মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প - লতিফ জোয়ার্দার

ধুসর কিছু স্মৃতির অন্তরালে বাদামি দুটি মন
লতিফ জোয়ার্দার

ব্যস্ত নগরীর ফুটপাত ধরে পথ চলতে চলতে, মনে হলো কে যেন পিছন থেকে ডাকছে আমায়। থমকে দাঁড়ালাম, মাথাটা ঘুড়িয়ে তাকানোর পূর্বে কেন জানি মনে হলো! আমি হয়তো ভুল শুনেছি। এখানে আমাকে কে চেনে! চেনাজানা তেমন কারো কথা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। আবার ছুটতে শুরু করি, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকি আমি। মনে হলো সেই মানুষটাও আমার পিছু নিয়েছে। কয়েক কদম যেতে আবার সেই সুমিষ্ট কন্ঠের আহবান শুনতে থাকি। আবার থমকে দাঁড়াই... এবার আর না তাকিয়ে পারি না। আমার সামনে তখন মধ্য বয়সী এক নারী। নাদুসনুদুস চেহারা। মেকাপের ভিড়ে প্রকৃত অবয়ব হারাতে বসেছে। কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। কে এই নারী। কিছু সময় একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ টিপ টিপ করতে থাকে। অথচ কিছুতেই পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না। আগন্তুক নারী আমাকে বলতে থাকে।
Ñ তুমি মনে হয় আমাকে চিনতে পারোনি। আর চিনবার কথাও না। কতদিন আগের কথা। বছর কুড়িতো হবেই।
কথা বলতে বলতে থেমে যায় ভদ্র মহিলা। কিছু সময় আবার তাকিয়ে থাকে। কিছু মানুষ আমাদের ধাক্কা দিয়ে নিজের পথ তৈরি করে ছুটে চলেছে, যার যার গন্তব্যে। দুরন্ত ছুটে চলা এ নগরী, কখনো থেমে থাকে না। অবিরত ছুটতেই থাকে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে আলাপ করা বেশ কঠিন। কিন্তু আমার তখন বেশ তাড়া! সামনে থেকে রিকসা নিয়ে কমলাপুর যেতে হবে। তিনটা দশে রাজশাহী গামী সিল্কসিটি ট্রেন। ধরতে না পারলে আজ নিশ্চয় বাড়িতে পৌঁছাতে পারবো না আর।
Ñ দেখুন আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, আর সেই সময়ও আমার নেই, আর ঘন্টা দেড়েক পর আমার বাড়িতে যাওয়ার ট্রেন, ধরতে না পারলে! আমাকে এই নগরীতে থেকে যেতে হবে। আর থাকবো! তেমন পরিচিত কেউ নেই আমার এখানে। তবে ইচ্ছে করলে হোটেলে থেকে যেতে পারি কিন্তু হোটেলে থাকতে হলে যে পরিমান অর্থ প্রয়োজন তার অর্ধেকও নেই আমার পকেটে।
আবার সে কথা বলতে শুরু করে। এমন ভাবে কথা বলতে থাকে যেন, সে আমার কত দিনের চেনা।
Ñ সত্যি! তুমি আমাকে চিনতে পারোনি! আমি রোজী... এক সাথে এক কলেজে দু’বছর পড়েছি গো। বলো এখনো তুমি আমাকে চিনতে পারোনি।
আমি তখনো হাবার মতো চেয়ে থাকি। স্মৃতির ডাটা কেবল্স গুলো দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। রোজী! কোন রোজী। রোজী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।
Ñ ও বুঝেছি! তুমি আমাকে এখনো চিনতে পারোনি। চলো! সামনে যে কোন একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে কিছু সময় বসি, সেখানেই বাদ বাকি কথা সেরে ফেলা যাবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ।
Ñ আপনাকে তো বলেছি, আমার তাড়া আছে, ট্রেন ধরতে হবে।
আমার এসব কথায় তার কোন ছোঁয়া লাগেনা। রোজী তবুও নাছোর। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছু সময় তাকে দিতেই হবে। কিছু বলার জন্য ওর ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে। মুখের অভিব্যক্তি গুলো দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।
Ñ তবে চলো। তোমার সাথে আমিও না হয় ষ্টেশন পর্যন্ত যাই। আর রিকসায় যেতে যেতে কথা বলি।
Ñ আপনি আমার সাথে! কী বলছেন। মাথা ঠিক আছে তো।
Ñ কেন! তোমার কোন সমস্যা আছে?

