মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কবিতা ভাবনা - পলিয়ার ওয়াহিদ

পলিয়ার ওয়াহিদ
কবিতার রূপ ও স্বরূপ


কবিতা একটি অমিমাংশিত শব্দশিল্প। মূলত কবিতার কোনো নিদিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে এটাও বলা যাবে না যে, আসলে কবিতার কোনো সংজ্ঞা হয় না। কবিতা খানিকটা আলো-আধারির খেলা বলা যেতে পারে। যারা চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে গিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন সেখানকার পরিবেশ খানিকটা আধো আধো আলো ছায়ার একটা ব্যাপার থাকে। অবশ্য এ রকম পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করে। কবিতাও সে রকম সবাইকে মুগ্ধ করে এটা আমরা সবাই স্বীকার করি। ঝাঁঝালো অতি সচেতন শব্দ- কবিতা নয়, তাকে স্লোগান বলাই শ্রেয়। কবিতা শব্দটির নাম শুনলে আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা আবেশ ছড়িয়ে আবেগের ঘরে প্রবেশ করায়। সবাই যেন কোথায় মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যায়। এই যে হারানো, হারিয়ে যাওয়া ক্ষণিকের জন্যে এটাই কবিতার আত্মা। কবিতা এক নান্দনিক শব্দ সমাহার বিশিষ্ট কথামালা। কবিতার ক্ষেত্রে কবিকে প্রথম এসে ভর করে চিন্তা। তারপর কবি ভাবের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন। সচেতন একটি উপলব্দি এসে সুরসুরি দিয়ে কবিকে করে যান অবচেতন। তারপর শব্দের ভেলায় চড়ে বাক্যের রাজ্যে এগিয়ে যান কবি। তৈরি হয় কবিতার শরীর। চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-কল্পনা, ভাব-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, উপলব্দি-অভিজ্ঞতা যখন শব্দের সংমিশ্রনে মিলেমিশে বাক্যে রূপ নেয় তখন তা কবিতায় অবয়ব ধারণ করে। কবির মনে এক ধরনের মৃদু দোলা অনভূব হয়। ভালো কবিতা প্রথমে কবিকে দুলিয়ে যায়। কবি কখনো কখনো হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেন। মানুষের মন থেকে আগত যে কোনো ভাব, মস্তিষ্কে ব্যবহৃত ভাবনা, দক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার ছন্দোবদ্ধ শিল্পিত প্রকাশই কবিতা বা পদ্য। যদিও কবিতা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। কিন্তু আজ অবধি কবিতার সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা আমরা পাই নি। এই যে কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় নাই এর মানে দাঁড়ায় কবিতা গণিতের মতো কোনো সূত্রতো নয়ই বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ ছকেও সীমাবদ্ধ নয়। কবিতা এক অসীম আকাশের ঠিকানা। কবিতা কখনো আবেগ কেন্দ্রিক, কখনো অনুভূতিপ্রবণ মনের বহিঃপ্রকাশ, কখনো সমকালের মুখপাত্র, কখনো শাব্দিক ঝংকার, কখনো বেদনাবিধুর হৃদয়ের কান্না, কখনো শোকাহত হৃদয়ের আর্তনাদ, কখনো সংগ্রামী স্বশস্ত্র সৈনিক, কখনো আবার অধিকার বঞ্চিত শ্রমজীবি মানুষের মুখপাত্র।

প্রশ্ন হতে পারে কবিতা তাহলে কি? সাধারণত আমরা যারা কবিতার সাথে দিনরাত উঠা বসা করি তারা এভাবে বলতে চেষ্টা চালায় তাহলো এমন ‘কবিতা একটা সুন্দরী নারীর মতো।’ তাকে তুমি মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাও। তার কপালে কালো টিপ নাকি লাল টিপ আঁকলে ভালো লাগবে তা কবিকে নির্বাচন করতে হয়। ললাটে পরাতে পারো সোনার টিকলি। নাকে নথ, গলায় গজমতি হার নাকি হীরার হার কোনটা মানাবে সবই তো কবিকে সিদ্ধন্ত নিতে হবে। সংগীতে বাঁধতে পায়ে নুপুর এবং আলতা পড়াতে পারো নিজের মতো করে। কামনীয় করতে কোমরে পারাতে পারো বিছা। এজন্য কবিকে তো অনেকে নবী কিংবা প্রভূ বলে থাকেন। কারণ তার সৃষ্টির মধ্যে কেউ নাক গলাতে পারে না। যেমন পারে না সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে। এভাবে তাকে সাজাতে হয় আবার লক্ষ্য রাখতে হবে সাজাতে সাজাতে যেন স্বরস্বতীকে কালী না বানিয়ে ফেলি তাহলে ঘটবে বিপত্তি। যে নারীর শরীরে বাড়তি মেদ নেই সেই নারীই কিন্তু হয়ে উঠে মোহনীয় কামনীয় সর্বপরি সৌন্দর্যের আধার। তাই সব দিকে খেয়াল করে কবিতার শরীরকে আঁকতে হবে। যেন বাড়তি মেদে সৌন্দর্যের হানি না ঘটে। আবার অনেকে বলেন, ‘কবিতার জন্য কবিতার সৃষ্টি; আর কারো জন্য নয়।’ এটা কোনো কথা নয়। কবিতার জন্যে আবার কবিতা কিসের? শিল্পের জন্যে শিল্প এ কথাকে তো অনেক আগেই অগ্রজ বাঙলী কবিরা খারিজ করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি সবকিছু মানুষের জন্যে। সব শিল্পই জীবনের জন্যে আর মানুষ জীবনের মধ্যে নিহিত। এটা এক ধরনের চতুর বিলাপ। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, কবিদের কোনো দ্বায়বোধ নেই তারা সংসার বিরাগী হয়। এসব খোঁড়া যুক্তি। সংসার বিরাগী হয় তো কবি বিশ্বসংসারের সংসারী হওয়ার জন্যে। সমাজের সবচেয়ে কমিটেড ব্যক্তিটি হচ্ছে কবি। কবির চেয়ে আর কেউ কমিটেড হতে পারে না। কবির একটা কমিটমেন্ট থাকতে হবে। দ্বায়বোধ না থাকলে আর যায় হোক অন্তত কবি হওয়া সম্ভব নয়।

কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণ নয় কবিতা আসলে কি এবং কেন তা জানার নেশা আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে বলেই আমি নিবেদিত হয়েছিলাম বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থের উপর। তাতে অবশ্য অশেষ উপকারই হয়েছে আমার নিজের আর আমার সাহিত্যকর্মী বন্ধুদের। কারণ প্রতেকটা ধর্মই সুন্দর সুন্দর তথ্য দিয়েছে কবিতার। যা আমরা ভাবতে পারি না। এখানে অনেকের গা রি রি করে উঠতে পারে। কবিতার সাথে আবার ধর্মের সম্পর্ক কিসের? আছে আছে সমাজের এমন হোনো বিষয় নেই যে তা নিয়ে কবিতা আলোচনা করে না। কবিতা নিজেই একটা সার্বিক শিল্প এর মধ্যে বিশেষের কোনো স্থান নেই। মানবমুক্তির একমাত্র আসমানী কিতাব আল-কুরাআনে বলা হয়েছেÑ ‘সুসংবদ্ধ সত্যসুন্দর শব্দ সমষ্টিই গজল বা কবিতা।’ আবার গীতা’য় বলা হচ্ছেÑ ‘সুনন্দন তত্ত্বের সমাহার বিশিষ্ট শব্দমালাকে শ্লোক বা কবিতা বলা হয়।’ অন্যদিকে বাইবেল গ্রন্থে বলছেÑ ‘পরস্পর মেলবন্ধন বা সংযুক্ত সৎ ও স্বচ্ছ কথাধ্বনিকে বলা হয় সংগীত বা কবিতা।’ এভাবে আমি আরো তথ্যের জন্যে অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থের স্বরপাণœ হয়েছি। যতটা পারা যায় কবিতা সম্পর্কে আমি জানতে চায় উজার করে। তাই আমার এই সামান্য চেষ্টা। তবে এই চেষ্ট শেষ নয়। অতিসামান্য ভেবে কবিতার এই নানাবিধ সংজ্ঞা আমি দিতে পারি কিন্তু সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। আমি শুধু চেষ্টা করেছি কবিতার বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব সম্পর্কে পাঠকের সাথে স্ববিস্তর আলাপ করতে। আর এই জন্যে কবি বন্ধু রাসেল আর আজিম হিয়ার অনুরোধে এই কঠিন কাজে মগ্ন হবার মতো দুঃসাহস দেখাতে চেষ্টা করেছি।

একেক জনের দৃষ্টিতে কবিতার সংজ্ঞা এক-এক রকম স্বাদ পেয়েছে। এখন হাজির করবো বিভিন্ন কবিদের কাছ থেকে পাওয়া কবিতা সম্পর্কিত সংজ্ঞা। পৃথিবীর অনেক কবি আজ পর্যন্ত কবিতার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। আর তাদের সংজ্ঞায় ও দর্শনে ফুটে উঠেছে কবিতার নান্দনিকতা। ম্যাথ্যু আর্নল্ড-এর কবিতাবিষয়ক বিখ্যাত সেই সংজ্ঞাটির কথা আমরা জানিÑ যে সংজ্ঞায় তিনি কবিতাকে ‘ক্রিটিসিজম অব লাইফ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ স্বীকার করেন, ‘পয়েট্রি ইজ ইমিটিশন অব লাইফ, মিরর অব লাইফ’। এটাই যে কবিতার সংজ্ঞা প্রকৃত তা কিন্তু নয়। হুমায়ুন আজাদের মতেÑ ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।' অসাধারণ জটিল কাব্যিক সংজ্ঞা এটি। সিকানদার আবু জাফরের মতেÑ ‘আমার চোখের সামনে যা দেখি তাকে অনুভব করেই যা সৃষ্টি হয় তাই কবিতা।’ বুদ্ধদেব বসুর মতেÑ ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না; কেবল মাত্র বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়। কবিতা সম্বন্ধে 'বোঝা' কথাটাই অপ্রসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে, ‘বোঝানো যাবে না’। আল মাহমুদ বলছেন ‘পাখীর নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার সেটাই কবিত্ব।’ এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে কবিতা লিখতে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন। অর্থাৎ, কবি সাহসী।’ সৈয়দ শামসুল হকের মতেÑ ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ।’ শেলীর ভাষায়Ñ ‘কবিতা হলো পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।’ রবার্ট ফ্রস্ট বলেন ‘কবিতা হল পারফরমেনস ইন ওয়ার্ডস।’ কবি কোলরিজ এর মতামতÑ ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’ এডগার এলান পোর মতে ‘সৌন্দর্যের ছন্দোময় সৃষ্টি।’ কীট্স বলেনÑ ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।’ কবি এলিয়ট বলতেÑ ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ কার্লাইল বলেনÑ ‘কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট।’ জগৎ বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল কবিতার সংজ্ঞায় বলেন ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো।’ কবি সেন্ট অগাস্টিন বলেনÑ ‘যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না।’ বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ার বলেনÑ ‘প্রত্যেক কবি অনিবার্যভাবেই সমালোচক। একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়া যতটা স্বাভাবিক তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হতে হবে যদি একজন কবির মধ্যে সমালোচক জেগে না থাকে।’ ইংরেজ কবি জনসন বলেনÑ ‘কবিতা হল মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ এবং সত্যকে মেলাবার শিল্প যেখানে ৎবধংড়হ কে সাহায্য করার জন্যে ডাক পড়ে রসধমরহধঃরড়হ এর।’ কবি মিল বলেনÑ ‘চিন্তা এবং বাক্য, যার মধ্যে আবেগ পেয়ে যায় নিজের শরীর।’ মেকল বলেন ‘ কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প যা শব্দকে ব্যবহার করে এমন ভাবে যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।' ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেনÑ ‘কবিতা সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সুক্ষ আতœা।’ এসব সংজ্ঞা থেকে প্রতিমান হয় যে কবিতা এক ‘আবেগের ঘোর’। যাকে উপলব্দি করতে হয়, বুঝা যায় কিন্তু বোঝানো যায় না। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল¬াহ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজেই সংশয়ে পড়েছেন। ‘সত্যি অর্থপূর্ণ কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া খুবই কঠিন।’

কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে আমার সবচেয়ে ভালোলাগে যে কয়েকটি লাইন তাহলো কবি শঙ্খ ঘোষের ‘বোধ’ কবিতাটি পাঠকের বোধের জন্য দ্বায়বোধ মনে করেই উপস্থাপন করছিÑ
‘‘যে লেখে সে কিছুই বোঝে না
যে বোঝে সে কিছুই লেখে না
দুজনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কি না ভাবে অর্থহীনতার পরপারে!’’
আমার মনে হয় না যে আর কোনো কবিকে হাতে করে শেখাতে হবে না যে কবিতা এ রকম ও রকম। এরপরও যদি কাউকে বলে দিতে হয় কবিতা এ রকম তা হলে তাকে দিয়ে কবিতা হবে না অন্য কিছু ভাবতে বলায় মঙ্গল।



পলিয়ার ওয়াহিদ
সাব এডিটর, দৈনিক যায়যায়দিন