মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সিনেমা : মাহদী হাসান

ফার্স্ট/চীফ অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের কাজ কি?
মাহদী হাসান



একজন ডিরেক্টরের সর্বোচ্চ কতোজন অ্যাসিস্টেন্ট থাকবে সে ব্যাপারে কোনো সীমা পরিসীমা নেই। শিক্ষানবীস হিসেবে অনেকেই থাকতে পারে। তবে, কমার্শিয়াল সিনেমায় একজন ডিরেক্টরের অধীনে সাধারনত ৩ থেকে ৫ জন অ্যাসিস্টেন্ট থাকে। এর মাঝে কোন অ্যাসিস্টেন্ট সরাসরি ডিরেক্টরকে অ্যাসিস্ট না করে কোনো অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরকে (এডি/AD) সহযোগীতা করে থাকে। এই যেমন, Second Second Assistant Director (22AD) এর কাজ হলো সেকেন্ড এডি কে সাহায্য করা। দেশ ভেদে এটা আবার ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, সেকেন্ড সেকেন্ড এডি’র প্রচলন মুলত নর্থ আমেরিকায় দেখা যায়। ব্রিটেন বা অস্ট্রেলিয়াতে 22AD পদ না রেখে বরং তারা আরেকজন সেকন্ড এডি রাখেন; এই সেকেন্ড এডিকে অন্য সেকেন্ড এডি’র সমপরিমান দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে। (উকিপিডিয়া)

বলা হয়ে থাকে, একটা ফিল্ম বানাতে একজন ডিরেক্টরের প্রথমেই একজন ভালো অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের প্রয়োজন পড়ে। সহজ ভাষায়, একজন ডিরেক্টরের হয়তো ভালো সিনেমাটোগ্রাফার রয়েছে, ভালো কাস্টিং করা হয়েছে, ভালো ক্রু মেম্বার রয়েছে – কিন্তু ভালো অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর না থাকলে এদের মাঝে লিঁয়াজো রাখা প্রায় অসম্ভব (যখন টিম অনেক বড় থাকে)।

আপনি যদি কোনো প্রফেশন্যাল শুটিং স্পটে যান, তাহলে দেখবেন একজন সবাইকে অর্ডার দিয়ে দিয়ে তটস্থ রাখছে, ক্রু থেকে কাস্ট পর্যন্ত সবাইকে মুভিং (moving) এর উপর রেখেছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন উনি ডিরেক্টর, তাহলে ভুল করবেন। উনি আসলে ফার্স্ট অথবা চীফ অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর (ফার্স্ট এডি)... সংক্ষেপে, সেট এর দায়িত্ব থাকেন ফার্স্ট এডি। কোনো ক্রু মেম্বার এমনকি কাস্ট ও তার উপর কথা বলবেন না; কারন তারা জানেন যে ফার্স্ট এডি কাজ করছেন ডিরেক্টরের সরাসরি নির্দেশে।

চীফ এডি’র প্রধান রোল কি? আমরা অনেকেই ফিল্মে কাজ করতে ইচ্ছুক। অনেকেই ডিরেক্টরকে অ্যাসিস্ট করি পরিচালনার বিষয়বস্তুগুলো নখদর্পনে আনার জন্য। কিন্তু, অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে আমরা কি সঠিক কাজগুলো করছি? অথবা এভাবে জিজ্ঞেস করা যায় – এডি হিসেবে আমরা কি আমাদের কাজগুল সঠিকভাবে করছি? আসুন দেখে নেই চীফ অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের প্রধান রোলগুলো কি কি। চীফ এডি’র প্রধান দায়িত্বগুলোকে দুইভাবে ভাগ করা যায়। একঃ প্রি-প্রোডাকশন রোল; দুইঃ প্রোডাকশন রোল।