আমরা রিকসার জন্য সামনে এগুতে থাকি। সবেমাত্র প্রেসক্লাবের সামনে আমরা। এখান থেকে রিকসা নিলে দিগুন টাকা গুনতে হবে, সে কারণে আমার ইচ্ছে ছিলো দৈনিক বাংলার মোড় থেকে রিকসা নিবো। কয়েক কদম যেতেই রোজী একটা রিকসা ডেকে বসে।
Ñ এই রিকসা কমলাপুর যাবা।
Ñ যামু! তয় আশি টাকা লাগবো।
Ñ টাকা কোন সমস্যা না। যাবা কিনা বলো।
কথা বলতে বলতে রোজীর সাথে রিকসার চড়ে বসি। বেশ ঘুরে যেতে হবে কমলাপুর। রোজী আমার শরীরের সাথে লেপটে বসে আছে, আমার মুখের দিকে মুখ নিয়ে কথা বলছে।
Ñ শফিক! তোমার মুখের পোড়া দাগটা দেখি অবিকল ঠিক তেমনি আছে। কেমন আছো তুমি!
আমি কথা বলবো কী! অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে থাকি। কী যে হয়েছে আমার! পুরনো কিছুই ঠিক ঠাক মতো মনে করতে পারি না। এক সিগনালে আমাদের রিকসা তখন আটকে আছে। লাল বাতি হলুদ বাতি অতঃপর সবুজ বাতি জ্বললেই আমরা যেতে পারবো। কতক্ষণ যে, এ অবস্থায় থাকতে হবে কে জানে!
আমি সবকিছু মনে করার চেষ্টা করি। এক রোজীর কথা, তখন আবছা মনে আসছে আমার, কিন্তু সে তো এমন মোটা ছিলো না। একেবারে লিকলিকে। মনে হতো বাতাসে উড়ে যাবে। পাখির মতো কেমন যেন উড়ে উড়ে বেড়াতো সারাদিন। সেই রোজী কী! মেলানোর চেষ্টা করি। কিছুতেই মেলে না। সেই চুল সেই হাসি, কোন কিছুতেই কোন মিল খুঁজে পাই না। রোজীর দীঘল লম্বা চুল আর সাথে লাগাতার হাসি। আর সেই রোজী না হলে... এমন করে আর কে এখানে চিনবে আমায়! লম্বা মুখটা মাংশের ভারে গোল হয়ে গেছে। আর চুল ছেটে ববকার্ট করেছে রোজী। আমার দিকে তাকিয়ে, কেমন যেন হো হো করে হাসতে থাকে রোজী।
Ñ কী ব্যাপার! এখনো তুমি আমাকে...। হাই কপাল আমার... যার সাথে একবার কথা বলতে পারলে ধন্য হতো শফিক সহ কতজন... সে আমাকে এখন চেনে না। সত্যি করে বলোতো... তুমি আমাকে চিনতে পারোনি! নাকি, চিনে না চেনার ভান করছো। তবে এটা ঠিক, আমি তখন এমন ছিলাম না। এমন মোটা বেঢপ চেহারা ছিলো না আমার।
রোজী! সেই রোজী, আমাদের কাদের স্যারের মেয়ে রোজী। যাকে একটা গোলাপ দেবার জন্য কতদিন প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেছি রাস্তায়। সেই রোজী! যার একটু ভালোবাসা পাবার জন্য হন্নে হয়ে তার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরেছি। কী কপাল আমার! সেই রোজী এখন আমার সামনে! অথচ...
আমার চোখ জলে ভিজে ওঠে। বিষণœ হয় চারিপাশ। একটা অদ্ভুত স্মৃতি এসে দোলা দিয়ে যায়। আমি তাকে চিনতে পারাতে, চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। পুরো মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় । এই প্রথম রোজীর মুখের দিকে ভালো করে চাইলাম আমি। কালো শাড়িতে মেচিং ব্লাউজ,তার দুধ আলতা রঙের শরীরের সাথে এমন ভাবে ফুটে আছে যে, অন্য রকম এক শিহরণ দিচ্ছে আমায়। ভেতর থেকে সাদা ব্রা উকি দিয়ে যাচ্ছে। তার নরম কমল শরীর এসে আমাকে মোহগ্রস্থ করে দিচ্ছে। তবে আর যাই হোক! সেই আগের রোজী আর নেই। সেই দুরন্ত চঞ্চল অদ্ভুত মায়াবী মেয়েটি। কলেজে সবার দৃষ্টি আটকে যেতো যার চোখে।

Ñকী ব্যাপার থমকে গেলে মনে হয়।
Ñ থমকে যাবার কথা কী নয়। এতদিন পড়ে আবার তোমার দেখা পাব কোনদিন ভাবতে পেড়েছি। যার জন্য কত অস্থির বিকেল, আমাকে ব্যথার দোলায় দোলাতো। যার জন্য থমকে যেতো সময়। এখন আমার সব মনে পড়ছে। বাস্তবিক সংসার নামক অদ্ভুত বস্তুটার সাথে আমি কিছুতেই পেরে উঠছি না আর। অভাবের সাথে সংগ্রাম করে কতদিন টিকে থাকা যায় বলো। দুই ছেলে আর এক মেয়ে আমার। একজন মেডিকেলে, আর দুজন কলেজে। আমার ছোটখাট ব্যবসা দিয়ে আর কুলাতে পারছি না। তাই জায়গা জমি বিক্রি করে, বিদেশ যাবার জন্য তিন লক্ষ টাকা দিয়েছি এক দালাল কে।
বিদেশতো! পাঠাতেই পারলোই না। এখন টাকাগুলো নিয়ে পায়তারা শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে রোজী অন্য রকম হতে থাকে। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা ব্যথার পাহাড় নিয়ে পিছন ফরে চায়।
চোখ ছলছল করে ওঠে। মনে মনে ভাবতে থাকে, এই সেই শফিক! যে কিনা তার একটু ভালোবাসা পাবার জন্য কত রকম চেষ্টা করে যেতো। সেই চিঠির কথা আজো মনে আছে তার। ছোট্র দুই লাইনের সে কী আবেক। একটা বই পড়তে নিয়েছিলাম ওর থেকে। সেখানেই ছিলো...



রোজী
তোমায় নিয়ে বুকের ভেতর হয় যে তোলপাড়
জানি তুমি! একদিন হবে যে আমার।

কী যে মাদকতা এখনো মনে হলে উলোট পালোট হয় সব। কিন্তু তখন আমি অলরেডি আরেক জনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ওদিকে শফিককে কষ্ট দেবার মতো অবস্থা আমার ছিলো না। তাকে দেখলেই মুচকি একটা হাসি দিয়ে ব্যস্ততার ভান করে পালিয়ে যেতাম। কখনো কখনো একটু আদটু সময় দিতাম তাকে। এতেই মনে হতো সে যেন স্বর্গ পেয়েছে। কলেজের ক্লাস আমার ভালো লাগতো না। মামুনের সাথে মোটরবাইকে লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পড়তাম। সেই বয়সেই মামুন বিয়ের জন্য অস্থির হতো। কতদিন বুঝিয়ে রেখেছি। মামুন আমার দু-ইয়ার সিনিয়র। কলেজে রাজনীতি করতো। বাম রাজনীতি তার রক্তের সাথে মিশে যেতে থাকলো। রাতদিন মিছিল মিটিং। রাত করে বাড়ি ফেরা। দিনে দিনে আমাকে সময় দেওয়া কমিয়ে দিলো মামুন। তখন এরশাদ হটাও আন্দোলন তুঙ্গে। সবদল এক হয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ হটাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। সবাই যেন সমস্ত ভয় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সিপাহীদের তপ্ত কন্ঠ তাদের দমাতে পারে না। তাদের গুলির ভয়ে কেউ রাজপথ ছাড়ে না। একজন বুক পেতে দিলে! আরো দশজন মিছিলে এসে যোগ দেয়। সর্বপুরি সব মানুষের একটাই দাবী। স্বৈরাচারী এরশাদ তুই কবে যাবি!

দেখতে দেখতে এইচ.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা সামনে চলে এলো। রাতদিন পড়াশুনায় ব্যস্ত তখন আমি। শফিকের সাথেও তেমন একটা দেখা সাক্ষাত হতো না আমার। পরীক্ষার দুদিন আগে একবার দেখা হলো শফিকের সাথে। আমি তখন প্রবেশপত্র নেবার জন্য কলেজে গিয়েছি মাত্র। সামনে এসে দাঁড়ালো শফিক। ও হয়তো সেজন্যই এসেছে। চোখের ভাষা বিনিময় হলো। সাথে দু’চারটি কথা। মনে হলো ভালো নেই শফিক। বেশ উসকো খুসকো চেহারা। মনে হচ্ছে শরীরে কতদিন জলের পরশ পড়েনি।
Ñ শফিক, কী হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন?
Ñ না! তেমন কিছু না। ভেবো না। ভালো আছি আমি।
আমার নিকট সবকিছু এড়িয়ে গেল শফিক। বড্ড কষ্ট পেলাম। মামুন দূরে সরে যাচ্ছে দিনেদিনে,্ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। আমাকে ছাড়তে পারবে কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে যেতে পারবে না কোনদিন। ওদিকে শফিক নিজেকে মনে হলো গুটিয়ে নিচ্ছে।
কোন মতো পরীক্ষাটা পার করে ঢাকাতে চলে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য, কোচিং-এ ক্লাস করা শুরু করলাম। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম লেখাপড়া নিয়ে। ভুলে যেতে চাইলাম পিছন সব স্মৃতি। কোথায় পড়ে থাকলো মামুন আর কোথায় শফিক।

মাঝে মাঝে এখনো বেশ মনে পড়ে শফিক আর মামুনের কথা। যখন মনটা বড় বেশি বিষণœ হয়। কোন কাজে মন বসে না। মন হারিয়ে যায় তেপান্তরের ওপারে, তখনই বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে। এখানে আমি সব পেয়েছি, বড় লোক স্বামী, দামী গাড়ি বাড়ি সব। কিন্তু সেই কলেজ জীবনের সেই বাদামি স্মৃতি এখনো আমায় কাঁদায়। এখনো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই ছোট্ট শহর ঈশ্বরদীতে। রেললাইন ধরে ছুটে চলা মাইলের পর মাইল। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এখনো কী সে শহর তেমনি আছে। শফিক মনে হয় ফিরে গিছে পুরনো সেইদিনে। স্মৃতির রাস্তা ধরে পিছন ফিরে চাইছে শফিক।

আবার দু’জনই বেশ কিছু সময় চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। সিগনাল ছেড়ে আবার রিকসা চলতে শুরু করেছে। এক সময় আবার আমরা ফিরে যাব, যে যার যার গন্তব্যে। আবার একাকিত্ব আবার স্মৃতির রশি ধরে টানাটানি। কথা বলতে শুরু করি আমি।
Ñ একটা কথা বলবো রোজী?
Ñ বলো?
Ñ তুমি কী সেদিন আমাকে! সত্যিই...
এটুকু বলে আর কিছু বলতে পারি না। থমকে যাই। রোজীর চোখ থেকে তখন জল গড়িয়ে পড়ে। আরার নিশ্চুপ আমরা। আবার নিস্তব্ধ আমরা। রিকসা চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়। ভাড়া মিটিয়ে আমরা ষ্টেশনের ভেতরে যেতে থাকি। ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে নির্দিষ্ট লাইনে। কিছু সময় পর আবার যাত্রা শুরু করবে। রোজী একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে যেতে চাইলে। আমি ওর হাত ধরে ফেলি। কিছুতেই কান্না শামাল দিতে পারে না রোজী। আমার হাতের মধ্য থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এগুতে থাকে। আমি চেয়ে থাকি রোজীর যাত্রা পথে...