মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সিরিজ কবিতা - বিধান সাহা

রুহুচণ্ডালের বায়স্কোপ
বিধান সাহা



০১.

এসো। এসো এইখানে। এইখানে তুমুল বিষাদ। এইখানে নীল আগুনের ফুলকি ওড়ায় যে অনুরাগী, সে-ই ছিলো আজ্ঞাবহ তোমার যুবক। তার প্রার্থনা ও প্রতীকের আড়ালে, দেখ ঐ, নিদারুণ ভেসে যাচ্ছে রূপোর বুদ্বুদ। কিছুটা বেড়াল স্বভাব আর প্রতিবন্ধুর মগজের ব্লু-প্রিন্ট, এর বাইরে, আর কোন সত্য জেনেছিলে? পরিযায়ী পাখিরা এসেছে আজ। চলেও যাবে। তোমার কাজল চোখে তবু থেকে যাবে যুগপৎ ঘুণ ও ঘুমের কোলাজ। থেকে যাবে ছদ্মবেশ, রস ও রূপকে আড়াল।

তোমার সিথানে রাখা আছে স্বেচ্ছাতুর কাঠি, পৈথানে কাচের কলস আর প্রহরায় সুচতুর কাব্য-প্রতারক! ডালিমকুমার আজ নগরের প্রিয়পরিহাস!


০২.

ভীষণ ক্ষত নিয়ে যে পাগলটা শাহবাগের মোড়ে গান গায়, উলঙ্গ শুয়ে থাকে, মুখে এঁটো-ভাতের কণা আর লালা-মিশ্রিত শশ্রু নিয়ে ঘুরে বেড়ায়- সে-ই কেবল জানে, কোন সংগুপ্ত বেদনার ধারালো ড্যাগার নিয়ে এ নগরে পা রাখে তরুণ কবি। সে-ই কেবল জানে, বাংলা একাডেমী থেকে ফেরার পথে কেন বৃষ্টি আর কান্না একে অপরের সম্পূরক হয়ে ওঠে!


০৩.

একা একা একটি বটগাছ দীর্ঘ-জন্মের শাপ নিয়ে একাডেমী চত্তরে নিঃসঙ্গ কেঁদে যাচ্ছে। হাওয়ার ঘুর্নিতে ফেঁসে যাচ্ছে রমনার শুকনো পাতা, আর একটি আর্ত বিড়াল আশ্রয়হীন ঘুরে বেড়াচ্ছে কুয়াশা-মোড়ানো নগরের পথে পথে।

এইসব দৃশ্যের শেষে, আয়নাতে দেখি আমার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না!


০৪.

ঘুম আসেনা। এখন মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ শীৎকার ধ্বনি শোনা যায়। অথচ যৌথতার সেই সমবায়ে আমি নেই। এক অতি-অচেনা ছায়া দংশন করে রোজ। আর সে খিল খিল হেসে ওঠে। সেই তরঙ্গ-ধ্বনিতে মূর্ছা যায় চেনা বন্দরের বহু-পুরাতন নাবিক। স্পষ্ট দেখতে পাই, কামনা-কিরিচ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ল্যাংটা-জাদুকর! তার বুকের কাছে ঝোলানো এক আসমানি আয়না। যেখানে হরদম ফুটে উঠছে রিপা তলাপাত্রের মুখ, আমার গোপন দূর্বলতা, আর হাত ফসকে ছুটে যাওয়া সেই কবন্ধ-মোরগ।

আমার কান্না পায়। মনমরা এক তিতির পাখি উড়ে আসে। তাকে বলি-- ও পাখি, এই নে যৌন-কিতাব। রক্তমঞ্চে যদি তার সাথে দেখা হয়, বলিস তাকে, এক আশ্চর্য বেদনার নীলনদী পার হয়ে এই পারে ফেলেছি তাঁবু। ব্যালে-নর্তকীরা মাঝে মাঝে আসে এখানে আর আসে এক বয়স্ক শৃগাল। তারা আমার নামের পাশে রেখে যায় কয়েকশ অগ্নি-কারাগার। বলে-- জন্ম আসলে এক বৃথা আয়োজন, অসংখ্য একক আর একে বিভাজন। মান্য বা অমান্য নয়, আমি সবস্মিয়ে এইসব কথার মর্ম উদ্ধার করতে করতে হেঁটে যাই বরফের দেশে। দেখি হাঁঠু-ভাঙ্গা দ-এর মতো সেখানে বসে আছে ওপাড়ার অনন্ত ঠাকুর। তৈলক্ষ্য পূজার ফাঁকে যিনি প্রায়ই সিদ্ধি-অভিযান চালাতেন। আর সমর্পণের ছলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেন।

ভেবেছিলাম ভুলে যাব সব। কোথায় কী! মায়া-প্রাসাদের বাইরে দেখি ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধ ভিক্ষুক আর তার রসবতী মেয়ে। এই দেখে হেসে ফেলে কামদেব। অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আর শো শো শব্দে তেড়ে আসে বায়ুদৈত্য। সেই অন্ধ-সুন্দরীর তামাটে ঘরে জমে ওঠে নৈশ-মজলিশ। তার নিরঞ্জন মুখের উপর বিজলী-চমকের মতো ফুটে ওঠে পাপ ও প্রতিহিংসা। কেউ কারো নই, তবু তার দেহের মুদ্রা ও মন্থনে ভয়ানক ভোর হয় রোজ!

ঘটনা আসলে কিছুই নয়, বাগানের বাইরে, আকীর্ণ পথের ধারে একদিন পেয়েছিলাম সাপিনীর ডিম। সেই থেকে আমার ফুলাকাঙ্ক্ষা আর মৈথুনেচ্ছা সমান্তরাল লাল হয়ে আছে!


০৫.

আমি অতো-শত বুঝি না কবি! কইফিয়তও চাই না। জানতে চাই না, সমস্ত উদ্দীপক লেখার পরে তোমার চোখের কোনে যে অশেষ নীরবতা নেমে আসে, তার প্রান্তে দাঁড়িয়ে কিভাবে একটা এক্সলামেটরি তোমাকে সংকেত-সঙ্গমী করে তোলে।

কেবল জানি, উপযুক্ত বয়সে, বৃষ্টির ভেতর হেঁটে যাওয়ার সময়ই কান্না করা ভালো।


০৬.

ও জল, আজ তোর কথা শুনবো। মেঘরে, আজ তুই একা-ই বলে যা-- দক্ষিণে বাবুদের বাড়ি, উত্তরে নরসুন্দরপাড়া, মাঝখানে শিমুল গাছের যে ব্যক্তিগত প্রোফাইল, তার ভেতর পাখিটির ছোট এক বাসা। তুই তো জানিস মেঘ-- ভার্চুয়াল নগরে তার নামে একটা গাঁদা ফুলের গাছ বুনেছি। তার পাশেই রসভৈরবী নামে আমার এক ছোট চারচালা। তাবৎ ভব-নাটকের শেষে পাখিটা এখানে এসে দাঁড়াতো খানিক। তারপর কথায় ও কল্পনায় উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে তারপর আরো উড়তে উড়তে স্বপ্নের উড়ন্ত লগ্নে হঠাৎ লগআউট হয়ে মিলিয়ে যেত রূঢ় ব্যস্ততায়।

পাখিটার জন্য আজ শোক। পথে পথে আজ তাই উধাও বনস্পতি আর ভার্চুয়াল ঘরভর্তি থোকা থোকা সাইলেন্স।

ও পাখি, ডাক নামে একবার শিষ দিয়ে যা...