প্রি-প্রোডাকশন রোলঃ
  • শিডিউল তৈরী করা। বিস্তারিতভাবে লিখে রাখা কোন দিন কয়টার সময় কোন শট নেয়া হবে এবং সেসময় সেটে কারা কারা থাকবে। উল্লেখ্য, হলিউডে শুটিং চলাকালে প্রতিদিন সকালে ডিরেক্টরের নিকট স্টুডিও থেকে একটা শিট আসে যেটাতে ঐদিন কারা কারা কোন কোন চরিত্র প্লে করছে এবং স্ক্রিপ্টের কোন অংশ শুট করা হবে ইত্যাদী লেখা থাকে। এটাকে বলা হয়ঃ দৈনিক ডাকাডাকি কাগজ (ডেইলি কল শিট).. স্টুডিও এই কাজটি করে থাকলেও এটা মুলত চিফ এডির কাজ। বাংলাদেশের পারস্পেক্টিভে এই কাজটি চিফ এডির কাজ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
  • স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করে ফেলা। ডিরেক্টরের পরে যদি কারো মাথায় সম্পূর্ন স্ক্রিপ্ট থেকে থাকে, তাহলে সেটা চিফ এডির মাথায়। গল্পটাকে ডিরেক্টর কিভাবে দেখছে, সেটা জানাও জরুরী চিফ এডির জন্য।
  • স্ক্রিপ্টকে ভাগ করা। যেহেতু গল্পের গতি অনুযায়ী শুট করা হয়না, বরং অভিনেতা/অভিনেত্রীদের শিডিউল, সময়, লোকেশন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে স্ক্রিপ্ট এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে শুট করা হয়ে থাকে, সেহেতু সেসব বিষয় বিবেচনা করে স্ক্রিপ্ট ভাগ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও,
  • চিফ এডি সকল ডিপার্টমেন্টের প্রধানের সঙ্গে ডিরেক্টরের লিঁয়াজো তৈরীতে সাহায্য করে থাকে। যেমন, ক্যামেরা ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্ট এডি জেনে নেয় কি ধরনের ইক্যুপমেন্ট প্রয়োজন ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টের।
  • হলিউডে কাস্টিং এর কাজ করে থাকে স্টুডিও ও কাস্টিং ডিরেক্টর, এবং অ্যাক্টর/অ্যাক্ট্রেসদের শিডিউল নিয়ে সেটাকে জেনারেট করে কল শিট তৈরী করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশে চীফ এডি অভিনেতা/অভিনেত্রীদের সাথে যোগাযোগ করে উনাদের শিডিউল নিয়ে কাজ করেন।

প্রোডাকশন রোলঃ
  • ফার্স্ট এডি সবার নিকট নিজেকে পরিচিত করে শুটিং এর প্রথমদিনেই। সবাইকে জানিয়ে দেয়, যে কোনো সমস্যা বা প্রয়োজনে যেনো তাকে নক করা হয়। ডিরেক্টর চাইবেনা শুটিং এর সময় রানারের (টি-বয়) কোনো সমস্যা অথবা লাইট ভাড়া নিয়ে কোনো সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে। ডিরেক্টরকে যদি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় তাহলে টোটাল প্রোডাকশনে অর্থাৎ ফাইনাল পিকচারে সেটার প্রভাব পড়বে; এবং অবশ্যই তা নেগেটিভ প্রভাব হবে।
  • ফার্স্ট এডি হচ্ছে সেট এর ‘ভয়েস’ অর্থাৎ, তাকে প্রচুর দৌড়ুতে হয়, প্রচুর পরিমানে কথা বলতে হয়। ফার্স্ট এডি অ্যাক্টিভ থাকা মানে পুরো সেট অ্যাক্টিভ। আর তিনি ইনঅ্যাক্টিভ থাকলে সেট এর অন্যান্য ক্রু মেম্বার ইনঅ্যান্টিভ মুডে চলে যাবে।
  • ফার্স্ট এডিকে ব্লকিং দেখতে হয়। অ্যাক্টির মার্কিং, শট ব্লকিং, ক্রু ব্লকিং ইত্যাদী দেখার দায়িত্ব ফার্স্ট এডির। অবশ্যই, ডিরেক্ট্র শট ব্লকিং সম্পর্কে ফার্স্ট এডিকে বিশদ ধারনা দিয়ে রাখে।
  • ব্লকিং শেষে টেকনিশিয়ানরা কাজে নেমে পড়ে। সিনেমাটোগ্রাফার ততক্ষনে লাইটিং কিভাবে হবে সেটা জেনে যায়; লাইটম্যানরা লাইট সেট করে ফেলে। ফাইনাল তাচ দেয় আর্ট ডিরেক্টর।
  • যখন সবকিছু রেডি, তখন ফার্স্ট এডিকে সবাই ইনফর্ম করে। ফার্স্ট এডি ডিরেক্টরকে ইনফর্ম করে।
  • ক্যামেরা রোলিং করার শুরু করার আগে সেট এর সবাইকে ফার্স্ট এডি ‘quiet’ বা ‘silence’ বা ‘silent’ বা ‘সব চুপ’ বলে চুপ করাবেন। ক্যামেরা রোলিং সাউন্ড রোলিং ইত্যাদী বলে অ্যাকশন ও বলবেন ফার্স এডি। এক্ষেত্রে অবশ্য সবসময় ফার্স্ট এডি অ্যাকশন বা কাট বলে থাকেন এমন নয়; বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ডিরেক্টর বলে থাকেন। অন্তত উপমহাদেশে ডিরেক্টর অ্যাকশন ও কাট বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে, ডিরেক্টর চুপ করে শুধু অব্জার্বেশন করেন অনেকক্ষেত্রেই; সেক্ষেত্রে ফার্স্ট এডির দায়িত্ব হলো অ্যাকশন ও কাট বলা। এরপর ডিরেক্টরের সাথে কনফার্ম করে শট ওকে হয়েছে এটাও জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ফার্স্ট এডির।
  • কোন শট এনজি (নট গুড) হলে ক্রু মেম্বারদের আবার শতের শুরুর পজিশনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ফার্স্ট এডির।
  • শিডিউল ঠিক রাখার দায়িত্ব ফার্স্ট এডির। এর জন্য যদি ক্রু মেম্বারদের একটু দ্রুত কাজ সারতে হয়, সেটা দেখার দায়িত্বও ফার্স্ট এডির।
  • ফার্স্ট বা চীফ এডি সকল ডিপার্টমেন্টের হেডের সাথে কথা বলে লাঞ্চ টাইম বা স্ন্যাক্স টাইম কিছুক্ষন পিছিয়ে দিতে পারেন শট এর প্রয়োজনে।

যেসব স্কিল থাকা প্রয়োজনঃ
  • টিম লীড দেবার ক্ষমতা
  • মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগ রাখার ক্ষমতা
  • প্ল্যান তৈরী করার ক্ষমতা
  • সমস্যার ফলপ্রসু সমাধান দেবার ক্ষমতা
  • দূরদর্শীতা
  • কম্পিউটার দক্ষতা
  • অন্যকে মোটিভেইট করার ক্ষমতা
  • বাজেট ও শিডিউল নিয়ে বিশদ ধারনাঅর্গানাইজড ও ফ্লেক্সিবল
  • প্রচন্ড চাপে মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা

শুটিং সেটে চীফ এডি’র পদখানি সত্যিকার অর্থে অমূল্য কিন্তু প্রায়ই উপেক্ষিত। অর্থাৎ, ফার্স্ট এডি ছাড়া একটা বড় সেট অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, বেশীরভাগ সময় ডিরেক্টরদের ঝাড়িগুলো প্রথমে ফার্স্ট এডিকেই খেতে হয়। তবে, ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে সব কাজ যে নিজেকেই করতে হবে এমন নয়; তার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকতে পারে। এছাড়া, সেকেন্ড ও থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরও তার অধীনে কাজ করতে পারে।

ডিরেকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বই পত্র পড়ে শেখা যায়না। আপনাকে কাজ করে শিখতে হবে। প্রফেশন্যাল লাইফে আপনাকে শুরুতেই কেউ ফার্স্ট এডি বানাবে না। আপনি যদি একেবারেই নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বা রানার বা টি-বয় হিসেবে কাজ শুরু করতে পারেন। উল্লেখ্য, কোনো কাজই ছোট নয়। প্রতিটি কাজ সমান গুরুত্বপূর্ন। আলফ্রেড হিচকক তার ফিল্ম ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু করেছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে।


স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক