মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প-মামুন ম.আজিজ

ইরি আমার ছিল না
মামুন ম. আজিজ


এক


তার নামটা ইরি। শুনলেই সায়েন্স ফিকশনের কোন চরিত্র কিংবা ধানের শীষ হৃদয় পটে ভেসে ওঠে। এমন নাম কী কারণে কে জানে? অবশ্য আমি তা জেনেছিলাম অবশেষে।
আমার দোষ ছিল না, প্রকৃতি এক খেলা খেলছিল আমরা সরলতার সাথে। সেই ক্লাশ এইটে কোচিংয়ের সময় প্রথম জানলাম আমাদের ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার নাম ইরি। ছাত্র ছিলাম ভালোই তবুও অনেক সহপাঠীর কণ্ঠে আমার নামের আগে বিশেষ উপাধি ছিল ‘কেলাস’। সেই আমি-কেলাস রনি মেয়েদের সাথে কথা বলতামই না প্রায়, আমার সংকোচ হত। সহপাঠী বন্ধুরা এক একজন প্রেমের পাঠও নিয়ে নিয়েছে ঐ বয়সে, তবে আমার মনে ইরির প্রতি একটা আকর্ষন কেবল অনুভত হচ্ছিল, সেটাকে রোজ জাগ্রত হবার আগেই কবর দিয়ে দিতাম।
রোজ আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ইরি স্কুলে যায় আসে। আমি তিনতলার জানালায় পর্দার আড়াল হতে উঁকি মারি, চলে যাবার পর স্কুলের পথে পা দিই। নাইনে আমাদের ডে শিফট আর ওদের হলো মর্ণিং।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠলাম, তবুও আমি সেই কেলাসই রয়ে গেছি। সামনের পথে মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় অজান্তেই। তারপর মনে পড়ে ইরিতো এখন কলেজে উঠেছে। ইরির সাথে বোধহয় আর কোনদিন দেখা হবে না। বাসাটা ওদের খুব একটা দূরে নয়, কিন্তু সে পথে পা দেবো, ওমা! আমি কি সেই ছেলে। তারচেয়ে ইরি, সাইফাই উপন্যাসের মহাশূণ্যে ঘুরে বেড়ানো কোন চরিত্র হয়েই আমার মনে নির্বাসনে থাক...অথচ...
ঠিকই একদিন চমকে গেলাম। সমানের বিল্ডিংটার দোতলায় ডান পাশের বারান্দায় এক বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম অথচ নীরব হাহাকারে জ্বলে উঠল এক নারী মূর্তি, চিনলাম-আমার ইরি। মনের কবরে ভাঙনের আলোড়ন টের পেলাম। রাতে পড়া শিঁকেয় উঠলো। পড়তে পারলাম না আরও কয়েক রাত। আবার দেখলাম আরেক বিকালে, তারপর আরও একদিন। ইরি যেন আমার জানালার দিকেই তাকিয়ে থাকে। একদিন চোখে চোখ পড়ে গেলো। আমি পর্দা টেনে লুকালাম। কেটে গেলো কয়েকটা দিন।
হঠাৎ ক্লাশ শেষে এক বিকেলে বাড়ি ফিরছি, গরমে ঘেমে শেষ। তিন তলায় উঠে হাপাচ্ছি, হঠাৎ কানে এলো নারী কণ্ঠের ফিসফিসানি। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজতেই মিললো, ঐ তো তিন তলা থেকে চারতলার যাবার মাঝ সিঁড়িতে জানালা ধারে দু’জন উঁকি দিচ্ছে আর হাসছে। ওরা মাথা ঘোরাতেই, চোখে চোখ পড়তেই চিনলাম, সেই আমার ইরি। সাথের মেয়েটাকেও চিনলাম-নন্দিতা, সামনের বাসাটা ওদেরই।
আমার সামনে দিয়ে দু’জন দৌড়ে নেমে যাচেছ, আমি বোকার মত তাকিয়ে আছি। হঠাৎ কী মনে করে ইরি তাকাল, ‘তুমি রনি না, আছ কেমন, ভাল তো? পড়ে কথা হবে’ ...বলেই নেমে গেলো। আমিও ছুটে ঠিক তাদের দাঁড়িয়ে থাকা জানালার কাছে চলে গেলোম। নিচে তাকিয়ে দেখছিলাম ওদের চলে যাওয়া। হঠাৎ দরজার দিকে পায়ের আওয়াজ পেলাম। আমার বড় ভাই মণি।
‘কীরে হাপাচ্ছিস কেনো? ওখানে কি?’
কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না, নিশ্চয় ওদেরকে সিঁড়িতে দেখেছে... পকেটে একটা চকলেট পেয়ে গেলাম, ওটা দেখিয়ে বললাম ‘ভাইয়া, এইতো এই খোসাটা ফেলতে..’
তোকে না বলেছি ঐ সব খাবি না একদম, সব ভেজাল...
মুখে বললাম, ‘আর খাবনা ভাইয়া;’...আর মনে মনে-‘শালা ডাক্তারি পড় দেইখ্যা একটু পোদ্দারি করলা। আমিও সুযোগ নিবানে, তরী আপার লগে গেইদিন হাত ধইরি কী করছিলা দেখছি ভালোই।’


দুই.


যাক, সে রাতে মোটামুটি অংক কষে ফেললাম, ফলাফল- ইরিও আমার প্রতি দূর্বল। না হলে নন্দিতার সাথে এত সখ্যতা পাতানো আর আমাদের সিঁড়িতেই চলে আসা। ...কয়েকদিন খেয়াল রাখলাম। ইরি এক দুদিন পর পরই ও বাসায় আসে। জানালার পর্দা এখন অনেকটাই খুলে রাখি। ইরি সেটা ধরতে পেরেছে। সে মুচকি হাসে।
গতকাল বিকেলে নিচে দেখা হয়ে গেলো। দোকানে ওরা কিছু কিনছিলো। আমাকে ডাকলো, আমি দুরু দুরু বুকটা ফুলিয়ে এগিয়ে গেলাম। কথা হলো। ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা আর কী।
নন্দিতাকে বললাম, ‘ইরি আর তুমি একই কলেজে বুঝি?’
ইরি পার্সে টাকা রাখতে রাখতে বলল, ‘হ্যাঁ রনি, আমরা একসাথে। তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।’
আমি উচ্ছ্বসিত। বললাম, ‘শুনব আগে কিছু খাও। বল কি খাবে-আইসক্রিম?’
ইরি না বলতে যাচ্ছিল, কত ভদ্র মেয়ে! নন্দিতা তার আগেই বলে উঠল, ‘হুম, চকবার...’
টাকা পরিশোধ করছিলাম। ইতিমধ্যে হঠাৎ ‘বাই’ বলে আইসক্রিম নিয়ে নন্দিতার বাসার দিকে চলে গেলো দু’জন । পেছনে তখন দেখি ভাইয়া ফিরছে। না দেখার ভান করে বাসার দিকে এগোলাম।
দু’দিন পরের ঘটনা...
ইরি নন্দিতাদের বাসায় আছে সেটা এক নজর দেখেছি। তারপর আর দেখলাম না। মন জানালার পাশে আর টিকছিলনা, বাইরে বেরিয়ে মোড়ের দোকানে গিয়ে চা খাওয়ার নামে বসলাম। এখান থেকে নন্দিতাদের বারান্দা খুব স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু দেখা নেই। হঠাৎ তারা বারান্দায় হাজির। মুখ গোমড়া। আমি তবুও সেদিকে তাকিয়ে কেবলা কান্তের মত একটা হাসি দিয়ে ফেললাম। তারপর ভীষন অবাক হলাম। ইরি হাতটা বাড়িয়ে মনে হলো আমাকে ওখানে থাকতে বলল।
একটু পরেই নিচে নেমে এল। কাছে আসতেই বললাম, ‘খাবে...আইসক্রিম।’
নন্দিতা হাসল। ইরি বলল, ‘না খাওয়ানে উচিৎ তো আমারই।’
আমি সে কথার অর্থ তেমন বুঝলাম না। তবে তারপর ইরি যা বলল তাতে আমি হাতে চাঁদ পেলাম না চাঁদ থেকে পড়ে গেলাম ঠিক বুঝলাম না, হঠাৎ এক বিস্ফোরণ ছিল আমার জন্য।
বলল,‘ তোমাদের বাসায় যাবে। ফিজিক্সের একটা নোট লাগবে।’
আমি মনে মনে ভাবলাম, বাসায় যাবার উছিলা; কেবল মুখ ফুটে কেউ একজন বলে ফেললেই এখন হয়ে যাবে প্রেম। কিন্তু ভাইযার তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। দূর নোটের উছিলা আসে না।
দু’জনেই বাসায় ঢুকল আমার সাথে। মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম স্কুলের সহপাঠী বলে। একটু পড়েই ভাইয়া ঘরে ঢুকল খুব গম্ভীর চেহারায়। মনে হচ্ছে কার সাথে রাগ-টাগ করে এসেছে যেন। নিশ্চয় ঐ আপুটার সাথে। আমরা তিনজন ড্রইং রুমে বসে ছিলাম। মা চা করে দিয়েছিল সেটা হাতে নিয়ে মোটামুটি নীরবই ছিলাম। হঠাৎ ভাইয়া একুট পিছিয়ে ঘরে উঁকি দিলো। একটু যেন থতমত খেলেন...আওি অতি উৎসাথে বললাম, ‘ভাইয়া ওরা আমর সাথে স্কুলে পড়ত, নোট নিতে এসেছে।’
ভাইয়ার মনে হলো শোনার আগ্রহ নেই। কেবল একটা ভাব নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ও আচ্ছা তোর ক্লাশ মেট। ভালো।’
ইরি খুব হাসছিল মুখ টিপে। ভাইয়া দেখতে খুবই সুন্দর, হ্যান্ডসাম। আবার ভাইয়ার দিকে না ইরির মন যায়। তাড়াতাড়ি কণ্ঠ নামিয়ে বলে ফেললাম, ‘ভাইয়াটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি বদের হাড্ডি। একটা আপু আছে তরী নাম। ওর সাথে পড়ে। মাঝে মাঝে বাসায় আসে, আমি একদিন দেখে ফেলেছি দুজনে হাত ধরাধরি করছিল। আরেকদিন দিন শুনেছি ফোনে কার সাথে প্রেমালাপ করছে। সে যে তরী আপু না তা বুছেছিলাম।’
ইরি আর নন্দিতা এক বাক্যে যেন বলে উঠল, ‘তাই। খুব বাজে তোমার ভাই। ঠিক তোমার উল্টো। তুমি এত লক্ষ্মী হলে কেমনে?’
কেবলা হাসি দিলাম। মনে মনে ভাবলাম যাক ভাইয়ার প্রতি দূর্বল হবে না অন্তত।
ওরা দেরী করল না, যাবার সময় বলে গেলো কাল বিকালে যেন আমি ইরিদের পাড়ার ওপাশে ফাস্টফুডে যাই। জরুরী সেই কথাটা বলবে।



তিন

সময়ের আগেই পৌঁছে গেলাম। ওরা একটু পরে এল। খাবার ওর্ডার দেয়ার পর ইরি মুখ খুলল, ‘তুমি খুব লক্ষ্মী ছেলে রনি। স্কুলে সবাই তোমাকে কেলাস বলতো আসলে তুমি কেলাস না। এই নাও আমার আপুর বিয়ের কার্ড। তোমাকে আমার তরফ থেকে বিশেষ দাওয়াত।’
কার্ডটা হাতে নিয়ে খুললাম। ডাক নাম ‘তরী’ লেখা দেখে বললাম, ‘ইরির বোন তরী..., আপু কি করেন?
‘তোমার ভাইয়ার সাথে ইন্টার্নী করছে। শীঘ্রই ডাক্তার হয়ে যাবে।’
মানে?
‘মানে বুঝলে না আমাদের দেবর মিয়া’ নন্দিতার এই বাক্য শুনে আরও কিছই বুঝলাম না।
বললাম, ‘দেবর মানে? কাল কেনো বললে না ঐ তরী আপুই তোমার আপন বোন...?
ইরি মুখ খুলল, একটু লজ্জা যদিও মুখে, সেটা লুকিয়ে বলেই ফেলল, আরে বুদ্ধু তুমি যে আমার কী উপকার করেছো জান না। আরেকটা ছোট উপকার, করে দাও ভাই প্লিজ... এই ছোট প্যাকেটটা তোমার ভাইয়াকে দেবে।’
‘আমি তো কিছুই বুঝছিনা।’
‘আমরাও বুঝতে পারিনি সেদিন যখন তোমাকে দেখলাম তিনতলার সিঁড়ি ঘরে, আমরা তো অপেক্ষা করছিলাম তোমার ভাইয়ার জন্য। নন্দিতা বলল আরে ওই তো আমাদের ক্লাশের সেই কেলাস রনিটা না। সরি , তুমি আসলে কেলাস নও... মণির ভাই রনি, মিলে যাচ্ছিল, তারপর তোমাকে ডাকলাম...’
‘রনি, তোমার ভাইয়ার সাথে আমার এফেয়ার অনেক দিন ধরেই। আপুর সাথে বাসায় যেত। থাক অত যেনে তোমার লাভ নেই, তুমি খুব লক্ষ্মী দেবর আমার। কাল তোমার ভইয়ার সাথে ঝগড়া হচ্ছিল। আমিও নাছর বান্দা, বললাম তোর মার সাথে দেখা করেই ছাড়ব। আর তুমি তুরুপের তাস, পৌঁছে গেলাম তোমাদের বাসায়...’
খাবার চলে এল। ওরা মন খুলে হাসছে। আমিও বোকা বোকা একটা হাসি দিলাম এবং একই সাথে মনের ভেতর আবার ইরিকে দিলাম কবর । কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাহস করে বলেই ফেললাম, ‘তোমাকে তবে ভাবী বলেই ডাকি।’
হো হো করে হেসে উঠে ইরিবলল, ‘তোমাকে তবে ছোট্ট দেবর ...’
‘ওকে, একটা প্রশ্ন ছিল-তোমার নামটা ইরি কেনো বলবে?
‘ মণিকে কখনও এর উত্তর দেইনি, যদি ওকে না বল...!’
‘বলব না, প্রমিস ভাবী...’
‘ আমার নানা ফিলিপাইনস এ ধান গবেষণা ইনিষ্টিটিউট মানে ইরি তে চাকুরী করেছিলেন এক সময়, নানার শখ আর তরীর বোন .. হয়ে গেলাম ইরি...।’