মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গুচ্ছ কবিতা - ওবায়েদ আকাশ

বাংলাদেশে একদিন ইংলিশ রোড নামকরণ হলো
ওবায়েদ আকাশ


আমার নাম দাও শিবপোকা। শিবপোকা মানে, একটি নতুন পোকার নামকরণের ক্ষমতা।... তুমি করো দোয়েলের চাষ। দোয়েল কি পরিযায়ী নাম? ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো সেবার বর্ষায় ছিল সাদারঙ হয়ে। আমি জানি, এ প্রকার জলসাদা ব্যাঙ পৃথিবীতে কখনো ছিল না। এমন ব্যাঙরঙ ধরে যখন ভোর হয়, আবার কৈবর্তপাড়ায় ভেঙে যায় রাজ্যের নিয়ম। কেমন আফিমগন্ধে বাজারের আঁশটের ভেতর আমি শিব শিব করে পোকা হয়ে উড়ি তোমার তালাশে।... তুমি করো দোয়েলের চাষ।... ভালো ছাইরঙ বোঝো।... মেটে কলসি, লাউয়ের খোঁড়লে কী গভীর সুর তুলে আনো। তোমাকে জানাই তাহলে, আমাদের ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো আমার জিহ্বার তল থেকে একদিন তুলে নিয়ে গেছে সমস্ত লালা। সেই থেকে সুরহারা হয়ে শীতল শস্যের মতো তোমাকে সযত্নে রাখি ঘরের নিভৃত কোণে। তুমি তো জানো, কতোটা বেসুরো হলে হাটের গুঞ্জন ওড়ে আকাশে বাতাসে



ধানক্ষেতের পুবালি বাতাসে


কারো কাছে আমার সংসারের আয়-ব্যায়ের
হিসাব থাকবার কথা নয়

আমি যদি সীতার দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে
দুচোখ দিয়ে কয়েক লক্ষ গ্যালন
অশ্রুপাত করে থাকি

তাতে আমার সংসারের আয়-ব্যায়ের ওঠানামা নিয়ে
কার এমন দায় পড়েছে যে ভাবতে বসে যাবে?

কিংবা প্রিন্সেস ডায়নার মৃতদেহ জুড়ে
কত লক্ষ টন পুষ্পার্ঘ্য বর্ষিত হলো

সে-সব ভাবনার ওঠানামা জুড়ে
কতবার আমার সংসারের আয়ব্যায়ের হিসাব
গেঁথে দেয়া হলো তা-ও তো কখনো ভাবল না কেউ!

আমি এখন খোলা গায়ে খোলা মাঠে
গলায় গামছা পেঁচিয়ে পোয়াতি ধানক্ষেতের
ভেতর দিয়ে হাঁটি
গোলাভরা ধানের সম্ভাবনার মতো
আমার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ফুলেফেঁপে ওঠে

আমার হাতে আমার স্ত্রীর স্বপ্নের সাধ
সন্তানের জামা-জুতো-খেলনার দাবি
আজ দেখো ধানক্ষেতের পুবালি বাতাসে দুলছে...



প্রকৃতিপুত্র



ভাবতে গেলে তুমিই একদিন
আমাদের হারানো শেকড়, হারানো চুল, বয়সভেদে
ছোট হয়ে আসা পরিত্যক্ত পোশাকের ধরন, ছায়াভিত্তিক
ঘাসের আকৃতি, বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা মাঠ
আলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ধানক্ষেতে পড়ে যাবার স্মৃতি
একদিন ডেওয়া ফলের ঘ্রাণের মতো ফিরিয়ে দিতে পারো

যখন সাঁকোর কম্পন দেখে বুঝে নিতাম
মাছেদের হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি, স্রোতের প্রবাহ দেখে মনে হতো
ভেসে যাচ্ছে সম্রাট দারায়ুস কিংবা স্কাইলাক্সের অধিকৃত রাজত্বের ধ্বংসাবশেষ
আর যত্রতত্র অশ্বদৌড় দেখে মনে পড়ত
সেই সকল ক্রীতদাস ব্যবস্থার প্রবর্তক, যাদের
ঐসব দুরন্ত অশ্বের লেজে জুড়ে দিয়ে
ঘোরানো হচ্ছে কাঁটাঝোপ, বনবাদাড়, তপ্ত মরুভূমি
একদিন আলোছায়ার নক্ষত্রের মতো
তুমিই তার ভালমন্দ, উঁচুনিচু শিখিয়ে নিতে পারো

যখন মাথার ওপর সুস্নিগ্ধ মেঘের পরিচ্ছদ দেখে
মনে হতো প্রাগৈতিহাসিক কুশলীরাজ কিংবা প্রাচীন গ্রীসীয়
স্থাপত্যপ্রেমিক কোনো রাজরাজড়ার মহান কীর্তির কথা
কিংবা মনে পড়ে যেতÑ গাছে গাছে বিবিধ কূজন আর বর্ণালি ফলের
আস্ফালন দেখে ইবনে বতুতার চোখে অপ্সরী ও গন্ধর্বের পরম সংসার; আর
অতল সুখের এই পলিধৌত সুশীল রাজ্যের মতো স্বর্গীয় মাতৃভূমির কথা

ভাবতে গেলে একদিন তুমিই তার আগাপাছতলা দেখে ফেলেছিলে
আজ আবার পুনরুদ্ধারিত গৌরবের মতো
তারই কিছু গ্রহণ বর্জন সুখ স্মৃতি অনায়াসে তুলে ধরতে পারো জানি



হালখাতা


সুদীর্ঘ বর্ষায় দেখো
তোমার মাথার নিচে গজিয়েছে শামুকের চারা
তারা সব ঝুলে ঝুলে
বেবাক নিয়েছে বুঝে চুলের ব্যাপার

আমি এক মৃত নগরের শব
কাঁধে করে নিয়ে যাই পারস্য নগরে
যেতে যেতে কেউ দেখে, হালখাতা এসে গেছে
আমারও রয়েছে কিছু কারবারি দেনা
শবখানা নড়েচড়ে দেখে
পারস্য নগরে কিছু গজিয়েছে মাঠ
কেউ তার বোঝে না ব্যাপার

তোমার মাথার নিচে ছোটবড় শামুকের চারা
তারা সব প্রাচীন শহরে এসে
খুলে খুলে জলে নেমে যায়

হালখাতা এসে গেছে, এমন বিস্তৃত মাঠে
শবখানা ভাসাও ডোবাও



প্রাক-বৈবাহিক


একবার আমাকে একটি বিবাহ-উপযুক্ত মেয়ের হস্তাক্ষর পাঠিয়ে বলা হলো, এই মেয়ে এতদিন জলেই বসবাস করেছেন; আর তার সাম্প্রতিক স্যাঁতসেঁতে প্রকাণ্ড শরীর রৌদ্রে শুকোতে দেয়া আছে। তার হস্তাক্ষরে এই যে কোথাও মাত্রা পড়েছে বা পড়েনি, আর এই যে যতিচিহ্নের কোথাও ভুল বা কোথাও সঠিক ব্যবহারÑ এসব কিছুই নাকি মেয়েটির যথার্থ যোগ্যতা বা দোষগুণ যেটাই ধারণা করা হোক। মেয়েটির উচ্চতা আমাদের মাঠভর্তি জলের সমান, অর্থাৎ এটা আমার আন্দাজ করে নেয়ার কথা। যা হোক, আমি মায়ের কাছ থেকে পত্রমারফত এ সংবাদ জেনেই কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নপত্র তৈরি করেছি। আর ভাবছি, মীন রাজ্যের অধ্যয়ন পর্বে মেয়েটির দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব প্রশ্ন খুব একটা কমন পড়ার কথা নয়। আর তাহলে এভাবে হস্তাক্ষর পাঠিয়ে এক জননীর কোনো অনাথ যুবকের এ মতো মন ভোলানোর কোনো মানেই হয় না। ভেবে দেখছি, আমার অপেক্ষার দিনগুলো কী উৎকণ্ঠার! শীত কিংবা বর্ষাই আমার প্রিয় ঋতু হলেও ভাবছি, তাকে ভেজা জবুথবু নাকি শীতে কোঁকড়ানো দেখতেই বেশি আনন্দদায়ক হবে। আজ এই মুখর বর্ষণে ছাতা হাতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে এমনতর ভাবনাগুলোই পোস্টাপিস অবধি পৌঁছে দিয়ে এলাম। আর তখনই আমার হঠাৎ মনে এলোÑ তাকে শেষ প্রশ্নটি করাই হয়নি যে, অবশিষ্ট জীবনে তিনি মীন ধর্মেই ফিরে যেতে আগ্রহী কিনা



বিয়ারিংকাল

তোমার পাশে গিয়ে বসতে পারলেই
হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের একপ্রকার
প্রশান্তি খুঁজে পেতাম

অথচ তুমি সারাদিন শুধু বিয়ারিং চিঠি আর বিয়ারিং
খামের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে রেখে
নিজে নিজেই ভাল থাকবার অভিনয় করে যাও

সেই কত কত কাল আগে আমাদের লালমিয়া চাচা
এক এক করে তোমার হাতে এই চিঠিগুলো পৌঁছে দিয়েছিলেন

আর এখন যখন তুমি এসব খুলছÑ তার ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসছে:
গরুর পিঠে হাল জুড়ে লাঙল বাইছে কৃষক
পাল তুলে নৌকা বাইছে মাঝি আর
পায়ে আলতা, চোখে কাজল মেখে
ঘোমটা টেনে হেঁটে যাচ্ছে ও পাড়ার যুবতী সখিনা

আমি আরো গুটিসুটি হয়ে
তোমার নিঃশ্বাসের কাছে নিতান্ত চুপটি মেরে বসে থাকি
আর মনে মনে বলি, হারানো সুখ, হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে
এর চেয়ে অসামান্য খেলা আর কী হতে পারে!

তবু একবার সাহস করে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে বলেই বসি:
“এই মহাপ্রাযুক্তিক যুগে কী সব বিয়ারিং ফিয়ারিং নিয়ে
পড়ে আছো দাদা?”
সেও তখন মাথা নিচু করে
আমার প্রশ্নের জবাব দেয়