগ করে বাংলার ক্লাস নিগে যা। দুগ্গা ফোনে বলল, ওখানে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কীসব গোলমাল হয়েছে। ছাত্রদের বহিরাগত বলে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। প্রফেসররা নাকি বাইরে চায়ের দোকানে ক্লাস নেবার কথা ভাবছে। বাংলার হাল ঝরঝরে, তুই গিয়ে ওদের একটু বাংলাটা শিখিয়ে আয়।
বিষ্ণু শুনেই লাফিয়ে উঠল। সত্যি, ওখানে এই রকম ঝামেলা বেধেছে? গুড গুড। এই রকম শুনলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম, মানুষ এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে চলে যাচ্ছে, আমাদের স্বর্গ নিয়ে না টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়ে যায়। পারবে না, বুঝলি? নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেই মরবে। আমাদের এই বিজনেস চলতেই থাকবে অনন্তকাল। নে, বোতল ফোতল কী আনিয়েছিস বের কর।
3 comments:
নো কমেন্ট। এত ভালো লেখাটাকে, ইতিহাস বিজ্ঞান পুরাণের ককটেলটাকে আমি ভালো বললেই বাঁকাচোখগুলো স্বজনপোষণ হচ্ছে বলে কলরব তুলবে। তবু বলি, হোক কলরব।
এই লেখকের সমস্ত লেখাই অনবদ্য-অসাধারণ । নমস্কার রইল 🙏
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন