মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প - পারভীন আক্তার

পারভীন আক্তার
ফেরা


তলপেটে প্রচন্ড পেইনের হিস্ট্রি দেবার পর বেডে তোলা হলো মেয়েটিকে। পালপেশন করে দেখার শুরুর দিকেই ডাক্তার আর একটি বিষয় লক্ষ্য করলেন। মেয়েটার লাল সালোয়ারের অনেকটা অংশ ভেজা।

"অন্য কোন সমস্যা আছে তোমার? "—ডাক্তার জানতে চাইলেন।
"না আপা। শুধু প্যাটে ব্যথা। "
"পিরিয়ড হয়েছে নাকি? "
"না। "
"লাস্ট কবে হয়েছিল? "
"তিন -চার মাস আগে। "
"বিয়ে তো হয়েছে। পেটে বাচ্চা -কাচ্চা এসেছে কিনা, কিছু বুঝতে পারো? "
সাথে আসা মেয়েটার ভাবী জবাব দিল এবার,
"না আপা। স্বামী দ্যাশের বাইরে থাকে। "
"ও...,আচ্ছা। কতদিন হল? "
"এই তো...।সাত -আট মাস হইবো। "
পেটে ব্যথার সম্ভাব্য কারণগুলোর সবগুলো বিষয়ে হিস্ট্রি নেবার পরও মেয়েটা মুখ খুলছিলোনা বলে এবার কিছুটা বিরক্ত হলেন ডাক্তার। সন্দেহটা আগেই হয়েছিল। শুধুমাত্র এর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ বলে এতটা সরাসরি বলাও যাচ্ছেনা।
"শোন মেয়ে, যদি অন্য কোন ব্যাপার থাকে, তোমাকে তো বলতে হবে। না বললে চিকিৎসা হবে কি করে? "
"আমি একটু বাথরুমে যামু। "

বেড থেকে নামানো হল তাকে। কিন্তু সে নড়ছেনা। ডাক্তার লক্ষ্য করলেন, তার দু 'পা বেয়ে রক্তের ধারা মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
"এবার বল মেয়ে, এসব কি? কোন ওষুধ -পত্র খেয়েছো আজ -কালকের মধ্যে? "
মেয়েটা এবার হ্যাঁ -না কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের মুখের দিকে। তার ভাবী বলল,
"হ আপা।খাইছে। "
"কি ঔষধ? "
এবার দু'জনেই চুপচাপ।
"কোন পরীক্ষা -নিরীক্ষা করা হয়েছিল? "
"হ্যাঁ আপা। "-ভাবীর জবাব।
"কিসের পরীক্ষা? "
"প্রস্রাবের। "
"বাড়িতেই? "
"হ্যাঁ। "
"কয়দাগ উঠেছিল ? "
"দুই দাগ। "
এবার ডাক্তার বিরক্ত হয়ে মেয়েটাকে বললেন, "আগে বলোনি কেন মেয়ে?শুধু শুধু এতগুলো কথা খরচ করালে। "
মেয়েটা কিছু না বলে মেঝেতেই বসে পড়ল চুপচাপ। আর তারপর নিজ হাতেই টিকটিকির বাচ্চার মত একটা কিছু বের করে কাঁদতে লাগল।
ডাক্তার ভাবলেন, ছেলে মানুষ। মায়া হচ্ছে হয়তো বাচ্চাটার জন্য। কিন্তু ডাক্তারের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে সে কাঁদতে কাঁদতেই তার ভাবীকে বলে উঠল,
"আমার জামাই শুনলে মাইরা ফালাইবো ভাবী। "
ভাবী তাকে আশ্বস্ত করল, "চুপ কর। কেউ জানবো না। "
ডাক্তারের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে এবার মেয়েটাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন,
"কান্দিসনা। আগে মনে আছিলো না? এহন ডরাস ক্যান? "
আর মেয়েটা ডাক্তারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
"আমার জামাইরে দিয়াই হইছে। "
"সে কি দেশে এসেছিল তিন -চার মসের মধ্যে?"
ডাক্তারের এই প্রশ্নটার জবাব তার ভাবী দিল,
"না আপা। আসেনাই। "
মেয়েটা এবার বলে উঠল,
"আমার আগেও এমন দুই -তিন মাস বন্ধ থাকত। কতজনের তো এমন কইরা বাচ্চা প্যাটে আসে। আমারও তেমনি হইছে। জামাই দ্যাশে থাকতেই। "
"যাদের এমন করে হয়, তাদের স্বামী সাথেই থাকে মেয়ে,বিদেশে নয়। আর তুমি যা বলছ, তা সত্যি হলে তোমার বাচ্চা আরও বড় হত। "
মেয়েটার নির্বোধের মত আত্মপক্ষ সমর্থের চেষ্টা দেখে তার প্রতি করুণা হল ডাক্তারের। আর তার বাবার প্রতি প্রচন্ড রাগ। যে বাবা মেয়েটিকে জরুরী বিভাগে ঢুকিয়ে দিয়েই বাইরে চলে গেছেন। হয়তো তিনিও জানেন সব। লজ্জায় ভিতরে আসছেন না। এদের মত বাবারা দশ পেরোলেই মেয়ের বিয়ে দিয়েই ঝাড়া হাত -পা।

ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন। স্পনটানিয়াসলি প্লাসেন্টা আউট হয়ে গেছে। মেয়েটার সৌভাগ্য। তারপর কিছু ইনভেস্টিগেশন ও ঔষধ লিখে অ্যাডমিশন দিয়ে ইনডোরে পাঠিয়ে দেয়া হল মেয়েটিকে।ডাক্তার ভাবীকে সতর্ক করে দিলেন, যেন ভালোভাবে ধরে নিয়ে যায়। কেননা, প্রচুর লস হয়েছে। ভীষণ ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে মেয়েটিকে।প্রেশার ফল করে গেছে। বেডে নিয়ে দ্রুত চ্যানেল ওপেন করতে হবে।

ভাবী মেয়েটিকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দোতলায়, ইনডোরে। ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছে মেয়েটি। তার বাবা আর এলেনইনা ভিতরে। ডাক্তার মেয়েটার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক। একটা অচেনা কষ্ট বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

বাল্যবিবাহের কুফলের এক জ্বলন্ত প্রমাণ চোখের সামনে দেখে সমাজের নির্বোধ মানুষগুলোর প্রতি যার পর নাই বিরক্ত হলেন তিনি। পুতুল খেলার বয়স পেরোতে না পেরোতেই এরা পুতুল পুতুল মেয়েগুলিকে তার সম্পূর্ণ অজানা -অচেনা সংসার নামক এক অন্ধকার রাজ্যে ছুড়ে দিতে পারলেই ভাবে, দায়িত্ব শেষ।

ডাক্তারের ভাবনায় ছেদ পড়ল এক মৃদু আর্ত চিৎকারে। মেয়েটি হাত -পা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েছে বারান্দার ফ্লোরে। আর তার ভাবী তাকে দু 'হাতে আগলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ডাক্তার উঠে গিয়ে মেয়েটাকে পুনরায় জরুরী বিভাগে নিয়ে আসতে বললেন।মেয়েটির বাবা এবার আর না এসে পারলেন না। মেয়েটাকে বেডে তুলে দেয়া হল। ডাক্তার দেখলেন, তার সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ডাক্তার পালস দেখলেন। ভীষণ লো ভলিউম। ব্লাড প্রেশার আগের চেয়েও ফল করেছে। শকে চলে যাচ্ছে রোগী। দ্রুত হাতে চ্যানেল ওপেন করা হল। জরুরীভাবে কিছু ইঞ্জেকশন দেয়া হল চ্যানেলে।

জ্ঞান ফিরতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগলো।ডাক্তার মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেন। ঘামে ভেজা একটা শান্ত স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখ। তিনি মেয়েটাকে তার নাম ধরে বার কয়েক ডাকলেন।
মেয়েটার পাতলা ঠোঁট দু 'টো তিরতির করে কাঁপছে। ডাক্তার জানতে চাইলেন,
"কেমন বোধ করছ এখন? "
সে জবাব দিতে পারলোনা। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের মুখের দিকে। তারপর পুনরায় তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এল। মাথার ভিতর এলোমেলো সব চিন্তার ভিড়। একরাশ ঘেন্নায় মনের ভেতরটা তেতো হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর একটা দীর্ঘশ্বাসের কবর দিল সে।

আর কিছুই ভাবতে চাইলোনা মেয়েটি।ডান বাহুতে একটা চাপ অনুভব করল সে। বুঝতে পারল, ডাক্তার তার প্রেশার দেখছেন। এরপর ডান হাতেরই কব্জির কাছে আঙ্গুল চেপে ডাক্তার নাড়ী দেখলেন হয়তো। তারপর ডাক্তারকে তার বাবার সাথে কথা বলতে শুনলো মেয়েটি।তিনি বাবাকে বললেন, "এখন একটু ভালো আছে। "
বাবাকে দোষারোপ করলেন বার বছরেই মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য।এই বয়সে ওর মত মেয়ের কিভাবে হেসে -খেলে, নেচে -গেয়ে বেড়ানোর কথা —এসব বলছিলেন বাবাকে।
আর...আর...ঐ যমপুরীতে যেন আর আগামী বছর তিনেক না পাঠানো হয় মেয়েকে, যেহেতু তার স্বামী বিদেশেই থাকবে ততদিন। আর ততদিনে মেয়েটি তার জীবনের ভাল -মন্দ বিষয়গুলো বুঝতেও শিখবে।

মেয়েটি বুঝতে পারল, ভাবীর কাছে হয়তো সেই বিভিষিকাময় রাতের কথা শুনেছেন ডাক্তার,যে লজ্জার কথা আর কাউকে বলতে পারেনি সে। ডাক্তারের কথাগুলি শুনতে শুনতে অবচেতন মন মেয়েটাকে নিয়ে গেল বছরখানেক আগে।

মায়ের হাতের ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ভাজ করে তুলে রাখা কাপড়ের মত মেয়েটারও বহু যত্নে ভাজ করে তুলে রাখা স্মৃতিগুলোর পাট ভাঙছে একে একে।

গাঁয়ের মাঠে ঘাটে দাপিয়ে বেড়ানো এক চঞ্চলা কিশোরী —
ছি -বুড়ি আর গোল্লাছুটের দুরন্ত জনপ্রিয় হার না মানা দৌড়বিদ, দলে পেয়ে খেলার সাথীদের ধন্য ধন্য হাসিমুখ —
রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে খালের ঘোলা পানিতে ডুব-সাতার শেষে রক্ত জবা ফোলা চোখ স্বাভাবিক না হওয়া অবধি, অথবা ভেজা কাপড়-জামা রোদে বসে গায়েই না শুকানো অবধি ঘরে না ফেরা —
গায়ে ধুলা-মাটির গন্ধ মেখে পা টিপে টিপে বাড়ি ফিরেই বাড়ির এক চিলতে উঠোনে বসে থাকা মায়ের মধুর মধুর গালি —
রাতে কুঁড়ে ঘরে মাটিতে পাটির বিছানায় ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমানো। মায়ের গায়ের মিষ্টি "মা মা" গন্ধ আর কাঁথায় ন্যাপথলিনের; নেশা নেশা গন্ধে মনে প্রশান্তি, দু'চোখে ঘুম।
আহ্!