অঞ্জন আচার্য
কবিতা লিখি কেন
কেনো লিখি? বিশেষ করে কবিতা? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়শই আমাকে হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকি। উত্তর যে নেই তা কিন্তু নয়। আছে। উত্তরটি বরং রবীন্দ্রনাথের ওপর চাপিয়ে দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথের তাঁর পঞ্চভূত গ্রন্থের পরিচয় প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছিলেন- “জীবন এক দিকে পথ আঁকিয়া চলিতেছে, তুমি যদি ঠিক তার পাশে কলম হস্তে তাহার অনুরূপ আর একটা রেখা কাটিয়া যাও, তবে ক্রমে এমন অবস্থা আসিবার সম্ভাবনা, যখন বোঝা শক্ত হইয়া দাঁড়ায়- তোমার কলম তোমার জীবনের সমপাতে লাইন কাটিয়া যায়, না তোমার জীবন তোমার কলমের লাইন ধরিয়া চলে। দুটি রেখার মধ্যে কে আসল কে নকল ক্রমে স্থির করা কঠিন হয়। জীবনের গতি স্বভাবতই রহস্যময়, তাহার মধ্যে অনেক আত্মখণ্ডন, অনেক স্বতোবিরোধ, অনেক পূর্বাপরের অসামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু লেখনী স্বভাবতই একটা সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিতে চাহে। সে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা করিয়া, সমস্ত অসামঞ্জস্য সমান করিয়া, কেবল একটা মোটামুটি রেখা টানিতে পারে। সে একটা ঘটনা দেখিলে তাহার যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে উপস্থিত না হইয়া থাকিতে পারে না। কাজেই তাহার রেখাটা সহজেই তাহার নিজের গড়া সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে, এবং জীবনকেও তাহার সহিত মিলাইয়া আপনার অনুবর্তী করিতে চাহে।” অর্থাৎ নিজের জীবনের রেখার পাশে কলমের রেখা দেওয়ার জন্যই হয়ত লিখি। সত্যিকার অর্থে আমার কিছু বলার আছে যা সবার সাথে ভাগাভাগি করার। ভাবনাগুলো তাই লিপিবদ্ধ করি। বলা যায় ভাবনার বুদ্বুদগুলো মস্তিষ্ক থেকে প্রসব করি মাত্র।
তবে কবিতাই যে কেন লিখি তা আমার কাছে অনেকটা রহস্যময়। হয়ত সহজ কথা সহজভাবে বলতে পারি না বলেই কবিতার রহস্যময়তার আশ্রয় নেই। আসলে আমার ভাবনাগুলোই ছন্দবদ্ধ হয়ে ধরা দেয় মাথার ভেতর। মোটা দাগে বলতে গেলে, আমি কবিতা লিখি না, কে যেন আমাকে দিয়ে লেখায় কবিতা। ভাবনা-বুদ্বুদগুলো খুব সংক্ষিপ্ত; অথচ বিস্তৃত অর্থবহ। যেমন আমার একটি কবিতার লাইন এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। কবিতাটি মাত্র দু লাইনের- “আগুন পোড়ায় না হাত/ হাত পোড়ে আগুনে।” এ দিয়ে কী বোঝা গেল? আসলে আমরাই আগুনের কাছে যাই। পুড়ে অঙ্গার হই। কাব্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন- “...কাব্যের আনুষঙ্গিক ফল যাহাই হউক কাব্যের উদ্দেশ্য উপকার করিতে বসা নহে। যাহা সত্য যাহা সুন্দর তাহাতে উপকার হইবারই কথা, কিন্তু সেই উপকারিতার পরিমাণের উপর তাহার সত্যতা ও সৌন্দর্যের পরিমাণ নির্ভর করে না। সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলিয়া সুন্দর নহে, সুন্দর বলিয়াই উপকার করে।” আমিও তাই মনে করি।
পৃথিবীর কোনো কিছুই সাধনা ছাড়া হয় বলে আমার মনে হয় না। কবিতা তার বাইরের কিছু নয়। প্রতিনিয়ত সাধনার ফলেই নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গড়ছি আজো। প্রতিভা-ফতিভা বলে কিছু থাকলে, তা থাকতে পারে। আমি তার ওপর নির্ভর করে বসে নেই। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে লেখা আর আজকের লেখার মধ্যে এই যে আমি বিস্তর ফারাক দেখতে পাই- তা তো সাধনারই ফল। যদি সেসময়ের লেখাকে এখনও কালজয়ী ভেবে বসে থাকতাম, তাহলে কুয়োর ব্যঙ হয়ে বেঁচে থাকতে হতো। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ জলের উপর জলছাপ-এর অনেক লেখাই এখন আমার কাছে লেখা মনে হয় না। প্রথম সন্তানের প্রতি একটু আলাদা দরদ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বলে তার কোনো ত্রুটি থাকতে পারবে না- তা ভাবা অন্যায়। আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল সেই সাক্ষ্যই বহন করে। নিজেকে নিজের থেকে ক্রমাগত অতিক্রম করা মানেই তো জীবনের সার্থকতা। আর লেখালিখি তো জীবনেরই এক অংশ। যারা কলম-শ্রমী তাদের কাছে লেখা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ জীবনের।
তবে কবিতার পাঠকই কবিদের বাঁচিয়ে রাখে যুগের পর যুগ। তাদের স্মৃতিকোষেই বেঁচে থাকে কবিতার পঙ্ক্তি। তারা তো ইতিহাসের নীরব বাহক। আজ যাদের কবিতা আমরা পড়ি কিংবা শুনি, তার অনেকাংশ প্রশংসার দাবিদার ওই পাঠকেরা। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতার পাঠকরা একটু ভিন্নতর। তারা কবিতার মতোই সংবেদনশীল। সবাই কবিতা পড়েন না। তারাই কবিতা পড়েন যারা সত্যিকার অর্থেই কবিতা ভালোবাসেন। জীবননান্দ যেমন বলেছিলেন- “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।” কবিতা তো তেমনই। পৃথিবীতে যদি একজনও আমার কবিতার পাঠক থেকে থাকে- আমি তার জন্যই কবিতা লিখে যেতে চাই আমৃত্যু। মৃত্যুর আগে অন্তত এ ভেবে শান্তি পাবো, যে অন্তত একজনের কাছে আমি কবিতার মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে পেরেছি।
ধানমণ্ডি, ঢাকা ১২০৯
কেনো লিখি? বিশেষ করে কবিতা? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়শই আমাকে হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকি। উত্তর যে নেই তা কিন্তু নয়। আছে। উত্তরটি বরং রবীন্দ্রনাথের ওপর চাপিয়ে দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথের তাঁর পঞ্চভূত গ্রন্থের পরিচয় প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছিলেন- “জীবন এক দিকে পথ আঁকিয়া চলিতেছে, তুমি যদি ঠিক তার পাশে কলম হস্তে তাহার অনুরূপ আর একটা রেখা কাটিয়া যাও, তবে ক্রমে এমন অবস্থা আসিবার সম্ভাবনা, যখন বোঝা শক্ত হইয়া দাঁড়ায়- তোমার কলম তোমার জীবনের সমপাতে লাইন কাটিয়া যায়, না তোমার জীবন তোমার কলমের লাইন ধরিয়া চলে। দুটি রেখার মধ্যে কে আসল কে নকল ক্রমে স্থির করা কঠিন হয়। জীবনের গতি স্বভাবতই রহস্যময়, তাহার মধ্যে অনেক আত্মখণ্ডন, অনেক স্বতোবিরোধ, অনেক পূর্বাপরের অসামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু লেখনী স্বভাবতই একটা সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিতে চাহে। সে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা করিয়া, সমস্ত অসামঞ্জস্য সমান করিয়া, কেবল একটা মোটামুটি রেখা টানিতে পারে। সে একটা ঘটনা দেখিলে তাহার যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে উপস্থিত না হইয়া থাকিতে পারে না। কাজেই তাহার রেখাটা সহজেই তাহার নিজের গড়া সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে, এবং জীবনকেও তাহার সহিত মিলাইয়া আপনার অনুবর্তী করিতে চাহে।” অর্থাৎ নিজের জীবনের রেখার পাশে কলমের রেখা দেওয়ার জন্যই হয়ত লিখি। সত্যিকার অর্থে আমার কিছু বলার আছে যা সবার সাথে ভাগাভাগি করার। ভাবনাগুলো তাই লিপিবদ্ধ করি। বলা যায় ভাবনার বুদ্বুদগুলো মস্তিষ্ক থেকে প্রসব করি মাত্র।
তবে কবিতাই যে কেন লিখি তা আমার কাছে অনেকটা রহস্যময়। হয়ত সহজ কথা সহজভাবে বলতে পারি না বলেই কবিতার রহস্যময়তার আশ্রয় নেই। আসলে আমার ভাবনাগুলোই ছন্দবদ্ধ হয়ে ধরা দেয় মাথার ভেতর। মোটা দাগে বলতে গেলে, আমি কবিতা লিখি না, কে যেন আমাকে দিয়ে লেখায় কবিতা। ভাবনা-বুদ্বুদগুলো খুব সংক্ষিপ্ত; অথচ বিস্তৃত অর্থবহ। যেমন আমার একটি কবিতার লাইন এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। কবিতাটি মাত্র দু লাইনের- “আগুন পোড়ায় না হাত/ হাত পোড়ে আগুনে।” এ দিয়ে কী বোঝা গেল? আসলে আমরাই আগুনের কাছে যাই। পুড়ে অঙ্গার হই। কাব্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন- “...কাব্যের আনুষঙ্গিক ফল যাহাই হউক কাব্যের উদ্দেশ্য উপকার করিতে বসা নহে। যাহা সত্য যাহা সুন্দর তাহাতে উপকার হইবারই কথা, কিন্তু সেই উপকারিতার পরিমাণের উপর তাহার সত্যতা ও সৌন্দর্যের পরিমাণ নির্ভর করে না। সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলিয়া সুন্দর নহে, সুন্দর বলিয়াই উপকার করে।” আমিও তাই মনে করি।
পৃথিবীর কোনো কিছুই সাধনা ছাড়া হয় বলে আমার মনে হয় না। কবিতা তার বাইরের কিছু নয়। প্রতিনিয়ত সাধনার ফলেই নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গড়ছি আজো। প্রতিভা-ফতিভা বলে কিছু থাকলে, তা থাকতে পারে। আমি তার ওপর নির্ভর করে বসে নেই। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে লেখা আর আজকের লেখার মধ্যে এই যে আমি বিস্তর ফারাক দেখতে পাই- তা তো সাধনারই ফল। যদি সেসময়ের লেখাকে এখনও কালজয়ী ভেবে বসে থাকতাম, তাহলে কুয়োর ব্যঙ হয়ে বেঁচে থাকতে হতো। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ জলের উপর জলছাপ-এর অনেক লেখাই এখন আমার কাছে লেখা মনে হয় না। প্রথম সন্তানের প্রতি একটু আলাদা দরদ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বলে তার কোনো ত্রুটি থাকতে পারবে না- তা ভাবা অন্যায়। আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল সেই সাক্ষ্যই বহন করে। নিজেকে নিজের থেকে ক্রমাগত অতিক্রম করা মানেই তো জীবনের সার্থকতা। আর লেখালিখি তো জীবনেরই এক অংশ। যারা কলম-শ্রমী তাদের কাছে লেখা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ জীবনের।
তবে কবিতার পাঠকই কবিদের বাঁচিয়ে রাখে যুগের পর যুগ। তাদের স্মৃতিকোষেই বেঁচে থাকে কবিতার পঙ্ক্তি। তারা তো ইতিহাসের নীরব বাহক। আজ যাদের কবিতা আমরা পড়ি কিংবা শুনি, তার অনেকাংশ প্রশংসার দাবিদার ওই পাঠকেরা। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতার পাঠকরা একটু ভিন্নতর। তারা কবিতার মতোই সংবেদনশীল। সবাই কবিতা পড়েন না। তারাই কবিতা পড়েন যারা সত্যিকার অর্থেই কবিতা ভালোবাসেন। জীবননান্দ যেমন বলেছিলেন- “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।” কবিতা তো তেমনই। পৃথিবীতে যদি একজনও আমার কবিতার পাঠক থেকে থাকে- আমি তার জন্যই কবিতা লিখে যেতে চাই আমৃত্যু। মৃত্যুর আগে অন্তত এ ভেবে শান্তি পাবো, যে অন্তত একজনের কাছে আমি কবিতার মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে পেরেছি।
ধানমণ্ডি, ঢাকা ১২০৯
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন