পথ আর গন্তব্য শেষ না হবার এইতো জীবন
সৈয়দ আবু মকসুদ
সেই শৈশবে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে নতুন বছরের শুরুতে সকালের প্রথম অথচ মিষ্টি রোদে বসে মৃদুমন্দ হাওয়ায় নতুন ক্লাসের বাংলা বইয়ের গল্প-কবিতা পড়তাম, যদিও তখন স্কুল খোলেনি। হৈমন্তী, বিলাসী, পন্ডিত মশাই, আরো কত এক নিঃশ্বাসে শেষ করার মতো গল্প! তারপর স্কুল শুরুর আগে বইগুলোতে যতœকরে পুরানো ক্যালেন্ডারের পাতা দিয়ে মলাট লাগাতাম। বাংলাভাষী হিসাবে অতি গর্বের বিষয় হলো আমরা অসাধারণ অনেক কবি-সাহিত্যিক পেয়েছি। ক্লাসের বইয়ের বাইরের বই পড়ার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও স্কুলের পড়া ও মাঠে খেলাধুলা করার পর যে সময়টুকু থাকত তা মনের মতো করে কাটানোর জন্য বইয়ের অভাব হতো না। তেমনি অভাব কোনদিন দেখা যায়নি গুনগুন করে গাওয়া গানের রতœভান্ডার। ‘এই পৃথিবী পান্থশালা’ নামে বাংলা ভাষার একটি অমর এবং চিরায়ত গান আছে। ছোট বেলায় কোন এক সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা ছবিতে সেই যে শুনেছিÑ এখনো মনে আছে। কখনও গভীর রাতে কিংবা নির্জীব একাকীত্বে কেন যেনো অহরহ সে গানটি আজো হৃদয়ের মনিকোটায় বাজে। মানুষের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা লাভ-লোকসানের খতিয়ান যাই হোক এ নশ্বর পৃথিবী আসলেই তো একটি পান্থশালা। আর এই পৃথিবীর মানুষজন হচ্ছেন মুসাফির তথা পথিক। এই পথিক কিংবা পান্থজনের আগমন-নির্গমন আর ক্ষণিকের এই বিশ্বচরাচরে পথ চলা অত:পর চলে যাওয়া অবিনশ্বরে। স্রষ্টার এক অপার কুদরতে আমরা মানুষ হিসাবে জন্মেছি। আমরা তো পোকা-মাকড় কিংবা অন্য কোন প্রাণীরূপে এই পৃথিবীতে আসতে পারতাম। কিন্তু মহান স্রষ্টার কৃপা ও দয়ায় মানুষরূপেই আমাদের আবির্ভাব। মানুষ হিসাবে এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে। মানুষ পৃথিবীতে তার কর্তব্যবোধ নিয়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারলেই মানবতার গৌরব চিরত্ব ও স্থায়িত্ব লাভ করে। তখন কিসে পড়ি তা ঠিক মনে নেই। হুমায়ুন আহমেদের বই "নন্দিত নরকে” পড়েছিলাম। আমি অভিভূত হয়েছিলাম। জুলভার্নের বই যেমন আমাকে আগ্রহী করে তুলতো মহাকাশ বৈজ্ঞানিক হতে, হুমায়ুন আহমেদের সেই বই পড়ে সংকল্প করেছিলাম লেখক হব। স্টিফেন কিং এর স্মৃতিচারণ এর একটা বইতে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন যে লেখক তৈরী হয় না বরং কারো কারো মাঝে লেখক গঠিত হয়। হুমায়ুন আহমেদ তেমন একজন ছিলেন। পাঠক হিসাবে আমার দৃষ্টিতে এমন ঔপন্যাসিক শরত্চন্দ্রের পরে আর কেউ আসে নি। আবার হয়ত একশ বছরে এমন একজন ঔপন্যাসিক আমরা পেতে পারি। আমি তাঁর প্রতিটা বই পড়তাম প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে। এক বন্ধুর বদৌলতে। সে কিনতো। ওর পড়া শেষ হলে আমি ধার নিতাম। সে সিরিয়াস হয়ে বলতো, "আমার বিয়ের কার্ডে লিখে দেব - বই ছাড়া অন্য কোন উপহার গ্রহণযোগ্য নয়"। আমরা যা চাই তা পাই না। আমার বন্ধুও পায় নি। সে প্রেম করে বিয়ে করেছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় নি। তার বইও পাওয়া হয় নি। এটাই হয়তো জীবন !! জীবনের রহস্যময় পথ যার সন্ধান অনাদিকাল থেকেই মানুষ করে চলেছে। কিন্তু কী সেই সঠিক পথ? কারো বেলায় পথের সন্ধান মিলেছে। কারো মিলে নি। অনেকেই পথহারা হতে হতে নি:শেষ হয়ে চলে গেছেন অন্য জগতে। পথের বিষয়ে কুরআন পাকের প্রথম সুরা ফাতিহায় মানুষের সঠিক পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। ইসলামে বিশ্বাসী মাত্রেই সেই পথের অনাবিল সন্ধান চলছে বিরামহীন ভাবে। বিশ্বনবী(দ) বলেছেন Ñ“সত্য এবং ন্যায়ের পথই আসল পথ”। তিনি আরো বলেছেনÑ“যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়, মানুষের মধ্যে সেই সর্বোত্তম”। আবার শ্রীগীতায় আছে-“ভালো কাজ করলে ইহলোক ও পরলোক কোথাও তার বিনাশ হতে পারে না।” বাইবেলে আছেÑ“ মন্দের বিনিময়ে মন্দ করো না। সকল মানুষের দৃষ্টিতে যা উত্তম ভেবে-চিন্তে তাই করো”। আর ত্রিপিটকের বাণীতে আছে-“যে সৎপথে চলে, অন্যায় করে না, পরস্ব অপহরণ করে না, মানুষের মনে দু:খ দেয় না, জীব হত্যা করে না;এইরূপ ব্যক্তিদেরকে আমি নির্বাণ লাভ করাই”। সব কিছুর উর্দ্ধে হচ্ছে মানুষ। মানুষরূপে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য সঠিক পথের সন্ধানে সর্বদা ব্যাকুল থাকতে হবে। প্রচেষ্টা থাকতে হবে। আর পথিক মাত্রেই তার জন্য প্রয়োজন উত্তম সঙ্গীর, দরকার একজন ভাল বন্ধু; পান্থজনের সাথী। কিন্তু প্রশ্নটাইতো এখানেই এই সখীর আবির্ভাব হবে কখন!!! প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই যখন একজন কিশোর দেখে, অসম্ভব রাগী বাবা বেদম পেটাচ্ছে তার মাকে; নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে সে হয় খুনি হবে, নয়তো বাবার মতোই নারী নির্যাতন করে আনন্দ পাবে। অপরাধ জগৎ নিয়ে মনস্তত্ত্ববিদদের গবেষণা বিস্তর। একজন কিশোরের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি। যারাই পরিবারের কিংবা সমাজের আজ অভিভাবক, তারাই জন্মলগ্ন থেকে কচিমনকে শৈশবেই মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, স্নায়ুবিকভাবে দেউলিয়া করছে কোন না কোনভাবে সে হউক ইচ্ছাতে কিংবা অনিচ্ছা। তাইতো বিশ্বাস ব্যপারটা আজ আমাদের কাছে অনেক দূরের পথÑপঙ্খীলতা আমাদের কুড়ে কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত যা কাম্য নয় আমাদের কারোরই। তবুওতো চলতে হয় পথ। অবচেতন মনে প্রশ্নের উদ্রেগ হয় প্রকৃত বন্ধু কিংবা পান্তজনের সাথীকে চেনার উপায় কী ? ডা: লুৎফর রহমান বলেছেনÑ“বন্ধুকে বন্ধুভাবেই মনে করবে,তাকে বিশ্বাস করবে,আর কোন বিচার করবে না। জগতে প্রকৃত বন্ধু একান্ত দুর্লভ।” হযরত আলী(র) বলেছেনÑ“ পথ চলা ও দীর্ঘ ভ্রমনের জন্য প্রয়োজন হয় একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর।” এমারসন বলেছেনÑ“ প্রতিটি মানুষ বন্ধুত্বের সন্ধানে জীবন কাটিয়ে দেয়।” এ বিষয়ে একটি চিরন্তন গানের কলি সর্বদাই প্রাণে বাজে Ñ“ বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও/মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে এঁকে নিও।” এভাবেই মানুষের পথের সাথী, জীবনের প্রকৃত বন্ধুকে পাওয়ার আকুতি প্রকাশিত হয়ে এসেছে জগতময়। মানুষের জীবন-যৌবন-বার্ধক্য তথা সর্বোপরি জীবনবোধের ভাবনাবৃত্তে আনন্দ-বেদনার কতো বর্ণময় চিত্র আছে। কেউ জীবনকে আরাম-আয়াশে বিচিত্র রসোত্তীর্ণ এবং মাধুর্য মিশিয়ে ভোগ করেন। আবার কেউ বা তার উল্টো। অল্পতেই তুষ্টি, এই দর্শনের উপরে অনেকেই বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন। ডব্লিউ বি ইয়েট্স্ একজন বড় কবি ছিলেন। বিশ্ব বিখ্যাত এই ইংরেজ কবি সমাজ ও ধর্মবিশ্বাসের কোলে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কবিতায় ডুবে যান। যৌবনের শুরু থেকেই জীবন কাব্যের আনন্দ-বেদনা,প্রেম-বিরহ,দু:খবোধও হতাশাসহ বহু বিচিত্র কবিতা আছে তার। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তার ভেতর প্রবল ধর্মবোধ এবং অনুশোচনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করছেনÑ“আমার বাল্য-কালের সরল ধর্ম বিশ্বাস কেড়ে নিলেন হাক্সলি এবং টিন্ড্যাল। সে জন্য আমি তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখতাম।” পরবর্তীতে খৃষ্টান ধমের্র আশ্রয় থেকে বঞ্চিত ইয়েট্স্ আইরিশ পুরাণ,কাব্যগাথা এবং আইরিশ লোক ঐতিহ্যের বিষয়াদি নিয়ে একটি নতুন ধর্মের কাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আয়ার্ল্যান্ডের সুদর্শনা এক তেজস্বিনী নারীর প্রেম ও আইরিশ বিপ্লবে জড়িয়ে জীবনের ব্যর্থতার উপর তার বেশ কিছু বেদনাঝরা কবিতাও লিখেছেন তিনি। যেমন ‘ব্রকেন ড্রিম্স’ নামের সুদীর্ঘ কবিতায় প্রেম নিসৃত বিরহ-কাতর অপ্রাপ্তির এক বেদনার আর্তি ফুটে উঠেছে স্বকরুণভাবে। জীবনের অনেক সাফল্য-ব্যর্থতার পরও তিনি হাল ছাড়েন নি। পথের সন্ধান করেছেন। যদিও অন্তরের ভিতর-বাইরের ব্যর্থতার কাব্যতিক্ত নৈরাশ্যের আমেজে কবি ইয়েট্স জীবনের অন্তিম দশক কাটিয়েছেন অনেকটা হতাশার মধ্যে। ঠিক তেমনি কবির মতোই দেখাহীন থেকে গেছে কতদিন দলকলসের ফুলেদের। তবুও হঠাৎ সবুজ শাড়িতে কাঁশফুলেদের মেলা দেখে নিভৃতে গোপাটে পথের ধারে, নিজের কলুষিত কোলাহলে বারবার জেগে উঠে ভুল করে ভুলেভালে ফেলে আসা সেইসব দূরন্ত দিনের অখ্যাতিমান সেই দলকলসের শৈশব। স্মৃতির ভর কেন যেন তেমন করে আমাদের ক্লান্ত করে, চোখের জল নামে অতীতের পিদিম নামে...তবুও প্রচন্ড অনিচ্ছায় আমরা মানুষেরা বিচরণ করি পৃথিবীতে। যদিও আঁধারে আঁধারে ভরে যায় উঠোন। বিহঙ্গ খন্ডিত করে সতেজ আকাশ। ওপাশের রোদটুকু চুপিচুপি হাসে ক্যাকটাস পাশে। তবুও জীবনে পদধ্বনি দেয় কত অনাকাঙ্খিত ভোর। তেমনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবনের সমস্ত কর্ম-সাধনার সারবস্তু ছিল মানুষ। আসল পথের সন্ধানে এক নিরন্তর সাধনা। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে শুরু করে আশি বছরের উপান্তে এসে তার সমগ শিল্প-সাহিত্যকর্ম কাব্য ও সংগীত রচনা তথা সকল কাজের সৃষ্টিশীলতা আজ অবধি নিজস্বগুণেই বিভাসিত হয়ে আছে। ইয়েট্স এর মতো রবীন্দ্রনাথও ধর্মসমাজ ও ধর্মবিশ্বাসের কোলে জন্মগ্রহন করেছিলেন এবং লালিত হয়েছিলেন। কিন্তু যৌবনকাল শেষ না হতেই আগেকার ধর্মবিশ্বাসের চৌহদ্দী থেকে বেরিয়ে তিনি চলে এলেন সামগ্রিকতায়। তেমনি মানতার কবি আমাদের জাতীয় চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও পান্থজন ও পথের সন্ধানে ছিল নিরন্তর প্রচেষ্টা। তিনি কবিতার মধ্যদিয়ে বলেছেনÑ“এক সে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু/একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু।” আরেক জায়গায় বলেছেনÑ“সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুজে/ স্রষ্টারে খোঁজÑআপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।” হিংসা-ক্রোধ আর ঘৃণাবোধ দিয়ে আসল পথ পাওয়া যায না। মানুষকে সর্বাত্মকভাবে গ্রহনের মধ্যদিয়েই সঠিক পথ ও পান্থজনের দেখা মেলে। তাই আমাদের একসুরে এক তালে বলতে হয় ; এক জীবনে আর কোন স্বপ্নের বিনাশ নয়; বিকাশ চাই কেননা স্বপ্নের ইতি যেখানে ঘটবে জীবন সেখানে শেষ হবেই...এটাই চিরায়ত সত্য... অনন্তের বিধান... তাই পাপ পঙ্খিলতা ঝেড়ে ফেলে আজ আলো ছড়িয়ে যাক সকল হৃদ্যতায়, আমরা পেরুবো অন্ধকারের পথ ভেঙ্গে ভেঙ্গে সত্য সুখের সন্ধানে। প্রজাপতির ডানার কুমকুম দিয়ে সকলের কপালে পড়াবো শান্তির টিপ; এসো খুলে ফেলি কাটাতারের বিভেদ। সম্মিলিত প্রয়াসে রচিত হবে আগামীর সোনালী ভোর। অন্ধকার ডুবে গেছে গতকাল। আজ কেবল আলোয় আলোয় আলোকিত হবার দিন। মানুষ আরো কিছু মানবিক হও; চেয়ে দেখো চোখ বন্ধ করলেই হাজারো চোখ চেয়ে থাকে। চোখের কুয়োয় উঠে আসে কালো দিন। রাত যদি ফুরিয়েই এলো চোখ বুঁজে আর কতকাল ঘুমাবে ? মনুষ্য সংকীর্ণতার সর্বস্ব ধুয়ে গিয়ে তুমুল বর্ষন হোক আজ। আজ এখানে ফুটুক ভালোবাসার সবকটি ফুল। আমরা এগিয়ে যাবো মেরুদন্ড সোজা রেখে নিপীড়িত রোদনের ছাপ উপেক্ষা করে। আমরা এগিয়ে যাবো বিষন্ন জোৎস্নার রাতে অগণিত আলেয়ার বেশে। আমরা এগিয়ে যাবো পঙ্গু করতে সকল আগামীর পাপ-পঙ্খিলতা। আমরা এগিয়ে যাবো শ্লোগানে – শ্লোগানে বোধের আগুন জ্বেলে। আমাদের স্বপ্নে জাগ্রত সর্বক্ষণথ মানুষের মঙ্গল হোক, সফল হউক সকল স্বপ্নের স্বপ্নসাধনা । স্বপ্নকাতর নজরুলও যে বলে গেছেন “মানুষেরে ঘৃণা করি, ওরা কারা কোরান বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!/ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পূজিছে গ্রন্থ, ভন্ডের দল।” ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মানুষকে সৌভ্রার্তৃত্বের মর্যাদায় স্থান দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেনÑ“এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান ! এস বৌদ্ধ/এস ক্রিশ্চায়ান! আমরা সব গন্ডি কাটাইয়া/ সব সঙ্কীর্ণতা সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করে, প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।” ইংরেজিতে লেখা ‘হৃদ মন্দির’ বইয়ের একটি অংশে মৃত্যুপথযাত্রী গুরুকে শিষ্যরা বলছেন, ‘আপনি কিছুতেই মরতে পারেন না। আপনি মরলে দেখার কী আছে? গুরুর উত্তর, সারা জীবনই আমি নদীর পানি মানুষের হাতে তুলে দিয়েছি, তাই তোমরা কখনোই নদী দেখতে পাওনি। আমার বিশ্বাস, মৃত্যুর পর তোমরা সেই নদীটিই দেখতে পাবে।’ পথের কথায় ফিরে আসি। পথের নিরন্তর প্রচেষ্টাই মানুষের কাজ। পৃথিবীর সেরা বিশ্ব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন অনেক। দীর্ঘ পথ, দুর্গম পথ পরিভ্রমন করে বিশ্বজয়ী তারেক, মুসা, নেপোলিয়ান কিংবা আলেজান্ডার কেউই শেষ পর্যন্ত পথ নিস্পন্ন করতে পারেন নি। পৃথিবীর অনেক বিচিত্র জয়ের মালা নিয়ে পথের কুল-কিনারার অতৃপ্তি নিয়েই একদিন তারাও এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অবিনশ্বরে। আর কবি গুরুর ভাষায়Ñ‘ পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!/এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে”। এত ব্যাকুলতা ও নৈরাশ্যের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন পরমের দিকে এগুবার পথ,পরমেশ্বরকে পাওয়ার পথ। এইতো মানুষের জীবন। পথ আর গন্তব্য শেষ না হতেই একদিন ঘটবে প্রস্থান। জীবনের আশা-প্রত্যাশা রিক্ততার বেশে শূন্যে মিশে যাবে। কিছুই রবে না এ- ভবে। জীবনের ক্ষীণালোক হবে ক্ষীণ থেকে আরো ক্ষীণতরÑ“অবশেষে মিলাবে আঁধারে।” কিন্তু তবু মানুষ তার গুণ সম্ভারের দীপ্তিদিয়ে জগতকে বিভাসিত করে যাবে। জীবনের ছায়াপথের কত স্মৃতি কত কীর্তি পড়ে থাকবে জগতময়। পথের দুরত্ব যতই হোক মানুষের পথ চলার শেষ নেই। এমুহুর্তে গালিবের একটি রোমান্টিক লাইন মনে পড়ছেÑ“স্বর্গের সত্য-মিথ্যা বেশ জানা আছে তবে/ মনকে ভোলাবার জন্য, গালিব কল্পনাটা মন্দ নয়।” তবুও মানুষের মন চেনা বড়ই কঠিন। শুধু বাহ্যিক দিকটা দেখে একজন মানুষকে বিচার করা যায়না। একজন মানুষের তলদেশ ঘেটে দেখে নেয়াটা বেশ সময় স্বাপেক্ষ ব্যাপার। মানুষের জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই মানুষ নামের মানুষটির সাথে কোন মানুষই না চায় একটা সুখময় অনুভূতি নিয়ে জীবনের যবনিকা টানতে। যখন কোমল, সুন্দর বুকভরা একরাশ সুখময় কল্পনার জালটা ছিঁড়ে তন্ন তন্ন হয়ে যায়, তখন পৃথিবীর সমস্ত কষ্টেরা এসে ভীঁড় করে জীবন মোহনায়, আর তখনি জমাট কষ্টের পাহাড়টা ভেঙ্গে খান-খান হয়ে যেতে চাইলেও আঁকড়ে ধরে রাখে অনন্ত জীবনের অন্বেষায়। তারপরেও মুক্তি পাওয়া যায়না। মানুষ নামের মায়াজালে তাই জীবন বন্ধনের কারাগারে আজন্ম বন্দি। কষ্টের নীড়ে বুকভাঙ্গা কান্নায় নিজের বুকের যন্ত্রণার জ্বালা কিছুটা লাঘব করা যায় কিন্তু মুক্তি পাওয়া যায়না কোনদিন...মৃত্যুঅবদি। তবুও একজীবনে বেঁচে বর্তে থাকতে মানুষকে দীর্ঘ পথপরিক্রমই করতে হয়। দীর্ঘ এই পথ যাত্রায় মানুষকে অনেক নাটকীয় জীবন শেষ করতে হয়। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ জীবনের পরেও মানুষকে অনেক অনেক দূরে যেতে হয়, একটি চরম ও পরম প্রাপ্তির আশায়। মানুষ সুন্দর এই পৃথিবীতে বুকভরা আশা ও ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়; রচনা করে বিশাল মায়ার জগত। এই জগত থেকে কেহ কোনদিন বিদায় নিতে চায়না, ইচ্ছেও করেনা আপনজনদের বিদায় দিতে। তবু তো অমোঘ নিয়মে চলে যেতে হয়। মানুষ তো আসে চলে যাবার'ই জন্য। চিরদিন মানুষকে ধরে রাখা যায়না পৃথিবীর কোন মায়ার বন্ধনে। কোন না কোন সময় এই বন্ধন ছিন্ন করতেই হয়, সেই সহজাত ধারাবাহিকতাতেই পাথর তলে যারা রেখে যায় জীবনের শেষ নিঃশ্বাষ-কষ্ট হলেও জানাতে হয় বিদায়ী সম্ভাসন। মন না চাইলেও বলতে হয় অনেক হয়েছে-এবার ঘুমাও। তোমাদের আত্মা শান্তি পাক। তোমরা ভালো থাক আকাশের তারা হয়ে আর আমরাও আসছি একে একে, হয়তো এমনও হতে পারে একসাথে দলবেঁধে। সৈয়দ আবু মকসুদ সহ-সম্পাদক দৈনিক আজাদী
সেই শৈশবে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে নতুন বছরের শুরুতে সকালের প্রথম অথচ মিষ্টি রোদে বসে মৃদুমন্দ হাওয়ায় নতুন ক্লাসের বাংলা বইয়ের গল্প-কবিতা পড়তাম, যদিও তখন স্কুল খোলেনি। হৈমন্তী, বিলাসী, পন্ডিত মশাই, আরো কত এক নিঃশ্বাসে শেষ করার মতো গল্প! তারপর স্কুল শুরুর আগে বইগুলোতে যতœকরে পুরানো ক্যালেন্ডারের পাতা দিয়ে মলাট লাগাতাম। বাংলাভাষী হিসাবে অতি গর্বের বিষয় হলো আমরা অসাধারণ অনেক কবি-সাহিত্যিক পেয়েছি। ক্লাসের বইয়ের বাইরের বই পড়ার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও স্কুলের পড়া ও মাঠে খেলাধুলা করার পর যে সময়টুকু থাকত তা মনের মতো করে কাটানোর জন্য বইয়ের অভাব হতো না। তেমনি অভাব কোনদিন দেখা যায়নি গুনগুন করে গাওয়া গানের রতœভান্ডার। ‘এই পৃথিবী পান্থশালা’ নামে বাংলা ভাষার একটি অমর এবং চিরায়ত গান আছে। ছোট বেলায় কোন এক সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা ছবিতে সেই যে শুনেছিÑ এখনো মনে আছে। কখনও গভীর রাতে কিংবা নির্জীব একাকীত্বে কেন যেনো অহরহ সে গানটি আজো হৃদয়ের মনিকোটায় বাজে। মানুষের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা লাভ-লোকসানের খতিয়ান যাই হোক এ নশ্বর পৃথিবী আসলেই তো একটি পান্থশালা। আর এই পৃথিবীর মানুষজন হচ্ছেন মুসাফির তথা পথিক। এই পথিক কিংবা পান্থজনের আগমন-নির্গমন আর ক্ষণিকের এই বিশ্বচরাচরে পথ চলা অত:পর চলে যাওয়া অবিনশ্বরে। স্রষ্টার এক অপার কুদরতে আমরা মানুষ হিসাবে জন্মেছি। আমরা তো পোকা-মাকড় কিংবা অন্য কোন প্রাণীরূপে এই পৃথিবীতে আসতে পারতাম। কিন্তু মহান স্রষ্টার কৃপা ও দয়ায় মানুষরূপেই আমাদের আবির্ভাব। মানুষ হিসাবে এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে। মানুষ পৃথিবীতে তার কর্তব্যবোধ নিয়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারলেই মানবতার গৌরব চিরত্ব ও স্থায়িত্ব লাভ করে। তখন কিসে পড়ি তা ঠিক মনে নেই। হুমায়ুন আহমেদের বই "নন্দিত নরকে” পড়েছিলাম। আমি অভিভূত হয়েছিলাম। জুলভার্নের বই যেমন আমাকে আগ্রহী করে তুলতো মহাকাশ বৈজ্ঞানিক হতে, হুমায়ুন আহমেদের সেই বই পড়ে সংকল্প করেছিলাম লেখক হব। স্টিফেন কিং এর স্মৃতিচারণ এর একটা বইতে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন যে লেখক তৈরী হয় না বরং কারো কারো মাঝে লেখক গঠিত হয়। হুমায়ুন আহমেদ তেমন একজন ছিলেন। পাঠক হিসাবে আমার দৃষ্টিতে এমন ঔপন্যাসিক শরত্চন্দ্রের পরে আর কেউ আসে নি। আবার হয়ত একশ বছরে এমন একজন ঔপন্যাসিক আমরা পেতে পারি। আমি তাঁর প্রতিটা বই পড়তাম প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে। এক বন্ধুর বদৌলতে। সে কিনতো। ওর পড়া শেষ হলে আমি ধার নিতাম। সে সিরিয়াস হয়ে বলতো, "আমার বিয়ের কার্ডে লিখে দেব - বই ছাড়া অন্য কোন উপহার গ্রহণযোগ্য নয়"। আমরা যা চাই তা পাই না। আমার বন্ধুও পায় নি। সে প্রেম করে বিয়ে করেছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় নি। তার বইও পাওয়া হয় নি। এটাই হয়তো জীবন !! জীবনের রহস্যময় পথ যার সন্ধান অনাদিকাল থেকেই মানুষ করে চলেছে। কিন্তু কী সেই সঠিক পথ? কারো বেলায় পথের সন্ধান মিলেছে। কারো মিলে নি। অনেকেই পথহারা হতে হতে নি:শেষ হয়ে চলে গেছেন অন্য জগতে। পথের বিষয়ে কুরআন পাকের প্রথম সুরা ফাতিহায় মানুষের সঠিক পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। ইসলামে বিশ্বাসী মাত্রেই সেই পথের অনাবিল সন্ধান চলছে বিরামহীন ভাবে। বিশ্বনবী(দ) বলেছেন Ñ“সত্য এবং ন্যায়ের পথই আসল পথ”। তিনি আরো বলেছেনÑ“যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়, মানুষের মধ্যে সেই সর্বোত্তম”। আবার শ্রীগীতায় আছে-“ভালো কাজ করলে ইহলোক ও পরলোক কোথাও তার বিনাশ হতে পারে না।” বাইবেলে আছেÑ“ মন্দের বিনিময়ে মন্দ করো না। সকল মানুষের দৃষ্টিতে যা উত্তম ভেবে-চিন্তে তাই করো”। আর ত্রিপিটকের বাণীতে আছে-“যে সৎপথে চলে, অন্যায় করে না, পরস্ব অপহরণ করে না, মানুষের মনে দু:খ দেয় না, জীব হত্যা করে না;এইরূপ ব্যক্তিদেরকে আমি নির্বাণ লাভ করাই”। সব কিছুর উর্দ্ধে হচ্ছে মানুষ। মানুষরূপে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য সঠিক পথের সন্ধানে সর্বদা ব্যাকুল থাকতে হবে। প্রচেষ্টা থাকতে হবে। আর পথিক মাত্রেই তার জন্য প্রয়োজন উত্তম সঙ্গীর, দরকার একজন ভাল বন্ধু; পান্থজনের সাথী। কিন্তু প্রশ্নটাইতো এখানেই এই সখীর আবির্ভাব হবে কখন!!! প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই যখন একজন কিশোর দেখে, অসম্ভব রাগী বাবা বেদম পেটাচ্ছে তার মাকে; নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে সে হয় খুনি হবে, নয়তো বাবার মতোই নারী নির্যাতন করে আনন্দ পাবে। অপরাধ জগৎ নিয়ে মনস্তত্ত্ববিদদের গবেষণা বিস্তর। একজন কিশোরের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি। যারাই পরিবারের কিংবা সমাজের আজ অভিভাবক, তারাই জন্মলগ্ন থেকে কচিমনকে শৈশবেই মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, স্নায়ুবিকভাবে দেউলিয়া করছে কোন না কোনভাবে সে হউক ইচ্ছাতে কিংবা অনিচ্ছা। তাইতো বিশ্বাস ব্যপারটা আজ আমাদের কাছে অনেক দূরের পথÑপঙ্খীলতা আমাদের কুড়ে কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত যা কাম্য নয় আমাদের কারোরই। তবুওতো চলতে হয় পথ। অবচেতন মনে প্রশ্নের উদ্রেগ হয় প্রকৃত বন্ধু কিংবা পান্তজনের সাথীকে চেনার উপায় কী ? ডা: লুৎফর রহমান বলেছেনÑ“বন্ধুকে বন্ধুভাবেই মনে করবে,তাকে বিশ্বাস করবে,আর কোন বিচার করবে না। জগতে প্রকৃত বন্ধু একান্ত দুর্লভ।” হযরত আলী(র) বলেছেনÑ“ পথ চলা ও দীর্ঘ ভ্রমনের জন্য প্রয়োজন হয় একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর।” এমারসন বলেছেনÑ“ প্রতিটি মানুষ বন্ধুত্বের সন্ধানে জীবন কাটিয়ে দেয়।” এ বিষয়ে একটি চিরন্তন গানের কলি সর্বদাই প্রাণে বাজে Ñ“ বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও/মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে এঁকে নিও।” এভাবেই মানুষের পথের সাথী, জীবনের প্রকৃত বন্ধুকে পাওয়ার আকুতি প্রকাশিত হয়ে এসেছে জগতময়। মানুষের জীবন-যৌবন-বার্ধক্য তথা সর্বোপরি জীবনবোধের ভাবনাবৃত্তে আনন্দ-বেদনার কতো বর্ণময় চিত্র আছে। কেউ জীবনকে আরাম-আয়াশে বিচিত্র রসোত্তীর্ণ এবং মাধুর্য মিশিয়ে ভোগ করেন। আবার কেউ বা তার উল্টো। অল্পতেই তুষ্টি, এই দর্শনের উপরে অনেকেই বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন। ডব্লিউ বি ইয়েট্স্ একজন বড় কবি ছিলেন। বিশ্ব বিখ্যাত এই ইংরেজ কবি সমাজ ও ধর্মবিশ্বাসের কোলে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কবিতায় ডুবে যান। যৌবনের শুরু থেকেই জীবন কাব্যের আনন্দ-বেদনা,প্রেম-বিরহ,দু:খবোধও হতাশাসহ বহু বিচিত্র কবিতা আছে তার। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তার ভেতর প্রবল ধর্মবোধ এবং অনুশোচনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করছেনÑ“আমার বাল্য-কালের সরল ধর্ম বিশ্বাস কেড়ে নিলেন হাক্সলি এবং টিন্ড্যাল। সে জন্য আমি তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখতাম।” পরবর্তীতে খৃষ্টান ধমের্র আশ্রয় থেকে বঞ্চিত ইয়েট্স্ আইরিশ পুরাণ,কাব্যগাথা এবং আইরিশ লোক ঐতিহ্যের বিষয়াদি নিয়ে একটি নতুন ধর্মের কাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আয়ার্ল্যান্ডের সুদর্শনা এক তেজস্বিনী নারীর প্রেম ও আইরিশ বিপ্লবে জড়িয়ে জীবনের ব্যর্থতার উপর তার বেশ কিছু বেদনাঝরা কবিতাও লিখেছেন তিনি। যেমন ‘ব্রকেন ড্রিম্স’ নামের সুদীর্ঘ কবিতায় প্রেম নিসৃত বিরহ-কাতর অপ্রাপ্তির এক বেদনার আর্তি ফুটে উঠেছে স্বকরুণভাবে। জীবনের অনেক সাফল্য-ব্যর্থতার পরও তিনি হাল ছাড়েন নি। পথের সন্ধান করেছেন। যদিও অন্তরের ভিতর-বাইরের ব্যর্থতার কাব্যতিক্ত নৈরাশ্যের আমেজে কবি ইয়েট্স জীবনের অন্তিম দশক কাটিয়েছেন অনেকটা হতাশার মধ্যে। ঠিক তেমনি কবির মতোই দেখাহীন থেকে গেছে কতদিন দলকলসের ফুলেদের। তবুও হঠাৎ সবুজ শাড়িতে কাঁশফুলেদের মেলা দেখে নিভৃতে গোপাটে পথের ধারে, নিজের কলুষিত কোলাহলে বারবার জেগে উঠে ভুল করে ভুলেভালে ফেলে আসা সেইসব দূরন্ত দিনের অখ্যাতিমান সেই দলকলসের শৈশব। স্মৃতির ভর কেন যেন তেমন করে আমাদের ক্লান্ত করে, চোখের জল নামে অতীতের পিদিম নামে...তবুও প্রচন্ড অনিচ্ছায় আমরা মানুষেরা বিচরণ করি পৃথিবীতে। যদিও আঁধারে আঁধারে ভরে যায় উঠোন। বিহঙ্গ খন্ডিত করে সতেজ আকাশ। ওপাশের রোদটুকু চুপিচুপি হাসে ক্যাকটাস পাশে। তবুও জীবনে পদধ্বনি দেয় কত অনাকাঙ্খিত ভোর। তেমনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবনের সমস্ত কর্ম-সাধনার সারবস্তু ছিল মানুষ। আসল পথের সন্ধানে এক নিরন্তর সাধনা। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে শুরু করে আশি বছরের উপান্তে এসে তার সমগ শিল্প-সাহিত্যকর্ম কাব্য ও সংগীত রচনা তথা সকল কাজের সৃষ্টিশীলতা আজ অবধি নিজস্বগুণেই বিভাসিত হয়ে আছে। ইয়েট্স এর মতো রবীন্দ্রনাথও ধর্মসমাজ ও ধর্মবিশ্বাসের কোলে জন্মগ্রহন করেছিলেন এবং লালিত হয়েছিলেন। কিন্তু যৌবনকাল শেষ না হতেই আগেকার ধর্মবিশ্বাসের চৌহদ্দী থেকে বেরিয়ে তিনি চলে এলেন সামগ্রিকতায়। তেমনি মানতার কবি আমাদের জাতীয় চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও পান্থজন ও পথের সন্ধানে ছিল নিরন্তর প্রচেষ্টা। তিনি কবিতার মধ্যদিয়ে বলেছেনÑ“এক সে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু/একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু।” আরেক জায়গায় বলেছেনÑ“সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুজে/ স্রষ্টারে খোঁজÑআপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।” হিংসা-ক্রোধ আর ঘৃণাবোধ দিয়ে আসল পথ পাওয়া যায না। মানুষকে সর্বাত্মকভাবে গ্রহনের মধ্যদিয়েই সঠিক পথ ও পান্থজনের দেখা মেলে। তাই আমাদের একসুরে এক তালে বলতে হয় ; এক জীবনে আর কোন স্বপ্নের বিনাশ নয়; বিকাশ চাই কেননা স্বপ্নের ইতি যেখানে ঘটবে জীবন সেখানে শেষ হবেই...এটাই চিরায়ত সত্য... অনন্তের বিধান... তাই পাপ পঙ্খিলতা ঝেড়ে ফেলে আজ আলো ছড়িয়ে যাক সকল হৃদ্যতায়, আমরা পেরুবো অন্ধকারের পথ ভেঙ্গে ভেঙ্গে সত্য সুখের সন্ধানে। প্রজাপতির ডানার কুমকুম দিয়ে সকলের কপালে পড়াবো শান্তির টিপ; এসো খুলে ফেলি কাটাতারের বিভেদ। সম্মিলিত প্রয়াসে রচিত হবে আগামীর সোনালী ভোর। অন্ধকার ডুবে গেছে গতকাল। আজ কেবল আলোয় আলোয় আলোকিত হবার দিন। মানুষ আরো কিছু মানবিক হও; চেয়ে দেখো চোখ বন্ধ করলেই হাজারো চোখ চেয়ে থাকে। চোখের কুয়োয় উঠে আসে কালো দিন। রাত যদি ফুরিয়েই এলো চোখ বুঁজে আর কতকাল ঘুমাবে ? মনুষ্য সংকীর্ণতার সর্বস্ব ধুয়ে গিয়ে তুমুল বর্ষন হোক আজ। আজ এখানে ফুটুক ভালোবাসার সবকটি ফুল। আমরা এগিয়ে যাবো মেরুদন্ড সোজা রেখে নিপীড়িত রোদনের ছাপ উপেক্ষা করে। আমরা এগিয়ে যাবো বিষন্ন জোৎস্নার রাতে অগণিত আলেয়ার বেশে। আমরা এগিয়ে যাবো পঙ্গু করতে সকল আগামীর পাপ-পঙ্খিলতা। আমরা এগিয়ে যাবো শ্লোগানে – শ্লোগানে বোধের আগুন জ্বেলে। আমাদের স্বপ্নে জাগ্রত সর্বক্ষণথ মানুষের মঙ্গল হোক, সফল হউক সকল স্বপ্নের স্বপ্নসাধনা । স্বপ্নকাতর নজরুলও যে বলে গেছেন “মানুষেরে ঘৃণা করি, ওরা কারা কোরান বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!/ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পূজিছে গ্রন্থ, ভন্ডের দল।” ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মানুষকে সৌভ্রার্তৃত্বের মর্যাদায় স্থান দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেনÑ“এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান ! এস বৌদ্ধ/এস ক্রিশ্চায়ান! আমরা সব গন্ডি কাটাইয়া/ সব সঙ্কীর্ণতা সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করে, প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।” ইংরেজিতে লেখা ‘হৃদ মন্দির’ বইয়ের একটি অংশে মৃত্যুপথযাত্রী গুরুকে শিষ্যরা বলছেন, ‘আপনি কিছুতেই মরতে পারেন না। আপনি মরলে দেখার কী আছে? গুরুর উত্তর, সারা জীবনই আমি নদীর পানি মানুষের হাতে তুলে দিয়েছি, তাই তোমরা কখনোই নদী দেখতে পাওনি। আমার বিশ্বাস, মৃত্যুর পর তোমরা সেই নদীটিই দেখতে পাবে।’ পথের কথায় ফিরে আসি। পথের নিরন্তর প্রচেষ্টাই মানুষের কাজ। পৃথিবীর সেরা বিশ্ব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন অনেক। দীর্ঘ পথ, দুর্গম পথ পরিভ্রমন করে বিশ্বজয়ী তারেক, মুসা, নেপোলিয়ান কিংবা আলেজান্ডার কেউই শেষ পর্যন্ত পথ নিস্পন্ন করতে পারেন নি। পৃথিবীর অনেক বিচিত্র জয়ের মালা নিয়ে পথের কুল-কিনারার অতৃপ্তি নিয়েই একদিন তারাও এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অবিনশ্বরে। আর কবি গুরুর ভাষায়Ñ‘ পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!/এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে”। এত ব্যাকুলতা ও নৈরাশ্যের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন পরমের দিকে এগুবার পথ,পরমেশ্বরকে পাওয়ার পথ। এইতো মানুষের জীবন। পথ আর গন্তব্য শেষ না হতেই একদিন ঘটবে প্রস্থান। জীবনের আশা-প্রত্যাশা রিক্ততার বেশে শূন্যে মিশে যাবে। কিছুই রবে না এ- ভবে। জীবনের ক্ষীণালোক হবে ক্ষীণ থেকে আরো ক্ষীণতরÑ“অবশেষে মিলাবে আঁধারে।” কিন্তু তবু মানুষ তার গুণ সম্ভারের দীপ্তিদিয়ে জগতকে বিভাসিত করে যাবে। জীবনের ছায়াপথের কত স্মৃতি কত কীর্তি পড়ে থাকবে জগতময়। পথের দুরত্ব যতই হোক মানুষের পথ চলার শেষ নেই। এমুহুর্তে গালিবের একটি রোমান্টিক লাইন মনে পড়ছেÑ“স্বর্গের সত্য-মিথ্যা বেশ জানা আছে তবে/ মনকে ভোলাবার জন্য, গালিব কল্পনাটা মন্দ নয়।” তবুও মানুষের মন চেনা বড়ই কঠিন। শুধু বাহ্যিক দিকটা দেখে একজন মানুষকে বিচার করা যায়না। একজন মানুষের তলদেশ ঘেটে দেখে নেয়াটা বেশ সময় স্বাপেক্ষ ব্যাপার। মানুষের জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই মানুষ নামের মানুষটির সাথে কোন মানুষই না চায় একটা সুখময় অনুভূতি নিয়ে জীবনের যবনিকা টানতে। যখন কোমল, সুন্দর বুকভরা একরাশ সুখময় কল্পনার জালটা ছিঁড়ে তন্ন তন্ন হয়ে যায়, তখন পৃথিবীর সমস্ত কষ্টেরা এসে ভীঁড় করে জীবন মোহনায়, আর তখনি জমাট কষ্টের পাহাড়টা ভেঙ্গে খান-খান হয়ে যেতে চাইলেও আঁকড়ে ধরে রাখে অনন্ত জীবনের অন্বেষায়। তারপরেও মুক্তি পাওয়া যায়না। মানুষ নামের মায়াজালে তাই জীবন বন্ধনের কারাগারে আজন্ম বন্দি। কষ্টের নীড়ে বুকভাঙ্গা কান্নায় নিজের বুকের যন্ত্রণার জ্বালা কিছুটা লাঘব করা যায় কিন্তু মুক্তি পাওয়া যায়না কোনদিন...মৃত্যুঅবদি। তবুও একজীবনে বেঁচে বর্তে থাকতে মানুষকে দীর্ঘ পথপরিক্রমই করতে হয়। দীর্ঘ এই পথ যাত্রায় মানুষকে অনেক নাটকীয় জীবন শেষ করতে হয়। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ জীবনের পরেও মানুষকে অনেক অনেক দূরে যেতে হয়, একটি চরম ও পরম প্রাপ্তির আশায়। মানুষ সুন্দর এই পৃথিবীতে বুকভরা আশা ও ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়; রচনা করে বিশাল মায়ার জগত। এই জগত থেকে কেহ কোনদিন বিদায় নিতে চায়না, ইচ্ছেও করেনা আপনজনদের বিদায় দিতে। তবু তো অমোঘ নিয়মে চলে যেতে হয়। মানুষ তো আসে চলে যাবার'ই জন্য। চিরদিন মানুষকে ধরে রাখা যায়না পৃথিবীর কোন মায়ার বন্ধনে। কোন না কোন সময় এই বন্ধন ছিন্ন করতেই হয়, সেই সহজাত ধারাবাহিকতাতেই পাথর তলে যারা রেখে যায় জীবনের শেষ নিঃশ্বাষ-কষ্ট হলেও জানাতে হয় বিদায়ী সম্ভাসন। মন না চাইলেও বলতে হয় অনেক হয়েছে-এবার ঘুমাও। তোমাদের আত্মা শান্তি পাক। তোমরা ভালো থাক আকাশের তারা হয়ে আর আমরাও আসছি একে একে, হয়তো এমনও হতে পারে একসাথে দলবেঁধে। সৈয়দ আবু মকসুদ সহ-সম্পাদক দৈনিক আজাদী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন